#জানালার_ওপারে
||১২তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
অত্যন্ত ভার ভার লাগছে আজকের দিনটা। নিসা যাওয়ার পর থেকে দরজা বন্ধ করে বসে আছি ঘরে। আর ভাবতে পারছি না। দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে ঘর থেকে বের হলাম।
ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন রাসেল সাহেব ল্যাপটপ নিয়ে। গভীর মনযোগ তার স্ক্রিনটার দিকে। কাজ করছেন হয়তো। ভাবলাম, কফি হলে মন্দ হয় না।
কফি নিয়ে এসে তার পিছনে দাঁড়ালে স্ক্রিনে দেখতে পাই এক মেয়ে অবিকল কোনো পৌরাণিক দেবীর কষ্টিপাথরের মূর্তি যেন। ছবিতে থাকা অঙ্গভঙ্গিমাও মূর্তির মতোন। কালো কাতান মারাঠিদের মতো পরা, চোখে ঘন কাজল, গা ভর্তি স্বর্ণালংকার, চুলগুলো হাত খোপা করা। ক্লাসিকাল নাচের ‘শান্তাম’ পোজে ছবিটি তোলা।
“গার্লফ্রেন্ড না কি অব্যক্ত প্রেয়সী রাসেল সাহেব? না কি বৈরীপ্রিয়া আপনার যে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছেন?” ঠাট্টার ছলে টেক্সট করলাম তার ফোনে।
রাসেল সাহেব টেক্সটটা পড়ে আলতো হেসে ল্যাপটপটা বন্ধ করতে করতে উত্তর দিলেন,
“স্ত্রী সে আমার। অব্যক্ত প্রেয়সী এককালে ছিল, এখন নেই।”
একটু চমকিত বোধ করলাম। এতোদিন ধরে এখানে আছি রাসেল সাহেবের স্ত্রী সম্পর্কিত কোনো কথা শুনিনি। অবশ্য মানুষটা স্বল্পভাষী, কিন্তু মিষ্টিভাষী ও হাসি-খুশি ধরনের। পুনরায় টেক্সট দিলাম,
“আপনি ম্যারিড? কখনও বলেননি তো? আর ভাবী কোথায়? বাপের বাড়ি গিয়েছেন?”
“না, একবারে চলে গিয়েছে লন্ডন। মেয়ে আরিশাও তার কাছেই।”
“আ’ম সরি। আপনাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে আমি বুঝতে পারিনি।”
“ডিভোর্স? আমাদের কোনো ডিভোর্স হয়নি। শুধু এক দৃশ্যমান স্থানের ও অদৃশ্যমান মনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে সম্পর্কে।”
“আপনার কথা অনেক ধাঁধাময়! কটু খোলাসা করে বলুন।”
“আমি যখন ঢাকা ম্যাডেকেলে তৃতীয় বছরের ছাত্র তখন একটা অনলাইন ইভেন্টের মাধ্যমে আয়রার সাথে পরিচয়। সে তখন ঢাবিতে ফোর্থ ইয়ারের ছাত্রী। ছয় মাসের পরিচয়ের পর বিয়ে, অনেকটা ঝোঁকের বশেই আমাদের বিয়ে। আয়রার বাবা-মা দুজনেই ইউকে প্রবাসী। তাদের কিছু জানায় না সে। আপু আমার হুটহাট এমন সিদ্ধান্ত ও কাজে চমকে ঠিকই গিয়েছিল। যদিও সমাদরে গ্রহণ করেছে আমাদের সম্পর্ক।
বিয়ের ছয়মাস গড়াতেই এক্সিডেন্টালি প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ে আয়রা। এবর্শন করানোর পক্ষে আমরা কখনওই ছিলাম না। আর আয়রার খরচ সে নিজেই সামলাতো, আমাদেরটা আমি এবং আপু মিলে। তাই ফাইনানশিয়াল কোনো প্রবলেমও ছিল না। এবার আয়রা তার মা-বাবাকেও জানালো। বাচ্চাটা গর্ভে আসার তিনমাস পর তার বাবার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। ইউকে যাওয়ার কথা বললে আমি না করে দেই। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের মতো আগলে রাখা, বিয়ে অবধি না করা বোনটাকে একা ছাড়তে আমি পারবো না।
