নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই।(পর্ব–১৫)
কলমে– পারমিতা মন্ডল।
সেদিনের পর আর অমৃতার খোঁজ নেওয়া হয়নি। খুব কাজের চাপ ছিল। তাছাড়া ফোন করে খোঁজ নিলে যদি উনি অসন্তুষ্ট হন, তাই ফোন ও করা হয়নি। কিন্তু ঐ বাড়ি থেকে আসার পর উনি নিশ্চয়ই ভালো নেই । সেদিন যে ভাবে ওনাকে হেনস্তা হতে হয়েছে, সেটা তো চোখের সামনে দেখলাম। তবুও ফোন করে খোঁজ নেওয়ার সাহস হয়নি। কারন উনি যখন তখন ফোন করা পছন্দ করেন না । কিন্তু ঐ টাকা খোয়া যাওয়ার ব্যপারে একটু কথা বলার দরকার ছিল। ফোন কি করবো ?–মনে মনে ভাবেন সৌহার্দ্য।
না,না ফোন করে কাজ নেই। ওনার মনের অবস্থা ভালো না । দরকার হলে তো নিজেই ফোন করতেন । যখন কোন যোগাযোগ করেননি , তখন আমার ফোন করা ঠিক হবে না ।কিন্তু ওনার কিছু কাগজপত্র যেমন আধার কার্ড বা ভোটার কার্ড দরকার। ওটা না পেলে তো কিছুই করা যাবে না। যাকগে ফোনটা করেই ফেলি। আমি তো আমার দরকারে ফোন করছি না। নিশ্চয়ই কিছু মনে করবেন না। ভেবেই ডায়াল করে সৌহার্দ্য। কিন্তু ফোন তো সুইসাইড অফ বলছে। এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছেন ? মাত্র তো আটটা বাজে।
থাক বরং বাড়িওয়ালা মলয় বাবুকে একবার ফোন করে জানতে চাই। উনি নিশ্চয়ই সব বলতে পারবেন । সুজাতাকেও ফোন করতে পারতাম । কিন্তু ওরা সবে গতকাল ফিরেছে । এতোকিছু হয়ে গেছে হয়তো জানেনা । অমৃতা যা চাপা স্বভাবের মেয়ে । নিশ্চয়ই কিছু বলেননি। যাইহোক মলয় বাবুকেই ফোন করে দেখি। মলয় বাবুকে ফোন করে সৌহার্দ্য।
“হ্যালো, মেসোমোশাই আমি সৌহার্দ্য বলছি । একটু বিরক্ত করলাম। আসলে অমৃতাদেবীর একটা আধার কার্ড খুব দরকার ছিল । কিন্তু ওনার ফোন তো সুইচড অফ বলছে। তাই বাধ্য হয়ে আপনাকে ফোন করলাম। আপনি ওনাকে একটু বলে দেবেন যেন আধার কার্ড নিয়ে কাল আমার সাথে একবার দেখা করেন।”
“কাকে বলবো সৌহার্দ্য ? অমৃতা তো এখানে নেই ।” বলেন মলয়বাবু।
“নেই মানে ? আবার কি ঐ বাড়িতে গেছেন নাকি ? সেদিনের এতোকিছুর পর আবার গেলেন ? সরি মেসোমোশাই। এটা আমার বলা ঠিক নয়। ওনার ব্যক্তিগত ব্যপার। কিন্তু ওখানে সেদিন যেভাবে অপমানিত হয়েছেন , তাতে আমার মনে হয় ওদের সাথে আর সম্পর্ক রাখা ঠিক নয়।”
“আরে তুমি বলবে কাকে ? সেতো বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আমার ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে কিছুই জানি না । ঠিকানা দিয়ে যায়নি। শুধু একটা চিঠি লিখে চলে গেছে। ফোন করেও পাওয়া যাচ্ছে না।সুইচড অফ।”– বলেন মলয়বাবু।
“সেকি কথা? এরকম মানষিক অবস্থার মধ্যে উনি গেলেন কোথায় ? হয়তো কোন আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়িতে গেছেন। দু”একদিন পরেই চলে আসবেন। আপনি এতো চিন্তা করবেন না। কিন্তু আমার আধার কার্ডটা এই মুহূর্তে পেলে সুবিধা হতো। যাইহোক ফিরে এলেই না হয় নেওয়া যাবে। উনি এলে আমাকে একটা খবর দেবেন। এখন রাখি তাহলে। “-বলে ফোন রেখে দেয় সৌহার্দ্য।
