সুখের নেশায় পর্ব-৫

0
1030

#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৫

হলদে নিয়ন আলো ছড়িয়ে আছে একটুখানি জায়গা জুড়ে। সুদূরে গাঢ় অনামিশার ভিড়। হাসপাতালের করিডোরের একপাশে দাঁড়িয়ে বাহিরের দিকে দৃষ্টি মেলে রেখেছে চৈত্রিকা। বাহিরে অসংখ্য মানুষের আনাগোনা চলছে। কেউ কেউ প্রিয়জনের টানে ছুটে আসছে হসপিটালের দিকে,তো আবার কেউ সোজা রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে নিজ নিজ গন্তব্যে। চৈত্রিকার চোখে মুখে ক্লান্তির লেশমাত্র নেই। দৃষ্টি অনুভূতি শূন্য। অথচ দেহের অভ্যন্তরে হৃদপিন্ড নামক স্থানে বিষাদের ছড়াছড়ি। সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছাড়তেই জানালায় ভেসে উঠে মিমের প্রতিবিম্ব। মিম নিচু, বিষন্ন কন্ঠে বলে উঠল,

‘ বাবার চিকিৎসার এতো টাকা কে দিল আপু?কে পুরো চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে আমাদের সাহায্য করল?’

‘ জানিনা মিমু।’

নিরলস ভঙ্গিতে জবাব দিল চৈত্রিকা। তার এই মুহুর্তে কারো সাথেই একটা শব্দ উচ্চারণ করার ইচ্ছে বা আগ্রহ কোনোটাই নেই। তবুও মুখ খুলে জিজ্ঞেস করল,

‘ মা কোথায়?’

‘ বাবার কেবিনে বসে আছে। ‘

‘ বাবার জ্ঞান ফিরেছে?’

‘ উঁহু! ‘

চৈত্রিকার বাবা সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। পা দুটো অকেজো হয়ে পড়েছে। বিছানায় শুইয়ে কাটবে উনার বাকি জীবনটুকু। না জানি আল্লাহ কোন কর্মের শাস্তি দিচ্ছেন উনাকে এতো কঠিনভাবে। চৈত্রিকার ইচ্ছে করছে তার বাবার সবটুকু কষ্ট নিজের মধ্যে নিয়ে নিতে। বাবার এতো যন্ত্রণাদায়ক জীবন মেনে নিতে পারছে না সে। তীব্র কষ্টে ছেঁয়ে যাচ্ছে ভিতরটা।

হাসপাতালে যখন পৌঁছাল ফাহমিদা কাঁদতে কাঁদতে বলল এক টাকাও নেই হাতে,ডাক্তার তো টাকা ছাড়া চিকিৎসা করবে না। আহমেদ সাহেব কে ফেলে রাখা হয়েছে করিডোরে। ছুঁয়েও দেখছে না ডাক্তার রা। চৈত্রিকার মায়ের কথাগুলো শুনে যতটা না কষ্ট হয়েছে তার চেয়েও অধিক যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়েছে বুকের মধ্যিখানে, বাবার রক্তাক্ত নিথর দেহখানি দেখে। কয়েক মুহুর্তের জন্য নিষ্পলক চেয়েছিল বাবার মুখের দিকে। গালে লাল রঙ ছেয়ে ছিল আহমেদের। মেয়েটা একটুও ভাঙ্গে নি তখন। কাজল মাখা নেত্রে টলমল করে নি জল। ওই সময়ে চৈত্রিকা শুধু অনুভব করেছে দুনিয়ায় কতো আঁধার এবং আঁধারে বসবাস কত নিষ্ঠুর,নিকৃষ্ট মানবের।

