জানালার ওপারে পর্ব-১৬

0
304

#জানালার_ওপারে
||১৬তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
আমাদের ছোটো বসার ঘরটা মানুষে গিজগিজ করছে। গত কিছুদিন ধরে গরম বেড়েছে দ্বিগুণ হারে, এতোটাই যে রাত বাড়লেও গরম যায় না। আর এখানে তো ছোটো জায়গায় এতো ভীড়। সবাই-ই ঘেমে যাচ্ছে। আবেগ ভাই আমার পাশে গম্ভীর মুখে বসা, মনে হচ্ছে তাঁর নিজের সাথেই যুদ্ধ চলমান নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার। অবশেষে হাফসার মাও বিরক্তিমাখা মুখে আমাদের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলো।

আবেগ ভাই তাঁর ক্রুব্ধ দৃষ্টি আমার দিকে ফেলেন। যদিও খুব বেশি সঙ্গ পাইনি এই মানুষটির, তবুও তাঁর চোখের ভাষা অল্প হলেও বোধগম্য হয় আমার। আমি উঠে যেয়ে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চড় লাগাই হাফসার গালে। ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে হাফসা। কেমন যেন এক দাম্ভিকতা বোধ হয় কারণ নিজেকে কোনো একশন ফিল্মের নায়িকা মনে হচ্ছে। অবশ্য আমার হাত দেখতে বেশ কোমল, মোলায়েম মনে হলেও খাণিকটা শক্ত ছেলেদের মতোন। উত্তেজনা ও ক্ষোভে তাকে ফ্লোর থেকে তুলে আরেক দফা চড় বসিয়ে দিলাম।
আমার হাত টান দিয়ে সরালেন হাফসার মা। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। তিনি ক্ষুব্ধ, বাকিরা রুষ্ট ও অবাক চেহারা দেখেই অনুধাবন করতে পারছি।

(গল্প পড়ার পূর্বে কিছু কথা—- হাতে গণে গণে দীর্ঘ দু’মাস হতে পাঁচ দিন কমের পর আবার এই শহরে পা দিলাম। আসলে নিজের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলোতে এতোটা হাপিয়ে উঠেছিলাম কিছুদিনের জন্য সবকিছু থেকে হারিয়ে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছে জন্মেছিল। তবে এর চেয়েও ফিরে আসিনি মূলত প্রচণ্ড খেদ বা অনুতাপ থেকে আপনাদের এতোটা অপেক্ষা করানোর। নিজেকে গুছিয়ে গুছিয়ে নিতে নিতে দেখি মাস খাণেক হয়ে গিয়েছে বিরতি নেওয়ার, কিছুটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলাম মাঝে মাঝেই এমন পাঠকদের অপেক্ষা করানোর থেকে লেখালেখি থেকে বিদায় নেওয়াই বরং ভালো হবে। তারপর ঘনঘন অসুস্থতার গল্প তো এখনও চলছেই। এই অসুস্থতার কারণে কলেজে দুটো দিন ঠিকমতো যেতে পারিনি, জীবনে প্রথমবারের মতো পরীক্ষা মিস দিলাম। শিক্ষকদেরও বোধহয় বিরূপ ধারণা জন্ম নিয়েছে আমার প্রতি। যাই হোক এই বছরটা হয়তো আমার জন্য ছিল না। ফিরে আসবো না ভেবেও আপনাদের অসংখ্য ম্যাসেজ পেয়ে নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। যদিও ভীতিটা প্রচুর, এতো অপেক্ষার পর আপনাদের প্রতিক্রিয়ার তাও… আর হ্যাঁ, আপনাদের টেক্সট সাড়া ফেলেছে ম্যাসেঞ্জারে, হৃদয়ে। সময় পাইনি বা ফেসবুকে আসিনি বললে ডাহা মিথ্যে ছাড়া আর কিছুই হবে না। পেয়েছি কিন্তু দেখিনি, সত্যি বলতে দেখার মন-মানসিকতা বা ইচ্ছেশক্তি কোনোটাই আমার ছিল না। তবে আপনাদের বিরামহীন এতো ম্যাসেজ পেয়ে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না। বিরতিটা মোটেই প্ল্যান্ড ছিল না বুঝতেই পারছেন, তাই ক্ষমার আবেদন। বকা দিলেও রাগ করবো না, এর যোগ্য যে। তবে একটা গুড নিউজ বলি লেখালেখিটা আমার অভ্যাস, নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি ইতি টানার মানসিকয়া সত্ত্বেও। যারা চন্দ্রপুকুর সিজন 2 চাচ্ছিলেন, তাদের জন্য আরও রহস্যময় ফ্যান্টাসি, সামাজিক থ্রিলার ধর্মী প্লট সাজানো ও সূচনা পর্ব লিখে ফেলেছি। তবে কন্টিনিউ করবো না কি তা নিয়ে একটু দ্বিধায় আছি)

হাফসার মা তো রাগে, ক্ষোভে চিৎকার করে উঠেন, “আপনার মেয়ের গলার সাথে সাথে কি মাথাটাও গেছে না কি! কীভাবে রাক্ষসের মতো মারলো আমার মেয়েটাকে! দস্যি মেয়ে!”

