#জানালার_ওপারে
||৪র্থ পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
ছুড়িটা হাতের কবজিতে বসাতে গেলেই চোখ গিয়ে পড়ে বাদামি আর্টিফিশায় লেদারের মলাটে আবৃত ডায়েরিটার দিকে। আকস্মাৎ মনে হলো, গল্প সমাপ্ত না করে জীবনের ইতি টানতে পারি না।পরশুদিন শুক্রবার, আমার প্রিয় মানুষটির সাথে ছোটো বোনের আকদ। শুক্রবার আসার আগেই বিদায় জানাতে হবে এ বিষাক্ত শহরকে, সমাপ্ত করতে হবে তাঁর জানালার ওপারে গড়া গল্পকে। ডায়েরি কলম নিয়ে বসে পড়লাম পুনরায়।
——-
🥀🌺পৃষ্ঠা- ৪
“তুমি আমার বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি খেলে ক্যানো? ছিঃ! ছিঃ! নষ্ট করে দিলে আমার স্বাদের বোতলটা!”
তিনি মুখটাকে এমন বিকৃত করলেন যেন আমার ঠোঁট লাগায় তাঁর বোতল নোংরা হয়ে গিয়েছে। যদিও আমি নিজেও শুচিবাইগ্রস্তা, তবে তাঁর এমন করায় বেশ রাগ হলো। আবার ঘিনঘিনও লাগছে তাঁর বোতল দিয়ে পান করায়।
তেড়ে উঠে বললাম,
“আমি কি বলেছিলাম আমাকে পানি দিতে? আর আমি কি নোংরা যে একটু মুখ লাগানোতে আপনার বোতল অশুদ্ধ হয়ে যাবে?”
“আমার বোতল নোংরা করে আবার বাঁকা উত্তর দিচ্ছো মায়াবালিকা!”
আবারও একই কথা বলায় প্রচণ্ড অপমানবোধ হলো, প্রচণ্ড রাগও হলো। ঠাশ করে হাতে থাকা কাচের বোতলের সমস্ত পানি ছুঁড়ে দিলাম তাঁর মুখে।
লোকটা অবাক, বিস্মিত। এতোটাই যে তার প্রভাব পেরিয়ে রাগান্বিত হলো কি না মুখভঙ্গি দ্বারা তা বুঝতে পারলাম না। আমি নিজেও হতবাক। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, কাঁপছি অনবরত। ইচ্ছে করছে নিজের মাথায় জোরেশোরে এক চাপড় মারি। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমদিন এসে এমন সব কাণ্ড কে ঘটায়? কে?
তিনি চোখ ছোটো ছোটো করে যেই না মুখ খুলবে ওমনি আমি দৌড়। কোনো দিকে আমার তাকানোর আর সময় নেই, গেট পেরিয়ে গেলেই আমি থামবো। যদিও বার কয়েক মন চাচ্ছিলো তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখতে, তবে তা উপেক্ষা করলাম সতর্কতার সাথে।
রিকশায় উঠে স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। কিন্তু কেন যেন দমফাটা হাসি পেল ভয়ংকর মানুষটির জলসিক্ত হতবাক চেহারা মনে করে। রিকশাচালক মামাও আমার হাসি দেখে অদ্ভুৎ দৃষ্টিতে তাকালেন। হয়তো ভাবছেন, মেয়েটি পাগল না কি… কথাটা মাথায় আসতেই চট করে হাসি থামিয়ে শান্ত হয়ে বসলাম।
টিউশনি করিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল হলো। গোসল সেরে বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি ড্রইংরুমের আলো জ্বলছে।
না তাকিয়েই মা ভেবে চুল মুছতে মুছতে অনুরোধ করি,
“আম্মু এক কাপ চা করে দাও না, ভার্সিটি থেকে এসে প্রচুর টায়ার্ড লাগছে।”
“হ্যাঁ, অন্যকে বিশেষ করে সিনিয়র ভাইকে চড় মারা, পানি মারা নিঃসন্দেহেই ভীষণ ক্লান্তির কাজ মায়াবালিকা।”
শান্ত সেই বজ্রকণ্ঠ যেন পপ মিউজিকের মতো কানে বাজলো আমার। চোখ বড়ো বড়ো করে সামনে তাকাতেই দেখি সেই অসভ্য লোকটা বসা। আমার মাথায় বাজ, আমি ওড়না ছাড়া এই লোকটার সামনে! ছুটে চলে গেলাম ঘরে।
সঙ্গে সঙ্গেই ফ্ল্যাটের দরজা খুলে আম্মু ঢুকলো। কোক নিয়ে এসেছেন এই অসভ্য লোকটার জন্য।
“শোনো বাবা, আমার মেয়েটাও তোমার বিষয়ে একই জায়গায় ভর্তি হয়েছে। একদম পড়াচোর, ফাজিল। তুমি একটু ওকে মাঝে সাঝে সময় করে পড়িয়ো। তোমার মাকেও বলেছিলাম।”
কথায় আছে ঘরের শত্রু বিভীষণ, এই যেমন আমার মা। ভীষণ রাগ হচ্ছে, এই অসভ্যটার সামনেও মান-সম্মান রাখলো না আমার। কেমন বিটকেলের মতো হাসছেন অসভ্য লোকটা!
