অরোনী, তোমার জন্য~৯
লিখা- Sidratul Muntaz
রাহাত অরোনীর মুখে মুখে তর্ক করতে পারল না। কিন্তু রাফাত-অরোনী চলে যাওয়ার পর মায়ের কাছে এসে ঠিকই বলল,” এই বেয়াদব মেয়ের সাথে তুমি কিভাবে আছো মা? একটা ভালো কথা বলি, ওদের আলাদা করে দাও৷ রাফাত তো গোল্লায় গেছেই বউয়ের কথা শুনতে শুনতে। ও এখন আর তোমার কন্ট্রোলে আসবে না। এই ছেলের সাথে থাকলে তুমি শুধু অপমান আর অসম্মানই পাবে।”
রাবেয়া ছেলের কথা শুনে তেতে উঠলেন,” বেয়াদব হলেও সে উচিৎ কথাই বলেছে। রাফাত এতোকিছুর পরেও আমার সাথে আছে। কখনও আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করেনি। কিন্তু তুই কি করেছিস? বিয়ের আগেই জানিয়ে দিয়েছিস একসাথে থাকতে পারবি না। যেদিন বিয়ে হলো তার পরদিন সকালেই বউ নিয়ে ভাড়ার ফ্ল্যাটে চলে গেলি। সেই তুলনায় রাফাত তোর থেকে ঢের ভালো। আমাকে সে কখনও ছেড়ে যাবে না।”
রাহাত অবাক হয়ে বলল,” বাহ, এখন রাফাত ভালো হয়ে গেল? যেই ছেলে বউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে মাকে অপমান করে সে ভালো? আর আমি আলাদা আছি বলে আমিই খারাপ?”
” তুই ভালো না খারাপ সেটা বোঝার সুযোগই তো পেলাম না। দূরে থাকলে সবাই ভালো। কাছে থাকলেই কেবল বোঝা যায় কে কেমন!”
” মা, বিশ্বাস করো যদি অফিসটা দূরে না হতো তাহলে আমি কখনও তোমাকে ছেড়ে যেতাম না। চাকরির জন্য আমাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। এই কষ্ট আমারও কি কম?”
” এই উবার-পাঠাওয়ের মতো অনলাইনের যুগে যাতায়াত কোনো সমস্যাই না। রাফাতের অফিসও তো অনেক দূর। তোর বাপ-চাচারাও বহুত দূরে গিয়ে অফিস করেছে। কিন্তু কখনও বাড়ি ছেড়ে যায়নি। ঘরের ছেলে দিনশেষে ঘরেই ফিরে আসে। কিন্তু তুই স্বার্থপরের মতো বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গেছিস। এজন্যই তো অরোনী তোকে এইসব বলার সুযোগ পেয়েছে। রাফাত যদি এতো ঝামেলা সহ্য করেও এখানে থাকতে পারে তাহলে তুই কেন পারবি না? যদি সাহস থাকে তাহলে অন্তত একমাসের জন্য হলেও তুই আর বউমা এই বাড়িতে এসে থাক। নবাবের বেটিকে দেখিয়ে দে।”
রাহাত হার মেনে বলল,” ঠিকাছে মা। তুমি যা বলছো তাই হবে। শুধু একমাসের জন্য না, আমি সারাজীবনের জন্যই দীপ্তিকে নিয়ে এই বাড়িতে চলে আসবো।”
রাবেয়া ছেলের জবাবে ভীষণ সন্তুষ্ট হলেন। অরোনী নিজের বিপদ নিজেই ডেকেছে। এবার বুঝুক, জায়ের সাথে সংসার করতে কেমন লাগে!
