নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই।( পর্ব–১১)
কলমে– পারমিতা মন্ডল।
একা লড়ে নিজের পরিচয় তৈরী করা সত্যিই খুব কঠিন। শূন্য থেকে শুরু করেছিল অমৃতা। একটু একটু করে ঘুরেও দাঁড়াচ্ছিল । কিন্তু বিধাতা কি অন্য কিছু চাইছিল? তাহলে আজ কেন এতো বড় ক্ষতি হয়ে গেল অমৃতার ? মাথার উপর যেন একেবারে আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এবার সে কি করবে ? অনেক চেষ্টা করছিল ঘুরে দাঁড়াতে। একটু একটু করে লক্ষ্য পূরন করছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা মনে হয় আর হলো না।
দোকান কেনার জন্য অমৃতা লোনের দরখাস্ত করেছিল। পেয়েও ছিল কিছু টাকা। তার থেকে দু’লাখ টাকা সে এডভ্যান্স দিয়েছিল একজন প্রোমোটারকে। দোকান কেনার জন্য। সে সব টাকা মেরে দিয়ে পালিয়ে গেছে। যা কিছু ঠিকানা দিয়ে ছিল সব মিথ্যা। এগ্রিমেন্ট পেপারে যেখানে সই করেছিল সেই নাম ঠিকানা সব ভুয়ো। একটু একটু করে জমানো টাকা থেকে লোন সোধ করে দেবে ভেবেছিল ।কিন্তু লোনের টাকা যে এভাবে চোট হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি অমৃতা। তার আরো সচেতন হওয়া উচিৎ ছিল। এখন লোন শোধ করবে নাকি নতুন করে ব্যবস্যা শুরু করবে ? না আশ্রমে খাবার ডেলিভারি দেবে ? কোথায় পাবে এতো টাকা।তার অনেক কষ্টের টাকা এভাবে মার হয়ে গেল? কাকে বলবে একথা ?
সদ্য বিয়ে হয়েছে সুজাতার। ওরা এখন হানিমুনে গেছে। ওদের বিরক্ত করা উচিত হবে না। তাহলে কি আশ্রমের ম্যানেজার কাকুকে বলবে নাকি বাড়িওয়ালা মেসোমহাশয়কে বলবে ? মাথা কাজ করছে না কিছুতেই ?ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে অমৃতা। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে।
এদিকে অমৃতার কাছে যারা কাজ করে ওরা চলে এসেছে। ওকে এভাবে অচৈতন্য হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ওরা ভয় পেয়ে যায়। ছুটে গিয়ে খবর দেয় বাড়িওয়ালাকে । সবাই এসে চোখে মুখে জলের ছিটে দেয়, বাতাস করতে থাকে। আস্তে আস্তে জ্ঞান ফিরে আসে অমৃতার। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। সব শেষ হয়ে গেল মেসোমহাশয় । একটু একটু করে জমানো টাকা ঐ প্রমোটর রাজীব সব মেরে দিলো। এখন আমি কি করবো ?
সব শুনে উনি বলেন “দাঁড়াও অমৃতা , এতো ভেঙে পড়ো না । কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিক হবে। ওকে ধরা যাবে। পুলিশে ডাইরি করতে হবে। ওর হেড অফিস আছে তো ভবানীপুরে। ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে। তুমি এতো ভেঙে পড়ো না । আমরা সবাই আছি তোমার পাশে। দরকার হলে ঐ প্রোমোটারের বিরুদ্ধে কেস করা হবে। তুমি চিন্তা করো না।
শান্তনা তো দেন মেসোমহাশয়। কিন্তু কাজটা মোটেও সহজ নয়, সেটা তিনি জানেন। এসব ক্ষেত্রে বেশীর ভাগ সময় টাকা আর ফেরত পাওয়া যায় না। ওদের ধরা খুব মুশকিল হয়। কারন পুলিশের সাথে ওদের হাত থাকে। ঘুষ খাইয়ে রাখে। তাই শান্তনা দিলেও বেশ চিন্তিত দেখা যায় ওনাকে।
অমৃতা বলে–কিন্তু মেসোমহাশয় কেস লড়তে ভালো একজন উকিল লাগবে। খরচ প্রচুর। কোথায় পাবো এতো টাকা ?তাছাড়া আমার হয়ে কে করবে দৌড়াদৌড়ি ? আমার তো কেউ নেই। ঐ টাকা আমি আর ফেরত পাবো না।
এতো ভেবোনা । এখন একটু বিশ্রাম নাও। আজ আর বেরিও না। ওদের বুঝিয়ে দাও। ওরা ঠিক খাবার পৌঁছে দেবে। তুমি বরং একটু স্নান করে খেয়ে ঘুমিয়ে নাও। শরীর মন দুটোই সুস্থ রাখতে হবে। এতো সহজে হেরে গেলে চলবে ? তুমি না লড়াই করবে বলে ঘর ছেড়েছো ?-বলেন বাড়িওয়ালী মাসিমা। দেখি আমরা কি করতে পারি ?
