#আলোকিত_অন্ধকার
কলমেঃ-নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
৮ম পরিচ্ছেদ
_________________________
বাসায় ফিরে তিন্নি ভাবতে থাকে আতিফের কথা৷ তিন্নির জাস্ট ফ্রেন্ড আর বয়ফ্রেন্ড এর হিসাব তিন্নি নিজেও জানে না৷ বড়লোক বাবা আর সুন্দর চেহারা এদুটোকে মূলধন করে তিন্নি তার সীমা অতিক্রম করত সবসময়ই।
তিন্নির একটা বদঅভ্যাস ছিল, হুটহাট করেই যেকোনো একটা দিনে সে সবাইকে “হাই” লিখে টেক্সট পাঠাতো। তাদের সবাইকে একসাথে টেক্সট পাঠাতো যারা তিন্নিকে পছন্দ করত।
তিন্নির উপযাচক টেক্সট সেইসব প্রেমিক পুরুষদের মনে যে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দেবে এতো বলাই বাহুল্য।
তিন্নির ভাবনা এই পর্যায়ে এসে থামে যে, সে আতিফকে পাত্তাই দেবে না দেখা যাক কি হয়।
এ পর্যায়ে তিন্নি সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া প্রয়োজন।
কোটিপতি ব্যবসায়ী বাবামায়ের সন্তান তিন্নি আর তুর্য। ছোটবেলা থেকে চেয়েছে কিন্তু পায়নি এমন কিছুই ছিল না তিন্নির জীবনে। শুধু অভাব ছিল তার জন্য সময়ের। টাকার পিছনে চরকির মতো ঘুরে তার বাবা মা।
বছরের অধিকাংশ সময়ই তার বাবা থাকে ব্যবসার কাজে বাইরের দেশে। উচ্চশিক্ষিত মা সামলান দেশের ব্যবসা। তুর্য বিয়ে করে কানাডা সেটেল্ড।
পরের দিন থেকে তিন্নি শুরু করলো অন্য পথ ধরা, উদ্দেশ্য দুটো এক. আতিফ আসলেই তার উপর দুর্বল কিনা, দুই. তিন্নিকে নিজেকে আতিফের থেকে সামলে চলতে পারে কিনা।
আপাতদৃষ্টিতে তিন্নির পরিবর্তন দেখে যে সবচেয়ে বেশি খুশি হলো সে রাফিয়া। তবে তিন্নির উন্নাসিক আর অতি আধুনিক মন বারেবারেই আতিফে ঝুঁকছিল। এভাবে দিন মাস গড়িয়ে কাটতে থাকে তিন্নির সময়।
.
অষ্টাদশী বালিকাবধূ চারু যখন এবাড়িতে পা রেখেছিল, মনে এনেছিল একরাশ আশা। অনেক চাওয়া, অনেক আকাঙ্ক্ষা। জীবন থেকে পালিয়ে চারু ভেবেছিল এবার বুঝি সুখের দীপ জ্বলে উঠল। মায়ের স্নেহ এই বুঝি মিলল। স্বামী-সংসারে এসে হয়তো জীবনের কঠিন-কালো সময় গুলোকে ভুলেই যাবে।
আসলে মানুষের চাওয়া নিয়ে কেন জানিনা জীবন চলে না। সব মানুষের চাওয়া পূরণ হওয়ার নয়। আবার কিছু মানুষ যা চায় সেটাই পেয়ে যায়। এটা আমাদের কাছে অসংগতিই মনে হয়। অথচ আল্লাহ এর স্পষ্ট জবাব দিয়েছেন সূরা আল বাকারার ১৫৫ নম্বর আয়াতে,
وَلَنَبْلُوَنَّكُم بِشَىْءٍ مِّنَ ٱلْخَوْفِ وَٱلْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ ٱلْأَمْوَٰلِ وَٱلْأَنفُسِ وَٱلثَّمَرَٰتِ وَبَشِّرِ ٱلصَّٰبِرِينَ
অর্থঃ আর আমি নিশ্চয়ই তোমাদের পরীক্ষা করবো কিছু ভয়, আর ক্ষুধা দিয়ে, আর মাল-আসবাবের, আর লোকজনের আর ফল- ফসলের লোকসান ক’রে। আর সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের।
হয়তো মহান রাব্বুল আলামিন চারুকেও পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। মানুষ যতক্ষণ অবাধ্যতায় ডুবে থাকে তার কাছে সবই ধোঁয়াশা মনে হয়৷ তারপর যখন আলোর দেখা পায়, শান্তির দেখা পায় তখন অনুতপ্ত হয়, এতদিন সে কি ভুলটাই না করেছে!