রাহাত জানে এই বাড়িসহ গ্রামের অনেক সম্পত্তি বাবা দলিল করে রেখেছেন মায়ের নামে। তাই এমতাবস্থায় মাকে রাগানো মোটেও কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মায়ের ভালো এবং লক্ষী ছেলে হয়ে থাকা এখন অতীব জরুরী। রাফাতের মতো বোকারাই কেবল ধনী মাকে রাগায়। কিন্তু রাহাত তো বোকা নয়। সে তার ধনী মায়ের বাধ্য ছেলে। তাই মা যা বলবে রাহাত বাধ্যের মতো তাই করবে। কষ্ট করে কয়টাদিন মায়ের সাথে থেকে মায়ের মন জয় করতে পারলে ক্ষতি কি? দীপ্তিকেও বোঝাতে হবে যাতে সে মিষ্টি মিষ্টি কথায় মাকে খুশি রাখে। রাফাত-অরোনীকে মা ইতিমধ্যে সহ্য করতে পারছেন না। তাই ফাঁকা ময়দানে গোল দেওয়া রাহাতের জন্য কোনো ব্যাপারই না!আর একবার সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ার পর কে কোথায় যাবে তার ঠিক নেই। তখন রাফাতই না হয় মায়ের ভালো ছেলে হওয়ার ভূমিকাটা পালন করবে!
আজ সকাল থেকেই গোছগাছ চলছে। অরোনী রুম থেকে মাথা বের করে একটু পর পর ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছে। আজ থেকে দুই তলার উত্তর পাশটা আর খালি পড়ে থাকবে না। রাহাতের তালাবদ্ধ ঘরটা অনেকদিন পর খোলা হয়েছে। এখন থেকে সে বউসহ এইখানে থাকবে। অরোনীর বিশ্বাস হচ্ছে না। তার বলা মাত্র কিছু কথার জন্য রাহাত ভাই এতোবড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন! সত্যিই অবাক কান্ড। নিচ থেকে চিৎকারের শব্দ এলো। দীপ্তি ভাবী চলে এসেছেন। নিলিমা, রুমা, তানজু হৈচৈ করছে। অরোনী জানালা থেকে উঁকি মেরে দেখল, বেশ লম্বা করে ফরসা চেহারার সুন্দরী মহিলা গাড়ি থেকে নামল। চেহারা আহামরি কিছু না। কিন্তু জৌলুসে ভরপুর। চোখে সানগ্লাস, কানে- গলায় ডায়মন্ড। ঠোঁটে গাঢ় রঙের লিপস্টিক। চুল কার্ল করে একসাইডে এনে রাখা। গায়ে স্লিভলেস ব্লাউজ আর সিল্কের শাড়ি। চুলের খোপা দেখে মনে হচ্ছে পার্লার থেকে বেঁধে এসেছে। এইভাবে অরোনী সাজলে তাকে বলিউডের নায়িকা মনে হতো। দীপ্তি গাড়ি থেকে নামতেই রুমা, তানজিমা আর নিলিমা তাকে চারপাশ থেকে জড়িয়ে ধরল। বড়ভাবীকে পেয়ে কি উল্লাস তাদের! বলাই বাহুল্য যে বড়ভাবী তাদের ভীষণ প্রিয়। মাঝে মাঝেই তারা তিনবোন রাহাত ভাইয়ের বাড়িতে চলে যায়। দীপ্তি ভাবীর সাথে সময় কাটায়। ভাবী তাদের রান্না করে খাওয়ায়, শপিং করে দেয়। এখন সেই ভাবী পারমানেন্টলি বাড়িতে চলে এসেছে। তাদের জন্য তো আজ ঈদ! অরোনী পেছনে তাকিয়ে উর্মির উদ্দেশ্যে বলল,” তুমি বসে আছো কেন উর্মি? যাও বড়ভাবীর সাথে দেখা করে আসো।”
উর্মি দায়সারাভাবে বলল,” উপরে তো আসবেই। তখন দেখা এমনিই হবে। নিচে গিয়ে দেখা করতে হবে কেন? নতুন বউ নাকি যে গেইট থেকে রিসিভ করে আনতে হবে?”