সত্যিই ওনারা খুব ভালো। নিজের মেয়ের মত স্নেহ করেন। রক্তের সম্পর্ক দূরে সরিয়ে দিলো । আর ভালোবাসার পাতানো সম্পর্ক কাছে টেনে নিলো। সত্যিই বড় বিচিত্র এই মানুষের মন।
কিন্তু একা লড়াই করা যতটা সহজ ভেবেছিলাম, আসলে ততটা নয় । কিছুতেই উঠে দাঁড়াতে পারছি না। এক পা এগিয়ে যেন তিন পা পিছিয়ে যাচ্ছি। শূণ্য থেকে শুরু করে মোটামুটি দাঁড়িয়ে ছিলাম। আজ এতোগুলো টাকার ধাক্কা আমাকে আবার শুণ্যতে নামিয়ে দিলো। তবুও হেরে গেলে , মনবল ভেঙ্গে গেলে চলবে না। আমাকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। আবার উঠে দাঁড়াবো আমি। কেস লড়বো ঐ প্রোমোটারের বিরুদ্ধে। হারলে হারবো। তবুও অন্যায় মানবো না। পিছু হটলে চলবে না। লড়াইয়ে ময়দানে যখন নেমেছি তখন একচুল জমিও ছাড়বো না লড়াই না করে। জিততে আমাকে হবেই ।তবে তার আগে একজন ভালো উকিলের দরকার।
আচ্ছা সৌহার্দ্যকে বললে হয়না ? ছেলেটি তো বেশ ভালোই। যদিও আমার বিরোধী পক্ষ ছিল ডিভোর্স কেসে। ওটা তো ওনার পেশা।কিন্তু উকিল হিসেবে তো বেশ ভালোই।এখন তো আর বিরোধী পক্ষ নয়। আবার সুজাতার বন্ধু । যদি বলে কয়ে একটু কম টাকায় কেস লড়তে রাজি হয় ? কথা বলে কি দেখবো একবার ? কিন্তু ফোন নাম্বার তো নেই আমার কাছে। যোগাযোগ করবো কিভাবে ? সুজাতাকে বলবো ? না, না । ওরা তো হানিমুনে গেছে। ওদের বিরক্ত করা ঠিক হবে না । তাহলে এখন উপায় ? ভাবতে থাকে অমৃতা।
হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে ।এসময় কার ফোন ?চিন্তা সুত্র ছিঁড়ে যায় অমৃতার। ফোন হাতে নিয়ে দেখে আশ্রম থেকে রমাদি ফোন করেছে । কি ব্যাপার ? এখন কেন ফোন করছে রমাদি ? তাহলে কি খাবার পৌঁছায়নি ? নাকি কোন সমস্যা হয়েছে ? আজ তো অসুস্থ হয়ে পড়ায় নিজের থেকে ভালো করে দেখতেও পারিনি। তাই কি কোন গন্ডগোল হলো ?
