#জানালার_ওপারে
||৩য় পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
🥀🌺পৃষ্ঠা- ৩
কাঠফাটা রোদে খোলা মাঠে কানে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। প্লাস্টিকের শীর্ণ চেয়ারে পায়ে পা তুলে বসে আছেন সেই আগুন্তক। আস্ত এক অসভ্য লোক! দোষ নিজের সিনিয়দের জেনেও আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন। যদিও ঐ বখাটে সিনিয়র ভাইদেরও ছাড় দেননি। আমার থেকে একটু দূরত্বেই মুরগী হয়ে বসে আছে তারা। সাথে তো চড়-থাপ্পড় ফ্রী আছেই।
রোদের তাপে ঘাম চুয়ে চুয়ে পড়ছে আমার কপাল থেকে। মাইগ্রেনের ভুক্তভোগী আমি, অতিরিক্ত গরম আমার ব্যথার ট্রিগারপয়েন্ট। মাথা ব্যথায় টনটন করতে শুরু করে। মেজাজ চড়ে যায় পঞ্চম আকাশে। ঠাস করে কান থেকে হাত ফেলে দেই। ধপাধপ পা ফেলে চলে যেই লোকটির নিকটে।
কড়া গলায় আঙুল উঁচিয়ে বলি,
“দেখুন জনাব, আমি মোটেও আর কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবো না। দোষ আপনার সিনিয়র ছেলেপেলের, আমার না। বুঝলেন?”
তিনি উঠে দাঁড়ান। এতোই দ্রুতো উঠে দাঁড়ান যে তাল সামলাতে না পেরে বেচারা বৃদ্ধ চেয়ারটাও পড়ে গিয়েছে। নিজেকে ঐ চেয়ারের মতো বেচারা মনে হচ্ছে এখন আমার। কী দরকার ছিল লোকটাকে রাগানোর? চুপচাপ দৌড়ে চলে গেলেই তো পারতাম। যদি ঐ সিনিয়র ভাইদের মতোন আমাকেও চড় দেন।
তিনি এক ধাপ এক ধাপ করে আগাচ্ছেন আমার দিকে, কিন্তু আমি গল্পের নায়িকার মতোন পিছাতে পারছি না। আমার পা ভয়ে জমে গিয়েছে। চোখ-মুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে আছি। হুট করে মুখে একঝাঁক মৃদু উষ্ণ বাতাসের আভাস পাই। কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে তাকাতেই দেখি সেই ভয়ংকর রাক্ষুসে মুখটি দেখতে পাই। যদিও মুখটি মানুষেরই, দানবীয় নয়। বরং নজরকাড়া বড়ো বড়ো চোখের পাপড়ির অধিকারী। বিষয়টা ভাবতেই ঈর্ষা বোধ হলো।
ভাবনার মাঝেই তিনি আমার কানের নিকটে মুখ এগিয়ে শান্ত কণ্ঠে শুধান,
“মেয়ে, তোমাকে মোটেও আজকের জন্য শাস্তি দেইনি। গতকাল জ্ঞান হারিয়ে আমায় বিপদে ফেলার পঁয়তারা করার জন্য এ শাস্তি।”
“দে-দেখুন…”
“দেখাও, আমি দেখি।”
ঠোঁট কামড়ে হাসেন অসভ্য লোকটি। তাকিয়ে দেখি আশেপাশে থাকা ছেলে-মেয়েগুলোও হাসছে। আমি দৃষ্টি নত করে দুই ধাপ পিছিয়ে যাই। মনে মনে আক্ষেপ করি, আমার সাথেই কেন এমন হয়? হচ্ছে?
“নাম কী তোমার মেয়ে?”
“আ-আমার নাম…”
“তোমার নাম মায়াবালিকা। আমি তোমায় মায়াবালিকা বলেই ডাকবো, নাম যা-ই হোক।” খাপছাড়া ভাব নিয়ে চলে গেলেন তিনি। আমি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। এমন নির্বাক করা চরিত্রও বুঝি বাস্তবে মানুষের হয়!
ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম ক্লাসরুমে। আমি বসার কিছুক্ষণ পরই স্যার বেরিয়ে গেলেন, সাথে সকল ছাত্র-ছাত্রীও। অতঃপর তীব্র মাইগ্রেনের ব্যথা নিয়ে মাথা ধরে আমি একাই বসে রইলাম ক্লাসরুমে। হুট করে কেউ চোখের সামনে এক পাতা ঔষধ সহ পানির বোতল ধরলো। তাকিয়ে দেখি ঐ লোকটা। ক্লান্ত আমি আবারও চোখ নামিয়ে ফেলি।
“এই ঔষধটা খাও। ভালো লাগবে।”
খেয়াল করে দেখি ডাক্তারের দেওয়া ঔষধটাই। বিনা বাক্যব্যয়ে সেবন করলাম তাঁর দেওয়া ঔষধ। এক সূক্ষ্ম ভালো লাগার সঞ্চারণ হলো হৃদয়ে। মনে হলো এই মানুষটা একদম খারাপ তো নয়ই। পরক্ষণেই লোকটা এমন কিছু করলো মনে হলো পৃথিবীতে তাঁর চেয়ে বাজে, অসভ্য আর কেউ নয়।
————-
নিজের প্রিয় মানুষের পাশে দেখা সবার সহ্যের বাহিরে, যদি সেই প্রিয় মানুষটির পাশে নিজের বোনকে দেখতে হয়? ডায়েরি লিখা থামিয়ে, আমার রুমে বসে স্পষ্ট দেখছি ছোটোবোন আমার প্রিয়তমের বাড়ি থেকে আসা শাড়ি, গহনা গায়ে লাগিয়ে নেড়েচেড়ে। আমার হৃদয় জ্বলছে, প্রচণ্ড হৃদয় জ্বলছে। যেন কেউ হৃদয় চিড়ে কাঁচা ঘাতে লবণ-মরিচ লাগিয়ে রেখেছে।
ছোটো বোন হাফসা আমাকে টেনে নিয়ে তার এঙ্গেজমেন্টের শাড়িটা তুলে দিয়ে বলল,
“দেখ আপু, কী সুন্দর শাড়ি দিয়েছে! শাড়িটা না কি আবেগ সাহেব পছন্দ করে কিনেছেন!”
চোখের সম্মুখভাগ ঘোলাটে হয়ে এলো। এই অশ্রুগুলোও না! একদম বিদ্রোহী, বাধ মানে না কখনওই। মুখ ঘুরিয়ে কোনোরকম জল মুছে নিলাম। আবেগ ভাই এতো নিষ্ঠুর! কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে দিতে আমার প্রিয় সোনালী রঙের শাড়িই পাঠালেন।
আমার এক কাকাতো বোন এলেম, মেহের নাম। তাঁর চেহারা আর মিষ্টি আচার-ব্যবহার বৈকী কিছুই দেখিনি কখনও। কঠোর পর্দাশীল নারী।
তিনি আমায় জড়িয়ে ধরে দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করলেন, “কী গো কাকী, বড়ো মেয়ে রেখে ছোটোটার বিয়ে দিচ্ছেন ভালো কথা! এবার আমাদের এই বুড়ির কথাও ভাবুন।”
“ওকে আর কে বিয়ে করবে? ওর কি এখন আর সে যোগ্যতা আছে! এখন ভাইদের ঘাড়ে বসেই খাবে।”
চোখ জোড়া অসম্ভব রকম জ্বলছে। আর সহ্য করা সম্ভব নয়। আমার গলা ফাঁটিয়ে কাঁদতে হবে, নাহয় আমি মরে যাবো। মরেই যাবো। কেন মৃত্যু হলো না আমার ঐ দিন? এই বিভীষিকাময় দিনগুলোর চেয়ে মৃত্যুটাই হয়তো বেশি কাম্য ছিল আমার।
নিঃশব্দে বেডরুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম। অবশ্য শব্দ করার জোরও আমার নেই। মুখ চেপে কাঁদতে হাতে একটা চাকু তুলে নিলাম। আমি হার মেনেছি, নিজের অসহায়ত্বের কাছে হার মেনেছি, প্রেমের কাছে হার মেনেছি, জীবনযুদ্ধ হার মেনেছি। এখন শুধু যুদ্ধ ত্যাগ করা বাকি।
চলবে…
এই পর্বের লক্ষ্য, ৬০০+ রিয়েক্ট ক্রস করলেই ৪র্থ পর্ব এসে যাবে। ছোটো পর্বের জন্য দুঃখিত, পরের পর্ব বড়ো করে দিব।