#ভালবেসে_অবশেষেপর্ব: ১৪
#নুশরাত_জেরিন
আজ সিয়ামরা বাড়ি ফিরে যাবে। ব্যাগ গোছানো হয়েছে আরও সকালে। ভোরে আতাউর রহমানের সাথে নামাজ শেষে সিয়াম হাটতে বের হয়েছিলো।পথিমধ্যে কয়েকজন মহিলার কানাঘুষা শোনার পর থেকে তার মেজাজ গরম হয়ে আছে। তারা মুলত মিলিকে নিয়েই কথা বলছিলো। অন্য কারো ব্যপারে এত টানা হেঁচড়ার কী আছে কে জানে! সিয়াম মিলিকে ভালবাসে কী বাসে না, অথবা বোনের ভাসুর হোক দেবর এতে পাড়াপ্রতিবেশির কী এসে যায়? তাছাড়া সকাল থেকে মিলিরও কোনো হদিস নেই, মাঝেমধ্যে মেয়েটা লুকোচুরি খেলা শুরু করে। সামনেই আসতে চায় না।
সিয়াম বিছানায় বসে পাশের টি টেবিল থেকে চায়ের কাপ হাতে নিলো। চা দিয়ে গেছে এ বাড়ির কাজের মেয়েটা। দরজায় নক দেবার আগেই সিয়াম বুঝেছিলো মেয়েটা এসেছে। দুলাভাই বলার সাথে সাথে এমনভাবে হেসে কুটিকুটি হয়! সিয়াম ভেবে পায় না, দুলাভাই ডাকের ভেতর হাসির কী আছে।
চায়ে চুমুক দিতে মন মেজাজ আরও একধাপ খারাপ হয়ে গেলো। চিনির পরিমাণ বেশি হয়েছে, সিয়াম চায়ে চিনি একেবারেই কম নেয়।
এতদিন ঠিক থাকলেও আজ বেঠিক হবার কারণ কী! শশুড়বাড়ি না হলে নির্ঘাত সিয়াম আজ হুলুস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে ফেলতো, তবে শশুড়বাড়ি এসব করার উপায় নেই।
চায়ের কাপ পাশে রেখে ফোন হাতে নিতেই মিলি এসে ঢুকলো। কোনো কাজে এসেছে বোধহয়। ঘরে ঢুকেই আলমারী খুলে কোনো কিছুর সন্ধান চালাতে লাগলো।
সিয়াম উঠে দাড়িয়ে মিলির পিছে দাড়ালো। তার নিশ্বাস মিলির ঘাড়ে পরতেই সে লাফিয়ে উঠলো। বলল,
“পাগল নাকী আপনি? এভাবে ভূতের মতো পিছে দাড়িয়েছেন কেনো?”
“ঘাড় মটকাবো বলে।”
সিয়ামের নির্লিপ্ত জবাব শুনে মিলি চোখ তুলে তাকালো।
“মানে কী?”
“বুঝতে পারছো না?”
মিলি মাথা নাড়লো।
সিয়াম তার বাহু চেপে আরেকটু কাছে টেনে আনলো।
“ইগনোর কেনো করছো আমায়?”
মিলির মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে আবার বলল,
“আমার সামনে এলে তোমার বিরক্ত লাগে? আমি কী বিরক্ত করি তোমায়? কোনো ব্যবহারে খারাপ লেগেছে?”
এবারের কন্ঠে তার মলিনতা। মিলির চোখে তখন বিস্ময়। বলে কী এই লোক।
বলল,
“যা বোঝার দরকার সেটা না বুঝে উল্টো কেনো বোঝেন?”
“বুঝিয়ে বলো।”
মিলি মিনমিন করে বলল,
“আমি লজ্জায় আপনার সামনে আসছি না, আর আপনি কীনা….”
সিয়াম থামালো।
“মানে কী? লজ্জা কেনো পাবা?”