ফোন ধরে অমৃতা ।” হ্যালো রমাদি বলো । কোন সমস্যা হয়েছে ? আমি তো আজ যেতে পারিনি।”
“সরি তোমাকে বিরক্ত করার জন্য অমৃতা। আমি শুনেছি তুমি অসুস্থ। কিন্তু এদিকে এমন একটি পরিস্থিতি হয়েছে যে ফোন না করে পারলাম না গো ।”
“ঠিক আছে তুমি বলোনা কি হয়েছে। আমি এখন ঠিক আছি। এই একটু মাথা ঘুরে গিয়েছিল। খাবার ঠিকঠাক পৌঁছায়নি। তাই তো ? নাকি রান্না ঠিক হয়নি ? আসলে আজ তো আমি নিজে দেখতে পারিনি ।”
না, না সে সব ঠিক আছে । আসলে সেদিন যে নতুন দুজন মেম্বার এলেন না ? দুই দিদা । তাদের মধ্যে একজন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। প্রতিমাদি বলে যিনি ছিলেন । ওনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে । কিন্তু উনি বারবার তোমার নাম করছেন। একবার তোমাকে ডাকতে বলছেন। সবাই বলছে উনি নাকি তোমার শাশুড়ি মা ছিলেন ? বারবার বলছেন “আমার বৌমা অমৃতাকে ডাকো । “আসলে এতো করে বয়স্ক মানুষ কাকুতি মিনতি করছেন তো । তাই বাধ্য হয়ে তোমাকে ফোন করলাম। তুমি কি একবার আসতে পারবে ? জানি তোমার ও শরীর ভালো নয়। ”
সত্যিই আমার শরীরটা ভালো নেই। তাছাড়া আমি গিয়ে কি করবো বলো? আমি তো ডাক্তার নই। ওনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান । ঠিক হয়ে যাবেন। নাহলে ওনার ছেলেকে খবর দিন। দেখো রমাদি আমি সত্যিই খুব অসুস্থ। তাছাড়া একটু ঝামেলার মধ্যেও আছি।– বলে ফোন ছেড়ে দেয় অমৃতা।
এরা আমাকে বাঁচতে দেবে না। সব ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি ; নিজের মত থাকবো বলে ।কোন কিছু দাবী করিনি। ডিভোর্সও হয়ে গেছে। তবুও পিছন ছাড়ছে না । বড় দেরী করে ফেলেছেন প্রতিমা দেবী। আজ কিছুতেই ওনার পাশে দাঁড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যে সম্পর্ক ছেড়ে চলে এসেছি কোনভাবেই আর তার সাথে জড়াতে চাইনা। আবার অশান্তি হবে। প্রয়োজনে আশ্রম ছেড়ে চলে যাবো। তবুও আর ফিরে যেতে চাই না।
কিন্তু সত্যিই ওনার কি হলো ? সুগার, প্রেসার তো ছিলই। সেটা কি বাড়াবাড়ি হলো ? ওরা কেন ছেলেকে খবর দিচ্ছে না ? কি করবো আমি ? একবার কি যাবো ? কোন সম্পর্ক ছাড়াও তো একজন মানুষ আর একজন মানুষকে দেখতে যেতে পারছ। একজন বয়স্ক মানুষ অসুস্থ । তাকে তো আমি দেখতে যেতেই পারি । আমি গিয়ে দাঁড়ালে যদি উনি একটু ভরসা পান ? না, না । সেটা ঠিক হবে না। মনকে শক্ত করতে হবে। না হলে আবার আমি জড়িয়ে পড়বো। আর ভাববো না ওনার কথা।
এমন সময় বাইরে কলিংবেলের আওয়াজ হয়। কে এলো এখন আবার ? এমনিতেই শরীর মন ভালো নেই। এতোগুলো টাকা চোট হয়ে গেল। তারপর আবার আশ্রম থেকে ফোন করে এমন একটা খবর দিলো। পিছুটান ছাড়তে চাইলেও কেন যে পারছে না কে জান? মনটা আজ বড় বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কিছুই ভালো লাগছে না।
আস্তে আস্তে দরজা খোলে অমৃতা। খুব দুর্বল লাগছে। যেই আসুক এখন আর বসতে বলবো না। বেশীক্ষন কথা বলতেও ইচ্ছা করছে না। তার এখন একটু বিশ্রামের দরকার। রাতে আর কিছু খাওয়ার ইচ্ছা নেই। ঘুমিয়ে পড়তে হবে তাড়াতাড়ি।
কিন্তু দরজা খুলে অবাক হয়ে যায় অমৃতা। মেসোমহাশয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে সৌহার্দ্য। সে কিভাবে চিনলো এই বাড়ি ? আর কেনই বা এসেছে এখানে ? অমৃতা তো সাধারণত তার ঠিকানা কাউকে দেয়না। যতদূর মনে পড়ে সৌহার্দ্যকেও দেয়নি। তাহলে ?
,চলবে—
All rights are reserved by paramita mandal.