নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই পর্ব-২

0
430

নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই। ( পর্ব –২)
কলমে — পারমিতা মন্ডল।

আপনাদের নিশ্চয়ই রায় বাড়ির বড় বৌয়ের কথা মনে আছে ?হ‍্যাঁ, আমি সেই রায় বাড়ির বড় বৌ অমৃতা রায় । যেদিন রায় বাড়ির সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে চলে এসেছি সেদিন থেকে আমি আবার অমৃতা সাহা হলাম। রায় বাড়ির সমস্ত চিহ্ন ধুয়ে মুছে বেরিয়ে এসেছি। শুরু করেছি একলা পথ চলা। এ লড়াই বড় কঠিন লড়াই। কিন্তু জেতা কঠিন নয়। মনের জোর নিয়ে এগিয়ে চলেছি। একদিন নিশ্চয়ই সফল হবো। আপনারা পাশে থাকবেন তো ?

কিন্তু যতটা সহজে বললাম, বেরিয়ে আসা ততটা সহজ ছিল না।নিজের মনের সাথে নিজে অনক লড়েছি। ভেবেছি অনেকবার। যদি মানিয়ে নেওয়া যায় ? কিন্তু সবাইকে মানিয়ে নিতে হয়তো পারতাম যদি দিন শেষে একটি স্নেহ শীতল হাতের স্পর্শ পেতাম, ।একটি ভরসার হাত পেতাম। আমি তো তাও পাইনি। পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবন হলেও আমাদের এখনো কোন সন্তান আসেনি। আমার স্বামী চাইতো না যে এখনই আমাদের সন্তান আসুক। অথচ সবার কাছে আমি দোষী হয়ে যাচ্ছিলাম। সে কিন্তু সব চুপ করে শুনতো। কোন প্রতিবাদ করতো না।

ওরা ভেবেছিল আমি হয়তো এভাবেই সারাজীবন কাটিয়ে দেবো। আমার মত “হাউজ ওয়াইফ ” হয়তো প্রতিবাদ করার সাহসই পাবে না কোন দিন। তাই যেদিন রাতুলের কাছে ডিভোর্সের কথা বলেছিলাম, ও পাত্তাই দেয়নি। হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। অনেক কথা বলেছিল অপমান সুচক। রাতুলও ভাবতে পারেনি যে আমি চলে আসবো।

কিন্তুকেউ যদি নিজের মনের জোর করে বেরিয়েএলেও, পারিপার্শ্বিক অবস্থা আপনার মেরুদন্ড ভেঙে দেবেই। কিছুতেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেবে না। যেমন আমার ক্ষেত্রে হয়েছে। এমনকি আমার নিজের বাবা আমার পাশে দাঁড়ায়নি । সংসার ভেঙে চলে আসা মেয়ের পাশে আমার সম্ভ্রান্ত বাবা দাঁড়াতে লজ্জা পেয়েছে। উনি যেনএকটা অপরাধ বোধে ভুগছেন ,। আমি কেন সংসার না করে চলে এলাম ? এবার তিনি কিভাবে সমাজে মুখ দেখাবেন ?

অথচ দিনের পর দিন যদি মেয়েটি শ্বশুর বাড়িতে কষ্ট পায়, তখন মা-বাবা- হা-হুতাশ করবে । কিভাবে শশুর বাড়িতে আরো ভালো থাকতে পারবে তার জন্য যাদের ক্ষমতা আছে অথবা যাদের নেই, তারা ধার দেনা করে আরো বেশী টাকা জামাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে মেয়ের সুখ ভিক্ষা করবে। কিন্তু তবুও মেয়েটার পাশে দাঁড়াবে না। তাকে মেনে নিতে ও মানিয়ে নিতে বলবে। এবং শেষ পরিনতি অনেকেরই জানা আছে।

অথচ জামাইয়ের পিছনে যে টাকা গুলো দিয়ে সুখ কিনতে চান বাবা- মা সেই টাকা গুলো মেয়েকে দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু হায় রে কপাল ? এই পোড়া দেশের বাবা মায়েরা কবে যে সেটা বুঝবে কে জানে ?