টলমল পায়ে ডাক্তারের কেবিনে গিয়ে অনুরোধ করে চিকিৎসা শুরু করার জন্য। কিন্তু ডাক্তার সাফ জানিয়ে দেয় তাদের হাসপাতালে অগ্রিম অর্ধেক পেমেন্ট না করলে ট্রিটমেন্ট শুরু করতে পারবে না তারা। এটা কেমন নিয়ম মানুষের জীবন বাঁচাতে অগ্রিম পেমেন্ট করতে হবে!হসপিটাল নাকি কসাইখানা! চৈত্রিকার কাছে মনে হলো এটা কসাইখানা। এখান থেকে বাবা কে নিয়ে যাওয়া উত্তম। কিন্তু এই মুহুর্তে তা তো সম্ভব নয়। চৈত্রিকা ব্যাগে থাকা পাঁচ হাজার টাকা জমা দিতে গেল। এই টাকা টা আজ ধার নিয়েছিল মিহিতার কাছ থেকে, বাড়িওয়ালার এক মাসের ভাড়া ক্লিয়ার করে দিবে ভেবে। কিন্তু বিপদ যেন সর্বদা ঘাড়ে চেপে বসে থাকে চৈত্রিকাদের। চৈত্রিকা যখন রিসিপশনে টাকা জমা দিত গেল তখনই রিসিপশনে কর্মরত মেয়েটা বলল,

‘ম্যাম মাত্র একজন পুরুষ আপনার বাবার নামে টাকা জমা দিয়ে গেছেন। আপনার বাবার অপারেশনের সম্পূর্ণ পেমেন্ট করেছেন। ‘

মেয়েটার কথা শুনে হতবাক, হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল চৈত্রিকা। অন্য কেউ তার বাবার অপারেশনের টাকা দিয়েছে এটা যেন অবিশ্বাস্য। কন্ঠে একরাশ বিস্ময় নিয়ে বলে উঠল,

‘ কে দিয়েছে?’

‘ নাম বলেন নি উনি। দেখতে লম্বা এবং সুদর্শন ছিলেন।’

চৈত্রিকা প্রচন্ড চমকালো। এক আকাশসম চমকের দেখা মিলল চৈত্রিকার মুখশ্রীতে। কে হতে পারে?এই শহরে পরিবারের পর তার পরিচিত বলতে হাতে গুনা কয়েকজন। তবে তারা এতোটাও নিকটবর্তী নয় যে অগোচরে সাহায্য করে বেড়াবে। পরিবারের পর চৈত্রিকা নিজের সবচেয়ে কাছের বলতে এত বছর ধরে মিছে মিছে হলেও সাফারাত কে ধরে রেখেছে। আচ্ছা সাফারাত দেয় নি তো?পরক্ষণেই চৈত্রিকার মনে উদয় হওয়া ভুল-ভ্রান্ত ধারণা কাঁচ ন্যায় টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ল। যেই ছেলে তাকে চিনে না বলে সোজাসাপটা না করে,অস্বীকার করে তাকে, সে কেন তার বাবার জীবন বাঁচাতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবে!চৈত্রিকার মন বলছে কেউ তো আছে যে গত কয়েকদিন যাবত অদৃশ্য হয়ে তাকে নিজের মাঝে আলিঙ্গন করে নিতে চাচ্ছে। কোনো স্বার্থবিহীন কেন নিজেকে আড়াল রেখে চৈত্রিকা কে ফুল দিবে?সাহায্য করবে?দু’টো মানুষ এক! ফুল দেওয়া এবং আজকের টাকা দেওয়া মানুষ টা ভিন্ন ঠেকছে না চৈত্রিকার নিকট। তবে তা কতটুকু সত্য ফলবে জানে না সে।

কাঁধে আলতো স্পর্শ অনুভব করতেই চৈত্রিকা নড়েচড়ে উঠল। মিম জ্যাকেট টা হাতে নিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকালো। এটা তো ছেলেদের জ্যাকেট মনে হচ্ছে। কিন্তু তার বোনের কাছে কি করে এলো?নিজের জানার আগ্রহ দমিয়ে রাখতে পারল না মিম। বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,

‘ এটা কার জ্যাকেট আপু?তোমার গায়ে ছিল কেন?দেখে তো মনে হচ্ছে কোনো ছেলের।’

চৈত্রিকা জানালার কাছ থেকে সরে এলো। মিমের কাছ থেকে জ্যাকেট টা নিয়ে বসে পড়ল করিডোরে রাখা বেঞ্চে। মিম ও পাশে বসল। বোনের বিষাদে ভরপুর মুখটা দেখে পীড়ন হচ্ছে তার।

‘ তুই যখন ক্লাস নাইনে পড়িস তোকে সাফারাতের কথা বলেছিলাম মনে আছে তোর?’