মনে মনে ভাবে সৌহার্দ্য যে বেশী কৌতূহল দেখিয়ে ফেললাম না তো ? একে তো আমাকে জড়িয়ে ওনার সম্পর্কে লোকে খারাপ কথা বলছে। যা সত্যি নয়। তারপর উনি যদি রেগে যান ? সে যাইহোক ,কিন্তু কোথায় যেতে পারেন অমৃতা। সুজাতাকে কি বলবো একবার ? খুব চিন্তা হচ্ছে । যা ঝড় যাচ্ছে মেয়েটির উপর দিয়ে। আচ্ছা আমি কেন ওনার কথা এতো ভাবছি ? উনি তো আমার ক্লায়েন্ট ছাড়া তো আর কিছুই নয়। তবুও কেমন যেন জড়িয়ে পড়ছি ওনার সাথে। আমার কি ওনাকে ভালো লেগে গেছে ? সেটা কিভাবে সম্ভব ? অমৃতা তো সব সময় দূরত্ব রেখে চলে। আমিও কখনো তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ভাবিনি। কিন্তু তবুও কোন না কোন ভাবে জড়িয়ে যাচ্ছি। এটা ঠিক হচ্ছে না। আমাকে দূরে সরে থাকতে হবে। আধার কার্ড দিলে দেবে। দরকার তো ওনার। আর আমি ভাববো না। কিন্তু অমৃতা গেলো কোথায় ? এই চিন্তাটাও কিছুতেই দূর করতে পারছি না মন থেকে।
আজ পাঁচদিন হয়ে গেল অমৃতার কোন খোঁজ নেই। কে বা খোঁজ করবে ? ওর আপনজন বলতে তো তেমন কেউ নেই? বাবা থেকেও নেই। যদিও পরের দিকে ওর বাবা তাঁর ভুল বুঝতে পেরে অনেকবার অমৃতাকে ডেকেছিল। কিন্তু সে যায়নি। তাহলে এখনো হয়তো বাবার কাছে যাবে না। তবে মেয়েটা কোথায় যেতে পারে ? নতুন করে কোন বিপদে পড়বে না তো আবার ?
আসলে ,ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসা যতটা সহজ ঘুরে দাঁড়ানো কিন্তু ততটা সহজ নয়। পদে পদে বিপদ আসবে। কেউ তো পাশে দাঁড়াবেই না বরং চেষ্টা করবে কিভাবে টেনে নীচেয় নামানো যায়? তারপর সে যদি সহায় সম্বলহীন হয় তাহলে তো কথাই নেই। খারাপ মেয়ের তকমা এঁটে দিতে এই সমাজ দু’বার ভাববে না। শত অত্যাচার সহ্য করেও স্বামীর ঘরে টিকে থাকাই হলো মেয়েদের একমাত্র ভবিতব্য,একমাত্র ভালো থাকার পথ বলে আজও অনেকেই মনে করে। তবে কেউ কেউ যে বেরিয়ে এসে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না তা নয়। বাবা মায়েরাও পাশে থেকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে তাদের। কিন্তু এখনো অমৃতার মত দুর্ভাগ্যও অনেকেরই আছে। তাই বিয়ের আগে দুবার ভাবা উচিত। কখনোই পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। অন্তত তাকে লড়াই করার জন্য তৈরী করেই বিয়ে দেওয়া উচিত।
আজ অমৃতার লড়াই দেখে অনেকেই হয়তো ভাবছেন ” কি দরকার ছিল রে বাবা স্বামীর ঘর ছাড়ার ? বেশ তো ভালো ছিলি। দুবেলা দুমুঠো খাচ্ছিলি। খাওয়া পরার কোন অভাব ছিল না। কেন বেরিয়ে এলি ,বেশী স্বাধীনতা দেখাতে ? দেখ এখন কেমন লাগে ? এতোই সোজা না ? নিজের পায়ে দাঁড়াবো, পরিচয় খুঁজবো — ওসব গল্পে , সিনেমায় হয় রে। বাস্তবে হয় না। বাস্তব বড় কঠিন জায়গা। আগুপিছু না ভেবে ঘর ছেড়ে চলে এলি ?
