জানালার ওপারে পর্ব-৬

0
280

#জানালার_ওপারে
||৬ষ্ঠ পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
🌺🥀পৃষ্ঠা- ৭
চোখ দু’টো অশ্রুতে টলমল করছে। আবেগ ভাই কী করে করে করতে পারলেন এমনটা আমার সাথে? চোখ মুছতে মুছতে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আসি।

ইদানীং বড্ড আবেগ পাগল হয়েছি আমি। অপ্রয়োজনেও ভার্সিটিতে যাই তাঁর দর্শন পেতে। বিনা কারণেই ঐ অসভ্য দলের আড্ডাখানা তথা বটতলার আশেপাশে ঘুরঘুর করি, সালামও দেই যেয়ে। এই বাহানায় যদি ব্যক্তিটি কথা জুড়ে দেয়। হোক না সেই কথায় একটু ঝাঁঝ, একটু নোকঝোক, কটাক্ষ; তবুও কথাটা হোক। কিন্তু অসভ্য যে লোকটি আগে খোঁচা দিতে মুখিয়ে থাকতেন, এখন ঠিকভাবে দেখেনও না হয়তো আমায়।

আজও এই ভাবনা মনে নিয়েই বটতলার সামনে গিয়েছিলাম। হাতে জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন বইটি। ভাব খানা এমন যেন গভীর ভাবে ডুবে আছি আমি বনলতা সেনের মায়ায়। অথচ, আবেগ ভাইয়ের ফন্দীবাজ মায়াবালিকার মনে অন্যই চিন্তা।

“পিপীলিকা, পিপীলিকা
দলবল ছাড়ি একা
কোথা যাও, যাও ভাই বলি।”
আমাকে দেখে আজকেও হাসিব ভাই কটাক্ষ করতে ভুল করেন না।

দলবল বলতে যে নিশাকে বুঝিয়েছে তা বোধ করতে দেরী লাগেনি। কারণ সাধারণত বেচারি নিশাকেও জোর করে নিয়ে আসি আমি, কিন্তু আজ আমি একাই। এই মানুষটার অদ্ভুৎ সব নাম ডাকাতে বিরক্ত আমি। আর আমিই নয় শুধু, সব জুনিয়াররাই। কাউকে কাঠবিড়ালি তো কাউকে মৌমাছি। বেচারি নিশাকে তো মশা ডাকতে ডাকতে কাঁদিয়ে ফেলেন।

তবুও প্রিয় মানু্ষের প্রিয় বন্ধু। তাই জোরপূর্বক কিঞ্চিৎ হেসে উত্তর দিলাম, “ঘাস কাটতে তো আর যাই না ভাইয়া। হাঁটছি এমনি।”

হাসিব ভাইয়া আরও হাজারটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। অথচ, যার জন্য আসলাম, তিনি আমাকে না চেনার মতোন নির্বিকার ভাবে মোবাইলে ডুবে। ধুপধাপ পা ফেলে চলে আসলাম সেখান থেকে। কল লাগালাম মাকে।

বললাম,
“আম্মু, তুমি পাশের বাড়ির ভাইয়া না কি আমায় পড়াবে। সপ্তাহ শেষ হয়ে গেল একদিনও আসলো না, পরে তো ঠিকই টাকা নিবে।”

আমার কথা বলার ধরনটা বেশ ভালোই কাজে লাগলো বোধহয়। মায়ের মেজাজ ভালোই চটেছে। নিশ্চয়ই এখনই কল দিবে আবেগ ভাইকে। ক্লাস নেই আজ, তাই খুশি মনে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াই যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

পাশে চোখ যেতেই মাথায় হাত। ক্যান্টিনের চাচার বারো বছর বয়সী মেয়ে দুলি বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে। দুলির সাথে আবেগ ভাইয়ের গলায় গলায় খাতির, যদি বলে দেয়… প্রেম-টেম সব বাদ, জীবন নিয়ে টানাটানি হয়ে যাবে।

আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম। অতিরিক্ত মধুমাখা কণ্ঠে কিছু বলার আগেই সে কড়া মেজাজে বলে,
“আপনি আবেগ ভাইয়ের নামে এসব কী কইলেন? আমি এহনই যায়া বলতাসি ভাইয়ের কাছে।”

