#ভালবেসে_অবশেষেপর্ব:৮
#নুশরাত_জেরিন
সিয়ামের ইদানীং ব্যস্ততা বেড়েছে। সেই যে সাত সকালে অফিসে ছোটে আর ফেরে সেই রাত করে। অফিস থেকে ফিরে এত ক্লান্ত থাকে যে দু’গাল খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। মিলির সাথে খুব একটা কথাবার্তা হয় না, মাঝে মাঝে দু’একটা হু হা চলে। আজ সিয়ামের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হতেই সে বাড়ির পথে ছুটলো। তবুও বেশ রাত হয়ে গেলো। ডিনার শেষে সবে ল্যাপটপ খুলেছে তখনই মিলির কথা মনে পড়লো। এইতো দু’দিন আগে মেয়েটা কেমন আবদারের সুরে মুভি দেখার কথা বলেছিলো, সিয়ামের সময় না থাকায় সে সাথে সাথে নাকচ করে দিয়েছিলো। মেয়েটার মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেলেও পুনরায় আর একটা বাক্য উচ্চারণ করেনি।
সিয়াম ল্যাপটপ বন্ধ করে রুম ছেড়ে বের হলো। মিলি এখনও রুমে আসেনি, এত রাতে বাইরে কী করছে কে জানে! মা আর নীরাও তো এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে।
সে ডাইনিং রুমের সামনে গিয়ে ডাকলো,
“মিলি?”
মিলি টেবিলের সব খাবার গুছিয়ে ফ্রিজে তুলছিলো। মায়ের শরীরটা আজ খারাপ, কাজের মেয়েটাও ছুটিতে আছে, তার ছোট ভাইটা অসুস্থ।
সব কাজ মিলিকেই করতে হচ্ছে। নীরাকে মিলি ইচ্ছে করেই এদিকটায় আসতে দেয়নি। সে কন্সিভ করেছে শোনার পর থেকে তাকে কেউ কোনো কাজে হাত লাগাতে দিচ্ছে না। এত সাধণার ফল! ডাক্তারের পেছনে কম দৌড়াদৌড়ি তো করেনি! নীরা মাঝে আশাই ছেড়ে দিয়েছিলো, শুধু আশা ছাড়েনি সৌরভ। সে নীরাকে কতটা যে সাপোর্ট দিতো, মিলি তো দেখেছে সব।
আতাউর রহমান আর মিলির মা ও এসেছিলেন নীরার খবরটা শোনার পর। খুশি হয়েছিলেন বৈ কি। মিলিকে ভালবাসে বলে নীরাকে কম ভালবাসে না। দু’টো মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আতাউর রহমান আধা ঘন্টা প্রায় চুপ করেই ছিলেন। সিয়াম এসে বিনম্র শ্রদ্ধায় সালাম জানিয়েছিল, টুকটাক আলাপ করেছিলো। মিলির মা তখনই বুঝেছিলেন, সিয়াম বদলেছে, বদলাচ্ছে।
নয়তো যে ছেলে দেখা হলে সামান্য সালাম টুকু দেয় না সে আজ এত কথা বলে কিভাবে, এ মিলির কেরামতি ছাড়া হতেই পারতো না।
আতাউর রহমান নিজেও যে খুশি হয়েছিলেন সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা গিয়েছিলো। এক ফাকে মিলিকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন,
“তুই ভালো আছিস তো বুড়িমা?”
মিলি তখন মিষ্টি হেসে বলেছিলো,
“ভালো থাকার ব্যবস্থাটা আমার বাবা নিজের হাতে করেছে, সেখানে আমি ভালো না থেকে পারি?”
পুরণো কথা ভাবার মাঝে সিয়াম এসে উপস্থিত হলো,
“ডাকছি যে উত্তর দাও না কেনো?”
“খেয়াল করিনি।
একটু থেমে আবার বলল,
“কেনো ডাকছিলেন?”
“রুমে চলো!”
“কেনো?”
“দরকার আছে।”
“কিসের দরকার?”
সিয়ামের চোখে তখন দুষ্টমি খেলছে,
“কেনো দরকার থাকতে পারে না? আফটার অল আমরা হাজবেন্ড ওয়াইফ।”
মিলি অভিমানে যেনো নুইয়ে পড়লো৷ এতক্ষণ শক্ত হয়ে কথা বললেও এবার অভিমানী গলা শোনা গেলো,
“আমি আপনার ওয়াইফ একথা মনে থাকে আপনার? মনে পড়ে কখনও? এতটুকু কথাও তো বলেন না। সারাক্ষণ কী কাজ কাজ আর কাজ!”
“রাগ করেছো নাকি?”
“না, যে রাগ বোঝে না তার উপর রাগ করা যায়?”
সিয়াম মৃদু হাসলো। ঠিক সেই মুহূর্তে মিলির রাগ পড়ে গেলো। এত সুন্দর করে কেউ হাসলে সামনের মানুষটা গলে পানি হয়ে যায় না? এটা লোকটার নতুন কৌশল কী না কে জানে!
সিয়াম বলল,
“আসো রাগ দুর করি, আজ সারারাত মুভি দেখি, দেখবা?”
মিলি লাফিয়ে উঠলো,
“সত্যি! আপা আর মাকেও ডেকে আনি? সবাই মিলে দেখি।”
“নীরা অসুস্থ না? মায়েরও তো শরীর খারাপ? তারা আসবে?”
“বলে দেখতে সমস্যা কোথায়?”
