#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___১৯
মন্থরগতিতে পা ফেলে মায়ের রুমে ঢুকল চৈত্রিকা। ক্ষীণ শব্দ কর্ণধারে পৌঁছাতেই ফাহমিদা চোখ তুলে তাকালেন। চৈত্রিকার রোগা,ফ্যাকাসে চেহারাটা অবলোকন করে তৎক্ষনাৎ মনে ব্যাথাতুর যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ে। সুস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কয়েক পল চেয়ে থাকলেন মেয়ের রক্তশূণ্য মুখশ্রী পানে। তিনি জানেন, আহমেদ সাহেবের চিরতরে চলে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছে চৈত্রিকা। মা হয়ে শত আদরে মেয়েকে ভরিয়ে দিলেও বাবার আদর তো তিনি দিতে পারবেন না। চৈত্রিকার জীবনের এই অভাবটুকু পূর্ণ করার সাধ্য যে কারো নেই। হয়ত তাহাফের মাধ্যমে চৈত্রিকার বিষাক্ত জীবনে সুখ আসবে। তা ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। চৈত্রিকা মায়ের দিকে চেয়ে আনতস্বরে বলে উঠল,
” ডেকেছিলে আম্মু?”
ফাহমিদা এগিয়ে এসে চৈত্রিকার মাথায় হাত রাখলেন। বিয়ের বিষয় নিয়ে বলতে গিয়ে বললেন না। সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। এবং তা স্থান,কাল বুঝে বলা উচিত। এই বিষয়টা দমিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে উঠলেন,
” আমরা কিন্তু একটু পর বেরিয়ে যাবো। ট্রেনের টিকিট তো কাটা হলো না। ”
চৈত্রিকা একটু ইতস্তত বোধ করে বললো,
” সাফারাতের গাড়ি করে যাবো আমরা। ”
ফাহমিদা চমৎকৃত নয়নে চেয়ে রইলেন চৈত্রিকার দিকে নির্নিমেষ। মস্তিষ্কে পুরোনো একটা কথা হানা দিতেই বলে উঠলেন,
” সাফারাতই কি সেই ছেলেটা যার কথা তুই কলেজে থাকতে বলেছিলি?”
” হুম আম্মু। ”
ফাহমিদা বেশ অবাক হলেন। চৈত্রিকা মায়ের সাথে প্রায় অনেক কথা শেয়ার করে ছোট থেকেই। তেমনি কলেজ জীবনে সাফারাতের সাথে বন্ধুত্বের বিষয়টা শেয়ার করে। চৈত্রিকা সর্বদা মায়ের নিকট সাফারাতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকত। সাফারাত কে ফাহমিদা দিহানের প্রস্তাব নিয়ে আসার আগে কখনো দেখেন নি। ফাহমিদা একটু চুপ থেকে বললেন,
” ঠিক আছে রেডি হয়ে নে। ”
চৈত্রিকা মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে মিম কে বলল রেডি হয়ে নিতে। নিজে রেডি হয়ে ছোট্ট বাটন ফোনটা বের করে জানালার কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। সাফারাতের নাম্বারে ডায়াল করতেই রিসিভ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ওপাশ থেকে ভেসে এলো মোহনীয় কন্ঠস্বর। শ্রবণগ্রন্থিতে মাদকতাময় গাম্ভীর্য সেই স্বর প্রবেশ করতেই চৈত্রিকার বুকে তোলপাড় করা মিহি সুরের ঘন্টা বেজে উঠল। যা বলতে ফোন দিয়েছিল তা গুলিয়ে ফেলছে। আজকাল সাফারাতের সান্নিধ্য,সন্নিকটে, কন্ঠস্বর চৈত্রিকাকে গভীর নেশায় ডুবিয়ে দেয়। এই এক সপ্তাহ সাফারাত নিজের কথা ভুলে দিন-রাত যেভাবে পাশে থেকেছে তাতে সাফারাতের প্রতি চৈত্রিকার সম্মান, ভালোবাসা বেড়ে গিয়েছে। চৈত্রিকার এখন মনে হয় সে নয়,তার চেয়েও বেশি ভালোবাসে সাফারাত তাকে। কিন্তু! এই ভালোবাসার সূচনা কবে থেকে?চৈত্রিকার কোনো রেসপন্স না পেয়ে সাফারাত গলা খাঁকারি দিয়ে ডেকে উঠল,
” চৈত্র কথা বলবেন না?”
