#আমার_ভুল পর্বঃ৫
অরিত্রিকা আহানা
পড়াশোনায় আমি বরাবরই ভালো। ভার্সিটিতে উঠেও সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। শত ঝামেলার মাঝেও রোজ পড়তে বসি। এই একটা জিনিসে কখনো আমার মনোযোগের হেরফের ঘটে নি। বলা চলে বেশ কৃতিত্বের সাথেই সাড়ে তিনবছর শেষ করেছি। বাকি আছে শুধু ফাইনাল সেমিস্টার। তারপরই গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট।
সবাই মোটামুটি ধারণা করে নিয়েছে এবছর ডিপার্টমেন্ট থেকে রাষ্ট্রপতি পদক আমিই আনবো। অ্যাভারেজ রেজাল্ট হিসেব করলে আমার রেজাল্টই সবার চাইতে ভালো।
আব্বাকে খবরটা দিলাম। ভীষণ খুশি হলেন। জিজ্ঞেস করলেন বাড়ি যাবো কবে। আমি ঠিকমত কিছু বলতে পারলাম না। সেমিস্টারের পড়া বাকি আছে। পরীক্ষার রুটিনও দিয়ে দিয়েছে।
ইতস্তত করে বললাম,’সেমিস্টার তো এখনো শেষ হয় নি। একটা রিসার্চ আর্টিকেল এর ও কাজ বাকি আছে। সেটা শেষ না করে বাড়ি ফিরতে পারবো না।’
আব্বা আপত্তি করলেন না। শুধু বললেন পড়াশোনায় যেন কোন ব্যাঘাত না ঘটে।
★
প্রিন্স ভাইয়ার সাথে সপ্তাহে আমাদের দুটো ক্লাস। মানে সপ্তাহে দুদিন অন্তত উনার সাথে আমার দেখা হয়। প্রথমদিকে আমি বেশ অস্বস্তিতে ছিলাম। ভাইয়া ডাকবো না স্যার ডাকবো এই নিয়ে কনফিউশন। ভাববাচ্যে কথা চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু পরে আস্তে আস্তে ‘স্যার’ ডাকা শুরুর করি। ক্লাসরুমে ভাইয়া ডাকা নিশ্চয়ই শোভনীয় দেখাবে না।
শানিবার, ডিপার্টমেন্ট বন্ধ।
লাইব্রেরিতে বসে পড়ছিলাম। পরীক্ষার যেহেতু রুটিন দিয়ে দিয়েছে তাই হাতে আর বেশি সময় নেই। পি এল এর সময়টাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে। নইলে ভালো রেজাল্ট এর আশা করা বোকামি। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম অন্য কাজে সময় ব্যয় কমিয়ে দিয়ে পড়াশোনায় সময় বাড়িয়ে দিতে। কিন্তু মাঝেমাঝে না চাইতেও সময় নষ্ট হয়
ফোন রিংটোনের মৃদু আওয়াজে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলো। প্রাপ্তির নাম্বার থেকে কল এসেছে।
বান্ধবীদের সঙ্গে আমার আগের মত আর যোগাযোগ নেই। সবার বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত সবাই। প্রাপ্তির সাথে প্রথম প্রথম কথাবার্তা হতো। কিন্তু প্রিন্স ভাইয়ার ঘটনাটার পর থেকে সে ও যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো। বেশ কিছুদিন আমার সঙ্গে কোন কথা বলে নি। তারপর আস্তে আস্তে আবার যোগাযোগ শুরু করলো। এবার অনেকদিন বাদে ফোন করেছে। ভালো লাগলো।
হাসিমুখে ওর স্বামী সংসারের কথা জিজ্ঞেস করলাম। প্রাপ্তিও আমার সাথে বেশ হাসিখুশি ভাবে কথা বললো।
কিন্তু ফোন ছাড়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে ও হঠাৎ প্রিন্স ভাইয়ার প্রসঙ্গটা তুলে বসলো। আমাদের ইউনিভার্সিটির বাংলা ডিপার্টমেন্টের এক ম্যামের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো প্রিন্স ভাইয়ার। কিন্তু উনি রাজি না থাকায় বিয়েটা ভেঙ্গে যায়। প্রাপ্তির কন্ঠে আফসোস। নিঃস্পৃহ গলায় বললো,
-‘ভাইয়াটাকে নিয়ে আমরা ভীষণ চিন্তায় আছি রে কিরণ। কি যে হলো ওর। বিয়ের নাম মুখেও আনতে চায় না। বাবা মা কত করে বোঝায়। কিন্তু কিছুতেই কোন লাভ হয় না। ও কি সত্যি সত্যিই আর বিয়ে করবে না?’