” তবুও তোমাদের বড় ভাবী বলে কথা! একটা রেসপেক্ট আছে না? তোমার বোনরা তো গেল সোজা গেইট থেকে রিসিভ করে আনতে।”
উর্মি মুখ বাঁকিয়ে বলল,” আমার এসব ঢং ভালো লাগে না। আর ওরা এইসব কেন করছে সেটা আমি জানি। তোমাকে জ্বালানোর জন্য।”
রিতু তাল মিলিয়ে বলল,” এই ব্যাপারটা আমিও বুঝছি।”
অরোনী কিছু বলল না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার জানালায় তাকাল। দীপ্তির হাত ধরে নামল তিনবছরের মাহাথির। কি সুন্দর দেখতে বাচ্চাটা! ফরসা, স্বাস্থ্যবান, একেবারে যেন সাদা একটা ডাব্বা।
দীপ্তি উপরে এলো অনেকক্ষণ পরে। বাড়ির সবার সাথে আড্ডা দিল। লাঞ্চ করল। তারপর ছেলেকে নিয়ে উপরে এলো। এদিকে অরোনী আজ উর্মি আর রিতুকে নিয়ে আলাদা লাঞ্চ করেছে। তার একা খেতে ভালো লাগে না। আর রাফাত তো অফিসেই থাকে। সে ফিরবে রাতে। দীপ্তি ঘরে ঢোকার সময় তাদের দিকে তাকালোই না। উর্মি ভেবেছিল ভাবী এইখানে এসে তাদের সাথে বসবে। কিন্তু বসল না। উর্মি মনে মনে একটা গালি দিল।
বিকালে অরোনী বিছানায় শুয়ে আছে৷ তার অনেক পেটে ব্যথা করছে। হঠাৎ কেউ পায়ে এসে চিমটি কাটতে লাগল। অরোনী তাকিয়ে দেখল মাহাথির। মুখ টিপে হাসছে দুষ্টুর মতো। তার হাসিটা একদম রাফাতের মতো। মাহাথি দেখতেও অনেকটা রাফাতের মতো হয়েছে। অরোনীর ভীষণ মায়া লাগল। শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,” অ্যাই বাবু, এদিকে আসো।”
মাহাথির অরোনীর কণ্ঠ শুনে দৌড়ে পালিয়ে গেল। অরোনীর খুব হাসি পেল। তার ধারণা মাহাথির আবার আসবে। ড্রয়ার থেকে একটা ক্যাটবেরির প্যাকেট বের করল অরোনী। তার পিরিয়ডের সময় রাফাত চকলেট এনে ড্রয়ার ভরিয়ে রাখে। স্বাস্থ্যের জন্য নাকি ভালো! অরোনীর এতো চকলেট খেতে ইচ্ছে করে না। বাচ্চাদের দিয়ে দিয়ে শেষ করতে হয়। মাহাথির আবার এসেছে। পর্দায় তার ছোট্ট আঙুল দেখা যাচ্ছে। অরোনী আদুরে কণ্ঠে ডাকল,” এদিকে আসো। আমার কাছে কিন্তু চকলেট আছে। নেবে?”
মাহাথির পর্দার ফাঁক থেকে মাথা বের করে তাকাল। চোখের পাপড়িগুলো ঘন, কালো। কি সুন্দর! ইচ্ছে করছে কোলে নিয়ে আদর করতে। অরোনী হাত দিয়ে ডাকল,” আসো।”
মাহাথির ধীরে ধীরে আসতে নিচ্ছিল। হঠাৎ দীপ্তি কর্কশ কণ্ঠে ডাকল,” মাহাথির!”
মাহাথির মায়ের ডাক শুনে আবার ছুটে চলে গেল। অরোনী এবার বিছানা থেকে নেমে দরজার সামনে গেল। তখনি দীপ্তির গলা আবার শুনল। মাহাথিরকে সে ধমকাচ্ছে,” আরেকবার ওইখানে গেলে থাপ্পড় দিবো বেয়াদব ছেলে। চলো ঘরে চলো।”
অরোনীর চেহারা অপমানে শুকিয়ে গেল। দরজার বাহিরে আর বের হলো না সে। বরং ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। তারপর বিছানায় গিয়ে বসল। জা আসার পর ভেবেছিল এবার একটা ভালো সঙ্গী পাবে। যে অন্তত অরোনীর সাথে ভালোভাবে মিশবে। কারণ দীপ্তি তো এই বাড়ির মানুষগুলো থেকে আলাদা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সবাই এক। দীপ্তিও তাদের মতোই। নয়তো বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে অরোনীর সাথে খারাপ ব্যবহার করবে কেন? অরোনী তার কি ক্ষতি করেছে?
