#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___২৪
ব্যাগে কত টাকা আছে চেক করে নিল মিম। সাফারাত গতকাল তাকে দুই হাজার টাকা দিয়েছে। কোনোমতেই নিতে চায় নি ও। সাফারাত যখন বললো ভাই হিসেবে ছোট বোনকে দিচ্ছে তখন আর ফিরিয়ে দিতে পারে নি। মানুষ তো বোনের বিয়েতে গেইট ধরে,জুতা চুরি করে,দুলাভাইয়ের হাত ধুয়ে দেয়। কিন্তু চৈত্রিকার হঠাৎ বিয়ে হবার কারণে এসব থেকে বঞ্চিত হলো মিম। দুপুরে লাঞ্চ করার সময় সাফারাত নিজ থেকেই তাকে বলে ভাইয়ার থেকে টাকা আদায় করার কথা ভুলে গেলে। ইশ!এতো ভালো কেউ হয়?মিম নিমিষেই উৎফুল্ল হয়ে উঠে। তার বোন সত্যিই খুব লাকি সাফারাতের মতো একটা মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে। এবার বোধ হয় চৈত্রিকার জীবনের সকল কষ্টের সমাপ্ত হবে। ব্যাগে একশ টাকা আছে। বাকিটা মায়ের কাছে রেখে এসেছিল মিম। মেয়েটা একদমই অযথা টাকা খরচ করে না। বোনের ত্যাগ তাকেও কঠোর হতে শিখিয়ে দিচ্ছে দিনকে দিন। কলেজ গেইট থেকে কিছুদূরে আইসক্রিম বিক্রি করছে। ভ্যাপসা গরমে আইসক্রিম খাওয়ার তীব্র ইচ্ছে জাগে মিমের। রাস্তা পেরিয়ে অপর পাশে চলে আসে। চকলেট ফ্লেভারের একটা আইসক্রিম কিনে পিছন ঘুরতেই নেত্রদ্বয় ভয়ার্ত হয়ে উঠল। বুক ধরফড় করতে লাগল প্রচন্ড ভয়ে। একটা ছেলে বাঁকা হেসে তাকিয়ে আছে। আরেকটু হলেই প্রায় ছেলেটার বুকের সাথে ধাক্কা লাগত। ছেলেটা হাত বাড়িয়ে আইসক্রিম টা ছিনিয়ে নিল। কামড় বসাতে গিয়ে হালকা হলদে বিশ্রী দাঁতগুলো দেখিয়ে বিদঘুটে হেসে বলে উঠল,
‘ তুই আগে কামড় দে তো। তোর ঠোঁটের স্পর্শ লাগলে আইসক্রিম টা মজা লাগব। আহ!কি সুন্দর গোলাপি তোর ঠোঁট দুইটা। তুই নাহয় থাপ্প/ড় দিছস, আমি তোরে আদর দিমু ওই ঠোঁটে। ‘
শ্রবণগ্রন্থিতে তীব্র শব্দ করে পৌঁছাল প্রত্যেক টা শব্দ। অকস্মাৎ ভোঁতা হয়ে এলো কান দুটো। ঘৃণায় বমি করে দিতে ইচ্ছে করছে। এসব কুপ্রস্তাব মেনে নিতে পারে না মিম। প্রথম যেদিন বাউন্ডুলে,অস/ভ্য রানা নামের এই ছেলেটা রাস্তায় একা পেয়ে প্রেম নয় শয্যাসঙ্গী হওয়ার কুপ্রস্তাব দিয়েছিল সেদিন রাগে নিজেকে সংযত করতে পারে নি মিম। সপাটে এক চড় বসিয়ে দিয়েছিল গালে। এটা প্রায় এক মাস আগেরকার ঘটনা। তারপর আর দেখে নি ছেলেটাকে। এলাকার ছোটখাটো গুন্ডা বলে সম্বোধন করা হয় একে। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা এদের প্রতিনিয়ত অভ্যাস। থাপ্পড় মারার পর থেকে ভীষণ ভয়ে ভয়ে থাকত মিম। বাবা অথবা চৈত্রিকা কাউকে বলার সাহস করতে পারে নি। অবশেষে কলেজে এসে মেয়েদের কানাঘুঁষাতে যখন শুনে রানা কে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে রেপ কেসে মিম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু আজ!সম্পূর্ণ সাহস,স্বস্তি সব কিছুর যেন মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেল।
‘ কিরে আইসক্রিম গলে যাইতাছে তো। ‘