আমার ক্ষেত্রে সেটা আমি হতে দেইনি। আমি অনেক বছর ধ‍রে সংসারকে সুখী করার জন্য শ্বাশুড়ির পায়ে পায়ে ঘুরেছি। যা বলেছেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। ওদের মেয়ের জন্য এক নিয়ম আর আমার জন্য অন্য নিয়ম ছিল। তাও মেনে নিয়ে ছিলাম। কিন্তু ওরা আমাকে “জড় ভরত” বানিয়ে ফেলছিল। আমার কোন স্বাধীনতা ছিল না। ওরা কখনোই আমার কথা ভাবেনি। আস্তে আস্তে আমার সখ- আল্লাদ, ভালো লাগা , মন্দ লাগা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। আমি “যন্ত্র মানবে “পরিনত হচ্ছিলাম। দম দেওয়া পুতুলের মত। তাই ছেড়ে আসতে বাধ্য হলাম। অন্তত স্বামী যদি আমার কষ্ট বুঝতো তাহলেও আর একবার ভেবে দেখতাম। কিন্তু সেও আমাকে ভালো বাসতে পারেননি। শুধু প্রয়োজনে কাজে লাগিয়েছে। আর বিছানার শয্যাসঙ্গিনী করে রেখেছে। তাতে না আছে সন্মান, না আছে ভালোবাসা।

তাই নিজের পরিচয় খুঁজতে আজ আমি বেরিয়ে এসেছি। জানি কাজটা এতোটাও সহজ নয়। আমার মতো হাজার হাজার মেয়েরা মেনে নিয়ে ও মানিয়ে নিয়ে সংসার করছে। অনেকের উপায় নেই, অনেকের আবার সাহস নেই। কারণ সমাজ এখনো ঘর ভাঙা মেয়েদের পাশে দাঁড়ায় না। তবুও সাহস করে বেরিয়ে এসেছি। কারন জীবন তো একটাই। ভালো থাকার অধিকার আমারও আছে । দেখি পারি কিনা , নিজের পরিচয় তৈরি করতে ?

সেদিন রায় বাড়ির বড় বৌয়ের পরিচয় ভেঙে যখন বেরিয়ে আসি, তখন বাবাও আমাকে জায়গা দেয়নি।

বাবা বলেছিল “সমাজে আমার একটা সন্মান আছে । সবাই আমাকে এক ডাকে চেনে। পাড়ায়, অফিসে, বন্ধু- বান্ধবের কাছে মুখ দেখাবো কিভাবে ? তাদের কি বলবো ? তুমি সংসার করতে পারোনি ? ঘর ভেঙে চলে এসেছো ? এতো টাকা পয়সা দিয়ে বিয়ে দিলাম তোমাকে। উচ্চপদে চাকরি করা জামাই আনলাম। আর তুমি কিনা সব ছেড়ে চলে এলে ?এরপর সারাজীবন কি করবে একবার ভেবে দেখেছো ?”

আমি বলেছিলাম –” বাবা আমি চাকরি করবো। লেখাপড়া শিখেছি। ঠিক যে কোন একটা কাজ যোগাড় করে নেবো। তুমি এতো ভেবোনা। মেয়েরা এখন আর এতোটা অসহায় নয়। শ্বশুর বাড়িতে দিনের পর দিন অত‍্যাচার সহ‍্য করে থাকলে তোমাদের ভালো লাগতো ?”ওরা যদি আমাকে প্রানে মেরে দিতো ? এমন ঘটনা যে হয়নি কখনো তা তো নয় ?

পিসিমা বলেছিল –” তবুও ওটা তোমার শ্বশুর বাড়ি। স্বামীর ঘর। ছেড়ে আসা একদম উচিত হয়নি । আমাদের একবার জানাতে পারতে আসার আগে। আমরা বুঝিয়ে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করতাম। মেয়েমানুষের এতো জেদ কিন্তু ভালো নয়। শ্বশুর বাড়িতে অমন একটু -আধটু হয়েই থাকে। মেয়েদের মানিয়ে নিতে হয়।”

বাবা সেদিন বিদ্রুপের হাসি হেসেছিল। বলেছিল –“এতো টাকা খরচ করে ভালো চাকরি করা ছেলের সাথে বিয়ে দিলাম। সংসার করতে পারলে না। সব বিসর্জন দিয়ে চলে এলে। এখন আবার বড় বড় কথা বলছো ? চাকরি করবে ? কে দেবে তোমাকে চাকরি ? চাকরি কি হাতের মোয়া ? যে বললেই পেয়ে যাবে ? আমার মান সন্মান সব বিসর্জন দিয়ে দিল এই মেয়ে ।”