সে যেতে অগ্রসর হয়। আমি দ্রুতো তার হাত আঁকড়ে ধরি। “কাউকে বলিস না প্লিজ। বিনিময়ে তোর চকলেট লাগবে না কি আইসক্রিম না খেলনা? যা চাবি দিব।”

মেয়েটা চুপ থেকে খাণিক ক্ষণ ভাবলো। আমার হৃদয় দুরুদুরু কাঁপছে।

“ঠিক আছে, কিন্তু পাঁচটা কিটক্যাট কিনে দিতে হইবে।”

স্বস্তির শ্বাস ফেললাম, সেই সাথে আফসোসও হলো বড্ড। কারণ আজ রিকশা স্বপ্নীয় বিলাসিতা, বাস দিয়েই বাড়ি যেতে হবে। অতঃপর তার বাবার দোকান থেকেই তাকে চকোলেট কিনে দেই। বালিকা বুদ্ধিমান আছে, বাবার বিক্রিও বাড়ালো, আবার উপহারও পেল।

ঐ অসভ্যটার উপর রাগ লাগছে, তিনি আমার সাথে একটু কথা বললেই আমার টাকাটা বেঁচে যেত।ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার পথে যে দৃশ্য দেখি তাতেই কান্না চলে আসে। আবেগ ভাই একজন মেয়ের সাথে গল্পে মেতে আছেন। হাসির ছলে বারবার মেয়েটা তাঁর গায়ে হাত দিচ্ছে। তবে কি মিথ্যে ছিল সব স্বপ্ন, এতো জল্পনা-কল্পনা?

ভার্সিটির বাহিরে যেয়ে কিছু দূর এগিয়ে গেলে আমাকে কেউ ব্যস্ত রাস্তা থেকে ডাক দেয়। তাকিয়ে দেখি রিকশায় বসে থাকা আমার কাজিন আবির ডাক দিচ্ছে। নিঃশব্দে রিকশায় চড়ে বসি। কেন যেন মনে হলো কেউ আমায় ডাকলো, ঐ পরিচিত বজ্রকন্ঠ। পিছনে তাকাতে গিয়েও তাকালাম না। ভাবলাম মনেরই ভুল হবে, ঐ অসভ্য যুবকের সময় কোথায় আমার জন্য?

বাসায় যেয়ে ‘ঘুমাবো’ বলে বেডরুমের দরজা আটকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। আসরের নামাজ শেষ হলে দ্বারে নক করে আবির ভাইয়া।

“কী রে! আর কতো ঘুমাবি!”

আমি তাড়াতাড়ি চোখে-মুখে পানি দিয়ে আসি। আবির ভাইয়ের পছন্দ, চিন্তাধারার সাথে আমার পছন্দ, চিন্তাধারার এক অসম্ভব মিলবন্ধন আছে। তার সাথে গল্পে মজে দুঃখগুলো কয়েক মুহূর্তের জন্য ভুলেই গেলাম। অথচ, এক মুহূর্তের জন্যও বোধ করিনি কেউ একজন অগ্নিদৃষ্টিতে দেখছে আমাদের। মাগরিবের আজান অবধি কথোপকথন চলে আমাদের

“আবেগ এসেছে। ড্রইংরুমে চলে যা।”
প্রথমে বিস্মিত হলেও পরে বড্ড কান্না পেল নামাজ শেষে এ কথা শুনে। ক্যানো এসেছেন তিনি? কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে? অভিমানে ঠোঁট, গাল সবই ফুলালাম। তবে অভিমানটা দেখার মানুষটি কি আদৌ দেখবেন?

মাথায় কাপড় দিয়ে গুটি গুটি পায়ে বই নিয়ে বসার ঘরে যেয়ে বসলাম। অশ্রুর পতন আটকানোর বহু প্রচেষ্টা আমার। আম্মু চা-নাস্তা দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। বাসায় এ মুহূর্ত তেমন কেউ নেই, সবাই কোনো না কোনো কাজে বাহিরে।

ভুলক্রমেও আবেগ ভাইয়ের দিকে চোখ তুলে তাকালাম না। তিনি বই নিয়ে একটা পেজ বের করে আমাকে তা দেখিয়ে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
“টানা আসর থেকে মাগরিব অবধি বলা এতো কথা পেটের কোন কোণে থাকে মায়াবালিকা? কই আমার সামনে তো কখনও বের হয় না!”

