নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই।(পর্ব–১৬)
কলমে– পারমিতা মন্ডল।
মর্গে যেতে হবে বডি সনাক্ত করার জন্য । কিন্তু একা যেতে কিছুতেই ভরসা পাচ্ছে না সুজাতা। এদিকে প্রনীলের কাজের প্রেসার খুব। এই তো ছুটি কাটিয়ে সবেমাত্র জয়েন করেছে। এখনই আর ছুটি নিতে পারবে না। আবার একথা মেসোমোশাইকেও বলা যাচ্ছে না। ওনার বয়স হয়েছে। তাহলে সৌহার্দ্য ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আমি বললে ও নিশ্চয়ই সময় বের করতে পারবে। কিন্তু গিয়ে যদি দেখি ওটা সত্যিই অমৃতা হয় তাহলে ? মেয়েটা তো বাঁচতে চেয়েছিল। নিজের পায়ে সৎ পথে রোজগার করে দাঁড়াতে চেয়েছিল। আমরা কেউ ওকে সাহস দিতে পারলাম না ? শেষ পর্যন্ত ও এই পথ বেছে নিলো ? আর ভাবতে পারেনা সুজাতা।
যদিও অমৃতার মত আমার জীবন নয়। আমার স্বামী আমার সাথে আছে। তবুও অমৃতা আমাদের প্রত্যেকটি মেয়ের হয়ে লড়ছে। এ লড়াই আমাদের সকলের । প্রতিটা ঘরে ঘরে ওর মত লড়াকু মেয়ের জন্ম হোক। ও কখনোই ময়দান ছেড়ে পালাতে পারে না । মর্গে শুয়ে থাকার জন্য অমৃতার মত মেয়েদের জন্ম হয়নি। ও প্রতিটি মেয়েদের প্রতিনিধি। পথ প্রদর্শক। অমৃতা হেরে যেতে পারে না। ক্ষিদ্দা যেমন বলতো ” “ফাইট কোনি ফাইট!” আজ আমিও তেমন বলবো “- ফাইট অমৃতা ফাইট।” উঠে পড় মর্গ থেকে। তোকে এই সমাজে খুব দরকার। মেয়েদের পথ দেখা। তুই তো এতো দূর্বল নয়। এভাবে চলে যেতে পারিস না। ফিরে আয় একবার । বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে সুজাতা।
এদিকে অমৃতাকে না পেয়ে সৌহার্দ্য ফোন করে সুজাতাকে। যে প্রোমোটার অমৃতার টাকা মেরেছিল তার খোঁজ পাওয়া গেছে। হয়তো ধরা যাবে। কিন্তু তার জন্য তো অমৃতাকে প্রয়োজন। কিছু ডকুমেন্ট লাগবে। সেটা তো অমৃতাই একমাত্র দিতে পারবে।
রিং হতেই ফোন ধরে সুজাতা ।”হ্যাঁ সৌহার্দ্য বল। ফোন কেন করেছিস ?
বলছি কেমন ঘুরলি তোরা ? সব ঠিকঠাক ছিল তো ? আসলে তোরা ব্যস্ত ছিলি তাই বলা হয়নি। অমৃতাকে পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে প্রোমোটারকে খুঁজে পাওয়া গেছে। কিছু ডকুমেন্ট দরকার। কিন্তু কি করি বল তো ? তোর কাছে কি ওনার কোন আধার কার্ড বা ভোটার কার্ডের জেরক্স আছে ?