রাহা আপু চক্ষুশূল হয়ে উঠলো আয়রার। রোজ রোজ ঝগড়া করতো। আপু আমাকে তার কথা শুনতে বলতো। অবশেষে একদিন সে জানায় সে চলে যাবে একবারের জন্য। এবার হয় সে আর বাবু, না হয় বোন। আমি একটুও রাগ দেখাইনি। বরং শান্ত কণ্ঠ বলেছিলাম, ‘তুমি মেয়ে হওয়ার দায়িত্ব পালন করো, আমি আমার ভাই হওয়ার দায়িত্ব পালন করি। আমার কোনো অভিযোগ নেই। তুমি তালাক দিলেও থাকবে না।’ এই যা। একদম যে যোগাযোগ নেই তা নয়। ফ্রেন্ডলিস্টে আছি, মাঝেমধ্যে বন্ধুসুলভ কথা হয় রাত জেগে। তবে মেয়েকে রোজ দেখি ভিডিওকলে। সেই সুযোগে মেয়ের মাকেও…।”
বুকটা আরও ভারী হলো আমার।
“আপনি আজও তার আশা রাখেন? সে মুভ অন করেনি? এখন তো শুধু ডিভোর্সই বাকি, সুতো তো সব ছিঁড়েই গিয়েছে।”
“বললে না কেন বলি না তার নাম কখনও? আপু অনেক অপরাধবোধে ভুগে এসব মনে পড়লেও। আমি সবসময় হাসি টেনে রাখি মুখে, যাতে আপুর না মনে হয় আমি তার জন্য অসুখী।
আর কখনও কখনও আশার এক সুতোতেও কারো পৃথিবী বাঁচে। আমি আজও প্রহর গুনী তার অপেক্ষায়। একদিন নিশ্চয়ই আবারও আমার আকাশে চাঁদের দেখা দিবে। আমি জানি সেও আমায় ছাড়তে পারবে না। আজও পারেনি। আমিও পারিনি। সে নেই তো কী হয়েছে?
আমি ঘুম থেকে উঠে, ঘুমাতে যাওয়ার সময় আজও তার ছবি দেখি। আমার প্রতিটি শার্ট আমার নয় তার পছন্দের রংয়ের, আমার রুমটার সাজও তার রুচি মোতাবেক। সে আজও আমার কথা রাখতে রোজ রোজ অপছন্দের শাড়ি পরে, হিজাবে ফুলের ব্রুচ পরে। আমরা একসাথে না থেকেও একে অপরের সাথে আছি।
জানো, খুব কম মানুষ এতোটা সৌভাগ্যবান হয় যে ভালোবাসার সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ পায়? তবে তারাই সবচেয়ে দুর্ভাগ্যবান হয় যখন পেয়েও সুযোগ হাতছাড়া করে।”
অলক্ষ্যেই এক ফোঁটা জল গড়িয়ে কফিতে মিশে গেল। আমিও কি ঐ সর্বোচ্চ দুর্ভাগ্যবান হতে যাচ্ছি নিজ দোষে? না, আমার সব জানতেই হবে।
“রাসেল সাহেব একটা হেল্প করবেন? আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পারবেন?”
রাসেল সাহেব আলতো হেসে মাথা দুলায়।
—
নিসাদের বাসার কলিংবেল বাজালে আন্টি এসে দরজা খুলল। আমাকে দেখে অবাক হয়েছ, তা মুখভঙ্গিতেই স্পষ্ট।
“সামু, তুমি? আমাকে তো ভুলেই বসেছো। আসো, ঘরে আসো। তোমার বান্ধুবী তার রুমেই আছে।”
আমি আলতো হেসে নিসার রুমে যেয়ে বসলাম। নিসা রুমে নেই। তবে বাথরুম থেকে গুনগুন আওয়াজ আসছে। বাথরুম থেকে বের হয়ে আমাকে দেখে বাক্যহারা আমার প্রিয় বান্ধুবী।
“সামু তুই এখানে?”