“সেটাও বলে দিতে হবে?”
সিয়াম মিনিট খানেক ভাবলো। একবার মিলির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার গাল দুটো লাল আকার ধারণ করেছে। কেনো? কাল রাতের জন্য? হুট করে সিয়াম হু হা করে হেসে উঠলো।
বলল,
“আশ্চর্য! লজ্জা ভেঙে দেবার পরও লজ্জা অবশিষ্ট আছে?”
মিলি ততক্ষণে আরও মিইয়ে পড়েছে৷ আকস্মিক প্রাণ পুরুষটির বক্ষস্থলে মুখ লুকিয়ে বিরবির করলো,
“অসভ্য।”
….
মিলিরা চলে যাবার ঘন্টাখানেক আগে থেকে আতাউর রহমানের বুক ব্যথা শুরু হলো। বিয়ের পরে মিলিকে বিদায় দেবার সময়ও ঠিক একই ব্যথা অনুভব হয়েছিলো। মেয়ের শূন্যতার ব্যথা হয়তো। আবার কবে দেখা হবে কে জানে! এ’কটা দিনে আবার সেই পুরনো অভ্যাসগুলো ফিরে এসেছিল। সকাল বিকেল মিলির হাতের চা। মিষ্টি খাবার চেষ্টা করলে মেয়েটা কেমন মায়ের মত শাসন করে! মুখ ফুলিয়ে কন্ঠে রাগ ফুটিয়ে বলে,
“তোমার না ডায়াবেটিস বাবা? মিষ্টি খাচ্ছো কেনো?”
আতাউর রহমানের চোখ ভরে এলো। এ ব্যথা মেয়ের বাবা বিনে কেউ বোঝে না হয়তো। ছোটবেলা থেকে আদর যত্নে গড়ে তোলা ছোট্ট পুতুলটাকে অন্য কারো হাতে তুলে দেওয়ার কী যে যন্ত্রণা। মিলি ঘরে এলো।
আতাউর রহমান চটজলদি চোখ মুছলেন,
“এসেছিস বুড়িমা?”
মিলি বলল,
“তুমি একা একা এসময় ঘরে বসে আছো কেনো? শরীর খারাপ? ”
“নারে তেমন কিছুই না, তোরা রওনা হবি কখন?”
“একটু পরে।”
মিলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বাবাকে পর্যবেক্ষন করে বলল,
“তোমার মন খারাপ বাবা?”
আতাউর রহমান মৃদু হেসে বললেন,
“আমার কলিজাটা বুক পিন্ঞ্জরা ছেড়ে চলে যাচ্ছে, একটু মন খারাপ হবে না?”
মিলি এগিয়ে এসে বাবার বুকে মাথা রাখলো। তার নিজেরও মনটা খুব খারাপ। এ বাড়ি ছেড়ে যেতেই ইচ্ছে করছে না। মেয়েদের জীবনের এ নিয়মটা কেনো তৈরি করা হলো কে জানে!
আতাউর রহমান বললেন,
“এখনও আমার উপর রেগে আছিস বুড়িমা?”
মিলি মাথা তুললো,
“কেনো বলো তো?”
“তোর মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়েছিলাম বলে।”
মিলির মুখে হাসি ফুটলো।
“তোমার মনে আছে বাবা, ছোটবেলায় আমি, মা আর আপা যখন নানুবাড়ি বেড়াতে গেলাম? তখন আমি প্রাইমারীতে পড়ি বোধহয়।
তোমার সবে চাকরীতে প্রমোশন হলো, ছুটি পেলে না। তোমাকে ফেলে আমরাই বেড়াতে গেলাম। ওখানে যাওয়ার একদিন কী দু’দিন পরেই আমার এলো জ্বর। সামান্য জ্বর।
তুমি খবরটা পাওয়া মাত্রই কেমন ছুটে চলে এলে, মনে পড়ে বাবা? অফিসের বস ছুটি দিতে না চাওয়ায় তুমি বলেছিলে, চাকরী তোমার দরকার নেই, আত্মার কিছু হয়ে গেলে বাঁচাই যেখানে দায় সেখানে চাকরী দিয়ে কী হবে?”