রাতে রিতুর সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করার পর রিতু বলল,” সবই হইছে কানপড়া। বড়ভাবী এই বাড়িতে ঢুকনের লগে লগে সবাই মিল্লা আফনের নামে বদনাম করছে। তাই এখন আফনেরে দেখতে পারে না। থাক, মুন খারাপ কইরেন না।”
অরোনী থমথমে মুখে বলল,” তোমার কি মনে হয়? শুধু বিকালের এই একটা ঘটনা নিয়েই আমি মনখারাপ করে আছি? এর চেয়েও কত বিশ্রী কাহিনী ঘটেছে আমার সাথে। তাও আমি মনখারাপ করিনি। কিন্তু আজ যা হলো…”
রিতু দ্রুত জিজ্ঞেস করল,” আবার কি হইছে ভাবী?”
অরোনী বলল,” আজ বিকালে এই ঘটনার পর আমি দরজা বন্ধ করে ঘরে শুয়ে ছিলাম। তখন তোমার বড় আম্মা আর বড়ভাবী ছাদে বসে গল্প করছিল। গল্প তো না, আমার নামে ক্রিটিসিজম।”
রিতু মুখ কুচকে বলল,
” কি সিজম?”
” ক্রিটিসিজম। মানে সমালোচনা আর কি। আমি নাকি বেয়াদব, মুখে মুখে তর্ক করি। আমার পারিবারিক কোনো শিক্ষা নেই। বাবাহীন মেয়ে বলেই আমার এই অবস্থা! আরও অনেক বাজে বাজে কথা যেসব আমি মুখে আনতে চাই না। এইসব উনি আমাকে আগে সরাসরি বলতেন তখন এতো খারাপ লাগতো না। কিন্তু এখন সম্পূর্ণ নতুন একটা মানুষের সামনে আমাকে হেনস্তা করে যাচ্ছেন। আর কিভাবে সহ্য করবো বলোতো?”
অরোনীর কণ্ঠ ভিজে আসছে। সে কি কাঁদছে? অরোনীর মতো কঠিন মেয়েও কাঁদতে পারে? রিতুর মনটা এতো খারাপ হলো! ইচ্ছে করল ছোটভাবীকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু সেই সাহস তার নেই। রিতু ক্ষীপ্ত কণ্ঠে বলল,” আজকে ছোটভাইরে আইতে দেন। তারপর আমি সব বলতাছি।”
অরোনী চোখ গরম করে বলল,” খবরদার রিতু, ওকে এসব কিছু বলবে না।”
” ক্যান কমু না?”
” ওকে এসব বললে বাড়িতে আবার একটা বড় সিন ক্রিয়েট হবে। এমনিতেও খুব হাঁপিয়ে উঠেছি। আর কত? তাছাড়া দেখলেই তো গতকাল কিভাবে রাহাত ভাই তাকে চড় মেরে দিল। আমি চাই না তোমার ছোটভাই সিন ক্রিয়েট করতে গিয়ে আবার কারো হাতে চড় খাক। আমি ওর অপমান আর সহ্য করতে পারবো না। তার চেয়ে ভালো, ওরা ওদের মতোই থাকুক আর আমি আমার মতো থাকি। ওদের সাথে তো আমার কথা বলার কোনো প্রয়োজন হচ্ছে না। একা থাকতে থাকতে আমার অভ্যাস হয়ে যাবে।”
” কিন্তু তাই বইলা একই বাড়িতে থাকলে এমনে কাউরে পাত্তা না দিয়া চলন যায়? আফনি কয়দিন চলবেন? ওরা যেই মানুষ, আফনেরে অতিষ্ট বানায়া ছাড়বো।”
অরোনী মুচকি হেসে বলল,” কিছু করার নেই। তোমার ভাই তো আর আমার জন্য তার পরিবারকে ছাড়বে না।”
রিতু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার এখানে কিছুই বলার নেই।
রাতে রাফাত বাড়ি ফিরেই বুঝতে পারল অরোনী ভালো নেই। বিছানায় চুপ করে শুয়ে আছে। রাফাত কথা বলতে গিয়ে ধমক খেয়েছে। মেয়েটার কি হলো?