আমি মোবাইলে টাইপ করলাম,
“আমার আগামীকাল অপেক্ষা করার মতো সবুর নেই। আমাকে এখনই বল যা বলতে চাস, বলতে এসেছিলি। আর বাড়ি আমি সব শুনেই যাব, তাই তা বলিস না।”
মুচকি হাসলো সে। কুমড়োর মতো ধপ করে পাশে বসলো।
“পুরো ঘটনা বলতে গেলে অনেক কিছুই বলতে হয় সামু। তাই অতি সংক্ষিপ্ত ভাবেই বলছি। আচ্ছা, তুই বল, তোর একবারও কি মনে হয়নি একটা কথা? যে মানুষটা তোর গায়ে সামান্য আঁচড় লাগলেও পাগল হয়ে তোর পিছে ছুটে ,সে এতো বড়ো এক্সিডেন্টের পর একবারও আসেনি কেন তোর সামনে?”
আমার মুখ গম্ভীর হলো। এটা কেমন প্রশ্ন আবার? ভালোবাসা ছিল না তাই আসেনি। কারণ প্রেমিকার বোনের প্রতি লোক দেখানো দায়িত্ববোধ থাকে, ভালোবাসার দায়িত্ববোধ না।
“থাক, তোর কিছু বলতে হবে না। আমিই বলছি। আবেগ ভাই তোর এক্সিডেন্ট দেখে পাগল হয়ে উঠেছিলেন। তিনিই কিন্তু তোকে হাসপাতালে এনেছিলেন। শক্ত, গম্ভীর ছেলেটাও পাগলের মতো কেঁদেছেন। হাসিব এবং আবেগ ভাইয়ের বন্ধুরা তাঁর অশ্রুর সাক্ষী। তিনি আর পাঁচ-দশটা ছেলের মতোন বলে-কয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেন না। ঐদিনই কাঁদতে কাঁদতে শপথ নিয়েছিলেন নিজের পরিবার এবং তোর সামনে দাঁড়াবেন না ,যতোদিন না তোর অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারেন।
তুই বিপদমুক্ত শুনে বের হয়ে গিয়েছিলেন তোর জন্য ন্যায়বিচার আনতে। বিশ্বাস কর, একটা দিনও বাড়িতে ফিরেননি তিনি, কোর্ট-কাচারি করে করে তার সময় যেতো। কতো রাত যে কোর্টের বেঞ্চে ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। কখনও বা হলে চলে যেতেন শুধু গোসল করে কাপড় বদলাতে। শুধু বিয়ের শপিংয়ের জন্য এসেছিলেন নিজ হাতে তোর জিনিসপত্র কিনতে, তাও জয় অনেকটা নিশ্চিত করে। এরপর পুনরায় যোগাযোগের বাহিরে চলে যান।
জানিস তো, মতি ব্যপারী কতো বড়ো মাপের ব্যবসায়ী! বড়ো বড়ো লোক, মন্ত্রী-মিনিস্টারদের সাথে তার আনাগোনা। এতোটা সহজ ছিল না মতি মিয়াকে ছাড়া পেতে না দেওয়া। তার বেইল আটকানো। কারণ আর্শির বয়ান নেননি। তুই মানা করায় আবেগ ভাই আর্শিকে এসবের মাঝে টানতে চাচ্ছিলেন না।
এখানে তো কেইসের উপর কেইস বছরের পর বছর পড়ে থাকে। এতো ফাস্ট বিচারকার্য করাটা প্রায় অসম্ভব ছিল। তার উপর একটা কেইস চালাতে খরচ যা লাগে তার ধারণা তোরও খাণিম আছে। নিজের স্টুডেন্ট লাইফের এফডি সহ ভেঙ্গে ফেলসেন তোর জন্য।
তবুও সব অসম্ভব হতো, যদি না ভার্সিটির দুজন বড়ো ভাই, যাদের কি না এজজন বড়ো কর্মকর্তা ও আরেকজন হাইকোর্টের লইয়ার, তারা না সাপোর্ট করতেন। আর তাদের সাপোর্টটাও এমনি এমনি আসেনি। আবেগ ভাইয়ের অনেক রিকুয়েস্টে, পরিশ্রমে তারা হার মেনেছিল। কতোদিন যে তাদের বাড়ির বাহিরে বসে থাকতেন রাত তিনটা-চারটা অবধি!
