তোমাকেপর্ব 9.1
মুনিরের বহুদিনের অনিদ্রা রোগ I মাঝে মাঝেই ঘুমের ওষুধ খেতে হয় তা নাহলে ঘুমাতে পারে না I আজও মনে হচ্ছে তেমনি একটা রাত I কিছুতেই ঘুম আসছে না I থেকে থেকে শুধু অনিমার আলমারিতে রাখা বইটার কথা মনে পড়ছে I মুনির কি সত্যিই অনেক দেরি কোরে ফেলেছিলো ? ওর কি আরো অনেক আগে ই অনিমা কে বলা উচিত ছিল ? কিন্তু ও তো ডেকেছিল অনিমা কে I অনিমা আসেনি I একটু সময় চেয়েছিল শুধু এর বেশি তো কিছু চায়নি I
নাহ এভাবে হবেনা কিছুতেই ঘুম আসছে না I মুনির ব্যাগ খুলে ঘুমের ওষুধ বের করল I আর ঠিক তখনই শুনলো বাগান থেকে গানের শব্দ ভেসে আসছে I অনিমা গান গাইছে I অনেক বছর পর অনিমার গান শুনলে মুনির I
আস্তে করে দরজা খুলে বাগানে বেরিয়ে এল মুনির I দরজাটা ঠিক সিঁড়ির নিচেই I মুনির টের পেল অনিমা সিঁড়িতে বসে গান গাইছে I ইচ্ছে করে ওখানে গেলো না সে I পাছে অনিমা গান বন্ধ করে দেয় I
চুপচাপ সিঁড়ির নিচেই দাঁড়িয়ে রইল I অনিমার গানের বিষন্নতা ছুঁয়ে গেল ওকেI বুকের ভেতর তীব্র একটা চাপা কষ্ট টের পেল I খুব ইচ্ছা করছে অনিমার কাছে যেতে I গান শেষ করে অনিমা একা একা কথা বলছে I মনিরের হঠাৎ মনে হল অনিমা বোধহয় ওর নাম ধরে ডাকলো I মুনির বাগানে বের হয়ে দেখল অনিমা অন্যদিকে তাকিয়ে বসে আছে I আস্তে আস্তে কাছে এগিয়ে গেল মুনির I অনিমা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল
বস মুনির I আমি জানতাম তুমি আসবে
মুনির আস্তে করে গিয়ে অনিমার পাশে বসলো
অনিমা পাশে তাকিয়ে ভুত দেখার মত চমকে উঠলো
তুমি এখানে কি করছ ? তোমার এ সময় এখানে আসা একেবারেই উচিত হয়নি
মনির হতভম্ব হয়ে গেল I বলল
তুমি তো আমাকে বসতে বললে
অনিমা উঠে দাঁড়ালো I দুই হাত দিয়ে মাথার দুই পাশে চেপে ধরে বলল
তুমি যাও এখান থেকে I
তারপর সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিল
মুনির বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল I
অনিমা ছুটতে ছুটতে ওর শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল I তারপর দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো I ওর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না নিচে যেটা হলো I অনিমা বহুবছর কাঁদে না I আজ খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে I
বিয়ের পর অনিমা যখন প্রথম এখানে আসে মুনিরের প্রতি একটা তীব্র অভিমান ছিল মনে I মুনির কখনো ওকে ভালোবাসিনি এমন কি ওর বন্ধুত্বটা ও ছিল স্বার্থের কারণে I এটা ভেবে খুব কষ্ট পেতে সবসময় I তারপর একসময় মনে হল তাতে কি হয়েছে অনিমা তো ভালোবেসেছিল I তাতে তো কোন খাদ ছিল না I আর এটাতো সত্যি যে এই পৃথিবীতে একমাত্র একজনই ছিল যে ওর মন খারাপ অভিমান কষ্টগুলো মুহূর্তে ধরে ফেলত I তারপর হঠাৎ করে খুব সাধারণ কিছু কথা বলে কি করে যেন ওর মনটা ভালো করে দিত I তাইতো কখনো সমুদ্রের ধারে বসে কখনো বহু লোকের ভিড়ে এখনো গভীর রাতে একা একা উঠোনে বসে কিংবা কখনো একা একা পথ চলতে চলতে অনিমা সারাক্ষণ ওর সঙ্গে কথা বলতো I এদেশে অনিমার কোনো বন্ধু নেই যার সঙ্গে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত দুঃখ কষ্ট গুলো ভাগ করে নেওয়া যায় I তাইতো ওর সুখে দুঃখে হাসি কান্নায় সাফল্য-ব্যর্থতায় মুনির সবসময় ওর পাশে ছিল I অনিমা অনেকবার ভেবেছে কেন ও মনিরকে এতটা ভালোবাসে কেন আজও ভুলতে পারেনি এমন কি ছিল ওর মধ্যেI অনেক ভেবে ও এর উত্তর পাইনি I হয়তো অনেক কিছুই ছিল কিন্তু সেই সবকিছুকে ছাপিয়ে একটা আত্মিক যোগাযোগ ছিল ওদের দুজনের মধ্যে I
মুনির দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল I অনিমা দাঁড়িয়ে আছে I ওর চোখ মুখ কেমন মলিনI
তুমি কি ব্যস্ত মুনির?