রিতু রাফাতকে টেবিলে খাবার বেড়ে দেওয়ার সময় রাফাত জিজ্ঞেস করল,” তোর ভাবীর কি হয়েছে? রেগে আছে কেন?”
” ভাবীর পেটের ব্যাথাটা বাড়ছে তাই এমন করতাছে।”
রাফাতের সন্দেহ তবুও দমল না। অরোনী পেটের ব্যথার জন্য এমন করবে না। আজ দুপুরেও তার পেটে ব্যথা করছিল। রাফাত ফোন করেছিল, তখন তো অরোনী এইভাবে কথা বলেনি। এখন নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। রাফাত রিতুকে ভালোমতো চেপে ধরল।
” আমার কাছে কিছু লুকাবি না রিতু। তাহলে সমস্যা বাড়বে। সত্যি করে বল কি হয়েছে? বড়ভাবীর সাথে কিছু হয়নি তো আবার?”
রিতু ঘরের দিকে একবার উঁকি দিয়ে দেখল অরোনী কি করছে। যখন নিশ্চিত হলো যে অরোনী তাদের কথা শুনবে না তখন রাফাতের কাছে এসে পুরো ঘটনা বলল। রাফাত কথাগুলো শোনার পর আর ভাত খেতে পারল না। এই সমস্যার সমাধান না করা পর্যন্ত তার গলা দিয়ে খাবার নামবে না।
রাফাত ছাদে চলে গেল। দুশ্চিন্তা তার পিছু ছাড়ছে না। পারিবারিক এই ঝামেলা দ্রুত মেটানো প্রয়োজন। কি করবে রাফাত? কি করা যায়? চট করেই মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। রাফাত দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে লাগল। ইদানীং এমন অবস্থা হয়েছে যে রাফাতের নিচে নামা মানেই বাড়িতে বড়সড় ঝগড়া হওয়া। রিতু ভীত গলায় বলল,” ছোটভাইয়া যাইয়েন না।”
রাফাত কোনো জবাব দিল না। সোজা বাবা আর মায়ের বেডরুমে চলে গেল। রাফাতের বাবা নির্মল সাহেব টিভি দেখছেন। পাশে তাঁর স্ত্রী বসে গায়ে লোশন লাগাচ্ছেন। রাফাতকে ভেতরে ঢুকতে দেখেই রাবেয়া মুখ ফিরিয়ে নিলেন। রাফাত মায়ের সাথে কোনো তর্কে গেল না। সরাসরি বাবার কাছে গিয়ে বসল।
” বাবা কেমন আছো?”
ছোট ছেলেকে দেখে নির্মল সাহেব টিভি বন্ধ করলেন। তারপর স্মিত হেসে বললেন,” আলহামদুলিল্লাহ বাবা। তোর কি অবস্থা? অফিস থেকে কখন ফিরলি? ”
” এইতো কিছুক্ষণ আগে। আজ আমি তোমার কাছে একটা বিচার দিতে এসেছি বাবা।”
নির্মল সাহেবের ভ্রু গেল কুচকে। তিনি স্ত্রীর দিকে তাকালেন। রাবেয়া ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। ছেলেটার কি মাথাখারাপ হয়ে গেছে? বাবাকে এসব বিষয়ে টানছে কেন? নির্মল সাহেব কখনোই পারিবারিক কলহে নিজেকে জড়ান না। কিন্তু রাফাত যেহেতু এইভাবে বলছে বিচারের কথা তার মানে অবস্থা গুরুতর। অতএব নির্মল সাহবেকে খুব মনোযোগ দিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে হবে। তিনি মাথা নেড়ে বললেন,” কি বিচার শুনি?”
” আজ আমি অরোনীদের বাড়িতে মানে আমার শ্বশুরবাড়িতে গেছিলাম। তারপর শারমিন আন্টি আমাকে চড় মেরেছেন।”
নির্মল সাহেব চোখ-মুখ কুচকে বললেন,” মানে? বেয়াইন তোকে চড় মারবে কেন? তুই কি করেছিস?”
