নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই।( পর্ব–১২)
কলমে— পারমিতা মন্ডল।
মানুষের জীবন কি কঠিন তাই না ? পদে ,পদে বাধা এসে জড়িয়ে ধরে শৈবাল দামের মত। কখনো অর্থ বাধা হয় কখনো পারিপার্শ্বিক অবস্থা বাধা হয়ে দাঁড়ায় । বিশেষ করে যে ঘুরে দাঁড়াতে চায় সে যদি মহিলা হয়। শুধু মহিলা নয়, ডিভোর্সী অথবা বিধবা হলে সমস্যা যেন বেশী হয়। তির্যক মন্তব্যে বিদ্ধ হতে হতে মনবল ভেঙে যায় একসময়। আর সবচেয়ে বড় কথা এই কাজটা মেরেরাই করে বেশী। একজন মেয়ে হয়ে আর একজন মেয়ের পাশে দাঁড়ালে সমাজ একদিন পিছু হটতে বাধ্য হবে। এটা এখনো মেয়েরা বোঝেনা। তবে অমৃতা কিছু ভালো মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছে। তার মধ্যে সুজাতা আর ওর বর প্রনীল একজন। এছাড়া বাড়িওয়ালা মাসিমা- মেসোমহাশয় ও ওকে খুব সাহায্য করেন। নাহলে ঘুরে দাঁড়ানো হয়তো এতোটা সহজ হতো না।
সমাজের সব পুরুষ মানুষ তো খারাপ নয়। রাতুলের সাথে তার বনিবনা হয়নি। তবে খুব বেশী ঝগড়াও হয়নি। কিন্তু ওখানে তার কোন স্বাধীনতা ছিল না। শাশুড়ির হাতের পুতুলের মত উঠতে বসতে হতো। এটা এখন কার কোন শিক্ষিত মেয়েরা মেনে নিতে পারেনা। এক্ষেত্রে স্বামী যদি পাশে দাঁড়ায় তবে অনেক ক্ষেত্রে ভাঙন আটকানো যায়। আজ কালকার স্বাধীনচেতা মেয়েরা এটা মেনে নেয় না। একান্ত যার যাওয়ার কোন জায়গা নেই বা সন্তান হয়ে গেছে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বাধ্য হয় জীবন কাটিয়ে দিতে। কিন্তু মন থেকে মানতে চায়না।
তবে এখনকার সচেতন বাবা মায়েরা মেয়েকে মুখ বুজে মানিয়ে নিতে না বলে মেয়ের পাশে দাঁড়ায় । চেষ্টা করে সমস্যা সমাধান করার ।না পারলে শশুর বাড়ির অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য, নিজের কাছে নিয়ে আসে মেয়েকে। দাঁড় করানোর চেষ্টা করে নিজের পায়ে। তবে আমার বাবার মত বাবাও যে আছে । এখনো তারা সমাজকে ভয় পায়। তাদের কপালে আমার মত দুর্ভোগ জোটে । একটু সহানুভূতি একটু ভালোবাসা পেলে জীবনটা হয়তো আজ আমার অন্যরকম হতো। বাবা পাশে দাঁড়ালে সহজেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতাম। আর স্বামী পাশে দাঁড়ালে হয়তো সংসারটাই ভাঙতো না। যাক যা হবার হয়েছে। এসব আর ভেবে লাভ নেই। এখন দেখি সৌহার্দ্য কেন এলো ? কিভাবে ঠিকানা পেল আমার ?