মিম ভয়ার্ত দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকালো। কেউ কেউ ওদের দিকে চেয়ে চলে যাচ্ছে। আবার কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। আইসক্রিম বিক্রেতার দিকে অসহায় চোখে তাকালো। বুড়ো লোক। উনার নিজেরও মিমের সমান একটা মেয়ে আছে। আজ যদি রানার বিরুদ্ধে গলা উঠায় তাহলে উনার মেয়েটা হয়ত আর নিরাপদে থাকবে না। তবুও ভয়ে ভয়ে বললেন,
‘ মেয়েডারে যাইতে দেন স্যার। ভয় পাইতাছে। ‘
রানার দৃষ্টি দেখে আইসক্রিমওয়ালা আর এক মুহুর্তও দাঁড়াল না। গাড়ি ঠেলে চলে যাচ্ছেন দ্রুত। মিম কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে শক্ত কন্ঠে বললো,
‘ আমাকে যেতে দিন। ‘
‘ না দিলে?’
মিম কি বলবে বুঝতে পারছে না। পিছনের ছেলেগুলো দাঁত কেলিয়ে হাসছে। দৌড় দিলে বাঁচতে পারবে তো?আর এতগুলো মানুষ কেউ তার সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে না। মিমের ইচ্ছে করল সবার মুখে থুতু দিতে। আজকাল কারো বিপদে কেউ এগিয়ে আসে না। উল্টো রং তামাশা করে। মিম দৌড় দেবার জন্য প্রস্তুত হতেই রানা খপ করে হাত ধরে ফেলল। দাঁতে দাঁত কেটে বললো,
‘ শা*লী রে গাড়িতে তোল। চড়ের শোধ টা বিছানায় লইমু। ‘
হাত পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে মিমের। রীতিমতো কাঁপছে ও। রানার পিছনের একটা ছেলে আরেক হাত ধরতেই মিম চিৎকার দিতে চাইল। কিন্তু প্রচন্ড ভয়ের চোটে গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছে না।
দিহান মিম কে দেখার জন্য অফিসের একটা মিটিং শেষ করে ছুটে এসেছে। এসে এমন কিছু দেখবে ঘুণাক্ষরেও ভাবে নি সে। মস্তিষ্ক ধপ করে জ্বলে উঠল। গাড়ি থেকে বের হয়ে দৌড়ে এসে দাঁড়াল মিমের পাশে। চোখের পলকে রানা ও পাশের ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মিমকে নিজের কাছে টেনে নিল। ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া মিম পরিচিত কারো সান্নিধ্য পেয়ে ঝাপটে ধরল। দিহানের শার্ট আঁকড়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। পিঠের উপর আলতো করে হাত রেখে দিহান আশ্বাস দেয়। রানা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল,
‘ শা*লা তোর সাহস হইল কেমনে আমারে ধাক্কা দেওয়ার। আবার আমার জিনিস কাইড়া নিয়া বুকে জড়াও।
দিহান রাগল না। বরং স্মিত হাসল। মিম কে নিজের থেকে আলাদা করতে চাইলে আরো জড়োসড়ো হয়ে বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলল মিম। এটা যেন ওর ভরসার স্থান। দিহানও আর চেষ্টা না করে ধরে রেখে বললো,
‘ ও কোনো জিনিস না। আমার ভবিষ্যৎ ও। আরেকবার স্পর্শ করে দেখাস তোকে জেলে পচিয়ে মারব আমি। তোর মতো ছোটোখাটো গুন্ডা কিভাবে হ্যান্ডেল করতে হয় তা দিহান চৌধুরী বেশ ভালো করে জানে। ‘