কথাটা বলার সাথে সাথেই আবেগ ভাই সপাৎ করে এক চড় দিলেন হাফসার গালে। তাঁর রক্তচক্ষুর কেন্দ্রবিন্দু এবার হাফসার মা।

“ছোটোলোকের বাচ্চা, তোর সাহস কী করে হয় আমার বউয়ের নামে এগুলা বলার! দোষ করে আবার বড়ো গলা করছিস! তোর মেয়ের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিলো এমন নষ্টামি কার থেকে শিখলো? এখন বুঝছি যার মা একটা নষ্টা, সে তো হবেই আরেক নষ্টা। আর বড়োলোকের ছেলের বিছানায় যাওয়ার এতো লোভ তাহলে রাতে রাস্তায় দাঁড় করাতে পারেন। আমি তো সামান্য মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত, কিন্তু সেখানে একদম খানদানি বড়লোক পাবেন, আবার পার ডে ইনকাম।“

মুখে তাঁর সূক্ষ্ম হাসি স্থির। কণ্ঠস্বর গম্ভীর ও সাবলীল। দেখে মনেই হচ্ছে না এতো তিক্ত বাণী উচ্চারণ করছেন তিনি। যত্তসব অসভ্য লোক! তবে হ্যাঁ, এই অসভ্য লোকটা আমার ভীষণের চাইতেও ভীষণ প্রিয়। কারণ তিনি শুধু আমার ক্ষেত্রেই অসভ্য।

আমি মিটমিট হাসছি, প্রাণপণ চেষ্টায় নিজের মুগ্ধতাকে বাঁধার চেষ্টা করছি হৃদ মাঝে। হাফসা আর তাঁর মায়ের চোখ জোড়া থেকে বয়ে চলেছে নোনাজল। আর যাই হোক আমাদের পরিবার বেশ বড়োসড়ো ঝটকা খেয়েছেন আবগে ভাইয়ের মুখের বচন শুনে। আয়েশা তো একটু বেশিই।

“কীসব বলছিস মেয়েটাকে, আবেগ!”
এতোটুকু বলেই নিঃশ্চুপ হয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন।

আমি ঠোঁট কামড়ে আমার অসভ্য লোকটার দিকে তাকালাম। মানে এই লোকটা শুধু আমাকেই চুপ করানোর মাঝে সীমাবদ্ধ নন। আবেগ ভাই নিজের ফোন ঘেটে ভয়েস ম্যাসেজটা অন করতেই হাফসার বলা সব কথা কর্ণগোচর হয় সকলের। ঐ সময় ভুলক্রমে কথাগুলো ভয়েস ম্যাসেজ হিসেবে আবেগ ভাইয়ের আইডিতে চলে গিয়েছিল।

“আমার আর মনে হয় না এখন কোনো এক্সপ্লেইনেশনের দরকার আছে আমাদের।“

আমার বাবা হুংকার দিয়ে উঠে,
“ছিঃ! ছিঃ! ইচ্ছে করছে থুঃথুঃ দিতে তোমাদের মুখে! হাফসার বাবা হিমেল ছিল মাটির মানুষ, আত্মার সম্পর্ক ছিল আমাদের। সেই সম্পর্কের খাতিরেই ওর মৃত্যুর পরপরই তোমার মেয়ের দায় কাঁধে নিয়েছিলাম। কারণ চারদিন না পেরুতেই তুমি তোমার পুরান প্রেমিকার গলায় ঝুলে গিয়েছিলে। তোমার মেয়ের উপর বাবার ছায়া হয়ে থেকেছি আমি, আমার পরিবার কখনও তাকে সামান্যতম কটু কথাও বলেনি। আমার স্ত্রীও কখনও আপত্তি করেনি। এর বিপরীতে তোমরা এই প্রতিদান দিলে? আর আমার মেয়ে…! সে তো ছোটো বোনের মতো ভালোবেসেছে, আগলে রেখেছে, ভাগ দিয়েছে সব জিনিসে সব জিনিসে চাইতেই। আর তোমার মেয়ের চাইতে চাইতে এমনই চক্ষু লজ্জা নিচে নেমেছে যে এখন তার ভালোবাসা আর স্বামীরও ভাগ চাইছে! আগে জানলে তোমাদের মা-মেয়েকে সাহায্য করা তো দূরে থাক মুখে চুনকালি মাখিয়ে লাথি দিয়ে বের করতাম।“

“তুমি ওদের কি বলছো সামুর বাপ? আমি তো তোমাকে কতোবার বলেছিলাম এই মহিলার মেয়েকে ঘরে তুলো না। যেই মহিলা বিয়ের পরও প্রেমিকের সাথে পরকীয়া চালিয়ে গেছে, সেই কষ্ট স্বামীটা হার্ট এ্যাটাকে মারা গেলেও শিক্ষা হয়নি, সেই মহিলার রক্ত আর যাই হোক ভালো না। তাও যখন জায়গা দিয়েছিলে বন্ধুর মেয়েকে, মানলাম। এই মহিলার সাথে সম্পর্ক রাখতে দিলে কেন? বাচ্চা হিসেবে তো হাফসাও ফুলের মতোই সাফ মনের ছিল। কিন্তু ঐ যে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। এখানের শরীরের রক্ত আর মায়ের সঙ্গ দুইটাই খারাপ। আগে তো আমার সন্দেহ ছিল এইটা হিমেল ভাইয়ের মাইয়া না কি মায়ের পাপের ফল? এখন তো মনে হচ্ছে এমন মেয়ে কোনোদিনও হিমেল ভাইয়ের হতে পারে না।”