প্রাপ্তি যেন প্রশ্নটা নিজেকেই করেছে। ওর কন্ঠে হতাশা, আক্ষেপ আর ভাইয়ের জন্য অপরিসীম ভালোবাসা। প্রিন্স ভাইয়াকে উনার বাসার সবাই ভীষণ আদর করে।
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। খারাপ লাগছে। কিন্তু কিছু করতেও পারছি না। ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম,’কেন করবে না? অবশ্যই করবে। তুই দেখিস আল্লাহ উনার জন্য অনেক উত্তম জীবনসঙ্গী নির্ধারন করে রেখেছেন।’
প্রাপ্তি আমার কথায় সায় জানিয়ে ফোন রেখে দিলো। আমি ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিলাম। কিন্তু পড়াশোনার মাঝেও প্রাপ্তির বলা কথাগুলো আমার মাথায় ঘুরতে লাগলো। নিজেকে অসহায় লাগছিলো।
শেষমেশ মাকে ফোন করে জানালাম। মা ও আফসোস করে বললেন,’তোর আব্বাকে সেদিন বলছিলাম ছেলেটার জন্য আমারও মায়া হয়। এত সুন্দর ছেলে মাশাআল্লাহ। কিন্তু কি করবো বল! তোর বাপ ভাই তো বিয়ের নাম শুনতেও রাজি নয়। তাছাড়া তোর পড়াশোনা তো শেষ হয় নি।’
আমি চুপ করে রইলাম। মায়ের কথা শুনে মনে হলো উনি আস্তে আস্তে প্রিন্স ভাইয়ার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছেন। গলায় আন্তরিক মমতা ঢেলে দিয়ে বারবার আল্লাহর কাছে প্রিন্স ভাইয়ার জন্য একটা উত্তম জীবনসঙ্গী প্রার্থনা করলেন। আমিও মনে মনে তাই দোয়া করলাম।
★
প্রায় দেড়মাসের মতন আমার পরীক্ষা চললো। ভালোভাবেই গ্র্যাজুয়েশন লাইফের ইতি টানলাম। ঠিক যেমনটা আশা করেছিলাম তেমনভাবে। রেজাল্ট বেরোনোর আগ পর্যন্ত মোটামুটি তিনমাসের মত ছুটি। আব্বা এসে আমাকে বাড়িতে নিয়ে গেলেন।
ছুটির দিনগুলো আমার বাড়িতে বসেই কাটছিলো। এর মাঝেই হঠাৎ একদিন মা খবর দিলেন প্রিন্স ভাইয়ার বাবা আবার ধরেছেন আব্বাকে। আমি চুপ করে রইলাম।
সিনেমায় নায়িকাদের মত শেষমুহূর্তে গিয়ে নায়কের প্রেমে পড়ে বাবাকে অস্বীকার করে এমন কোন ঘটনা আমার সঙ্গে হলো না। আমি শেষমুহুর্ত পর্যন্ত আমার আব্বার বাধ্য ছিলাম। আব্বা নিজের ইচ্ছেতেই আমাকে প্রিন্স ভাইয়ার হাতে তুলে দিলেন।
আসলে প্রিন্স ভাইয়ার জন্য আমার অনুভূতি কি ছিলো সেটা আমি কখনো তলিয়ে দেখতে যাই নি। যতবারই আমার উনার কথা মনে পড়েছে আমি মনকে জোরপূর্বক অন্যদিকে বিক্ষিপ্ত করে নিয়েছি। ভয়ে কখনো নিজের মনকে প্রশ্ন করতে যাই নি উনার প্রতি আমার কোন দুর্বলতা আছে কিনা!