হ্যাঁ, থাকতে পারে । এক সময় ওর সিভি অনেক জায়গায় দিতে হয়েছিল । ওর যে কোন একটা কাজের জন্য। তাই কিছু জেরক্স কপি আমাকে দিয়ে রেখেছিল। ওখানে মনে হয় আছে। সেটা ম্যানেজ হয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমিও এখন তোকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম।
কেন রে , কি হলো আবার ? তোর অফিস নেই আজ ?বলে সৌহার্দ্য।
হ্যাঁ, আছে তো ? শোন পুলিশে সেদিন অমৃতার জন্য যে মিসিং ডাইরি করেছিলাম ,ওখান থেকে ফোন এসেছে। একটা বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া গেছে। মর্গে রয়েছে। আমরা অমৃতার যা বর্ণনা দিয়েছি তার সাথে মিলে গেছে। তাই ওরা ডেকেছে বডি শনাক্ত করতে। তুই একটু আমার সাথে যেতে পারবি ? দেখ না প্রনীল কিছুতেই আজ বেরতে পারবে না। অনেকদিন পর অফিসে গেছে তো ? আমি ম্যনেজ করে বেরিয়ে আসবো। বলে সুজাতা।
হ্যাঁ যাবো কোন অসুবিধা নেই। আমার ওখান থেকে তো কাছেই। তুই বলে দিস কখন আসতে পারবি। কিন্তু অমৃতা কি শেষে এই পথ বেছে নিলো ? আর একটু বিশ্বাস ,ভরসা আমাদের উপর করতে পারলো না ? আমরা তো চেষ্টা করছিলাম ওনার পাশে থাকার। বলে সৌহার্দ্য।
দেখ ও যে মানষিক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল তাতে করে এটা করেও ফেলতে পারে।কিন্তু তবুও আমি বিশ্বাস করি ওটা অমৃতা নয়। কিন্তু আমাদের তো একবার যেতে হবে বল? বলে সুজাতা।
ঠিক আছে আমি যাবো। বলিস তুই কখন যাবি । একটু আগে থেকে বলিস। ম্যানেজ করতে হবে। এখন রাখি। বেরতে হবে।
ঠিক আছে বাই। আগে থেকেই বলবো। রেডি হয়ে থাকিস। ফোন ছেড়ে দেয় সুজাতা।
এদিকে রাতুলের শ্রাদ্ধের সব কাজ মিটে গেছে । এবার বুনি ফিরে যাবে। কিন্তু মাকে কি করবে ? আবার তো আশ্রমে দিয়ে আসতে হবে ।কিন্তু মা তো কিছুতেই আর ওখানে যেতে চাইছে না। আবার আমার পক্ষে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। কিন্তু এবাড়িতে একা থাকবেই বা কি করে ? কাজের লোকের ভরসায় তো রেখে যাওয়া যায় না । তবে এখন উপায়? আর এই বাড়িটা রেখে তো কোন লাভ নেই। বিক্রি করে দেওয়াই ভালো। এখানে কে বা থাকবে ? আমাকে তো ফিরে যেতেই হবে । ওদেশেই সব কিছু। শুধু শুধু বাড়ির মায়া বাড়িয়ে কি হবে ? তাছাড়া এভাবে ফেলে গেলে বাড়ি দখল হয়ে যেতে পারে । মনে মনে ভাবে বুনি।
কিন্তু এতো অল্প সময়ে খরিদ্দার পাওয়াও খুব কঠিন। তবে দামে একটু কম দিলেও বিক্রি করে দেবো । কারন এখানে বেশীদিন থাকা আর তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে ফিরে যেতে হবে ওদেশে। তাই খুব করে লোক খুঁজছে বাড়ি বিক্রি করার জন্য। কিন্তু মা যে বেঁকে বসেছে। বিক্রি করতে দেবে না। কি যে করি এখন কিছুই বুঝতে পারছি না ।