মিম কিয়ৎক্ষণ ভাবনায় মগ্ন হলো। তৎপরে তড়তড় করে বলে উঠল,

‘ তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড সাফারাত ভাইয়ের কথা বলছো?’

‘ হু।’

মিম খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল। সে জানে তার বোনের মনে কতটা ভালোবাসা জমে আছে সাফারাতের জন্য। যদি সাফারাত ফিরে আসে তবে তার বোনের জীবনে সুখের কমতি হবে না কোনো কালে। চৈত্রিকা তাদের অতীতের সোনালী স্মৃতি গুলো খুব সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করেছে তার কাছে। যা শুনে মিম এক বাক্যে বলেছিল, সাফারাত ভাই বোধহয় তোমাকে ভালোবাসত আপু। কিন্তু চৈত্রিকা নাকচ করে বলে,হতে পারে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার কারণেই এতটা পজেসিভ ছিল। অথচ মিম মানতে নারাজ। আজও মানতে নারাজ সে। সাফারাত কে সে কখনও দেখে নি তবে বোনের মুখ থেকে প্রশংসা শুনেছে ব্যাপক। বাবার জন্য মনে পুষে রাখা দুঃখকে কিছুক্ষণের জন্যে চাপা দিয়ে আনন্দপূর্ণ স্বরে বললো,

‘ তুমি কি সাফারাত ভাইকে খুঁজে পেয়েছ আপু?’

‘ খুঁজে তো সেদিনই পেয়েছি যেদিন দিহান নামের ছেলেটা তার মা’কে নিয়ে দেখতে এসেছিল। পাত্রের পাশে বসা ওর বন্ধু ছিল সাফারাত। আর এই জ্যাকেট টাও সাফারাতের।’

একের পর এক সেদিন হতে আজ পর্যন্ত সাফারাতের প্রত্যেক টা আচরণ সম্পর্কে বলল চৈত্রিকা। বলতে গিয়ে গলা ধরে আসছিল তার। কথাগুলো বার বার আঁটকে যাচ্ছিল। ভিতরে জমায়িত অশ্রুকণারা দলা পাকিয়ে যাচ্ছিল কন্ঠনালিতে। নিমিষেই মিমের দীপ্ত চেহারায় এক ফালি কালো মেঘ এসে হানা দিল। ফর্সা চেহারায় স্পষ্ট বেদনার ছাপ। সাফারাতের মাধ্যমেই হয়ত তার বোনের কপালে সুখের দেখা মিলত। আজ মনে হচ্ছে চৈত্রিকা এক অভাগিনী, যার বিষাক্ত জীবনে সুখের কোনো জায়গা নেই। আছে কেবল যন্ত্রণা, অপমান, আঘাতের জন্য অফুরন্ত স্থান।

‘ আজ মেহুলের কথা বড্ড মনে পড়ছে। আমার কারণেই আমার জীবন টা এলোমেলো হয়ে গেল। সেদিন যদি জেদ ধরে আমি মেহুল কে নিয়ে না যেতাম আজ ও আমাদের পাশে থাকত। তোর মাথার উপর তোর বড় ভাইয়ের হাত থাকত। বাবার একটা ছেলে আছে বলে গর্ব করতে পারতেন। আর আমিও কখনও বাবার চোখে দোষী হয়ে থাকতাম না। চাইলেও এখন আর বাবার বুকে মাথা রাখতে পারি না আমি ছোটবেলার মতো করে। বাবার চোখে চশমা টা পড়িয়ে দিয়ে বলতে পারি না,বাবা আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমার এই কপাল পোড়ার জন্য শুধুই আমি দায়ী। ‘

নিজেকে শক্ত করে ধরে রাখা চৈত্রিকার অক্ষিকোটর হতে শেষমেষ গড়িয়ে গেল এক ফোঁটা জল। মিমের আঁখিদ্বয় হতেও বিনা বাঁধায় গড়াচ্ছে অশ্রু।

মেহুল তার থেকে চার বছরের বড় ছিল বয়সে। বড় বোনের প্রতি বাবার অবহেলার কারণ জানতে চেয়েছিল একদিন মিম। সেদিন ফাহমিদা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন,চৈত্রিকার যখন আট বছর তখন মেহুলের মৃত্যু হয়, চৈত্রিকার অসতর্কতার কারণ বশত। হায়াত, মৃত্যু আল্লাহর হাতে। চৈত্রিকা নিজেও ছোট ছিল তাই তাকে দোষ দেওয়া যায় না।