আমি আবেগ ভাইয়ের পিঠে খোঁচা দিলাম। ইশারায় বুঝালাম সবাইকে থামান আমি কিছু বলতে চাই। তিনি তা-ই করলেন। সবার জিজ্ঞেসু দৃষ্টি এবার আমার দিকে।

আমি ইশারায় বললাম, “এতো কথা বলে লাভ নাই। সোজা কথা আপনি আপনার মেয়ে নিয়ে এই মুহূর্তে এক কাপড়ে আমাদের বাসা ছাড়বেন। কারণ আপনার মেয়ের যাবতীয় কাপড়-চোপড় আমাদের দেওয়া। আর হ্যাঁ, আমার বাবার থেকে স্ট্যাম্প করে যে টাকা নিয়েছিলেন, ঐটা তো মাফ করা হয়েছিল ঐ টাকাও ফেরত দিবেন্। আমার চললে তো আমি আজকের দিন পর্যন্ত আপনাদের পিছনে আমাদের প্রতিটা পয়সা ফেরত দিতাম। কিন্তু এতোও জালিম নই তো আমি!”

হাফসার মা ও হাফসা অনেক হাতে-পায়ে ধরেন। কারণ হাফসার মায়ের নতুন স্বামী বা তাঁর ভাইয়েরা কোনো দিন হাফসাকে বাড়িতে স্থান দিবে না। আর হিমেল চাচার তো কেউ নেই-ই। আমি ভেবেছিলাম তাঁদের এতো আকুতি ও ক্ষমা জানানোর পর আমার নরম হৃদয়ের মা-বাবা কখনওই তাঁদের ফেরাতে পারবে না। কিন্তু আমাকে অবাক করে আজ তাঁদের পাথরের মতো পাষণ্ড হৃদয়। পুড়তে পুড়তে মোমও শক্ত হয়। হাফসারা বের হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই বিব্রত ভঙ্গিমায় বেরিয়ে গেল।

আমাদের প্রতিটি দিনকে সুখময় কাটছে এখন। আবেগ ভাইয়ের মতো এতোটা কেউ কখনওই আগলে রাখেনি। নিজেদের কোনো প্রেমকাব্যের রাজা-রানি মনে হয়। প্রেমিক রাজা তাঁর সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আগলে রেখেছিল নিজের প্রেয়সীকে, তেমনই আমাকে আগলে রাখে, প্রতিনিয়ত নতুন করে বাঁচার, নিজের জন্য ভাবার প্রেরণা দেন আবেগ ভাই। আর আমাদের এই ছোট্ট এক কামরার ফ্ল্যাটটিও কোনো রাজভবন থেকে কম নয় আমার জন্য।

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে ভূমির বুকে। কী শীতল চারিপাশ! যেন শীতকাল সময় ছাড়াই এসে চমকে দিয়েছে। অথচ, আজ সকালেই কিন্তু ভ্যাপসা গরমে অসুস্থ করে তুলছিল আবহাওয়া। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিনা কারণেই মিটমিট করে হাসছি। মনটা আজকাল বড়ো বেশিই ভালো থাকে আমার। কয়েক মুহূর্ত পরই আমার কোমড় জুড়ে এক জোড়া উষ্ণ হাতের বিচরণ। আমি কম্পিত হলাম। সম্পর্কটার বয়স সাত মাস পনেরো দিন ছাড়ালেও তিনি এবং তাঁর স্পর্শ আজও আমার নিকট সদ্য ফোঁটা গোলাপের মতো সতেজ ও নব্য।

“আবেগ ভাই, ছাড়েন তো। ভালো লাগে না।“ দূরে সরে ইশারায় বললাম। কপট রাগ আমার চোখে-মুখে।

তিনি ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। মুখটা আরও একটু এগিয়ে টুপ করে নাকের উপরে আলতো এক কামড় বসালেন। তিনি জানলেনও না এটুকুতেই রন্ধ্রে রন্ধ্রে জ্বালা ধরিয়ে দিলেন।
“মায়াবালিকা, শেষবারের মতোন বলছি আমার ডিস্টার্বেন্স পছন্দ না জরুরি কাজের মাঝে। ফার্দার যেন বলা না লাগে।“ আমি ভেঙচি কাটলাম। এসবও না কি মানুষের জরুরি কাজ হয়।

“চুপ করে না থাকে এখন যেয়ে পড়ার টেবিলে বসো। আমি একটু পর আসছি। আর এই এক্সামে যদি টপে তোমার নাম না থাকে তাহলে… বুঝে নিও।“

পড়াশোনার ক্ষেত্রে বরাবরই আমি তেমন সচেতন নই, তবে একদম অমনোযোগীও নয়। কিন্তু রেজাল্টে প্রথম সাড়িতে থাকা আমার জন্য ভাবনাতীত। তার উপর পূর্বের বেশির ভাগ দিনগুলোতে মানসিক অশান্তিযাই হোক এই অসভ্য শিক্ষকের কথা তো আর অমান্য করা যায় না। চুপচাপ যেয়ে বই নিয়ে বসলাম।

বই খুলে কিছুক্ষণ পাতা নড়াচড়া করতেই, মনে হলো কতো পড়ে ফেলেছি আজ। অথচ, ঘড়ি মশাই বলছেন সবে মাত্র পাঁচ মিনিট হলো। বিরস মনে নোটগুলোতে ডুবার চেষ্টায় আমি তৎপর, তবে এ যেন মৃত সাগরে ডুবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা মাত্র। উপন্যাস কিংবা গল্পের বই হলে ভিন্ন কথা ছিল।

