#জানালার_ওপারে
||৫ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
‘মাঝ দুপুরে ফাঁকা রাস্তায় কিশোরী মেয়েটির হাত চেপে ধরে মতি ব্যাপারী। মেয়েটি হাত ছাড়াতে জোরাজুরি, চেঁচামেচি করলেও ফলাফল শূন্য। নোংরা স্পর্শ লেপ্টে যাচ্ছে তার অসহায় শরীরে।’ লিখতে লিখতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ঘুমেও এই বিষাক্ত দিনের স্মৃতি যেন পিছন ছাড়ছে না। স্বপ্ন হয়েও তাড়া করে যাচ্ছে।।
বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ঐ দিনটি না আসলে হয়তো এমন দুর্দিন দেখতে হতো না আমায়। । গভীর রাত্রি। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে পুনরায় ডায়েরি নিয়ে বসি।
—
🥀🌺পৃষ্ঠা- ৬
অসভ্য লোকটার নাম আবেগ। এসাইনমেন্ট নিয়ে আজ যাচ্ছি ভার্সিটিতে। সিএনজিতে বান্ধুবী নিশা ও তার ভাইও আছে। যাওয়ার পথে নিশাকে ভার্সিটির সব ঘটনা খুলে বললাম।
“সিরিয়াসলি? তুই আবেগ ভাইয়ের মুখে পানি মেরেছিস! তুই জানিস আবেগ ভাই রাজনীতি করে? টপারও। আর তুই কি না… আমার তো ভয় হচ্ছে উনি কোনো…”
কথার মধ্যেই ফোঁড়ন কেটে তার ভাই বলেম,
“চুপ! ভয় দেখাইস না তো! আবেগ মোটেও কারো ক্ষতি করবে না। ছেলেটা শুধু একটু রাগী। তবে এতো কমে ছেড়ে দিল তোমাকে…”
মুখ বাঁকালাম আমি। একটা এসাইনমেন্ট এতো কম সময়ে শেষ করতে দেওয়া কি কম শাস্তি? ভাইয়া চলে গেলেন আমাদের নামিয়ে।
ক্যাম্পাসে ঢুকে কয়েক কদম আগাতেই অসভ্য লোকটি মানে আবেগ ভাই তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ান।
“সিনিয়রদের দেখলে যে সালাম দিতে হয়, এটাও শিখো নাই না কি তোমরা?”তাঁর বন্ধু হাসিব ভাই ধমক দিয়ে উঠেন।
ধমক খেয়ে নিশা তোঁতা পাখির মতো ঝটপট সালাম দেয়। আমি মুখ বাঁকিয়ে উলটো দিকে তাকাই। বিড়বিড়াই,
“এমন অসভ্যের দলকে সালাম দিতে আমার বয়েই গেছে।”
অসভ্য লোকটার চোখে চোখ পড়তেই শুকনো ঢোক গিলি আমি। তাঁর চাহনি এমন যেন কাঁচা চিবিয়ে খাবেন আমায়।
দ্রুতো এসাইনমেন্ট এগিয়ে দিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে শুধাই, “আপনার এসাইনমেন্ট, আবেগ ভাই।”
তিনি হাতে নিয়ে তা পর্যবেক্ষণ করার মাঝেই আমি ও নিশা কেটে পড়ি।
নিশার ক্লাস থাকায় আমি একাই একাই ক্যান্টিনে বসে চা পান করছি।
“ভার্সিটিতে উঠতে না উঠতেই যে বফ পাতায় ফেলসো, বাসায় কি জানে না জানাবো?”
চমকে উঠে মুখ থেকে চা পড়ে যায়। রাগ হয়, সীমাহীন বিরক্তিও।
“কী সব বলছেন? পাগল হয়েছে বাসায় জানে না জানাবো?”
আমি উত্তর দিতে না দিতেই তিনি চেয়ার সমেত আমাকে নিজের দিকে ঘুরান। আমি হা হয়ে যাই।
“দেখেছি, তা-ই তো… তা-ই তো বলছি। ঐ ছেলেটা কে মায়াবালিকা?” তাঁর গলা গম্ভীর, তবুও কেমন যেন হৃদয় নাড়া দিল। চোখগুলোর চাহনি আজ এলোমেলো, অস্থির।
অন্যরকম অনুভূতি বোধ হচ্ছে আমার। এই দীর্ঘ কৈশোরে, যৌবনে এমন কখনও লাগেনি। নিজেকে সামলে নিলাম।
“আপনি অযথা ভুল বুঝছেন আবেগ ভাই। ঐটা নিশার ভাই ছিল। ভার্সিটির বিষয়ে বলছিলেন।”
শুনে সুগভীর এক নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর স্বস্তি মাখা তপ্ত শ্বাস আমাকেও ছুঁলো। অতঃপর কিছু না বলেই চলে গেলেন।
ক্লাস করার মন-মানসিকতা না থাকায় খাণিক ক্ষণ পরই বেরিয়ে পড়লাম। নীলক্ষেত থেকে একটা বই কিনতে গবে। তাই সেই উদ্দেশ্যেই হাঁটা ধরলাম।
আগে কখনও একা আসিনি তাই একটু সংকোচ হচ্ছে। ব্যস্ত রাস্তা, ভীষণ ভীড়। রাস্তা পাড় হতে গিয়ে কখন যে চলন্ত বাসের সামনে এসে পড়েছি বুঝিনি। খেয়াল হতেই জমে গেলাম আমি। মৃত্যু বোধহয় অবধারিত আজ। কিন্তু আল্লাহর দূত হয়ে আবেগ ভাই এসে টান দিয়ে সরালেন। মাটিতে পড়ে গেলাম উভয়ে।
“তোমার চোখ কোথায় থাকে! দেখেও ইডিয়টের মতো দাঁড়িয়ে আছো! স্টুপিড মেয়ে!”