সময়ের বহমানতায় আজ চারুর বিয়ের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। তাহের আজ তাদের এনিভার্সারি উপলক্ষ্যে বিশাল কেক নিয়ে এসে পার্টির আয়োজন করেছে। সুন্দর করে সেজেছে চারু, জমকালো কালো শাড়ি নিয়ে হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে কিন্তু তাহেরের আদেশ, আজ অনেক বন্ধু, স্টাফ আসবে। তাদের সামনে কিছুতেই চারুকে কোনো দিক থেকে কম দেখানো বিরাট প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে যাবে।
সম্মান আর সমাজে নিজেদের অবস্থান বাড়াতে মাহিমা একেবারে উদ্বাহু। তাই তাহেরের আয়োজনে একটু আমতা আমতা লাগলেও নিজেদের তথাকথিত সম্মানের দিকে তাকিয়ে চারুকেই রীতিমতো তাড়া দিতে লাগলেন। পার্লারের মেয়ের সাজানো সাজে পুরোদস্তুর খুঁত ধরতে ধরতে বেচারা তো রেগে চলে যেতেই চাইলো৷ চারু বিপদ বুঝে তাড়াতাড়ি বসালো মেয়েটাকে।
তবে মাহিমার আফসোস একটাই তিনি এখনো নাতি-নাতনির খবর শোনেননি। মাহিমার চরিত্রের যে দুর্বল দিকটা ছিল তা হলো অতিমাত্রায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং সেটা এই শতাব্দিতে এসেও।
তার মনে একটা ধারণা বদ্ধমূল হতে শুরু করেছে তা হলো চারুর কোনো সমস্যার জন্য তাহের-চারুর বাচ্চা হচ্ছে না। এ নিয়ে তিনি চারুকে অনেকবার এবড়োখেবড়ো প্রশ্ন করেছেন পাঁচ/সাত মাসে। চারু কোনো না কোনো ভাবে এড়িয়ে গিয়েছে।
এতেই মাহিমার রাগ।
-চারু এদিকে এসো।
চারুকে ডেকে এনে নিজের সামনে দাঁড় করালেন মাহিমা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন সব ঠিক আছে কিনা।
-টিপ কই?
-আসলে আম্মু ছোট থেকে কখনো টিপ পরিনি বিয়ের দিন ছাড়া, তাও পরতে চাইনি। আমার আম্মু টিপ পরা পছন্দ করতেন না।
চারুর কথায় মাহিমার মনে হলো বউমা তার উপর কথা বলা শুরু করেছে, পাল্টা ধমক দিয়ে বললেন,
-রাখো তোমার প্যাঁচপ্যাঁচানি! যাও ছোট্ট কালো একটা টিপ পরে এসো।
চারু জানে আর কোনো উপায় নেই। অগত্যা ঘরে গিয়ে টিপ পরে নিলো। বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তাহের সবকিছুই এনে ভরে রেখেছে।
যাই হোক এবার পুরো তৈরি হয়ে চারু ড্রয়িংরুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
চারুর দিকে সর্বপ্রথম চোখ পড়ল তাহেরের বন্ধু জিসানের। জোরে শিস দিয়ে উঠল বখাটে ছেলের মতো৷ তাহেরও কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, চারু যে এত সুন্দর তা সে নিজেই জানেনা, কখনো খেয়াল করেনি।
-ভাবি আসুন আসুন, আপনার জন্যই এই অনুষ্ঠান যেন পূর্নতা পেলো৷
জিসান এগিয়ে এসে চারুর হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় চারুর বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যায়। কিন্তু তাহেরের নির্বিকার ভঙ্গি আর হাসি দেখে আর কিছু বলার সাহস পায় না। কেক কাটার পর কেক খাওয়া থেকে শুরু করে নানা রকম সরস মন্তব্য চলতেই থাকল। একজন তো বলেই বসল,
-ভাবি আপনি আমার এই বন্ধুটাকে ছেড়ে চলে আসুন আমার কাছে, তাহের তোকে দেখে হিংসা হচ্ছে।
চারু আর থাকতে পারলো না। প্রচন্ড ঘৃণা হচ্ছে নিজের উপর। ভদ্রতার মুখোশে এ কোন ধরনের অশালীনতা! মেয়ে স্টাফদের সাথে তাহেরের ব্যবহার দেখে চারু রীতিমতো হতবাক!
এই মূহুর্তে হঠাৎ করেই চারু মনে পড়ছে তার মায়ের কথা! আচ্ছা বাবার বন্ধুরা তো কতবার এসেছে কই তার মা তো কখনো সামনে যায়নি। বাবাকে দিয়েই কাজ মিটিয়েছে, আপ্যায়ন করেছে যথার্থ। আচ্ছা তবে কি সে অনেক দূরে সরে এসেছে তার মায়ের আদর্শ থেকে?