“আন্টি এসব নাস্তা দিচ্ছেন কেন? ডায়েরিটা মনে হয় আপনার মেয়ে কলেজে ফেলে এসেছিল। আমি তো শুধু নাম দেখে এই ডায়েরিটা দিতে এসেছিলাম। এখন আসি।”
তিনি চলে গেলেন। আর শুরু হলো আমার মা জননীর বয়ান, যা থামবে কমপক্ষে এক ঘণ্টা পরে। আমি আনমনেই ডায়েরিটা হাতে নিয়ে খুললাম। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় গোটা গোটা অক্ষরে লিখে, ‘একবার বাগে পাই, সিনিয়রকে পানি মারার শিক্ষা তো দিতেই হবে। তাই না মায়াবালিকা?”
গলা শুকিয়ে গেল আমার। কী নিঃসংকোচ হুমকি তাঁর! তাও আমার বাড়িতে এসেই দিয়ে গেল! অসভ্য! আস্ত অসভ্য!
🥀🌺পৃষ্ঠা- ৫
আজ দু’দিন পর ভার্সিটিতে এসেছি, তাও জরুরি প্রয়োজনে। যা কাণ্ড করেছি, এর পর আমার জন্য ভার্সিটিতে আসা বড্ড ভয়ের কাজ।
চোরের মতো ক্যাম্পাসে ঢুকে প্রথমে দরকারী কাজটা করে নেই। ক্লাস থাকায় ক্লাসরুমের বিল্ডিংয়ের দিকে হাঁটি। তখনই একজন এসে জানায়, জুবায়ের স্যার না কি বলেছেন পশ্চিমের ভবনের ৩০৩ নং রুমে ক্লাস হবে আজ।
অবাক হলাম। যতোটুকু আমি জানি ঐ ভবনে আমাদের কোনো ক্লাস হয় না। তবুও বোকার মতোন চললাম৷ ৩০৩ নং রুমের দরজা খোলা, তবে একজনও মানুষ নেই। চমকে উঠি, ভয়ও পাই। বের হতে দ্রুতো পিছনে ঘুরতেই কারো সাথে ধাক্কা খাই।
“আপনি!” এই অসভ্য লোকটির সামনে পড়েছি ভাবতেই ভূমিস্থ হয়ে যেতে মন চাচ্ছে।
“হুম, আমি।”
তিনি এক পা এক পা করে আগাচ্ছেন। রুদ্ধশ্বাস আমার, পিছনে দেওয়াল। কোণঠাসা কণ্ঠে কোনোরকম উচ্চারণ করি,
“প্লিজ, আপনি আর আগাবেন না ভাইয়া।”
“তুমি কি ভয় পাচ্ছো? কেন? গতকাল তো বড্ড বেশিই হেসেছিলে আমাকে পানি মেরে নাস্তানাবুদ করতে পেরে। এখন কোথায় গেল সব সাহস? শাস্তি তো পেতে হবে। আবেগ কাউকে ছাড় দেয় না।”
আমি ঢোক গিললাম। তাঁর কোনো অভিব্যক্তি নেই। তাঁর সর্বদার মতোই গম্ভীর, নির্লিপ্ত, খাপছাড়া ভাব।
“দেখুন, আমি ইচ্ছে করে করিনি কিছু।”
“তুমি তো কিছুই ইচ্ছে করে করো না মায়াবালিকা। তোমার হাত, পা সব স্বতন্ত্রভাবে চলমান। যখন তখন একা একাই বিদ্বেষী হয়ে পড়ে। তাই তোমাকে নয়, তোমার স্বতন্ত্র অঙ্গ হাতকেই শাস্তি দিচ্ছি। এই যে আমার এসাইনমেন্ট, সব ডিটেইলস এই খাতায় দেওয়া আছে। পরশুর মধ্যে আমার চাই।”
আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই বের হয়ে গেলেন তিনি। আমি চোখ-মুখ কুঁচকে তীব্র বিরক্তি ও রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছি। অতঃপর অসহায় আমার নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে দিনরাত কাটিয়ে এসাইনমেন্ট শেষ করতে হয়। মনে মনে হাজারবার বকি। বলি, এই লোকটার সাথে যেন আর একটুও না দেখা হয়।
অথচ, ভবিষ্যৎ হতে চলেছে অন্যরকম। সামনের দিনগুলো বদলে দিতে চলেছে সকল অনুভূতি, আবেগ।
চলবে…
(বোঝার সুবিধার্থে ডায়েরির ভাগটায় পৃষ্ঠা নম্বর দিয়ে দিয়েছি। গতকাল দুই পর্ব দিব ভাবছিলাম। আর একটু লিখা বাকি ছিল, তখনই পুরো গল্প একটা ক্লিকে কেটে যায়🙂)