আতাউর রহমান হাসলেন,
“তোর মনে আছে সে কথা?”
মিলিও প্রতুত্তরে হাসলো। বলল,
“তখন আমার মনে হতো তুমি ছাড়া এমন পাগলের মতো আমায় কেউ ভালবাসতে পারবে না, অথচ দেখো এখন কিন্তু আমার ভাবনাকে ভুল প্রমানীত করে তোমার প্রতিপক্ষ চলে এলো।”
আতাউর রহমান এবার শব্দ করে হাসলেন। বললেন,
“এজন্য বুঝি বাবার উপর রাগ পড়ে গেলো?”
“উহু, তোমার উপর আমি কখনও রেগে থাকতে পারি না বাবা, চেষ্টা করলেও পারবো না।”
….
বাড়ি ফেরার পর বিকেল বেলা রেনু বেগম এবং নীরা একসাথে মিলিকে দু’পাশ থেকে দুজনে জড়িয়ে ধরলো। মিলির দম বন্ধ হবার অবস্থা।
সে দ্রুত হাত ছাড়িয়ে বলল,
“আমায় খুন কেনো করতে চাইছো তোমরা? আমি কী করেছি?”
সোরভ বলল,
“কী করেছো জানো না? আমার সাধা সিধে সহজ সরল ভাইটাকে পাগলাটে বানিয়ে ফেলেছো।”
মিলি হেসে উঠলো,
“সহজ সরল, সাধাসিধা ভাই?
” তা নয়তো কী?”
“তবে তো তাকে আগের মতো অফিসের সবার প্রতি কঠোর হতে বলতে হয়, যেহেতু আগে সহজ সরল ছিলো।”
নীরা বলল,
“আরামের ঘুম হারাম হবে তাহলে, আলসেমি ও দুর হবে। কাজ কমে যাওয়ায় আমার আর মাকে জ্বালিয়ে মারছে বুঝলি!”
নীরা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা শুনে সৌরভ নিজেও হাসলো। তার পরিবারটাকে কেমন পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। চারিদিকে মন ভালো করা বাতাস। ভাইটা তার যেখানে ঠিকমতো কথাও বলতো না সে আজ সৌরভকে জড়িয়ে ধরে কথা বলেছে, হেসেছে, গল্প করতে করতে খাবার খেয়েছে। এর থেকে খুশির খবর আর কী হয়! নীরারও তিনমাস চলছে, যেখানে আশাই ছেড়ে দিয়েছিলো।
সে বারবার বলল, “এ সুখে কারো যেনো নজর না লেগে যায়।”
রেনু বেগম মিলির হাত চেপে কেঁদে উঠলেন। নীরা সামলালো,
“আহ মা, কাঁদবেন না।”
রেনু বেগম বললেন,
“তোর কাছে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো রে মা।”
মিলি বলল,
“মায়ের কাছে নাকি মেয়েরা কৃতজ্ঞ থাকে শুনেছিলাম, এখন দেখছি পুরো উল্টো হচ্ছে। ব্যপারটা কেমন লাগছে না?”
রেনু বেগম কান্নার মাঝেই হেসে ফেললেন। সিয়াম দুরে দাড়িয়ে তার হাস্যজ্বল পরিবারটার দিকে তাকালো। এতদিন সে নিজের সাথে সাথে পরিবারের প্রত্যেকের হাসি গুলোকেও মলিন করে ফেলেছিল, অনিচ্ছায় করলেও করেছিল তো! সে বিরবির করলো,
“আর কখনও এই হাসি গুলোকে মলিন হতে দেবো না, কোনোদিন ও না।”
,
চলবে….