সিলেটে থাকতে বাড়ির পাশে নতুন তিন ‘তলা বিল্ডিং তুলেছে চৈত্রিকাদের দূর সম্পর্কের কাকা। চৈত্রিকাদের তখন টিনের ঘর। ছোট চৈত্রিকা এই বিল্ডিং দেখে ভীষণ খুশি হয়েছিল। মাঝে মাঝে যেত ওই বাড়ির মেয়ের সাথে খেলতে। মেহুলের জন্ম হওয়ার পর মায়ের থেকেও মেহুলকে নিজের কাছে রাখত বেশি চৈত্রিকা। যেখানে যেত সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য জেদ ধরত। টানা অনেক দিন চার বছরের মেহুল কে নিয়ে ছাদে খেলতে গিয়েছে। এতে বাবা অনেকবার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। অসাবধানে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। তাই চৈত্রিকা কে বার বার বলেছে ছাদে যেন খেলতে না যায়। কিন্তু অবুঝ চৈত্রিকা আমলে নেয় নি তা। বাবার থেকে লুকিয়ে মেহুল কে নিয়ে ছাঁদে গিয়েছিল। সেই যাওয়ায় ছিল মেহুলকে নিয়ে শেষ যাওয়া।

সন্ধ্যের প্রহর চলছিল। চৈত্রিকা মেহুল কে একপাশে বসিয়ে খেলছিল। ছোট্ট মেহুল উঠে কখন কিনারায় চলে গেল তা চোখে বিঁধে নি চৈত্রিকার। আর যতক্ষনে দেখল ছাঁদে রেলিং না থাকার দরুন মেহুল ছিটকে পড়ল উঁচু হতে ভূমিতে। নরম,কোমল একটুখানি দেহ টা থেঁতলে গিয়েছে প্রায়। ছোট্ট চৈত্রিকা স্তব্ধ হয়ে ছিল কিছু সময়। পরমুহূর্তে জোরে চিৎকার করে উঠে এবং জ্ঞান হারায়। সেদিন হতেই বাবার চক্ষু বিষ চৈত্রিকা। সেদিন যদি বাবার কথা মানত তবে আজকের পরিস্থিতি, চিত্র সবই হয়ত ভিন্ন হতো।

কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে চৈত্রিকার। মিমের ভিতর হতে কষ্টদায়ক নিঃশ্বাস বিমোচন হলো বাহিরে। বাবা কে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে চৈত্রিকার। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। কেবিনের দরজা কাঁপা কাঁপা হস্তে ঠেলতে গিয়েও থমকে গেল। ঢুকল না ভিতরে। বাবার এখন হুঁশ নেই তবে আকস্মিক যদি চক্ষু মেলে? যদি উত্তেজিত হয়ে পড়ে তাকে দেখে? বাবার ছেলের হত্যাকারী সে। হত্যাকারী নিজের আপন ভাইয়ের। বাবার দেওয়া আঘাত তো মেহুলের সেই বিধস্ত, থেঁতলে যাওয়া দেহ হতে খুবই নগন্য। খুবই!
__________

পুলিশ স্টেশনের সামনে গাড়ি ব্রেক কষল সাফারাত। পাশে বসা দিহান আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠল,

‘ তুই কি বুঝতে পারছিস সাফারাত,তুই কি করতে যাচ্ছিস?আপন চাচাতো ভাইয়ের জীবন বরবাদ করে দিচ্ছিস তুই। ‘

সাফারাত হাত মুঠো করে সিটে গা এলিয়ে দিল। ক্লান্ত, অবিশ্রান্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করে রোষপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠল,

‘ তোর চাচাতো ভাই যদি তোকে দু-দুবার মারার চেষ্টা করে, চেষ্টা করে তোর অস্তিত্ব মিটিয়ে দিবার তাহলে কি তুই তাকে ছেড়ে দিবি?তুই ছেড়ে দিলেও আমি এতো মহৎ না রে ভাই। স্যরি টু সে,নরম হৃদয়ের সাফারাত মারা গেছে তার মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে। ‘

#চলবে,,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here