সত্যিই বাস্তব বড় কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। প্রতিটি মানুষের নিজের মত করে বাঁচার অধিকার আছে। আজীবন কারো দাসত্ব করে নয়। হয়তো অনেকেই বলবেন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে দাসত্ব কোথা থেকে এলো ? এটা অপপ্রচার। এটা তো ভালোবাসার সম্পর্ক ।
একদম ঠিক। যেখানে ভালোবাসা আছে সেই সম্পর্ক বড় মধুর। কিন্তু যেখানে নেই ? যেখানে বৌকে বাড়ির হেল্পার মনে করা হয় ? দুটো টাকা বা সামান্য প্রয়োজনেও তাকে হাত পাততে হয় স্বামীর কাছে ? আর শুনতে হয় অনেক অপমান জনক কথা ?সেক্ষেত্রে ? অথচ এই মেয়েটি সারাদিন সংসারের খুঁটিনাটি কাজ করতে করতে সবার মন যোগাতে গিয়ে এক সময় নিজের মনটাই হারিয়ে ফেলে। তারপর একদিন সে যখন প্রতিবাদী হয়, ঘর ছাড়ে তখনো সবাই মেয়েটিকেই দোষ দেয়। অথচ সংসারে থেকে সে সারাদিন যা পরিশ্রম করে সেই একই পরিশ্রম করে কিন্তু সে বাইরে বেরিয়ে রোজগার করতে পারে। নিজের খরচা চালিয়ে নিতে পারে। রোজগার করার ক্ষমতা কিন্তু তার ও আছে। কিন্তু সে সংসারকে ভালোবেসে আঁকড়ে থাকতে চায়। সবাইকে ভালো রাখতে চায়। অথচ একদিন সেই সংসার তাকে বাটি হাতে বসিয়ে দেয় রাস্তায়। দাঁড় করায় কাঠগড়ায়। অপমানে অপমানে জর্জরিত করে। কোন কাজ জানেনা , স্মার্ট নয়, লেখাপড়া জানেনা বলে অনেক সময় সন্তানও মায়ের পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। ভুলে যায় সংসারে মেয়েদের অবদান। ভুলে যায় তারা ইচ্ছা করে গৃহবধূ হয়ে থাকে না । তারা ত্যাগ স্বীকার করে বলেই পুরুষ নিশ্চিন্তে বাইরে কাজ করতে পারে। ঘরে এসে শান্তিতে থাকতে পারে। তাই মেয়েরা কিন্তু ইচ্ছা করে ঘর ভাঙে না।
সে যাইহোক, একথা সমাজকে বোঝাতে আরো বহু যুগ কেটে যাবে। আপাতত আমরা দেখি অমৃতা কোথায় গেল ? কোন বিপদে পড়লো না তো মেয়েটা ?
এদিকে মলয়বাবুর বাড়িতে তো অমৃতার সব জিনিসপত্র রয়েছে। ওগুলো সে হয়তো একদিন নিয়ে যাবে। তাছাড়া ঘরভাড়াও দেওয়া আছে। তারচেয়ে বড় কথা মেয়েটিকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছেন তিনি। তাঁর নিজের মেয়ে তো অনেক দূরে থাকে। সবসময় আসতেও পারেনা। সেই জায়গাটা কখন যেন অমৃতা নিয়ে নিয়েছে। তাই মলয়বাবুও মনে মনে খুব ভেঙে পড়েছেন অমৃতা চলে যাওয়াতে। উনি আর কিছু না ভেবেই সুজাতাকে ফোন করেন। সত্যিই যদি মেয়েটার কোন বিপদ হয় ?