না I কি হয়েছে ?
তোমার কাছে শেষবারের মতো একটা হেল্প চাইবো
মুনির এর মনটা ধক করে উঠলো I শেষবারের মতো মানে এটা আবার কি ধরনের কথা I সেই রাতের পর মুনির আর বিরক্ত করেনি অনিমা কে I ওর ব্যক্তিগত জগতে ঢুকতে চায় নি I মুনির এখানে এসেছিল ওর কষ্ট কমাতে ও সমস্যা আরো বাড়িয়ে তুলতে না I
কি বল
আমার আজকে একটা মিটিং আছে I আমার ফিরতে দেরী হবে I
অনিমা কথা শেষ করলো না মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো
তোমার কি জ্বর অনিমা ?
অনিমা চমকে উঠলো I ওর জ্বর এটাতো বোঝার কথা নয়
এই একটু
ওষুধ খেয়েছো?
ওষুধ শেষ হয়ে গেছে Iএকটু পরে বাইরে যাব তখন কিনে নেব
ভেতরে আসো
না ঠিক আছে
তাহলে দাঁড়াও একটু
মুনির ভেতরে চলে গেল I একটু পর পানি আর জ্বরের ওষুধ এনে ওর হাতে দিল
খেয়ে নাও I জ্বর পুষে রাখে লাভ নেই
অনিমা ওষুধ খেলে তারপর আস্তে আস্তে বলল
তুমি কি একটু পারবে ম্যানেজ করতে ? আমি না আসা পর্যন্ত?
মুনির হেসে ফেললো বলল পারবো
আচ্ছা ঠিক আছে থ্যাঙ্ক ইউ I যাই তাহলে ?
অনিমা
বল
তুমি কিছু খেয়েছো সকালে ?
অনিমা আরেক দফা চমকালো I এই প্রশ্নটা ওকে অনেকবছর কেউ করেনি
না এখনো খাইনি
আমার বাসায় কোন খাবার নেই I আমি কি তোমার সঙ্গে একটু খেতে পারি ?
অনিমা হেসে ফেললো I মুনির একদম আগের মতো করে কথা বলছে
আচ্ছা এসো
মুনির অনিমাকে কোন কাজ করতে দিল না I নিজেই ফ্রিজ খুলে ব্রেড বের করে টোস্ট করল I কফি বানালো I তারপর টোস্ট এ জ্যাম মাখিয়ে অনিমাকে দিল I অনিমার মনে পড়ল এর আগেও একবার ওর এইরকম জ্বরের সময় মুনির ওকে খুব যত্ন করে খাইয়ে ছিল I
তোমার প্রোজেক্টের তো আর চার মাস আছে তাই না মুনির ?
হ্যাঁ খুব দ্রুত সময় চলে যাচ্ছে
এরপর তো তুমি চলে যাবে তাই না ?
মনির হাসলো বলল
কেন ? তুই কি আমাকে এর আগেই বিদায় করে দিতে চাও ?
না তা নয় I আমি আসলে ঠিক করেছি বাড়িটা বিক্রি করে ফেলব I সেরকম হলে তোমাকে অন্য কোথাও জায়গা ঠিক করে দেবো I
তুমি এই বাড়ি বিক্রি করে দেবে ? তোমার এত সখের বাগান তোমার লাইব্রেরী এসব ছেড়ে থাকতে পারবে ?