রাবেয়া গরম তেলে জল পড়ার মতো তেতে উঠলেন,” কি? ওই নবাবজাদীর মা তোকে চড় মেরেছে? এতোবড় সাহস? এই কথা তুই এখন এসে বাপের কাছে বলছিস? আগে বলিসনি কেন?”
রাফাত মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,” আগে বললে কি হতো?”
” কি হতো মানে? আমি গিয়ে ওই মহিলাকে বুঝিয়ে আসতাম আমার ছেলেকে চড় মারার পরিণাম কেমন! কোন সাহসে চড় মেরেছে তোকে?”
” চড় মারতে সাহস লাগবে কেন মা? তিনি তো আমার মায়েরই মতো। মারতেই পারেন।”
” মারতেই পারেন? আমি তোর মা হয়ে জীবনে কখনও তোর গায়ে হাত তুলিনি। এতো আদর করে মানুষ করেছি। আর কোথাকার কোন মহিলা এসে চড় মেরে দিবেন? এতো সস্তা?”
নির্মল সাহেব স্ত্রীকে থামানোর জন্য গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,” আহা, চুপ করো না। আগে শুনতে দাও পুরো ঘটনা। কি হয়েছিল বলতো বাবা? তোকে কেন চড় মারলেন?”
রাফাত মিষ্টি হেসে বলল,” কিছুই হয়নি বাবা। আমাকে কেউ চড় মারেনি। আমি শুধু মাকে এইটা বোঝাতে চাইছিলাম, সন্তানের গায়ে যখন অন্য কেউ হাত তোলে তখন একজন মায়ের কেমন কষ্ট হয়!”
রাবেয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। এখনও রাগে ফুঁসছেন। নির্মল সাহেব বললেন,” তোর কথা আমি কিছু বুঝতে পারলাম না বাপ।”
” তোমাকে বুঝতে হবে না বাবা। মা ঠিকই বুঝেছেন। আমি মায়ের সাথে এখন একটু আলাদা কথা বলতে চাই।”
নির্মল সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকালেন। রাবেয়া নিশ্চুপ। নির্মল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,” ঠিকাছে, কথা বল।”
বাবা চলে যাওয়ার পর রাফাত হাঁটু গেঁড়ে মায়ের সামনে এসে বসল। মায়ের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল। রাবেয়া ঝারি মেরে সরিয়ে দিলেন।
” আমার সাথে একদম আদিখ্যেতা করবি না।”
রাফাত হেসে বলল,” ঠিকাছে, আদিখ্যেতা করবো না। কিন্তু তোমার রাগ এখনও কমেনি। একটা মিথ্যে বানোয়াট গল্প শুনেই তুমি এতোটা রেগে গেছো। তাহলে অরোনীর মা যখন এই ঘটনা জানবেন তখন তিনি কতটা কষ্ট পাবেন ভাবোতো? আমি তো সবসময় তোমার চোখের সামনে থাকছি। কিন্তু অরোনী তো তার মায়ের কাছে থাকতে পারছে না। দূর থেকে মেয়ের ভালো থাকার দোয়া ছাড়া তিনি আর কি করতে পারছেন? তিনি যখন জানবেন তার মেয়েটা শাশুড়ীর হাতে চড় খেয়েছে তখন কি মেনে নিতে পারবেন? অরোনীকে নিলিমার জায়গায় চিন্তা করে দেখো মা। তুমি হলে কি মেনে নিতে পারতে?”
রাবেয়া কঠিন মুখে বললেন,” এ ধরণের ফালতু কথা আমাকে বুঝিয়ে লাভ নেই৷ আমি আমার সন্তানদের এতো কুশিক্ষা দিয়ে বড় করিনি যে বেয়াদবের মতো তর্ক করবে। আর বেয়াদবি না করলে তাকে কেউ চড় দিবে কেন?”