“মায়াবালিকা, বই-টই গুছিয়ে ফেলে রেডি হয়ে নেও। হাসপাতালে যাবো রিপোর্ট দিবে।“

আমি স্বভাবগতই প্রচণ্ড অলস ধাঁচের মেয়ে। যেখানে আমার বয়সী মেয়েদের ঘোরাঘুরি বেশ পছন্দনীয় কাজ, সেখানে আমার জন্য তা এক অঘোষিত বিরক্তি। হাসপাতাল তো আরও বিরক্তিকর জায়গা, আর এখন ভাগ্যদোষে প্রায় রোজ রোজই সেই হাসপাতালের দর্শন করতে হয়। কিন্তু আজ তো আমার ভার্সিটি, হাসপাতাল সবকিছু থেকেই ছুটি ছিল। আজকের দিনটা আমি কিছুতেই হাসপাতালের ফিনাইলের গন্ধে, কৃত্রিমতার মাঝে কাটাবো না। কিছুতেই না।

ইশারায় বুঝালাম আমাকে আজ বম মেরেও তিনি হাসপাতালে নিতে পারবেন না। তাতে খুব বেশি লাভ হলো বা পাত্তা দিলেন বলে মনে হলো না। বরং, তিনি তাঁর মতো টিশার্ট, গ্যাবার্ডিং প্যান্ট নামালেন। আমিও কম জেদি নই জন্মগত ভাবেই। বই-খাতা কোনোরকম রেখে ফোন নিয়ে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। এর পূর্বে এই শীতেও পূর্ণ গতিতে ফ্যান চালু করতে ভুললাম। এ এক শব্দহীন বার্তা আবেগ ভাইয়ের জন্য। তিনি খুব ভালো করেই জানেন আমি এভাবেই ঘুমাই।

চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নাই তাই ফোনে কম সাউন্ডে দ্য আজাইরা লিমিটেড এর বেশ পুরোনো একটা ভিডিও ছাড়লাম। তাদের ভিডিওতে হাসি না দিয়ে থাকা বেশ কঠিন। হাড় কাঁপিয়ে হাসি পেল, দমন করার কঠোর পরিশ্রম ব্যর্থ করে খিলখিল করে হেসে উঠলাম।
আবেগ ভাই কোনো বিলম্ব ব্যতীতই হাত শক্ত করে ধরে টেনে উঠালেন আমায়। সচকিত হয়ে মুখ থেকে কাথা সরালাম আমি। সবসময়কার মতোন গম্ভীর তাঁর মুখশ্রী।

“এগুলো কোন ধরনের ঘাড় ত্যাড়ামো মায়াবালিকা? হাসপাতালে যেতে হবে তো ডাক্তার ইমারজেন্সি ডাকিয়েছে। দেখো মেয়ে তোমার রাহা আপুও কিন্তু যেতে বলেছেন। আমি যাচ্ছি রিপোর্ট আনতে। উনি তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবো, তুমি উনার সাথে দেখা করতে চাও না বলে আসোনি।”
একটু ভাঙলাম, তবুও মচকালাম না। মানে বিচলিত হলেও শক্ত থাকলাম। কয়েক মুহূর্ত বিরক্তি ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি। আমি অনুধাবন করলাম, এবার বোধহয় হার মেনেছেন। কিন্তু তা আর কোথায়?

আমার মোটাতাজা দেহটা কয়েক মুহূর্তেই আবদ্ধ করে নিলেন নিজের মাঝে। বুঝি না, এতো শক্তি কোথায় পায় অসভ্য লোকটি!

আমি ছাড়ার জন্য ছোটাছুটি করছি। তাঁর ধরে রাখতে সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু ছাড়ার পাত্র তিনি তো নন।
“তুমি যাবে। আমার সাথেই যাবে। এখনই যাবে মায়াবালিকা!”

আমি মাথা নাড়িয়ে না, না বুঝাচ্ছি৷ চিৎকার করছি, কিন্তু মুখ দিয়ে অদ্ভুৎ রকমের শব্দ বের হচ্ছে।

“তুমি যাবে, বলেছি না! জাস্ট স্টপ ইট!”

আবেগ ভাই বারবার একই কথা বলেই যাচ্ছেন। আমিও বারবার না বলছি ইশারায় ও শব্দে, য

“না!” শব্দটা উচ্চারণ করে আমি নিজেই শকড। আবেগ ভাইও মুখটা মুরগির ডিমের সাইজের খুলে আমার পানে তাকিয়ে আছেন। তবে সেদিকে আমার ধ্যান নেই, আমি বিচার-বিবেচনা করতে ব্যস্ত যে যা হলো তা কী সত্যিই হলো না কি কোনো স্বপ্ন বা হ্যালুসিনেশন।

ভাবনার মাঝেই নিজেকে ভারশূন্য, চরকিতে ঘুরছি মনে হলো। সেকেন্ড কাটতেই বোধগম্য হলো আমি প্রকৃতপক্ষে আবেগ ভাইয়ের কোলে অবস্থান করছি। তিনি এমন ভাবে আমায় কোলে নিয়ে ঘুরাচ্ছেন, লাফাচ্ছেন যেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো সুসংবাদটা কর্ণগোচর হয়েছে।