অনিমা ম্লান হাসল বলল
এর চেয়ে আরো কত প্রিয় , কত দামি জিনিস ফেলে এসেছি I এটাতো সামান্য একটা বাড়ি I চাইলে আবার কিনতে পারব I এটা তো মানুষ না যার রিপ্লেসমেন্ট হয়না I
মুনির অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল I অনিমা এসব কি বলছে ? কাকে ফেলে এসেছে ও ? আশিক তো চলে গেছে I ওকে তো ফেলে আসতে হয়নি I মুনির অনিমাকে বুঝতে পারছে না I ও কেমন একটা খোলসের মধ্যে নিজেকে বন্দি করে রেখেছে I মুনির কি পারবে ওর ভালোবাসা দিয়ে ওকে এই খোলস ভেঙে বের করে নিয়ে আসতে ?
পর্ব 9,2
ওরা হাঁটতে হাঁটতে রবীন্দ্র সরোবর এর দিকে চলে গেল I জায়গাটা বেশ ছায়ায় ঘেরা I হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজের কাছে যেয়ে মনির ভুত দেখার মত চমকে উঠলোI ব্রিজের সামনে নিচু রেলিংয়ের ওপর অনিমা বসে আছে I মুনির অবাক হয়ে দেখল অনিমার চোখের নিচে কালি এলোমেলো চুল I ওর বুকের ভেতরটা
মুছড়ে উঠলো I মুনির কাছে গিয়ে জানতে চাইলো
তুমি এখানে কি করছ অনিমা? আরে এ কি অবস্থা হয়েছে তোমার ?
অনিমা ম্লান একটু হাসলো তারপর বলল
জ্বর এসেছিল I এখন একটু ভালো I বাসায় খুব দম বন্ধ হয়ে আসছিল I তাই একটু এলাম I
মনির অনিমার কপালে হাত রাখল I এখনও বেশ গরম
তুমি ওষুধ খেয়েছো ?
অ্যান্টিবায়োটিক শেষ I জ্বরের ওষুধ খাওয়া হয়নি সকালে I বাসায় যেয়ে খাব I
মনিরের প্রচন্ড রাগ হল I ভিজে ভিজে জ্বর বাঁধিয়েছে আবার ওষুধ ও খাবে না ঠিকমত
তুমি এখানে একা এসেছো ?
হ্যাঁ I আর কে আসবে ?
এই শরীর নিয়ে একা আসতে গেলে কেন ? চলো তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি
আমার এখন বাসায় যেতে ইচ্ছা করছে না
হাসিব দূর থেকে ওদের কথোপকথন দেখছিল I একটা মৃদু হাসি খেলে গেল ওর ঠোঁটে I পকেট থেকে ফোনটা বের করে কানে ঠেকালো I তারপর ওখান থেকে হাত উঁচু করে চেঁচিয়ে বলল
আমার একটা জরুরী ফোন আসছে I আমি গেলাম I
অনিমা আর মুনির ফিরে তাকালে হাসিব হাত নেড়ে বিদায় জানালো I
অনিমা বলল তুমিও যেতে পারো
মুনির অনিমার কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল
তুমি সকালে খেয়েছো কিছু?
না
কেন?
খেতে ইচ্ছা করে না I সবকিছু স্বাদহীন লাগে
মনিরের খুব মন খারাপ হয়ে গেল I মেয়েটা জ্বর এ পড়ে আছে অথচ ওকে যত্ন করে খাওয়ানোর ও কেউ নেই I
তোমাকে বাসা থেকে একা বের হতে দিল ?
বাসায় কেউ নেই I বাবা ইন্ডিয়া গেছে বিজনেসের কাজেI I মিঠু খালা অবশ্য বেরোতে নিষেধ করেছিল কিন্তু….
কিন্তু তুমি কথা শোনোনি তাই না ?
অনিমা কিছু বলল না I
আচ্ছা হয়েছে উঠ এখন
কেন?
আমি বললাম এই জন্য
অনিমা খুব অবাক হয়ে গেল I এরকম অধিকার নিয়ে ওকে সাধারণত কেউ কিছু বলে না I
মনির অনিমাকে নিয়ে রিক্সায় উঠল I একটা ফার্মেসির সামনে থেমে পানি আর জ্বরের ওষুধ ও কিনে নিল I অনিমা যদিও ওষুধ খেতে চাইছিল না মনির বলল
ওষুধ খাও তাহলে তোমাকে একটা জিনিস দেবো
কি বল
আগে খাও তারপর বলব
অনিমা ওষুধ খেল তারপর বলল
এবার বল
চলো তোমাকে রিক্সা করে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি
সত্যি? মুহূর্তে অনিমার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেল
রিকশা চলতে শুরু করলে মনিরের মনে হল অনিমার বোধহয় কষ্ট হচ্ছে
অনিমা তোমার কি কষ্ট হচ্ছে রিকশায় যেতে
একেবারেই না I আমার রিক্সা খুব প্রিয়
অনিমার জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে I মনির লক্ষ্য করলো অনিমা ঘামছে I দুপুরের করা রোদে ওর বেশ কষ্ট হচ্ছে I
হুড তুলে দেবো ?