আমতাআমতা করল চৈত্রিকা। ধরা গলায় বললো,
” যাওয়ার আগে বাবার কবরটা আরেকবার দেখে যেতে চাই। নিয়ে যাবেন?”
” রাস্তার ধারে আছি। চলে আসুন। ”
চৈত্রিকা এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে নিল ওড়না সমেত। উঠান পেরিয়ে রাস্তার ধারে এলো। সাফারাত উল্টো ঘুরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক। পড়নে তার একটা কালো পাঞ্জাবি। এই প্রথম তাকে পাঞ্জাবি তে দেখল চৈত্রিকা। হৃদপিণ্ডের নিয়ন্ত্রণ গতিহারা। অস্বাভাবিক হৃদযন্ত্রের স্পন্দন। ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। চৈত্রিকা বুকের দুরুদুরু নিয়ে নিঃশব্দে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়াল। সাথে সাথে সাফারাত দৃষ্টি সরিয়ে এনে পাশে রাখে। চেহারায় মলিনতা। চোখ দুটো ডেবে গেছে চৈত্রিকার। ঠোঁট কামড়ে ধরে সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ফেলে সাফারাত। মৌনতা বজায় রেখে দু’জনে পাশাপাশি হেঁটে কবরস্থানের কাছে এলো। চৈত্রিকা দূর থেকে নতুন কবরটায় তাকিয়ে থাকে। বাবা কতটা নিরবে, শান্তিতে শুয়ে আছে এখানে। চৈত্রিকা পাথরের মতো স্তব্ধ, স্থবির। কয়েক মুহুর্ত কেটে যেতেই নিষ্প্রাণ স্বরে বললো,
” আপনার কি বাবার কথা মনে পড়ে সাফারাত? আপনার বাবা-মা’র ব্যাপারে কিছু বললেন না। ”
প্রশ্নটা কর্ণপাত হওয়া মাত্র সাফারাতের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো। চোয়াল শক্ত। চৈত্রিকা পাশ ফিরে সাফারাতের এহেন রূপে বিস্মিত,হতভম্ব। ঘাবড়ে গিয়ে বললো,
” কি হয়েছে? ”
সাফারাত নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত রাখল। গাম্ভীর্যের সহিত বলে উঠল,
” আমি নিজ থেকে কিছু না বললে কখনও আমার ব্যাপারে কিছু জানার জন্য ফোর্স করবেন না চৈত্র। এটা আমার আদেশ,রাগ যা-ই মনে করেন করতে পারেন। বাট ডোন্ট ফোর্স মি। আই হেট দিস। ”
চৈত্রিকার মুখের ভাব পরিবর্তন হয়ে গেল নিমেষে। বিমূঢ়তায় নির্বাকহারা ও। সাফারাতের রাগান্বিত স্বরে অন্তস্থল কেঁপে উঠেছে। অভিমানে ভার হয়ে এলো মন। তবুও তা চেপে রাখল। দেখাবে না সাফারাত কে। ভালোবাসার মানুষের অতীত সম্পর্কে, বর্তমান অবস্থা জানার অধিকার নিশ্চয়ই আছে। সাফারাত কেন তাকে বঞ্চিত করছে অধিকার থেকে। চৈত্রিকা নিজেকে সংযত করে নেয়। হতে পারে সাফারাত সময় হলে নিজ থেকেই বলবে।
উল্টো ঘুরে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করে দু’জনে। চৈত্রিকা সাফারাতের কাছ থেকে শুনেছিল সাফারাতের দাদি ও চাচাতো বোন এখানে। অত্যন্ত নরম স্বরে জিজ্ঞেস করে,
” আপনার দাদি, বোন চলে গিয়েছে? ”
” হুম। গতকাল। ”
“ওহ্। ”