তিনি দাঁড় করিয়ে ইচ্ছে মতো ঝাড়লেন। অতঃপর শান্ত হয়ে প্রশ্ন করলেন,
“নীলক্ষেত যাচ্ছো? তাহলে আমার সাথে চলো, আমিও যাচ্ছি।”
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালাম। পড়ে গিয়ে পায়ে বেশ ব্যথা পেয়েছি। বহু কষ্টে হাঁটছি। মানুষের ধাক্কা থেকে বাঁচার অজস্র প্রচেষ্টা। তবুও পা ব্যথা নিয়ে মুক্তি কোথায়? আমার অবস্থা হয়তো যুবকটি বুঝতে পারলেন। এগিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে এমন ভাবে আড়াল করে নিলেন যে তাঁর গায়ের সাথেও গা লাগলো না, অন্য কারো সাথেও না।
অসম্ভব ভালো লাগে ছেয়ে গেল মনে। এতো মানুষের ভীড়ে বারবার আমার চোখজোড়া তাঁর উপরই আটকে যেতে শুরু করলো। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলাম যুবকটিএ দিকে। হয়তো অনেক সুদর্শন নয়, তবুও আমার নিকট অসম্ভব সুন্দর। বড়ো চোখের পাপড়ি দ্বারা অলংকৃত বুদ্দিদীপ্ত বাদামী চোখ যেন আমায় বারবার তাতে ডুব যেতে বাধ্য করছে।
বাসায় এসেও তাঁর মুখশ্রী মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। তাঁর সাথে কাটানো প্রতিটি স্মৃতি বারবার আমায় এলেমেলো করে দিচ্ছে। ইশ! কী টক-ঝাল-মিষ্টি অনুভূতি!
বই হাতে নিয়ে তাঁর কথা ভাবছি, আর মুচকি মুচকি হাসছি। আম্মু এসে ব্যাঘাত ঘটালো।
“কী রে! বসে আছিস কেন? যা, তাড়াতাড়ি গোসল করে আয়।”
কৃত্রিম ঝর্ণার শীতল বারিধারা ভিজিয়ে দিচ্ছে আমায়। তাও যেন আজ ঐ অসভ্যটার নেশা লাগিয়ে দিচ্ছে। কল্পনার জগতে দেখতে পাচ্ছি আবেগ নামক অসভ্য লোকটিকে। আমি চোখ বন্ধ করে অনুভব করছি তা।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি, আমি কি প্রেমে পড়ে গিয়েছি তাঁর? এই অসভ্য লোকটা একদিনের মাঝে কী জাদু করলো আমায়? আমার মন-প্রাণ তো আসক্ত করে দিল তাঁর নেশায়।
ঠিক তখনই দর্পণে ভেসে উঠলো অসভ্য লোকটার ছবি। তাঁর বড় বড় পাপড়িযুক্ত চোখে সেই অম্লান, গম্ভীর চাহনি।
আনমনেই বিড়বিড়ালাম,
“আপনাকে চাই, আবেগ ভাই। আপনাকে চাই। আপনিও কি আমাকে চান? আপনিও কি আমাকে নিয়ে ভাবেন এভাবে? ভাবছেন?”
একবার মনে হলো, সে কী করে আমাকে নিয়ে ভাবতে পারে? আমি ঘায়েল করার মতো সুন্দরী নই, নেই আজকালকার স্মার্ট চালচলন। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম আয়নায়। দেখতে একদম তো ফেলনা তো নই, অযোগ্য নই তাঁর। না আছে কোনো প্রতিবন্ধকতা, তবে তাঁকে কেন পেতে পারবো না?
আর তাঁর মনে যদি আমার জন্য কোনো অনুভূতি না-ই থেকে থাকে, তবে কেন আমার জন্য এতো চিন্তা? কেন এতো কেয়ার করেন? আর তাঁর চোখের সেই অন্যরকম দৃষ্টি! আরো কাউকে তো এভাবে শাসন করেন না, আগলে রাখেন না। না কি মায়ের কথা রাখতেই বা পরিচিত বলেই এমনটা? মন ও মস্তিষ্কের শীতল যুদ্ধ চলমান। মন বলছে এ প্রেমের টান, মস্তিষ্ক বলছে মানবিক দায়িত্ববোধ। বাস্তবতা কী জানি না, তবে ঐ পুরুষটিকে আমি চাই। একান্ত নিজের করে চাই। সবকিছুর বিনিময়ে হলেও চাই। কিন্তু তিনি কি ভালোবাসবে আমায়?
—-
এতোটুকু লিখতেই আমার হাসি পেয়ে গেল। আনমনে বললাম, “ভেবেছিলাম আমার কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। যদি জানতাম এতো বড়ো প্রতিবন্ধকতা আসবে তাহলে তখনই আপনার আশা ছেড়ে দিতাম আবেগ ভাই।”
||৬ষ্ঠ পর্ব||
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=405995038195255&id=100063542867943
চলবে…