ভাবতে ভাবতে সহসা দুলে উঠল চারুর বিশ্বাসের সেতু।
.
আজ সারা কলেজে রাফিয়া চুপটি করে আতিফকে লক্ষ্য করছিল, কিছুই ভাল লাগছিল না। ক্লাস শেষ হতেই রাফিয়াকে ড্রপ করে গাড়ি নিয়ে গ্যারেজে রেখে লিফটে উঠল তিন্নি। মনটা বেশ খারাপ হয়ে আছে ওর।
ঘরে ঢুকে মায়ের বেডরুমের দিকে একবার তাকালো তিন্নি।
তিন্নির মা খুব যত্নসহকারে তার হাতের নখে নেইলপলিশ লাগাচ্ছেন। কয়েকটা শিশি নিয়ে বসেছেন, বিভিন্ন নকশা করছেন হাতের নখে। আপাতত আর সব মনোযোগ সেখানেই নিবদ্ধ হয়েছে, যেন তার সবকিছু নির্ভর করছে এই নেইলপলিশ লাগানোর উপর, তাই হয়তো তিন্নির উপস্থিতি খেয়াল করেননি তিনি।
তিন্নি কিছু না বলে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। তিন্নির জীবনে স্বাধীনতার অভাব নেই। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে এসব উত্তর চাইবে না কেউ। বাবা মায়ের দায়িত্ব টাকা দেওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।
এ নিয়ে তিন্নির আক্ষেপ খুব বেশি নয়। মাঝেমধ্যে খারাপ লাগে। তবে নিজের মতো চলাফেলা, মাস্তি করতে পারায় আক্ষেপের পরিমাণ খুব বেশি নয়।
খারাপ লাগলে রাফিয়াদের বাড়ি যায়। রাফিয়াদের ফ্যামিলি খুব ভাল লাগে ওর, রাফিয়ার মা খুব ভালবাসেন ওকে। শুধু সমস্যা একটাই রাফিয়াকে বিভিন্ন শিকলে বেঁধে রেখেছে ওর পরিবার, এটা করা যাবে না ওটা করা যাবে না, যেখানে সেখানে যাওয়া যাবে না, মেয়ে বলে তাই। এসব একদমই ভাল লাগে না তিন্নির। এ দিকে থেকে সে ভালই আছে বলে মনে করে।
ফ্রেশ হয়ে এসে আবার মায়ের রুমের দিকে গেল তিন্নি।
-মা তুমি কি বের হচ্ছ কোথাও?
মেয়ের প্রশ্নে টিনা মুখ তুললেন। সবে নেইলপলিশ লাগানো শেষ করে হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে নিজের হাতের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলেন তিনি।
-হ্যাঁ বের হবো, আর ফিরতে অনেক রাত হবে, আর রাতে নাও ফিরতে পারি
নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন টিনা। কোথায় যাবেন কেন যাবেন এসব প্রশ্ন তিন্নি করবে না মাকে। ছোট বেলা থেকে এমনটা দেখেই অভ্যস্ত সে। ব্যাবসা বা নিজেদের কাজে বাবা মা সবসময়ই এমন।
-এখনই বের হবে?
-কিছু বলবি?
পালটা করেন টিনা।
-কেন জানিনা মনটা ভাল লাগছে না।
মায়ের পাশে বসতে বসতে বলো তিন্নি।
মেয়ের মুখের দিকে আরেকবার নিরীক্ষণের ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললেন,
-এক কাজ কর, ফ্রেন্ডদের নিয়ে একটা ট্যুর করে আয়।
-তোমার যা কথা! আমি বললেই ওরা টাকা খরচ করে যাবে?
ভুরু কুঁচকে বলল তিন্নি।
-আরে তুই নিয়ে যা, তোর পক্ষ থেকে?
মায়ের কথা শুনে আতিফের কথা মনে হলো তিন্নির। মুহূর্তের মাঝে পুরো প্ল্যানটা সাজিয়ে নিলো সে।
-ওওওও মা আই লাভ ইউ!
আনন্দে মাকে জড়িয়ে ধরল তিন্নি।
-লাভ ইউ টু মাই প্রিন্সেস, এখন যা প্ল্যান করে ডেট ফিক্সড কর। আমি ব্যবস্থা করে দিবো, এখন আমি একটু বের হবো।
-ওকে!
খুশি মনে মায়ের ঘর থেকে উঠে গেল তিন্নি।
(চলবে)