আমি হা হয়ে গেলাম। তীব্র বিস্ময় নিয়ে তাকালাম তাঁর দিকে। এই পুরুষটি জ্বিন না কি গুপ্তচর ? কী করে জানলেন এ বিষয়ে?

আমার দৃষ্টিতে তাঁর চোখজোড়া আরও সংকুচিত হলো। ধমক দিয়ে উঠলেন হুট করে,
“বইয়ের দিকে তাকাও ইডিয়ট। তোমার মা এদিকে সিসিটিভি ক্যামেরার মতো তাকিয়ে আছে। যত্তসব ঝামেলা কোথাকার!”

আড়চোখে রান্নাঘরে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই বলছেন তিনি।
“কেন বলবো? আর আপনার সামনে কীভাবে বের হবে? আপনার কি আমার কথার জন্য সময় আছে? আপনার তো বান্ধবের অভাব নেই, যারা কাঁধে, পিঠে কথায় হাত রেখে আনন্দে মাতিয়ে রাখে। আবির ভাইয়ার আমার জন্য সময় আছে, আপনার মতোন না আমার ভাই।” তীব্র কঠোরতা মিশে আছে আমার বচনভঙ্গিতে।

তাঁর মেঘের আড়ালে ঢাকা চেহারায় সূর্যের মতোন মৃদু হাসি উঁকি দেয়। পরক্ষণেই মুখ খানা গম্ভীর বানিয়ে ফেলেন।

“আমার বড়ো মামাতো বোন ছিলেন, ব্রিটেনে বড়ো হয়েছেন তা-ই একটু বেশিই ফ্রী। তবে সামনে আর হবেন না। আর হ্যাঁ, এসব কাজিন-ফাজিনকে ভাই-টাই আমি মানি না বুঝলে মায়াবালিকা? So stay away girl. Otherwise you would not like the consequences. আর আন্টিকে কী সব উল্টাপাল্টা কথা বলো আমার নামে। কান ধরে ক্যাম্পাস চক্কর দেওয়াবো বলে দিলাম।” গাম্ভীর্যপূর্ণ তাঁর কণ্ঠ।

উঠে দাঁড়ালেন তিনি। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। কী বললেন এসব? একই সাথে কেউ এমন দুই ধরনের ভাবাবেগপূর্ণ কথা বলতে পারে! এই লোকটা আমাকে বিস্মিত করার কোনো সুযোগ ছাড়েন না। আর এই দুলিটাও না! বলেই দিয়েছে সব তাঁকে! তবে সব বাদ দিয়ে অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করছে।

আপন মনেই বিড়বিড় করলাম, “আমার অন্তর খানা যে কাঁপিয়ে দিয়ে গিয়েছেন সামান্য কথার দ্বারা, তা কি জানেন আবেগ ভাই?”

হৃদয়ের মধ্যখানে শত প্রজাপতির আলোড়ন হচ্ছে। অন্যরকম ভালো লাগা, প্রাপ্তির সুখ। আমার কাঙ্ক্ষিত পুরুষটির মনেও আমায় নিয়ে অনুভূতি আছে, নাহলে আমাকে কেন ব্যাখ্যা করতে গেলেন এতো কিছু? এতোটা চিন্তা, ঈর্ষা কেন আমায় নিয়ে? সারাটা রাত্রি ঘুম হলো না। তাঁর ভাবনায় বিভোর হয়ে রাত কাটালাম, নব নব স্বপ্ন বুনলাম।

এখন কোনো বিষয় না বুঝলে আবেগ ভাই বাসায় আসেন। তিনি তো পড়া বুঝান, আমি শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকি। বিনা কারণেই তাঁর অসভ্য দলের সামনে দিয়ে যাই। তিনি তাঁর তীক্ষ্ম, গভীর দৃষ্টি ফেললে, আমি লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলি। বড্ড প্রেমময় যাচ্ছে আমার দিনগুলো।

___

এতোটুকু লিখেই কলম থামালাম। সুদীর্ঘ এক শ্বাস ফেললাম। কী সুন্দর ছিল দিনগুলো! কিন্তু এর পরের একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা সব ধ্বংস করে দিল! সব! নোনা জল গড়িয়ে পড়লো। লিখতে বসলাম সেই বিষাক্ত দিনটির কথা।

চলবে…

লেট হয়ে গেল। সরি। অর্ধেক ডিলিট হয়ে গিয়েছিল। আর দু-তিনটি পর্ব, তারপর…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here