কি হয়েছে রে বুনি ? তুই এমন করছিস কেন ? এটা আমার স্বামীর বাড়ি ছিল । এখন আমার বাড়ি। আমি চাই না এবাড়ি বিক্রি করতে। তুই কেন জোর করছিস ? বলেন প্রতিমা দেবী।
মা, একবার বোঝার চেষ্টা কর । কে থাকবে তোমার এই বাড়িতে ? দাদা তো আর নেই । বৌদির সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে। ওদের কোন ছেলে মেয়েও নেই। আর আমার পক্ষে তো এখনে পড়ে থাকা সম্ভব নয় । তাহলে কে আগলে রাখবে বল এ বাড়ি ?, তার চেয়ে বিক্রি করে ব্যাংকে টাকা রেখে দেই। সেটাই ভালো হবে। বুনি বোঝায় তার মাকে।
তুই কি নিয়ে যাবি আমাকে তোর সাথে ? তা তো নিবি না ? তাহলে আমার বাড়ি বিক্রির জন্য তোর এতো মাথা ব্যথা কেন ? আমার বাড়ি আমি বিক্রি করবো না । তুই চলে যা । আমি এখানেই একা থাকবো। আমার কোন অসুবিধা হবে না। বলেন প্রতিমা দেবী।
এতো মহা মুশকিল হলো ? এখন কি করি ? মাকে কোথায় রাখি ? কোন কথাই শুনছে না । মহা বিপদে পড়ে বুনি। ঠিক সেই সময় প্রতিমাদেবী যে আশ্রমে থাকতেন ,সেখান থেকে একটা প্রস্তাব আসে। কিছু কম দাম দিলে, আশ্রমের তরফ থেকে বাড়িটা কিনে নিতে পারে। এবং ওখানেই বৃদ্ধাশ্রমের আর একটি শাখা তারা খুলতে চান। বাড়িটা পেলে ওদের সুবিধা হবে। আর প্রতিমা দেবীকেও গৃহছাড়া হতে হবে না । উনি তার নিজের বাড়িতেই অন্যদের সাথে থাকতে পারবেন । আবার বাড়িটি বিক্রিও হয়ে গেল।
এই প্রস্তাবে বুনি যেন হাতে স্বর্গ পেল। এক কথায় রাজি হয়ে গেল। টাকা কিছু কম হলেও অবশেষে বাড়িটি বিক্রি করা যাবে আর মায়ের ও উপযুক্ত একটি ব্যবস্থা করা যাবে। মাও রাজি হয়ে গেল। বাড়িটি বিক্রি হয়ে যায়। বুনিও ফিরে যায় বিদেশে। প্রতিমাদেবী তার নিজের বাড়িতে বেশ আনন্দেই আছেন তার সমবয়সী অনেকের সাথে ।
এদিকে সৌহার্দ্যকে নিয়ে মর্গে পৌঁছায় সুজাতা। কোনদিন যা স্বপ্নেও ভাবেনি সেই কাজ আজ তাকে করতে হবে। আজ মনে পড়ে যাচ্ছে কত কথা । অমৃতা তার সত্যিই খুব ভালো বন্ধু ছিল । ওর মধ্যে প্রতিভা ছিল । লেখাপড়া শিখলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতো। কিন্তু ঐ মাথায় বিয়ের ভুত চেপে গেল। ভেবেছিল বিয়ে করে চুটিয়ে সংসার করবে। খুব ভালো থাকবে। কিন্তু ঐ কথায় বলে না ” অতি বড় ঘরনী ঘর” । ওর ও তাই হলো। ঘর পেলনা, সংসার পেলোনা। অবশেষে এইভাবে হলো অমৃতার তার শেষ পরিনতি । বেয়ারিশ লাশ হয়ে মর্গে শুয়ে আছে । আর তার আপনজন আজ থেকেও নেই। এভাবেই জীবনটা শেষ হয়ে গেল মেয়েটার ? মৃত্যুর সময় একটু স্নেহ স্পর্শ, একটু ভালোবাসা, একফোঁটা চোখের জল দেখতে পেলো না কারো । তবে সে কাদের জন্য সারাজীবন নষ্ট করলো ? এমন নিষ্ঠুর, ভয়ঙ্কর শেষ পরিনতি কেন হলো অমৃতার ? সে কি সত্যিই দোষী ছিল ?