সিয়ামের কথার অপেক্ষা না করেই মিলি ছুট লাগালো। সিয়ামের ঠিক তক্ষুনি মনে হলো মেয়েটা আরিয়ার চেয়ে একটু আলাদা না, পুরোপুরি আলাদা। আরিয়া কখনও তাদের দুজনের মাঝে অন্য কাউকে এলাউ করতো না। মাকে তো না ই। বিয়ের পর মায়ের সাথে কতটা দুরত্ব তৈরি হয়ে গেছিলো তার। দুরত্বটা এখনও যদিও আছে, ঘোচানো আর সম্ভব হয়নি।
…
রেনু বেগম বা নীরা কেউই এলো না। তবে রেনু বেগম খুশি হলেন খুব৷ মিলি তাকে বলতেই তিনি খুশিতে মিলির মাথায় হাত ছোঁয়ালেন। বললেন,
“তুই বলেছিস এতেই আমি খুশি হয়েছি মা।”
তবুও মিলি কী নাছোড়বান্দা! অতঃপর যেমন তেমন বুঝ দিয়ে তাকে ঘরে পাঠানো হলো। ঠিক করা হলো দিনের বেলা তিনি মিলির সাথে অবশ্যই মুভি দেখবেন।
…
কাথা টেনে শুধু মুখটা কোনোমতে বাইরে রেখেছে মিলি। তারা দেখছে হরর মুভি। সিয়াম নিষেধ করেছিলো একবার, মিলি শোনেনি।
অথচ এখন রীতিমতো ভয়ে কাঁপছে। সিয়ামের একহাত খামচে দফারফা করে ফেলছে।
সিয়াম হাতের দিকে লক্ষ্য করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অলরেডি ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। হাতটা ছড়ানোর চেষ্টা করেও বিশেষ লাভ হয়নি। মিলি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে।
সে একটু বিরক্ত হয়েই বলল,
“এত যখন ভয় পাচ্ছো তখন মুভিটা বদলে দেই? অন্যকিছু দেখি নাহয়।”
মিলি সাথে সাথে প্রতিবাদ করলো।
“এই না না, একদম না, আমার হরর মুভি ই পছন্দ। ”
“ভয় পাচ্ছো যে!”
“ভুতের মুভি দেখে তো ভয় পাওয়ার জন্যই নাকি, ভয় না পেলে মজা পাওয়া যায়?”
“আচ্ছা? মুভি দেখার পর রাতে ঘুম হবে তো? শুনলাম যেদিন রাতে এসব দেখো সেদিন নাকি ঘুমোতেই পারো না? ওয়াশরুমে গেলেও দরজার সামনে কাউকে দাড় করিয়ে রাখো!”
সিয়ামের রসিকতা মাখা কথাগুলো শুনে মিলি মাথা তুলে তাকালো।
“আপনি কী করে জানলেন?”
“সেদিন নীরা বলছিলো সৌরভকে, যাওয়ার পথে শুনলাম!”
কিছুটা দুষ্টমি করে আবার বলল,
“আমি কিন্তু মুভি দেখার পরেই ঘুমিয়ে পরবো, আমাকে রাতে একদম জ্বালাতে পারবে না। ভয় পেলেও না।”
“কেনো? কেনো পারবো না? বন্ধুকে জ্বালাবো না তো কাকে জ্বালাবো?”
সিয়াম কিছুটা অবাক হয়েই বলল,
“বন্ধু? ”
“হ্যাঁ, আমরা তো বন্ধু বলেন। একজন বন্ধু ই আরেকজন বন্ধুর সাথে নিজের ব্যক্তিগত কথাগুলোও শেয়ার করতে পারে তাই না? তাছাড়া একজন হাজবেন্ড ওয়াইফের মাঝেও বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকাটা খুব জরুরি।
যাতে একজন আরেকজনকে বুঝতে পারে, তার ইচ্ছার গুরুত্ব দিতে পারে। যদিও এর মাঝে সমঝোতারও দরকার আছে। ধরুন একজনের কোনো একটা জিনিস বা কাজ খুব অপছন্দের কিন্তু ঐ কাজটা অন্য ব্যক্তির পছন্দের। তখন একজনকে তো সমঝোতা করতে হবে তাই না? নিজের অপছন্দের কাজটার বিনিময়ে যদি অপরজনের মুখে হাসি ফোটানো যায় তবে ক্ষতি কী! তবে সমঝোতা সবসময় যদি একজনই করে তবে সম্পর্কে তিক্ততা আসতে পারে। সেক্ষেত্রে দুজনকেই সমান এফোর্ট দিতে হবে!”
“বাহ্, তোমার তো এসবে দেখি বেশ অভিজ্ঞতা আছে। বয়ফ্রেন্ড ক’জন ছিলো বলোতো?”
“থাকলেও বা কী! আপনার তো এসবে কোনো মাথা ব্যথায় নেই।”
“কে বলল?”
মিলি বলল,
“আমিই বুঝেছি, কাউকে বলতে হবে কেনো?”
সিয়াম হাসলো।
“মুভি দেখার সময় এত কথা বলো কেনো? যাতে ভয় না পাও?”
সিয়ামের ফাজলামো বুঝে মিলিও হাসলো। কাঁধে মাথা রেখে ল্যাপটপে দৃষ্টি রাখলো। তবে অন্যজনের দৃষ্টি তখনও তারউপরই ঘুরছিলো।
,
,
চলবে….