রানার পিছনের ছেলেটা ছুরি বের করতেই হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেয়।বুঝতে পারে দিহান খুব পাওয়ারফুল লোক। তাই এই মুহুর্তে কোনো রিস্ক না নিয়ে কেটে পড়ল। মিম কে এক হাতে আঁকড়ে ধরে আশেপাশের এক লোক থেকে রানার সব ডিটেইলস জেনে নেয়। ছোট্ট একটা মেসেজ করে সাফারাতকে। মিম কে গাড়িতে বসাতে গিয়ে বাঁধে আরেক বিপত্তি। কিছুতেই ছাড়ছে না দিহানকে। যেই মেয়ে অন্য সময় দিহানের ছায়াটা সহ্য করতে পারত না, এখন ভয়ে ছাড়ছেই না। দিহান হাল ছেড়ে বললো,
‘ তুমি কি চাও তোমাকে কোলে নিয়ে ড্রাইভ করি?তাহলে কিন্তু তা তোমার জন্য মঙ্গলকর হবে না। আমিও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ব। তুমিও। ‘
দিহানের কথার মানে বুঝতে সময় লাগল না মিমের। শার্ট ছেড়ে সিটে বসল। চক্ষুকোটর হতে অবাধে গড়িয়ে যাচ্ছে জল। দিহান ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। অতঃপর নিঃশব্দে টেনে মিম কে আঁকড়ে ধরে এক হাতে৷ মিম টু শব্দ টুকু করে নি। বাড়ির গেইটের সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ যেতে পারবে?’
‘ হুম। ‘
দরজা খুলে নামতে নিলে দিহান হাতের উপর হাত রাখে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে ধরে মিম।
‘ শুনো, এখন থেকে রেগুলার আমি তোমাকে দিয়ে আসব। আসার সময় আমি নিয়ে আসব। ‘
মিম আমতা আমতা করে প্রশ্ন করে,
‘ কেন?’
‘ কেন এর উত্তর টা আজ তোলা থাকুক। একদিন তুমি নিজেই উত্তর খুঁজে পাবে। সাবধানে যেও। আমি অলওয়েজ থাকব তোমার আনাচে-কানাচে মিম ডিম। ‘
মিম ডিম ডাকে কপট রাগ হলেও তা প্রকাশ করে নি মিম। অজানা কারণেই আজ দিহান কে ভালো লাগছে তার। ভীষণ ভালো লাগছে। হতে পারে দিহান তার সম্মান রক্ষা করেছে বলে নয়ত জীবনে প্রথমবার কোনো পুরুষের খুব কাছাকাছি গিয়েছে বিধায়। ভরসা খুঁজে পেয়েছে বলে। গাড়ি থেমে নেমে টলমল পায়ে অনেকখানি এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখে দিহানের এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। দৌড়ে গাড়ির কাছে এলো মিম। জানালার দিকে ঝুঁকে মিহি স্বরে বললো,
‘ ধন্যবাদ। ‘
_______________
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। ঠান্ডা বাতাস বইছে সমস্ত প্রকৃতি জুড়ে। প্রতিদিন বৃষ্টি ভালো লাগে না চৈত্রিকার। মিমের গায়ে কাঁথা মেলে দিয়ে বিছানা ছাড়ল। রাতে জ্বর এসেছে মিমের। জ্বরটা যে ভয়ের তাড়নায় দিহান ফোন করে না জানালে কখনও জানতেই পারত না চৈত্রিকা। সবটা ওর অগোচরেই থেকে যেত। দিহান সবকিছু খুলে বলে ও মিমকে রেগুলার নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসার অনুমতি চায়। চৈত্রিকা উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারছিল না। তবে সাফারাত সায় দিল। তাই আর না করতে পারে নি। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই ফোন বেজে উঠে। ঝটপট রিসিভ করতেই সাফারাত ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,
‘ শালী সাহেবার জ্বর কমেছে? ‘
‘ হু। ‘
‘ অফিস যাবেন তো আজ?’
গতরাতে জবের জন্য সিলেক্ট করা হয়েছে এটার মেসেজ এসেছিল। চৈত্রিকা ছোট্ট করে জানালো,
‘ যাবো। আপনি?’