মেয়েদের পাগল করা খিলখিল হাসি, মুক্তঝরা হাসি নিয়ে বহু লেখক-কবি কাহিনী রচনা করেছেন। পুরুষদের সাথে না কি এ শব্দগুলো যায় না। কোথায় যায় না? এই যে এই মানুষটি খিলখিল করে হাসছেন, তাঁর হাসিতে মুক্ত নয় অজস্র হিরাই বরং ঝরছে। আমি নির্নিমেষ চাহনিতে দেখছি। আমার রন্ধ্র রন্ধ্র কম্পিত হচ্ছে, উন্মাদনা ছড়িয়ে যাচ্ছে দেহ-মনে।

বারবার একটা কথাই ঘুরে-ফিরে ভাবছি, – এই হাসিটা এতো সুন্দর, এতো ঘায়েল করা! কোথায়? ধারণা ছিল না তো! একদমই ধারণা ছিল না! এতো পাগল করা হাসি বলেই কি তিনি লুকিয়ে রাখতেন হাসিকে? কে জানে? জানা নেই। তবে মনে হচ্ছে, এই পাগল করা হাসিটার জন্যই, তাঁর এই সীমাহীন আনন্দ দর্শনের জন্যই না হয় আল্লাহ আমার কণ্ঠ ফিরিয়ে দেক।

আবেগ ভাইয়ের জোরাজুরিতে যথাসময়েই হাসপাতালে পৌঁছে যাই। ডাক্তারের কেবিন থেকে বের হয়ে করিডোরে পা রাখতেই রাহা আপু সঙ্গে সঙ্গে এসে আমায় জড়িয়ে ধরেন। আমি আলতো হাসি।

হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করি, “তুমি কেমন আছো? রাসেল সাহেব কেমন আছে? সবাই ভালো তো?”

“একদম ভালো। তুই তো ভালোই, ইনশা আল্লাহ এবার আগের মতোও হয়ে যাবি। ডক্টোর আহসানউল্লাহ স্যারের সাথে আমার কথা হয়েছে আগেই। আল্লাহর রহমতে তোর ভোকাল কর্ড আগে থেকে অনেকটাই রিকোভার করেছে। আর তোর সিচুয়েশন না কি প্রথম থেকেই অতোটাও বাজে ছিল না। সুস্থ হওয়ার যোগ্য। জানি না তোদের তোর অপারেশন করা ডক্টোর ভুল বা এমন হতাশাজনক তথ্য কেন দিয়েছে। তবে আরও ভরসার বিষয় স্যারের হাতে আসা তোর মতো সিমিলার সব কেইসগুলোতে ৮০%ই সুস্থ হয়েছে।“

“ইনশা আল্লাহ আপু। মায়াবালিকাও শীঘ্রই আগের মতো হয়ে যাবে। আল্লাহ ভরসা।“ আবেগ ভাইও সায় দেন।

জীবনে প্রথমবারের মতো নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। এতো ভালোবাসার অধিকারী হলে কার না মনে হবে? তবে শুনেছি অতিরিক্ত সুখও না কি কপালে সয় না। আমার কপালে সহ্য হবে তো?

দেখতে দেখতে আরও একটি বছর ঝরা পাতার মতো উড়ে গেছে। আমি পুরো দমে গৃহিণী না হলেও বেশ কিছু অংশে কর্মের ঢেঁকি হয়েছি। এই যেমন ফজরের নামাজ পড়তে উঠে আবেগ ভাইকে উঠানো হোক বা ঘর-দোয়ার গুছিয়ে রাখা হোক বা দুপুরের রান্না, বিকালের নাস্তা হোক এসব কিছুতে পারদর্শী বা পারফেক্ট না হলেও আমি চেষ্টা করি রোজ রোজ। সকালের নাস্তাটা অবশ্য আবেগ ভাইয়ের ডিপার্টমেন্ট, আমি শুধু মাঝেসাঝে হেল্পার। রাতেরটায় দু’জনের ভাগাভাগি কাজ। কাপড় ধোয়াটা বা রোদ দেওয়াটাও তেমনই।

অবশ্য আমার মা একবার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আবেগ ভাইকে সকাল সকাল কাপড় রোদে দিতে দেখেছিলেন, সাথে ভাবীও ছিল। এর পর তাঁদের কথার ঝাঁঝে বহুবার অনুরোধ কিংবা বলা হয়েছে একরোখা মানুষটিকে সব ডিপার্টমেন্টে আমায় প্রধান করতে, কিন্তু এই বালক কি আর বদলে গিয়ে কারো কথা মানতে পারেন? যদিও আমি নিজেও চাই না এই মানুষটি বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হোক।

অসভ্য, একরোখা লোকটা আজকাল বড্ড বেশি দিশেহারাও হচ্ছে আমার কারণে। অবশ্য আমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার মাঝে একটু একটু করে বেড়ে উঠা পুচকুটার। তার যে কী অদ্ভুৎ অদ্ভুৎ আবদার! রাত দেড়-দু’টো বাজে কসা মুরগি বা ঘুমন্ত দুপুরে কামালের বিরিয়ানী খাওয়ার লোভ কিংবা ঝাল করে ঘরে তৈরি হাক্কা নুডুলসের জন্য অস্থির প্রাণ।

সবমিলিয়ে আমাদের সম্পর্কটা এখনও ভোরে সদ্য ফুটন্ত বেলি ফুলের মতোই। আমার লজ্জা কিংবা তাঁর আগলে রাখা বা শাসন এখনও বেলির সৌরভের মতো দৃঢ়, আর তাঁর স্পর্শ আমার গায়ে যেন বেলির গায়ে লাগা প্রথম মুহূর্তের বাতাসের দোলা।

তবে হ্যাঁ, ছোটো একখানা আক্ষেপ আছে। চিনির দানার চাইতেও ক্ষুদ্র একটি মাত্র আক্ষেপ। তিনি আমাকে ভালোবাসি বলেননি, সরাসরি আজও প্রেম নিবেদন করেননি। যদিও তাঁর প্রতিটি বচন, কর্ম, শাসন ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তবুও একটি বার এই অসভ্য পুরুষটির মুখে ভালোবাসি শোনা কি আর চাট্টিখানা কথা এই মায়াবালিকার জন্য!