কিরে, কি এতো ভাবছিস ? পরিস্থিতির মুখোমুখি তো হতেই হবে । এতো চিন্তা করিস না । এভাবে ভেঙে পড়লে তোকে সামলানো আমার পক্ষে মুসকিল হয়ে যাবে। মনটাকে শক্ত কর। প্রনীলদা অনেক সাহস করে তোকে পাঠিয়েছে আমার সাথে। নিজে আসতে পারেনি বলে। আর তুই যদি এখন এমন করিস , তবে আমি কি করি বলতো ? বলে সৌহার্দ্য।
আমি পারছি না রে সৌহার্দ্য। তুই জানিস না এক সময় অমৃতা আমার কত প্রিয় বন্ধু ছিল। মাঝখানে অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না ঠিকই। জানিস ও আমাকে কত ভাবে সাহায্য করেছে ? আমাদের আর্থিক অবস্থা আগে ভালো ছিল না। কোন টিউশনি দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না আমার বাবার। অমৃতা ওর সব নোটস আমাকে দিতো। একটুও হিংসা না করে।তাইতো আমার এতো ভালো রেজাল্ট হতো। কি করে ভুলি সেসব কথা ? খুব মনে পড়ছে রে আজ। বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে সুজাতা।
মনকে শক্ত কর। এখনই হয়তো ডাকবে। এতো উতলা হোস না। ওটা তো অমৃতা নাও হতে পারে ? তুই আগে থেকে এতোকিছু ভাবছিস কেন ? আমরা তো অনুমানের উপর ভিত্তি করে শনাক্ত করতে এসেছি। সঠিক তো নয় যে ওটাই অমৃতা। আর ওনার মত লড়াকু মেয়ে কখনোই এমন ভুল কাজ করতে পারেন না । আমার বিশ্বাস ওটা কোনমতেই অমৃতা নয়।
সুজাতাকে তো সান্ত্বনা দিলাম । কিন্তু আমার মন ও যে কু গাইছে । কারন সেদিন যেভাবে অপমানিত হয়েছেন উনি তার একমাত্র সাক্ষী আমি। খুব কম মানুষের পক্ষে এতোটা অপমান বিনা কারনে ঠান্ডা মাথায় হজম করা কষ্টকর। তাই কোন রকম ভুল করে ফেলা একেবারেই অসম্ভব নয়। তারপর উনি একা মানুষ। পাশে দাঁড়ানো বা মনের কথা ভাগ করে নেওয়ার ও কেউ ছিল না।
ম্যাডাম ,আপনাদের ডাকছে । ওদিকের কোনের ঘরটাতে চলে যাবেন। বডি শনাক্ত করতে হবে। একটি ছেলে এসে ডাক দেয়।
হাত পা যেন ঠান্ডা হয়ে যায় সুজাতার । আর এক পাও এগোতে পারছে না । পা যেন আটকে যাচ্ছে।
সৌহার্দ্য এসে হাত ধরে। এক প্রকার টানতে টানতে নিয়ে যায় সুজাতাকে মর্গের সামনে । বলে এতো ভেঙে পড়লে চলবে না। আমাদের তো দেখতে হবে মর্গে সত্যিই অমৃতা কি না ? চল তাড়াতাড়ি । এভাবে কাঁদিস না ।
আসুন আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছি। বলেন অফিসার । রামু ওনাদের ভিতরে নিয়ে যাও। ঐ দশ নাম্বার বেডটা দেখিয়ে দাও ।
এই রকম দিন যে কোনদিন আসবে কখনোই ভাবেনি সুজাতা। মর্গে আসতে হবে কখনো ভাবেনি। ভাগ্য আজ এখানে টেনে এনেছে । সারি সারি পড়ে আছে মৃত দেহ। বেয়ারিশ লাস । হয়তো বাড়ির লোক সারাজীবন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে । অথচ সে মর্গে পড়ে আছে। আবার কারো হয়তো সত্যিই খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই। ভাবতে ভাবতে দশ নাম্বার টেবিলের সামনে পৌঁছে যায় সুজাতা আর সৌহার্দ্য। শক্ত করে চেপে ধরে সৌহার্দ্যের হাত সুজাতা। পিছন ফিরে তাকিয়ে থাকে সুজাতা। চোখ বন্ধ হয়ে আসে।
তাড়া লাগায় রামু। এদিকে আসুন আপনারা । এটাকে দেখিয়ে আমাকে আবার ওদিকে যেতে হবে। গুচ্ছের কাজ পড়ে আছে।
ওদের এসব ঘটনা গা সওয়া হয়ে গেছে। রোজ রোজ দেখতে দেখতে মায়া দয়াও কমে যায়। সুজাতা সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে ঢাকা দেওয়া কাপড় সরিয়ে দেয় রামু। চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি মেয়ের করুন মুখ। বড় ফ্যাকাসে । অথচ খুব দৃঢ় ।
কে ছিল মেয়েটা ? অমৃতা নাকি অন্য কেউ ? জানতে চোখ রাখুন পরের পর্বে।
চলবে—
All rights are reserved by paramita mandal.