তবে তিনি তোর রিলিজের পরদিনই বাড়িতে জানিয়ে ছিলেন তোর সাথে বিয়ে ঠিক করতে৷ তুই হয়তো জানিস না, আবেগ ভাই ছোট, তাঁর বড়ো বোন আছে। নানার বাড়িতে স্কুল লাইফ পাড় করায় বাবা-মায়ের সাথে অতো ফ্রী না। এমন একটা ছেলে নিশ্চয়ই তার বাবা-মাকে কল করে বলবে না আমি একজনকে ভালোবাসি, বিয়ে করবো তাকে। বড়ো বোন বা ভাই বা অন্যকাউকে দিয়ে বলাবে এটাই স্বাভাবিক।
আবেগ ভাইও তাঁর আপুকেই তোর কথা বলে। আপুর তোকে একদম পছন্দ ছিল না। তোর নামে একেক ধরনের কথা চলছিল চারদিকে, আর তুই কথা বলতে পারিস না, আর কোনো অজ্ঞাত কারণে তোর চালচলন, কথবার্তা সহ সবই তার চোখের বালি। তবে হাফসাকে বড্ড পছন্দ করতেন তিনি। তাই মস্তিষ্কে ছক আঁকেন হাফসাকে বউ করে আনার।
তিনি আবেগ ভাইয়ের থেকে শুনেছিলেন, তিনি একবারে বিয়ের দিন কোনো এক কাজ সেড়ে বাড়ি ফিরবেন, এতোদিন যোগাযোগ করতে পারবে না পরিবার বা কোনো আত্মীয়ের সাথে, ফোন সুইচড অফ থাকবে। ভেবেছিলেন বিয়ের দিন মান-সম্মান বাঁচানোর জন্য হলেও বিয়ে করবেন। আঙ্কেল-আন্টিকে তোর জায়গায় হাফসার কথা বলেন। তোর বাসায়ও হাফসার প্রস্তাব আসে।
আবেগ ভাইয়ের সাথে বিয়ে অবধি কারো কোনো যোগাযোগ ছিল না। আর শপিংয়ের দিনও আপু খুব চতুর ভাবে এই বিষয়ে একটু মাত্র আঁচ পেতে দেন না।আর তিনি শপিং শেষেই ফিরে গিয়েছিলেন। তাই জানতেও পারেননি।
আর আকদের কাপড় তোর পছন্দের রংয়ের। আবার শুনলাম আবেগ ভাই তোকে নিয়ে জ্বেলাসও ছিল রাসেল সাহেবের প্রতি। এতো মানুষ থাকতে হাফসা আন্টিকে বলে জোর করিয়ে তোকে নিল শপিংয়ে। তাও তুই বুঝিসনি? তুই যে তাঁকে শাস্তি দিচ্ছিস। এখন বল তাঁর দোষটা কোথায়?”
“কিন্তু আমাকে হাফসা যা যা বলল…” ম্যাসেজ পাঠালাম।
“ঐটা তুই ওর থেকেই জেনে নিস। তবে মনে হয় না ও যা বলছে তা সত্য। মেয়েটাকে আমার আগে থেকেই পছন্দ নয়। তোর জিনিসপত্র কেমন নষ্ট করে ফেলতো। আমি তো ওর চোখে হিংসাই দেখতাম, তুই বলতি ভুল করে। তাছাড়া পর কোনো দিন আপন হয় না, সেখানে কোন দুঃসম্পর্কের কাজিন বোন সে তোর।”
আমি নিসার উচ্চারিত প্রতিটি বাক্যে বাক্যে চমকে উঠছি। এও সম্ভব! কেমন যেন নাটকীয় সবকিছু!
অতি বিস্ময়ে যখন হা হয়ে বসে তখন আমাকে আরও বিস্ময় বাড়িয়ে নিসা বলে উঠে,
“আর হ্যাঁ, আবেগ ভাই কিন্তু এখন তোর আইনত স্বামী। ঐদিন হাসপাতালের ডিসচার্জ পেপারের সাথে রিসিপশনিস্ট আর ওয়ার্ড বয়কে টাকা দিয়ে তোর সাইন কাবিননামাতেও নিয়েছিল।
না হলে এদেশে ডিসচার্জ পেপারে কোন হাসপাতাল রোগীর সাইন নেয়, পরিবার থাকতে? এই বিষয়টা সে ছাড়া কেউ জানতো না, অবশ্যই তোর চিঠি পাঠানোর আগ অবধি।”
চলবে…
দুঃখিত লেট হওয়ায়। গতকাল রাতে একটু সিক হয়ে পড়েছিলাম। কোচিংয়েও যেতে পারিনি আজ তাই।