‘ আজ অফিস যাওয়াটা অনেক জরুরি। বিয়ে করেও বউকে যখন কাছে পাচ্ছি না। মুখদর্শনের জন্য হলেও অফিসে যেতে হবে চৈত্র মাস। ‘
হাত ফসকে মোবাইলটা ফ্লোরে ছিটকে পড়ল। বুকটা প্রচন্ড গতিতে ধুকপুক করছে চৈত্রিকার। ‘ চৈত্র মাস?’ ঠিক শুনেছে তো?শিরদাঁড়া বরাবর শীতল স্রোত বয়ে গেল। মোবাইলটা পড়ে আছে অবহেলায় মেঝেতে খন্ড খন্ড হয়ে।
পুরোনো ছাতাটা মেলে চৈত্রিকা গেইট অব্দি এলো। পড়নের কালো সুতির ড্রেস টা হালকা ভিজে গেছে বৃষ্টির ছিটায়। বৃষ্টি হবার কারণে গাড়ি,রিকশার চলাচল নেই তত একটা। চৈত্রিকা চিন্তায় পড়ে গেল কিভাবে যাবে। তাৎক্ষণিক তার চিন্তার অবসান ঘটিয়ে সাদা একটা গাড়ি হাজির হয়। প্রথমত চৈত্রিকা হকচকিয়ে যায়। পরক্ষণেই গাড়ির দরজা মেলে সাফারাতের গাড়ির ড্রাইভার কে দেখে ধাতস্থ হয়।
‘ আসসালামু আলাইকুম ম্যাম। স্যার আপনাকে অফিসে নিয়ে যেতে বললো। ‘
কথাটা বলেই ড্রাইভার নিজের হাতের মোবাইলটা এগিয়ে দেয়। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কানে ধরে ফোন টা চৈত্রিকা। অপরপাশ হতে ভেসে আসে হৃদয় নিংড়ে দেওয়া ক্রুদ্ধ কন্ঠস্বর।
‘ মোবাইল কোথায় আপনার?’
‘ হাত থেকে পড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ‘
‘ আচ্ছা আসুন। ‘
চৈত্রিকা মোবাইলটা ড্রাইভারের হাতে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। বৃষ্টি বেড়েছে। ইচ্ছে করেই জানালা টা লাগাল না। বৃষ্টির ফোঁটা ছুঁয়ে দিচ্ছে মুখ। চোখ বুঁজে বৃষ্টির আলিঙ্গন উপভোগ করছে চৈত্রিকা। চারপাশে বইছে সুখময় হাওয়া,অনিল।
মোনা মুগ্ধ চোখে অবলোকন করে যাচ্ছে সাফারাতকে এক নাগাড়ে। আজ সাদা শার্টের উপর হালকা নীল একটা ব্লেজার পড়েছে সাফারাত। ফর্সা মুখে চাপদাড়ি তার সৌন্দর্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। চোখ দিয়ে এক প্রকার গিলে খাচ্ছে মোনা সুদর্শন এই পুরুষকে। সাফারাত মোবাইলের দিকে নজর রেখেই গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
‘ চোখের দৃষ্টি সংযত করুন মিস মোনা। নয়ত গিয়ে আপনার রিজাইন লেটার তৈরি করুন। ‘
মোনার ফর্সা চেহারায় কালো আঁধার ছেয়ে গেল মুহুর্তেই। সে ভাবতেই পারে নি সাফারাত বুঝে ফেলবে। থমথমে মুখে বললো,
‘ স্যরি স্যার। ‘
‘ লিভ। ‘
‘ ইয়েস স্যার। ‘
মলিন মুখে বেরিয়ে যায় মোনা। সেদিকে চেয়ে সাফারাত চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিল। মুখের সামনে মোবাইলটা ধরে চোখ দুটো স্থবির রাখল স্ক্রিনে। চৈত্রিকা দাঁড়িয়ে ভাবনায় মগ্ন। একপাশ হতে ওর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি দৃশ্যমান। ছবিটা প্রায় অনেকদিন আগের তোলা। সাফারাত ঠোঁট বাকিয়ে হাসল। মুগ্ধ কন্ঠে উচ্চারণ করে,
‘ আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে চৈত্র। অনেক বড় সারপ্রাইজ,চমক,ধাক্কা। ‘
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)