অতঃপর দু’জনের মাঝে নিরবতা। আকস্মিক হাত ধরে আঁটকে দিল সাফারাত। চৈত্রিকা থমকালো। অবিন্যস্ত,শঙ্কিত দৃষ্টি ফেলল চারপাশে। এইদিকে মানুষের চলাচল খুব বেশি নয়। অধিক প্রয়োজন ব্যতীত এই পথ ধরে হাঁটে না কেউ। চৈত্রিকার দৃষ্টি প্রশ্নসূচক,জিজ্ঞাসু। সাফারাত দূরত্ব ঘুচিয়ে সামান্য ঘনিষ্ঠ হলো। মুহুর্তেই হৃদযন্ত্রের স্পন্দন থমকে গেল চৈত্রিকার। কিছু বলবে তার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। বক্ষে রণঢাক বাজছে। ভালোবাসার পরম সুখ এঁকে দিল সাফারাত কপালে। ছুঁয়ে দিল নরম, আর্দ্র ওষ্ঠদ্বয়। চৈত্রিকার নত চিবুকে আঙুল রেখে উপরে উঠিয়ে তাকিয়ে রইল লুব্ধনেত্রে। গভীর স্বরে আওড়ালো,
” খুব শীগ্রই আমরা এক হবো চৈত্র। ”
শরীর কাটা দিয়ে উঠল চৈত্রিকার। দেহের প্রত্যেক ভাঁজে ভাঁজে কম্পন। সাফারাত নিজের মাঝে আগলে নেয় চৈত্রিকাকে। চৈত্রিকা লজ্জা পেল। অনুভব করল নিজের গালদুটোর তাপমাত্রা। কত নিঃসংকোচে নির্লজ্জ একটা বাক্য উচ্চারণ করল সাফারাত! চৈত্রিকা ঠাহর করতে পারছে সাফারাতের সঙ্গ তাকে কাঁপিয়ে মারবে। সিলেটের ছোট্ট একটা গ্রামে দাঁড়িয়ে মাউন্ট এভারেস্টের হিম শীতল হাড় কাঁপানো ঠান্ডার মতো সাফারাতের স্পর্শ কাঁপাচ্ছে তাকে প্রকটভাবে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে জাগিয়ে তুলছে অদ্ভুত এক শিহরণ।
__________________
বৃষ্টিতে ভিজে চৈত্রিকার অবস্থা বেগতিক। দু’দিন আগেই তো জ্বর সাড়ল এখন আবার বৃষ্টিতে ভিজে জুবুথুবু অবস্থা। দ্রুত বেগে সিঁড়ি বেয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। কলিং বেল চেপে অপেক্ষা করছে দরজা খোলার। গতকাল ঢাকা ফিরে এসেছে ওরা। আজ টিউশনিতে যাবার মতোন মন মানসিকতা ছিল না। তবুও যেতে হয়েছে। স্টুডেন্টের এক্সাম। আজ অভিভাবক ফোন দিয়ে বলেছে আজকে পড়াতে না গেলে যেন আর পড়াতে না যায়। অথচ তারা বুঝতে চায় নি সদ্য পিতৃহারা চৈত্রিকার মনের অনুভূতি। কথাটা মনে হতেই চৈত্রিকার ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠে।
মিম দরজা মেলে সামনে তাকিয়ে হতবাক। তড়িঘড়ি করে উচ্চআওয়াজে বলে উঠল,
” এমন কাকভেজা হয়ে ফিরলে কেন আপু?দু’দিন আগেই তো সুস্থ হলে। সাফারাত ভাই জানলে আবার পাগলামো করবে। ”
মিমের শেষ কথাটায় উপহাসের রেশ স্পষ্ট। চোখ রাঙাল চৈত্রিকা। মিম কে ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। পা টিপে টিপে নিজের রুমে এসে মোবাইলটা খুঁজতে লাগল। কোথাও পেল না। টিউশনিতে যাবার সময় ভুলবশত মোবাইলটা বাসায় রেখে চলে গিয়েছিল। এখন দুপুর দু’টো বাজে। নিশ্চয়ই সাফারাত কল দিয়েছে। সকালে বলেছিল দুপুরে কল দিবে। মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে আর কল দেওয়া সম্ভব হবে না। চৈত্রিকা মিমের রুমে ছুটে এলো। বড় বড় শ্বাস ফেলে বললো,
” আমার মোবাইল টা দেখেছিস?”