“অমৃতা দেখো উনি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছেন ।তোমাদের তো আগে পরিচয় হয়েছে। “–বলেন মেসোমহাশয়।
এ বাবা ! কি ভাবছেন মেসোমহাশয় কি জানি ? আগে কয়েকবার দেখা হয়েছে ঠিকই । কথাও হয়েছে । তাই বলে বাড়িতে চলে আসার মত কোন সম্পর্ক তৈরী হয়নি।আর উনি ঠিক খুঁজতে খুঁজতে বাড়িতে চলে এসেছেন ? মতলবটা তো ভালো ঠেকছে না । যেই দেখেছে ডিভোর্স হয়ে গেছে অমনি একেবারে বাড়িতে হানা ? না, না ওনাকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না । বাইরে বসাতে হব।এসব মানুষদের বিশ্বাস করা একদম ঠিক নয়। এতোগুলো টাকা চোট হয়ে গিয়ে অমৃতা এখন খুব সচেতন। তাছাড়া মেসোমহাশয় কি ভাবছেন কি জানি ?
“আরে শোন অমৃতা । এতো ঘাবড়ানোর কিছু হয়নি । তুমি এতো ইতস্তত করছো কেন ? সৌহার্দ্যকে সুজাতা পাঠিয়েছে। আমি সুজাতাকে ফোন করেছিলাম । ওরা তো আমাদের বারবার বলে গিয়েছিল কোন সমস্যা হলে জানাতে। তাই তোমাকে না জানিয়েই ফোন করছিলাম। জানতাম তুমি করবে না। কারন ওরা হানিমুনে গেছে । কিন্তু তোমার এতোবড় সমস্যা আমি যদি না জানাতাম তবে ওরা রাগ করতো আমার উপর। সব শুনে ওরা সৌহার্দ্যকে পাঠিয়ে দিয়েছে। উনি তো উকিল এইসব ভালো বুঝবে। তারপর ওদের বন্ধু। ওরা তো এখন এখানে নেই। এবার অন্তত ঘরে ঢুকতে দাও।” বলে মেসোমহাশয় হেসে দেন।
অপ্রস্তুত হয়ে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ায় অমৃতা । ঘরে ডেকে বসতে দেয় । তারপর বলে ,”আসলে ওনাকে দেখে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম । ভাবলাম বাড়ি চিনলেন কিভাবে ?এখন আমার মাথার ঠিক নেই । এতোগুলো টাকা ক্ষতি হয়ে গেছে তো ! কিভাবে লোন শোধ করবো , ব্যবস্যা ধরে রাখবো এটাই মাথার মধ্যে ঘুরছে। কিছু মনে করবেন না সৌহার্দ্যবাবু।
“এতো চিন্তা করার কিছু নেই । আমরা সবাই তো আছি। একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তাছাড়া সৌহার্দ্য এসেছে। উনি তো আইন কানুন সব জানেন । নিশ্চয়ই কোন না কোন ব্যবস্থা হবে। তুমি এতো ভয় পেয়োনা।”– বলেন মেসোমহাশয়।
সত্যিই সুজাতা আমার প্রকৃত বন্ধু । নিজের এই খুশির দিনেও আমার কথা ভোলেনি । ঠিক ওনাকে পাঠিয়ে দিয়েছে।
“সব তো শুনলে বাবা। এবার বলো ঐ প্রোমোটারকে কিভাবে ধরা যাবে? দেখোনা অনেক গুলো টাকা তো ? অনেক কষ্ট করে এই লোনটা ও পেয়েছিল । আমি তো সব জানি। বড় ভালো মেয়েটা । খুব চেষ্টা করছে নিজের পায়ে দাঁড়াতে ।তার মাঝেই এই বিপত্তি।” বলেন মেসোমহাশয়।
“হ্যাঁ, ওকে ধরা কষ্টকর আছে । কারণ যা কিছু দিয়েছে সব ভুয়ো ডকুমেন্ট। তাই সহজে ধরা হয়তো যাবে না । আর ধরতে পারলেও টাকা পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে । তবে আমি চেষ্টা করবো। এতো ভেঙ্গে পড়লে তো হবে না ম্যাডাম। সাহস রাখতে হবে। তাছাড়া আপনি তো একা লড়বেন বলে এ পথ বেছে নিয়েছেন।
সরি আপনার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলে ফেললাম।” বলে সৌহার্দ্য।
চা নিয়ে এসে বসেছে অমৃতা । আজ আর তার ব্যক্তিগত বিষয় বলে কিছু নেই। সবকিছু সবার সামনে ওপেন হয়ে গেছে। সে সবার চোখে ঘর ভাঙা ডিভোর্সী মেয়ে মানুষ। তাই রাগ করারও কিছু নেই। এই সুজাতা, মেসোমহাশয়ের মত কিছু মানুষ তার প্রকৃত অবস্থা বোঝে। ভাগ্য তাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ।
মুখে বলে “না,না কিছু মনে করবো কেন ? সত্যিই তো একা লড়ে নিজের পরিচয় তৈরী করবো বলেই তো ঘর ছেড়েছি । তাই যে কোন বিপদেই আমাকে শান্ত থাকতে হবে। আপনি চিন্তা করবেন না। বলুন আমাকে কি করতে হবে ?”