না তোমার সমস্যা হবে থাক
যদিও হুট তুললে রিকশায় বসতে কষ্ট হয় মনিরের ঘাড় নিচু করে রাখতে হয় তারপরেও হুডটা তুলে দিল I মেয়েটার কষ্ট হচ্ছে রোদে I রিক্সা ততক্ষনে ফুলার রোডের কাছাকাছি চলে এসেছে I এ জায়গাটা বেশ ছায়াঘেরা I
গরম লাগছে অনিমা? সোয়েটার খুলে রাখবে?
হ্যাঁ
মুনির রিক্সা ছেড়ে দিল i ওরা নেমে দুজন কালভার্টের উপর বসলো I অনিমা সোয়েটার খুলে ব্যাগে রাখল I ঘামে ভেজা চুলগুলো একপাশে সরিয়ে নিল I
জ্বর নেমেছে ? মনির জানতে চাইল
অনিমা ইচ্ছা করেই বললো জানিনা
মনির কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর নেই I
খিদে পেয়েছে অনিমা?
অনিমা হেসে ফেললো I বলল হ্যাঁ তুমি কি করে বুঝলে?
চলো
কোথায়?
মনির যখন অনিমাকে নিয়ে নিরব হোটেল ঢুকলো তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে I
আমরা এখানে কেন এসেছি মুনির ?
ভাত খেতে
ভাত?
হ্যাঁ I তুমি না ভর্তা পছন্দ করো , এখানে অনেক ধরনের ভর্তা পাওয়া যায় I
শুক্রবার বলে আজ এখানে অনেক ভিড় I ওরা কোনার দিকের একটা টেবিল পেয়ে গেল ভাগ্যক্রমেI
মনির খাবার অর্ডার দিয়ে এসে বসলো I অনিমা বলল
আমার এখন ভাত খেতে একটু ও ইচ্ছা করছে না I ভাতে হাত ই দিতে ইচ্ছা করছে না
সমস্যা নেই তোমার হাত দিতে হবে না আমি খাইয়ে দেবো তোমাকে
কি ? তুই আমাকে খাইয়ে দেবে ?
কেন কি হয়েছে ? আমার ভাই বোনের যখন জ্বর হত তখন আমিই তো খাইয়ে দিতাম
মনির সত্যি সত্যি হাত ধুয়ে এসে প্লেটে ভাত নিল I তারপর ভর্তা দিয়ে মেখে অনিমার মুখে তুলে দিল I অনিমা প্রথমে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল I বিশ্বাস হচ্ছে না এসব সত্যি সত্যি হচ্ছে I মুনির বলল
কি হলো খাও
অনিমা ভাত মুখে নিল
মুনির লক্ষ্য করলো অনিমা মাথা নিচু করে খাচ্ছে Iতারপর দেখল ওর দুই চোখে বেয়ে বড় বড় ফোটায় জল গড়িয়ে পড়ছে I মনির প্লেট টা টেবিলে রাখল তারপর বাম হাত দিয়ে অনিমার চোখটা মুছিয়ে দিয়ে বলল
খাবার সময় কাঁদতে হয় না
অনিমা চোখভর্তি জল নিয়ে হাসলো
মুনির মনে মনে বলল আমি প্রতিদিন তোমাকে এভাবে ভাত খাইয়ে দেবো I আই প্রমিস I আজকে নিজের ভাবনায় মনির নিজে বিস্মিত হলো না I আপন মনে বলল তোমাকে আবার নতুন করে সব সাজাতে হবে I মুনির আহমেদ চৌধুরী তোমার জীবনের লক্ষ্য বদলে গেছে I
চলবে
লেখনীতে
#অনিমা হাসান#
(আজকের পর্বটা অনেক বেশি রোমান্টিক আর ইমোশনালI সবাই খুব সুন্দর কমেন্ট করবে প্লিজ I আমি যখন পাঠক হিসেবে একটা লেখা পড়ে যেতাম কখনো বা লাইকও না দিয়ে চলে যেতাম তখন বুঝতে পারিনি একটা সুন্দর কমেন্ট লেখককে কতটা উৎসাহিত করতে পারে I সবাই সঙ্গে থাকবেন I)