আমি বলেছিলাম–” বাবা আমি তো তোমার মেয়ে। শত্রু নয়। এভাবে কেন বলছো ? ওখানে থেকে যদি আমি অসুস্থ হয়ে পড়তাম বা মারা যেতাম তোমার ভালো লাগতো ? খুশি হতে ?কোথায় তোমরা আমার পাশে দাঁড়াবে তা না করে আমাকে দোষারোপ করছো ? এখন তো দিদিও নেই। আমি তোমার একমাত্র মেয়ে। তবুও মেনে নিতে পারছো না ? মেয়েরা অনেক এগিয়ে গেছে বাবা। শ্বশুরঘরে এভাবে কষ্ট করে কেউ পড়ে থাকে না। যাদের সামর্থ আছে তারা তো চাইবে নিজের মত করে বাঁচতে। আমি ঠিক কোন না কোন কাজ যোগাড় করে নেবো।”

বাবা সেদিন দৃঢ় কন্ঠে বলেছিল –” সমাজ এগিয়েছে বলেই তো এই অবস্থা।এর চেয়ে মরে গেলে তাও সবাইকে বলা যেত মারা গেছে আমার মেয়ে । কিন্তু এখন আমি কি বলবো সবাইকে ?”

এই কথার পর আর এখানে থাকা যায় না । বাবা সমাজকে এতো ভয় পাচ্ছে যে মেয়ের মৃত্যুতেও তার কিছু যায় আসেনা। কিন্তু এই সমাজ তো মানুষেরই জন্য। কেন তবে একটি মানুষ সে নিজের মত করে বাঁচতে পারবে না ? রক্তচক্ষু দেখতে হবে সমাজের ? কেন সে মেয়ে বলে ?আমি সেদিন কন্যা দায়গ্রস্থ বাবার রাগের, কারন বুঝেছিলাম।কিন্তু মানতে পারিনি।

মুখে বললাম–“দেখো বাবা সমাজের কি নিষ্ঠুর পরিহাস ? যদিও দিদি আজ বেঁচে নেই। কিন্তু বেঁচে থাকলেও ওর বিয়ে হয়নি বলে এবাড়িতে থাকতে পারতো। কারো কোন আপত্তি ছিলনা। কিন্তু যেহেতু আমার বিয়ে হয়ে গেছে এবং সেই বিয়ে টেকেনি ।তাই এই বাড়িতে আমার জায়গা হলোনা। আমি তোমার মেয়ে, এটা আমার ও বাড়ি । সেই পরিচয় মিথ্যা হয়ে গেল। আসলে কি জান তো বাবা ? মেয়েদের সত্যিকারের কোন বাড়ি হয়না। যতদিন না সে নিজের রোজগারে নিজের বাড়ি তৈরী করতে পারছে ? তুমি চিন্তা করোনা । নিজের পরিচয় তৈরী করে একদিন ফিরে আসবো তোমার কাছে। নিজের বাড়িও বানাবো একদিন। সেদিন কিন্তু আমাকে মেয়ে বলে অস্বীকার করোনা।

পিসিও সেদিন নিরুপায় ছিল। তাই আমার পাশে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু আর এক মুহূর্ত এখানে থাকা চলে না। এবাড়ি আজ আর আমার নেই। এটা বাবার বাড়ি । আর যেটা ছেড়ে এসেছি ওটা শ্বশুর বাড়ি। তাহলে আমর বাড়ি কোনটি ? সত্যিই তো আমার আজ নিজের কোন বাড়ি নেই। আমাকে আমার নিজের পরিচয় তৈরী করতে হবে।

ধীর পায়ে বেরিয়ে এলাম আমার সব পরিচয় মুছে দিয়ে। খোলা আকাশের নীচে এসে দাঁড়ালাম। আজ আমি না রায় বাড়ির বড় বৌ না সমীরণ বাবুর একমাত্র আদুরে মেয়ে। আজ সমাজের কাছে আমার একটাই পরিচয় –আমি কূলত‍্যাগী,, ঘর ভাঙা এক বেহায়া মেয়েমানুষ। এই পরিচয় আমাকে সেটে দিয়েছে এই সমাজ। এখান থেকে আমাকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। খুঁজে আনতে হবে আমার নিজের পরিচয়। আমি অমৃতা। না কারো বৌ, না কারো সন্তান । এটা আমার নিজের পরিচয়।

চলবে—

All rights are reserved by paramita mandal.
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here