“আপনার কাছে যা যা ডকুমেন্টস আছে সব এক কপি করে আমাকে দিন। ওদের এখানে যে অফিস আছে সেখানে নিশ্চয়ই ওনাকে পাওয়া যাবে। যদি পালিয়ে গিয়ে না থাকে। আর ওদের তো চেন থাকে। কাউকে না কাউকে ঠিক ধরা যাবে। তবে কথা দিতে পারছি না কতদিনে ধরতে পারবো আর সব টাকা উশুল করতে পারবো কিনা ?”
ঠিক আছে বাবা, তুমি অন্তত চেষ্টা তো কর। আজ কয়দিন ধরে মেয়েটা বড্ড মন মরা হয়ে আছে। বাইরেও খুব একটা বেরোচ্ছে না । বলেন মেসোমহাশয়।
কথা বলতে বলতেই অমৃতার ফোন বেজে ওঠে । আশ্রম থেকে ফোন। এই সময় ? কি হলো আবার ? উনি কি আবার পাগলামি শুরু করেছেন ? রমাদিকেও কতবার বলেছি আমাকে ফোন না করতে । কিছুতেই শুনছে না । আজ কড়া করে বেশ দুকথা শুনিয়ে দিতে হবে । নাহলে এমন হতেই থাকবে। যে সম্পর্ক মুছে গেছে , এবং বিশেষ করে যার জন্য শেষ হয়ে গেছে সেই সম্পর্ক আজ হাজার বার ডাকলেও আর জোড়া লাগবে না । কেন এটা বুঝতে পারছেন না প্রতিমা দেবী ?
উঠে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে ফোন ধরে অমৃতা।” হ্যালো রমাদি বলো ? কি হয়েযছে ?”
“বলছি অমৃতা তুমি বারন করেছিলে প্রতিমাদির কথা তোমাকে না বলতে। কিন্তু কি হয়েছে বলোতো—?
