#আমার_ভুল পর্বঃ৪
অরিত্রিকা আহানা
আব্বাকে বাগে আনতে না পেরে প্রিন্স ভাইয়ার বাবা মানে আংকেল আমাদের আত্মীস্বজনদের ধরলেন। তারাও আংকেলের কথামত আব্বাকে রাজি করানোর জন্য আদাজল খেয়ে নেমে পড়লেন।
সবাই মিলে আব্বাকে বোঝালেন ছেলে ভালো। পরিবার ভালো। এখানে বিয়ে হলে আমি সুখি হবো। উনারা মাটির মানুষ। আমার কোন অযত্ন হতে দেবেন না।
আব্বা ছেলের রাগের বিষয়টা তুললেন। সবাই হেসে উড়িয়ে দিলেন আব্বার কথা। ইয়াং বয়সের ছেলেপুলে একটুআধটু রাগ না থাকলে হয়! এই নিয়ে এত চিন্তা করার কি আছে। ভাগ্যে সুখ থাকলে কেউ ঠেকাতে পারবে না। আব্বা যেন আর বেশিকিছু না ভেবে বিয়েতে রাজি হয়ে যান।
মেয়ের বাবা হলে সিদ্ধান্ত নেওয়া যে কত কঠিন সেটা আমি আব্বাকে দেখে প্রথমবারের মত বুঝতে পারলাম। এই বিয়ের ব্যাপারে সবাই সবার মত করে মতামত দিচ্ছে শুধু আব্বা ছাড়া। আব্বার কোন স্যে নেই। ভেতরে ভেতরে টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন।
একদিকে আংকেলকে কথা দিয়ে এসেছেন অন্যদিকে আমার ভবিষ্যৎ। আমি ভালো ছাত্রী। ভালো একটা ক্যারিয়ার গড়ে নেওয়া আমার জন্য কঠিন কিছু নয়। আংকেল যদিও কথা দিয়েছেন আমার পড়ালেখায় কোন ব্যঘাত ঘটতে দেবেন না।
কিন্তু আব্বার চিন্তা অন্য জায়গায়।
মেয়ে হিসেবে আমি কতটা বাধ্য সেটা আব্বা জানে। আর জানেন বলেই আব্বার চিন্তা এত বেশি। যেই মেয়ে সারাজীবন বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে ধৈর্য ধরে এসেছে, নির্দ্বিধায় বাপের নেওয়া সকল সিদ্ধান্ত মেনে এসেছে সেই মেয়ের যদি কোন ক্ষতি হয়ে যায় এই সিদ্ধান্তে। বিয়ের সিদ্ধান্ত যদি আমার জন্য সঠিক না হয়! পাত্রপক্ষ যদি পরে তাদের কথা না রাখে!
ভবিষ্যতে যদি কোনদিন আমার এই ভেবে আফসোস হয় যে, ভালো ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও আব্বা আমাকে পড়ালেন না! শুধুমাত্র মেয়ে ভেবে অবহেলা করেছেন!
এসব ভেবে আব্বা অস্থির হয়ে পড়লেন।
এতদিন যদিও সবাইকে বলেছেন ভালো ছেলে পেলে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবেন কিন্তু সত্যি সত্যি যখন বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলো তখন আর সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না।
দিনরাত আমাকে নিয়ে টেনশন করতে করতে চোখের ঘুম হারাম করে ফেললেন। উনার অবস্থা দেখে মা ভাইয়া সবাই চিন্তায় পড়ে গেলো। এই বয়সে এত টেনশন। শেষে কোন অঘটন ঘটে গেলে!
নিরুপায় হয়ে মা হাল ধরলেন। আব্বার মাথায় হাত রেখে আব্বা বোঝালেন,’তোমার মেয়ে। কি করলে ভালো হবে সেটা তোমার চাইতে আর কেউ ভালো বুঝবে না। অনেকে অনেক কথাই বলবে। কারো কথায় কান না দিয়ে নিজের যেটা ভালো মনে হয় সেটাই করো। আমরা আছি তোমার পাশে। তোমার মেয়ে তোমার কথার বাইরে যাবে না।’
আব্বা মায়ের কথা শুনে আশ্বস্ত হলেন। জীবনে যতবার আব্বাকে কোনকিছু নিয়ে ঠেকতে দেখেছি সেখানেই আমার মাকে গিয়ে হাল ধরতে দেখেছি। কোনদিন আব্বাকে কোনকিছুতে একা ছেড়ে দেন নি। সব সমস্যায় দুজনে একসাথে লড়েছেন।
পরেরদিনই আব্বা গিয়ে আংকেলের সঙ্গে দেখা করলেন। নানারকম কথাবার্তার পর বিয়ের প্রসঙ্গটা তুললেন। আংকেল বেশ উৎসাহিত হয়ে আছেন বুঝতে পেরে সরাসরি বারণ না করে অন্যভাবে কথা তুললেন,
-‘আমার মেয়েটা এখনো অনেক ছোট ভাই। ওর সাথের ওর বড় বোনগুলোরও এখনো বিয়ে হয় নি। সবাই পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত। আমার বড় ছেলে রোজ বকাবকি করে। সে বিয়ের কথা শুনতেই রাজি নয়। তার আশা বোনকে অনেক দূর পড়াবে। মেয়েতো আমার মাশাআল্লাহ মেধাবী। আশা আছে ডাক্তারী পড়াবো। বাকি আল্লাহর ইচ্ছা। মেয়ের মায়েরও তাই মত। এখন আপনি আমাকে বুদ্ধি দিন ভাই আমি কি করবো?’