“বউ! বউ! কোথায় গেলে তুমি? এদিকে আসো।” আমের আচারের বয়াম বেতের চেয়ারে ফেলে ছুটলাম দরজা খুলতে। শাশুড়ি মায়ের বাজখাঁই গলা শুনে কোন মেয়েই বা বসে থাকতে পারে।

“আ-আসেন।“ খাণিকটা কষ্ট করে উচ্চারণ করলাম। বলা বাহুল্য এখন দুয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারি।

“হুম, বুঝেছি। গরুর গোশতের পিঠালি এনেছি। আবেগকে বলেছিলাম অফিসে যাওয়ার পথে নিয়ে যেতে বা তোমাকে পাঠাতে। আমার মেয়েটা ভাইয়ের জন্য চুলার তাপে পুড়ে কতো কষ্ট করে রান্না করলো, ছেলেটাকে ফোন দিল কতোবার ধরলো না। ম্যাসেজ দিল কতোবার, সিন করে রেখে দিল। কী যে হলো ছেলেটার! পরের কথায়, পরের জন্য মায়ের পেটের বোনকে পর করে দিল। আল্লাহ।“

আমার রাগের অগ্নি মুহূর্তে জ্বলে উঠলো, অন্য কেউ হলে বা নিজের বাবা-মা হলে এতোক্ষণে কান ভর্তি শব্দের বিষ ঢেলে দিতাম। নিজেকে শান্ত করে পিঠালি ঢেকে রাখতে রাখতে ফোনে টাইপ করে ভয়েসে কনভার্ট করে করলাম। কারণ মুখে বলা জাগ্রত স্বপ্ন আমার জন্য।

“মা, আপনার ছেলে কোনো ছোটো বাচ্চা নয় বা বোকাও নয় তাহলে দেশের নামধারী পাবলিক ভার্সিটির একজন ব্রাইট ছাত্র হতো না। সেখানে পরের কথায় চলা তো স্বপ্নেও ভাবার বিষয়। আর পরের জন্য বা পরের কথায় না হলেও নিজের বোধশক্তি আর সঠিক-বেঠিক বুঝ থেকে করতে পারে। তা চা খাবেন মা? করে দেই। বাসায় তো এক দণ্ড রেস্ট পান না, আয়েশা আপুর মেয়ে থেকে শুরু করে রান্না টু ঘর সামলানো সব তো আপনিই করেন। আপা তো ফোনে ব্যস্ত থাকে। আই মিন ফোনে কাজে ব্যস্ত থাকে।“

শাশুড়ি মা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। নিচু কিন্তু স্পষ্ট ভাবেই “বেয়াদব” শব্দটা উচ্চারণ করে দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে বের হয়ে গেলেন। আমি বিরক্তিমাখা শ্বাস ফেললাম। এই মানুষটি আমাকে যে তেমন একটা পছন্দ করে না তা আমি প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছি, তবে সত্য বলতে একদম অপছন্দও করেন তাও নয়৷ বরং, মন তাঁরও বেশ ভালোই। আমি বাড়িতে একা থাকি বলে এটা-ওটার বাহানায় বারবার চলে আসেন আমি ঠিক আছি কি না দেখতে।
এই তো পাঁচ-সাড়ে পাঁচ মাস আগে চিকুনগুনিয়ার আক্রমণে কাতর। আমার মা-বাবাও উমরা হজ্জে দেশের বাহিরে। ভদ্রমহিলা এক পাও নড়েননি আমার পাশ থেকে। খেতে পারতাম না বলে টক-ঝাল আঁচারি মুরগি থেকে মজাদার পাঁচমিশালী নিরামিষের মেল বসিয়েছিলেন। ডাবের পানি তো প্রতিদিন খায়িয়েই দম ফেলতেন।

আমি মায়ের সাথে তাঁর তুলোনা করবো না, মা তো নয় আমার। এতে যেমন আশা বাড়ে, তেমন মন ও সংসারের অশান্তি। তাঁর থেকে মায়ের মতো আরাম-আহ্লাদ আশা করি না, আর না তেমন মমতা, না নিজে মায়ের মতো স্থান দিব বলি, তবে মানি তাঁর দায়িত্বও আমার। যদি কোনোদিন অসুস্থতায় একমুঠো ভাত রান্না করে খাওয়ায়, তাতেও আমি কৃতজ্ঞ বটে।
যতোটুকু বুঝেছি খারাপ নয় তিনি। তাঁর অসন্তুষ্টি বা ক্রোধ বা ক্ষোভটাও একদম অস্বাভাবিক নয়। কোন মা সহ্য করবে পরের মেয়ের জন্য নিজের সন্তানদের মাঝে দ্বন্দ্ব। যতোই সেই মেয়ে সন্তানের স্ত্রী হোক না কেন। আমিও ব্যতিক্রম কেউ হবো না হয়তো এক্ষেত্রে।