” হু। টেবিলের উপর। ভাইয়া অনেকবার কল দিয়েছিল। প্রায় ঊনত্রিশ বার। ত্রিশ বার পূর্ণ হতে দেই নি আমি। তার আগেই টুপ করে রিসিভ করে ফেলেছি। ”
মিমের কথা শুনে চৈত্রিকা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। তবে সাফারাত যে আজ তাকে রাগে ভস্ম করে দিবে দিব্যি কল্পনা করতে পারছে। মোবাইলটা হাতে নিতে নিতে শঙ্কাভরা গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে মিমের দিক।
” কি বলেছেন?”
” আমাকে কেমন আছি এটাই জিজ্ঞেস করল। আর,,!”
” আর?”
ভ্রুঁ কুঞ্চিত করে তাকালো চৈত্রিকা। কপালে চিন্তার ভাঁজ। মিম মুখে সিরিয়াস ভাব এনে বললো,
” আর উনি আসছেন আমাদের বাসায়। ”
চৈত্রিকার আঁখিদ্বয়ে আতঙ্ক দেখা দিল মুহুর্তেই। মিমের হাত ঝাঁকিয়ে রাগ প্রকাশ করে মৃদু স্বরে আওড়ালো,
” তুই কি সাফারাতকে সব বলে দিয়েছিস মিমু?”
” হ্যাঁ। ”
চৈত্রিকার হাতের বাঁধন শিথিল হয়ে আসল। ভীত কন্ঠে বলে উঠল,
” কি করলি এটা?আমি তো মা’কে বুঝাতাম। ”
” কখন?কখন বুঝাতে তুমি আপু?একটু পরে তোমার আকদ তাহাফ ভাইয়ার সাথে। আর কখন বুঝাতে তুমি?তাহাফ ভাইয়ার নিকৃষ্ট চেহারাটা পর্যন্ত উন্মোচন করলে না আম্মুর সামনে। উল্টোদিকে আম্মু তোমার সুখ নিয়ে ভাবছে। বাবার মানসম্মান নিয়ে ভাবছে। কেবল আমিই জানি তোমার আসল সুখ সাফারাত ভাইয়ার মধ্যে নিহিত। সাফারাত ভাইয়া পারবে আম্মুকে ম্যানেজ করতে। তোমার মতো লুকিয়ে রাখা সম্ভব না আমার দ্বারা। ”
চৈত্রিকা চিন্তায় পড়ে গেল। আজ সকালেই ফাহমিদা অকস্মাৎ জানিয়েছেন তার ও তাহাফের আকদের কথা। স্তম্ভিত হয়ে পড়ে চৈত্রিকা। স্বামী হারিয়ে ফাহমিদার অবস্থাও শোচনীয় নয়। তার মধ্যে তাহাফের ব্যাপারটা কিভাবে খুলে বলবে,বিয়েতে নাকচ করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। সাফারাতকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েও পারল না জানাতে। মাত্র কয়েকদিনই তো গড়িয়েছে প্রণয়ের। সাফারাতকে বিয়ের কথা বলা বা বিয়ে নামক ভেজাল চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তাই সিদ্ধান্ত নেয় নিজ থেকে সবটুকু সমাধান করার এবং তাহাফকে উচিত শিক্ষা দেবার৷ কিন্তু এখন তো সাফারাত সব জেনে গেল। না জানি তার আগমনে কেমন ঝড়ের সৃষ্টি হবে!
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)