আব্বা যে বিয়ের ব্যাপারে পিছিয়ে গেছেন সেটা উনার কথা শুনেই আংকেল বুঝে গেলেন। উনি অনেক ভাবে আব্বাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন বিয়ের পর আমার পড়াশোনার কোন ক্ষতি হবে না। উনারা সাধ্যমত চেষ্টা করবেন। কিন্তু আব্বা নিজের সিদ্ধান্তে অটল। আংকেলের হাত চেপে ধরে বললেন,
-‘আপনি আমাকে বাঁচান ভাই। আমাকে মেয়েটাকে বদদোয়া দেবেন না। ভাগ্যে থাকলে আপনার ছেলের জন্য অনেক ভালো মেয়ে পাবেন। আমি দোয়া করি। আপনি মনে কষ্ট রাখবেন না।’
শেষমেশ আব্বার সিদ্ধান্তের কাছে আংকেল হার মেনে গেলেন। নানারকম কথাবার্তা বলে আব্বা উনাকে নরম করে ফেললেন। মেয়ে উনারও আছে। প্রাপ্তি পড়ালেখায় আগ্রহী হলে উনি নিজেও এত তাড়াতাড়ি ওর বিয়ে দিতেন না।
অতএব বিয়ের পর্ব নিয়ে জল্পনাকল্পনার এখানেই সমাপ্ত হলো। আমি মন দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য পড়ালেখা শুরু করে দিলাম।
প্রিপারেশন ভালোই ছিলো। মাঝখানে বিয়ের বিষয় ঝামেলা হওয়ায় কিছুদিন সময় নষ্ট হয়েছিলো। তাই মেডিকেলে চান্সটা হলো না। কিন্তু দেশের নামকরা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম। মেডিকেলে ভর্তি না হতে পারার দুঃখ কেটে গেলো। আব্বা নিজে গিয়ে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দিলেন।
ভেবেছিলাম প্রিন্স ভাইয়ার পর্বটাও বিয়ের সাথে সাথে সমাপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু না। নতুন করে সূচনা হলো আমি সেকেন্ড ইয়ারে থাকাকালীন।
আমার দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টার শেষ এই সময়ে উনি আমাদের ডিপার্টমেন্টে জয়েন করলেন। প্রাপ্তির কাছে আমি আগেই শুনেছিলাম উনি ভার্সিটিতে জয়েন করার জন্য অনেকদিন থেকে চেষ্টা করছেন। আমাদের বিয়ের কথা উঠবারও আগে থেকে। শেষমেশ সুযোগটা পেয়ে গেলেন। অবশ্য এতে আমার নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের কোন পরিবর্তন ঘটলো না।
আমি আমার মত করে ভার্সিটিতে যাই। পড়াশোনা করি। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মেলামেশা করি।
উনাকে দেখতে পাই। উনি উনার মত করে স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করেন। উনার দিক থেকে আমি এমন কোন চেষ্টা দেখতে পাই নি যাতে করে আমার মনে হতে পারে হি ইজ এক্সেপ্সনাল। অর হি ইজ কুল ইনাফ!
উনি সাধারণ। খুবই সাধারণ। এতই সাধারণ যে কেউ চিন্তাও করতে পারবে না।
ভার্সিটির বাইরে রিক্সা না পেলে কোনদিন আমাকে রিক্সায় তুলে দেন নি, বর্ষবরণের দিন আমাকে দেখে মিটিমিটি হাসেন নি কিংবা পরীক্ষায় এটেন্ড করতে না পারলে বাড়তি কোন সুবিধা দেন নি।
আবার আমার সঙ্গে অপরিচিতের মত ব্যবহারও করেন নি। বাকি সবার মত আমারও পড়া ধরেন, ভালো লিখলে ভালো মার্কস দেন, সালাম দিলে স্বাভাবিকভাবে সালামের জবাব দেন।
আমি মাঝেমাঝে অবাক হয়ে যায়। এই মানুষটা সত্যিই আমাকে ভালোবেসেছিলো? নাকি শুধু জেদের বশবর্তী হয়েই বিয়ে করতে চেয়েছিলো।