বস্তুত, আবেগ ভাই যে আয়েশার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন না, এতে আমারও নীরব সম্মতি আছে। আমি ভেবেছিলাম সব জানার পর হয়তো সে অনুতপ্ত হবে, ক্ষমা চাইবে, নরম হবে আমার প্রতি। কিন্তু এই বিশাল পৃথিবীতে কিছু মানুষের হৃদয় পিপীলিকার দেহ হতেও ছোটো, তাঁরা নিজের ভুল স্বীকার করতে বা নত হতে একদমই শিখেনি। ক্ষমা তো দূরেই থাক, তার ছোটো ভাইয়ের স্ত্রী হিসেবে সামান্যতম স্নেহ বা সম্মান করে না। মুখোমুখি হলে এমন একটা ভান করে যেন আমি খুব তুচ্ছ কেউ, খোঁচা মারা তো আছেই। আবেগ ভাই আমাকে তাই ঐ ফ্ল্যাটে যেতে একদম মানা করেছেন, নিজেও খুব কম যান। কারণ আয়েশার স্বামী বিদেশ থাকায় সে প্রায় সারা বছরই শ্বশুরালয় ছেড়ে পিতৃগৃহে পড়ে থাকে।

মাঝে মাঝে স্বার্থপরের মতো ভাবি সে না থাকলে কতো ভালো হতো। সবার সাথে থাকা যেতো, শ্বশুর মশাইয়ের সাথে সাথে হয়তো শাশুড়িও এবার মায়ের না হোক খালার স্নেহটাই দিতেন।

এসব ভাবতে ভাবতে ফোনে একটা কল আসে। আননোন নাম্বার, খাণিক বিরক্ত হলাম। এই সময়টা অসভ্য লোকটার কলের জন্য বরাদ্দ, বিরক্ত হওয়ার কথাই তাই।

“আমার পঁচিশ হাজার টাকার অনেক প্রয়োজন। মা চাচা-চাচীকে কল দিয়েছিল, ধরছে না। চাচা রে বইলো কালকের মধ্যে দিতে।“ ফোনের অপরপাশ থেকে হাফসার কথা শুনে ঠাঁটিয়ে চড় মারতে ইচ্ছে হচ্ছে। কল কেটে দিলাম।

টেক্সট পাঠালাম,
-তোর মায়ের আর তোর লজ্জা-শরম নাই? এতো কিছুর পরও আবার টাকা চাইছিস! তুই তো ছেলে ফাঁসানোর টেকনিকে একদম সিদ্ধ মানবী, আবেগ ভাইকে তো ফাঁসাতে পারিসনি। নতুন মুরগী খোঁজ। কবি তো বলেছেনই, একবার না পারিলে, দেখো শতবার।

আবারও কল আসলো। কেটে দিলাম। এই মানুষগুলোকে দেখে আসলেই অবাক হই, এমন কেন এরা? পরপর চারবার কল দিলেও রিসিভ করলাম না। আবেগ ভাইকে কল করলাম। আজ কী হলো মানুষটার এখন অবধি কল দিলেন না।চারবার রিং হতেই কণ্ঠের তৃষ্ণা মিটলো।

“কী হয়েছে? কল করেছো কেন? কোনো কাজ আছে?” খাণিকটা অদৃশ্য ধাক্কা খেলাম। আবেগ ভাইয়ের চড়া গলা, বিরক্তির রেশ স্পষ্ট। নিজেকে সামলে নিলাম দ্রুতোই।
“এ-এমনি।“
“আচ্ছা, রাখো তাহলে। আর এভাবে বিনা নোটিশে কল দিবা না প্লিজ। মিটিং ছেড়ে আসতে হলো।“

হৃদমাঝে চিনচিনে এক ব্যথার সঞ্চার হলো। কোনো রকম ‘হু’ উচ্চারণ করে কল কেটে দিলাম। অলক্ষ্যেই কপোল গড়িয়ে এক ফোঁটা অশ্রু যেয়ে মিশে গেল শাড়ির আঁচলে।

টুং করে এক আওয়াজ হলো ফোনে। হাফসা ম্যাসেজ পাঠিয়েছে।
-খুব উড়ছিস না আবেগের বউ হয়ে, তাই না? আবেগ আসলেই কি তোকে ভালোবাসে? হাউ ফানি! তুই আসলেই বোকা না নিজেকে বৃথা আশা দিচ্ছিস? আরে মেয়ে তুই ওর ভাগ্নীকে সেভ করতে গিয়ে বলি হয়েছিস, এজন্য জাস্ট তোকে কাঁধ দিতে বিয়ে করেছে সহানুভূতি দেখিয়ে। ভালোবেসে না। এখন তো বিয়ের মাত্র কয়েকদিন, আর কিছু সময় কাটুক এই মোহ-মায়া কেটে যেয়ে বিরক্তের নাম হবি তুই।

অন্য সময় হলে এ ধরনের কথাগুলোতে হয় রেগে যেতাম, নয় এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু আজ কেন যেন বিচলিত হচ্ছি। সত্যিই তো আবেগ ভাই কখনও ভালোবাসি বলেননি। আজ আবার হুট করে এমন বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ। পরক্ষণেই নিজেকে বোঝালাম। হতে পারে অফিসে সত্যিই কোনো ঝামেলা বা কাজ ছিল সেই চাপেই হয়তো না করেছে। আর একবার তো আবেগ ভাইকে কষ্ট দিয়েছিই তার কথা বিশ্বাস না করে, এই মেয়ের প্ররোচনায় পা দিয়ে। আর না। সামনে ইনকোর্স পরীক্ষা, সব ভাবনা বাদ দিয়ে পড়াশোনায় ডুব দিলাম।