“হ্যালো , মেশোমোশাই বলুন কেমন আছেন ? অনেকদিন হলো আপনাদের কোন খোঁজ নেওয়া হয়নি। ভালো আছেন তো ?”বলে ওপার থেকে সুজাতা।
“আর ভালো থাকি কি করে বলো ? তোমরা বেড়াতে গেছিলে ,। তাই কিছু জানানো হয়নি । তোমাদের বিরক্ত করতে চাইনি। এদিকে তো অনেক কিছু ঘটে গেছে।”– বলেন মলয়বাবু।
“কি হয়েছে মেসোমোশাই ? কোন বিপদ ? আমি তো কিছুই জানি না। অমৃতা তো আমাকে কিছু বলেনি। ও কেমন আছে এখন ? আমিও ব্যস্ত ছিলাম। ওকে ফোন করা হয়ে ওঠেনি।”–চিন্তিত সুরে বলে সুজাতা।
“অমৃতাকে আজ পাঁচদিন হলো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে কেউ জানে না । কোন ঠিকানা রেখে যায়নি। শুধু একটা চিঠি লিখে চলে গেছে।-“– বলেন মলয়বাবু।
“সেকি কথা ? এতোবড় কথাটা আপনারা কেউ আমাকে জানালেন না একবার ?সৌহার্দ্য ও তো বলতে পারতো আমাকে।–অনুযোগের সুরে বলে সুজাতা।
হ্যাঁ তোমাকে জানানো হয়নি। কারণ তুমি এখানে ছিলেনা। দুশ্চিন্তা করবে তাই। শোন ,তুমি হয়তো। এটাও জানো না যে, অমৃতার স্বামী রাতুল মারা গেছে।তুমি ঘুরতে গেছো তাই তোমাকে জানাতে বারন করেছিল অমৃতা। তাই বলা হয়নি। সৌহার্দ্যকে নিয়ে অমৃতা ওদের বাড়িতে যায়। সেখানে খুব খারাপ ভাবে অপমানিত হয় অমৃতা। আসলে এখন তো অমৃতা ওদের কেউ নয়। তাছাড়া সৌহার্দ্যকে নিয়েও অনেক বাজে কথা ওকে শুনতে হয়। ও শুধু প্রতিমাদেবী মানে ওর শাশুড়ির জন্যই গিয়েছিল। কিন্তু চরমভাবে অপমানিত হয়। মন থেকে একেবারে ভেঙে পড়েছিল মেয়েটা। সব কথা খুলে বলার বা প্রান খুলে কাঁদার ও কোন জায়গা নেই মেয়েটার। বড় অভাগী। খুব খারাপ লাগে ওর জন্য। কিন্তু এখন বড় সমস্যা হচ্ছে ওকে খুঁজে বের করা। আমার তো বয়স হয়েছে। মনোবল থাকলেও শক্তি বা সাহস নেই। তাই তোমাকে বললাম। দেখোনা মেয়েটা কোথায় গেল ?
এতোকিছু হয়ে গেছে, আর আমি কিছুই জানি না ? ঠিক আছে মেসোমোশাই ,আপনি চিন্তা করবেন না । আমি দেখছি । তবে আমাকে আরো আগে খবরটা দিলে ভালো হতো। দেরী হয়ে গেলো না তো ? এখনই পুলিশে মিসিং ডাইরি করতে হবে।– বলে সুজাতা।
সৌহার্দ্যকে নিয়ে সুজাতা পুলিশে নিখোঁজের ডাইরি করে। কিন্তু তাও তো দুদিন হয়ে গেল । এখনো কোন খবর আসেনি। কোথায় যেতে পারে মেয়েটা ? কোন বাজে লোকের পাল্লায় পড়ে পাচার হয়ে যায়নি তো ? অমৃতার চেনাশোনা সব জায়গায় সুজাতা খোঁজ নিয়েছে। এমনকি ওর বাবার কাছেও গিয়েছিল সুজাতা। সেখানেও যায়নি। তাহলে কোথায় গেল সে ?
আজ দুপুরবেলায় সুজাতার কাছে একটি ফোন আসে। পুলিশের ফোন। সুজাতার দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী একটি মেয়ের বেওয়ারিশ লাশ পড়ে আছে মর্গে তিনদিন ধরে। সুজাতাকে চেনার জন্য ডেকে পাঠিয়েছে পুলিশ।
কথাটা শোনার পর সমস্ত শরীর যেন অসাড় হয়ে আসছে সুজাতার । এ কি হয়ে গেল ? এভাবেই কি জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়ে অমৃতা সুইসাইডের রাস্তা বেছে নিলো ? না, না এটা কিছুতেই হতে পারেনা। অমৃতা এতো দূর্বল নয়। মনে মনে ভাবছে সুজাতা আর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।
আপনাদের কি মনে হয় ? ওটা কি অমৃতা ? সত্যিই কি সে হেরে গেল ? আর লড়াই করতে না পেরে ময়দান ছেড়ে পালিয়ে গেল ? জানতে চোখ রাখুন আগামী পর্বে।
চলবে——
All rights are reserved by paramita mandal.