” যখন আমি চড়ের গল্পটা বললাম তখন কিন্তু একবারও কারণ জানতে চাওনি মা। এর আগেই রেগে গেছো।”
রাবেয়া কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে চাইলেন। কিন্তু বলার মতো কিছু খুঁজেই পেলেন না। রাফাত মায়ের কোলে মাথা ঠেকিয়ে বলল,” সব দোষ আমার মা। তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অরোনীকে বিয়ে করেছি। কিন্তু তুমি কেন তাকে পছন্দ করো না সেটা আমি এখনও বুঝতে পারি না। তারা আমাদের বাড়িতে কোনো দামী উপহার পাঠায়নি বলে? এটাও তো আমার জন্যই। আমি নিষেধ করেছিলাম। কারণ তোমার ছেলে যৌতুকের ঘোর বিরোধী। মায়েরা তো সন্তানদের ভালো শিক্ষা দেয়। তাহলে তুমি মা হয়ে কেন খারাপ কাজে বাধ্য করছো বলোতো? অরোনীর গায়ে এই ক্ষোভ থেকেই তুমি হাত তুলেছো। এইটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি আমার হয়েছে। ব্যাপারটা শুনতে কত বিশ্রী লাগে না মা? যৌতুকের জন্য পুত্রবধূর গায়ে হাত তোলা। তুমি কি বুঝতে পারছো মা এটা কতবড় অপরাধ? মানলাম, অরোনী মুখে মুখে তর্ক করে। সে তোমার সাথে বেয়াদবি করেছে এটাও আমি মেনে নিলাম। কিন্তু সেজন্য তুমি তাকে শাসন করতে পারো না। কারণ শাসন করার অধিকার শুধু তার আছে, যে আগে স্নেহ করে। তুমি কি কখনও অরোনীকে স্নেহ করেছো? মেয়েটা যেদিন প্রথম এই বাড়িতে এসেছে সেদিন থেকেই খারাপ ব্যবহার করে ওর মনটা তুমি নষ্ট করে দিয়েছো। তাহলে কোন যুক্তিতে ওর থেকে তুমি ভালো ব্যবহার আশা করো? যেখানে তুমি নিজেই কখনও মেয়েটাকে দুই পয়সার দাম দাওনি? আমি দিনের পর দিন তোমার ব্যবহার দেখেছি আর অবাক হয়েছি। আমার মা তো কখনও এমন ছিলেন না। তাহলে হঠাৎ কেন এমন হয়ে গেলেন? অরোনীর কাছে কত লজ্জা হয় আমার জানো? ওর সামনে মাথা তুলে আমি দুই কথা বলতে পারি না৷ শুধুমাত্র তোমার ব্যবহারের জন্য। এমন তুমি কেন করছো মা? কি শান্তি পাচ্ছো এসব করে? আমরা তো কেউই ভালো নেই এভাবে। আমি হাঁপিয়ে উঠেছি মা। আমার দমবন্ধ লাগছে। প্লিজ এইবার অন্তত বন্ধ করো! প্লিজ থেমে যাও!”
রাবেয়ার কোল ভিজে গেছে রাফাতের চোখের জলে। রাবেয়া কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। কিছুক্ষণ আমতা-আমতা করলেন। অবশেষে বললেন,” তুই কি চাস?”
” কিছু চাই না। শুধু ভালো থাকতে চাই। ছেলে হয়ে মায়ের কাছে এইটুকু চাওয়া কি খুব অন্যায়?”
” আমি যদি অরোনীর কাছে ক্ষমা চাই তাহলেই সব সমস্যা মিটে যাবে তো? ঠিকাছে, ক্ষমা চাইবো। কিন্তু শর্ত আছে।”
” কি শর্ত?”
” অরোনীকে আগে আমার সাথে কথা বলতে হবে।”
রাফাত মাথা নেড়ে বলল,” ঠিকাছে, আমি এখনি অরোনীকে ডাকছি।”
রাফাত পাঁচমিনিটের মধ্যে ফিরে এলো অরোনীকে সাথে নিয়ে। অরোনী দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,” কেমন আছেন মা?”
রাবেয়াও একইভাবে অন্যদিকে চেয়ে বললেন,” আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
চলবে