সব কিছুর আগে আমার প্রথমে আব্বার কথা মনে পড়েছে। আব্বা ছেলেমেয়েদেরকে নিজের চাইতেও বেশি বিশ্বাস করেন। আমরা সেই বিশ্বাস ভঙ্গ করলে উনি সহ্য করতে পারবেন না। সেইজন্য আমরা তিন ভাইবোনই কোনদিন আব্বার অবাধ্য হই নি।
বিকেল বেলা বাইরে থেকে এসে আব্বাও একই কথা বললেন। প্রিন্স ভাইয়ার বাবা আবার আব্বার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। বারবার করে অনুরোধ করছেন আব্বাকে বিয়েতে রাজি হয়ে যাওয়ার জন্য। তাদের একটাই যুক্তি এখন তো আর আমার পরীক্ষার ঝামেলা নেই। তাহলে এখন রাজি হতে আব্বার সমস্যা কোথায়?
আব্বার কথা শুনে যা বুঝলাম তাতে মনে হলো প্রিন্স ভাইয়ার সঙ্গে বিয়েটা বোধহয় এবার হয়েই যাবে! আর কত ঘোরাবেন! চার বছর! কম সময় তো নয়। আব্বা নিজেও মায়ায় পড়ে গেছেন। প্রসন্ন গলায় আংকেলের সঙ্গে আলাপ আলোচনার বিস্তারিত বর্ণনা করলেন মায়ের কাছে।
ডাইনিং এ বসে আমিও শুনলাম। নিজের অজান্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এতদিন বাদে সাহস করে নিজেকে নিজে বলতে পারলাম ঐ মানুষটাকে আমি অবচেতন মনে নিজের করে চেয়েছি। শুধুমাত্র আব্বার সম্মতির অপেক্ষায় স্বীকার করতে পারি নি।
এই সম্মতিটুকু না পেলে হয়ত সারা জীবনেও আমি একথা স্বীকার করতাম না।
একমাসের মাথায় উনার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। ডিপার্টমেন্টে ছাত্রী বিয়ে নিষিদ্ধ।একধরণের অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা আমাদের চেয়ারম্যান স্যারের পক্ষ থেকে।
প্রিন্স ভাইয়া আমার মাস্টার্স এর কথা চিন্তা করে চাকরী ছেড়ে দিলেন। বিয়ের আগে তাড়াহুড়ো করে একটা বেসরকারি কলেজে লেকচারার হিসেবে জয়েন করলেন। বেকার অবস্থায় তো আর বিয়ে করা যায় না।
আমাদের বিয়েটা একেবারে ঘরোয়াভাবে হলো। আব্বার ইচ্ছা আমার রেজাল্ট বেরোলে একসাথে ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করবেন। আংকেলও রাজি হয়ে গেলেন। তাই বিয়ের দিন দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর উনারা বাসায় চলে গেলেন।
পরেরদিন প্রান্ত, প্রাপ্তি আর বেশকয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে প্রিন্স ভাইয়া এলেন। এসেই মা ভাবিদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। আব্বাও আশেপাশে ছিলেন।
উনি যেন আব্বাকে দেখেই ইচ্ছে করে ‘আমার বউ, আমার বউ’ কথাটা বেশি বেশি করে বললেন। হয়ত এতদিন উনাকে ওয়েট করিয়ে রাখার রাগ মেটাচ্ছেন।
আব্বা হাসেন। মাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
-‘অবস্থা দেখছো? ইচ্ছে করে এমন করেছে। সে কি বোঝাতে চাইছে তার বউয়ের ওপর বাপের কোন অধিকার নেই?’
মা জবাব না দিয়ে মুখটিপে হাসলেন। আমি নিরব দর্শকের মত এদের শ্বশুর জামাইয়ের খোঁচাখুঁচি দেখলাম। ভালোই লাগে। কেউ কারো চেয়ে কম নয়। যেমন শ্বশুর তেমনি তাঁর জামাই।