হঠাৎ মাথাটা গরম হয়ে যায় অমৃতার । ঝাঁঝালো সুরে বলে ওঠে,,—“- কেন ওনার কথা আমাকে বলবে তোমরা ? ওনার তো ছেলে, মেয়ে আছে । তাদের বলো। এ আশ্রম তো আমার নয় । শুধু খাবার সাপ্লাই দেই আমি । ব্যাস, আর কোন সম্পর্ক নেই আমার সাথে। যদি খাবার নিয়ে কোন সমস্যা থাকে, কথা থাকে তবে বলতে পারো। অন্য কোন কথা আমি শুনতে রাজি নয়।”
ফোনের ওপাশে রমাদি থতমত খেয়ে যান ।আসলে অমৃতাকে কখনো এভাবে কথা বলতে শোনেনি । বরং সব সময় দেখেছে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। এই বয়স্ক মানুষগুলোর কাছে এসে পরম মমতায় জানতে চেয়েছে তাদের অসুবিধা। সম্পূর্ণ অন্য রকম দেখেছে অমৃতাকে । তবে আজ কেন এতো রেগে গেল ? আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না ।”
সরি রমাদি । খুব খারাপ ভাবে তোমাকে বলে ফেলেছি। আমি সত্যিই খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আছি । তার জন্য কিছুটা হলেও ঐ মহিলা মানে তোমাদের প্রতিমাদি দায়ী। আজ একটা সত্যি কথা বলি। উনি সত্যিই আমার শাশুড়ি মা ছিলেন। আমি ওনার একমাত্র ছেলের বৌ ছিলাম । পায়ে পায়ে ঘুরতাম ওনাকে খুশি করার জন্য। যা বলতো তাই করতাম । কখনো প্রতিবাদ করিনি। নিজের জন্য কিছুই চাইনি কখনো। আমার ভদ্রতাকে ওরা দুর্বলতা ভেবেছিল। ছেলের কাছে আমাকে বিষিয়ে তুলেছিল নানা রকম কুমন্ত্রণা দিয়ে । ছেলেও কখনো সঠিকটা বিচার করেনি।আমি তাই ঘর ভাঙতে বাধ্য হয়েছিলাম । অথচ দেখো ভাগ্যের কি পরিহাস ? কিছু বছর যেতে না যেতেই ওনাকে এসে উঠতে হলো এই বৃদ্ধাশ্রমে । আবার দেখাও হয়ে গেল ঠিক আমার সাথেই।
কিন্তু বল রমাদি যে সম্পর্ক ভেঙে গেছে তা তো আর জোড়া লাগবে না। উনি আজ হাজার কাঁদলে, হাজার ক্ষমা চাইলেও আমার পক্ষে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। আর যদি এমন করেন তাহলে আমাকেই এখান থেকে চলে যেতে হবে। ”
“আমি শুনেছি অমৃতা, তোমার সব কথা। তুমি যা বলছো সব ঠিক। হয়তো মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আমি হলেও পারতাম না। তবুও আজ তোমাকে একটা খবর দেওয়ার জন্য তোমাকে ফোনটা করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল তোমাকে জানানো উচিত। “বলে রমাদি।
“হ্যাঁ, বলো। আসলে আমি অন্য একটা ব্যপার নিয়ে খুব ব্যস্ত আছি। ঘরে লোক বসে আছেন। অপেক্ষা করছেন ওনারা। একটু তাড়াতাড়ি বলো। “বলে অমৃতা।
রমাদি আমতা আমতা করে বলে যে “আসলে প্রতিমাদির একমাত্র ছেলে, কিডনির অসুখে ভুগছিলেন । আজ সকালে মারা গেছেন । এই খবরটা ওনাকে দেওয়ার পর থেকেই উনি মাঝে মাঝে সেন্সলেস হয়ে পড়ছেন। যখন জ্ঞান ফিরছে তখন বিড়বিড় করে তোমার নাম আওড়াচ্ছেন । তাই ডাক্তারবাবু বললেন তুমি যদি একবার সামনে এসে দাঁড়াও”।
পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যায় অমৃতার । এটা কি হলো?, আমাদের সাথে বনিবনা হয়নি তাই আলাদা হয়ে গেছি। কিন্তু আমি তো আজও রাতুলকে ভালোবাসি। এতোবছর ওর সাথে ঘর করেছি । কত স্মৃতি ! ভুলে থাকার ভান করেছি। ভুলতে তো পারিনি কখনোই। একটা সই কি জীবনের সব কিছু পাল্টে দিতে পারে ? এতো অসুস্থ ছিল রাতুল? তাই হয়তো আর ঝামেলা করেনি। তাড়াতাড়ি ডিভোর্সটা দিয়ে দিয়েছিল? নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল হয়তো। আর ভাবতে পারে না অমৃতা। এখন তার কি করনীয় ?
“এতো চিৎকার করছো কেন অমৃতা ? কি হয়েছে ?কার ফোন এলো? ” ওদিক থেকে ডেকে বলেন মেসোমহাশয়।
চলবে—-
All rights are reserved by Paramita mandal.