আবেগ ভাই চিকেন চাপ খেতে খুব ভালোবাসেন, তবে নান বা তন্দুররুটির সাথে নয়। অদ্ভুত ভাবে হলুদ ছাড়া পোলাও দিয়ে করা ঝরঝরা খিচুরির সাথে তাঁর চাপ পছন্দ, সাথে মরিচ ভাঁজা আর মিক্স সালাদ হলে তো কথাই নেই। কোমড়ে আঁচল গুঁজে রান্নায় লেগে পড়লাম। হতে হতে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গেল। আমিও ঘেমে নেয়ে গিয়েছি, প্রচণ্ড গরম আর অস্থির লাগছে তাই তাড়াতাড়ি ঢুকলাম ওয়াশরুমে।
বের হয়ে দেখি আবেগ ভাই গভীর মনযোগ সহকারে বিছানায় হেলান দিয়ে ফোনে কিছু একটা করছে। আমি চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় চলে গেলাম কাপড়-চোপড় এবং তোয়ালেটা রোদ দিতে। এবার ঘোর ভাঙলো তাঁর।

“এটা কোনো সময় মায়াবালিকা গোসল করার! যদি জ্বর-ঠাণ্ডা বা কিছু একটা হয়! তার উপর কতোক্ষণ লাগিয়ে গোসল করেছো।“ সেই পুরোনো গম্ভীর দৃষ্টি, রাগান্বিত কণ্ঠ। আমি এসবে বড়োই অভ্যস্ত। তাই কিছুটা কম্পিত হলেও পাত্তা দিলাম না।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের আঁচল ভাজ করে নিতে নিতে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করছি। আগের থেকে পেট কিছুটা ফুলে উঠে একজনের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। সাধারণত বোঝা যায় না, তবে এই ফিনফিনে পাতলা জরজেটের শাড়িতে স্পষ্ট।

“মায়াবালিকা তুমি কিন্তু বড্ড বেড়েছো। কথা কানে যাচ্ছে না!”
এবার বিছানা ছেড়ে একদম আমার পিঠে বুকে ঘেঁষিয়ে দাঁড়ান আবেগ ভাই। আলতো ভাবে গালটা চেপে ধরলেন। আমি কিছু না বলেই হাতটা গাল থেকে ছাড়িয়ে উদরে এনে রাখলাম।
“আমাদের।”

তাঁর ভাবমূর্তি বদলালো। শুধালেন,
“আমার, আমাদের!”

আমি নিবিড়ভাবে মিশে গেলাম তাঁর বক্ষপিঞ্জরে। অবশেষে আজ বলেই ফেললাম, “ভালোবাসি” লজ্জায় রাঙা হয়ে। এই প্রেম কাহিনী প্রেম নিবেদনটা নাহয় আমার থেকেই শুরু হোক। উত্তর দিলেন না তিনি। পূর্বের মতোই গম্ভীরতার রেশ ধরে নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেন। আমার সকল অনুভূতি সেকেন্ডেই যেন মাটিতে মিশে গেল। বহুদিন পর এই মানুষটির দ্বারা আহত হলাম আমি, যেমন তেমন আহত নয়, গভীর ভাবে আহত।

ধীর ভাবে সরে আসলাম। থমথমে মুখ খানা নিয়ে বের হয়ে গেলাম শয়নগৃহ ছেড়ে। তিনিও পিছন পিছন আসলেন।

আমার মাথাটা যেন হ্যাং হয়ে গিয়েছে, এলোমেলো ভাবনাগুলো মস্তিষ্ক জুড়ে৷ অথচ, কিছুই প্রসেস হচ্ছে না৷ নিঃশব্দে, কাঠপুতুলের মতোন রান্নাঘর থেকে খাবারের হাড়ি এনে রাখলাম। প্লেট, গ্লাস, সালাদ সব সাজিয়ে, প্লেটে তুলে দিলাম কোনো এক ঘোরেই৷

“বাব্বাহ! আজ তো শুক্রবারও না, না কোনো ওকেশন, তাও… যাক আমারই ভালো। কী হলো? তুমি খাচ্ছো না ক্যানো মায়াবালিকা?”

“হু!” চমকে উঠে অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় হাসলাম।

কোনো রকম দুয়েক গ্রাস মুখে তুলেই ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম৷ আবেগ ভাই ল্যাপটপ নিয়ে বসলেন, কোন প্রজেক্ট না কি আছে। যে মানুষটা আমায় প্রতিটি মুহূর্ত আগলে রাখে, এতোটা ব্যস্ততা তাঁর আজ কষ্টদায়ক। বড়োই কষ্টদায়ক!

নয়নযুগল বন্ধ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল, কতো বার পিঠ বদল হলো, তবুও নিদ্রার আগমন আর ঘটলো না। এলেমেলো চিন্তার ভারে, অদম্য এক যন্ত্রণায় পুড়লাম আমি গোটা রাত্রি। অবশেষে আবেগ ভাই শেষ রাতের দিকে বিছানায় এসে নিবিড় ভাবে আঁকড়ে ধরলে ঘুম ধরা দিল চোখে।

চলবে…
এখানেই ৩০০০+ শব্দ, তাই এক পর্বে শেষ করতে পারলাম না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here