#আমার_ভুলপর্বঃ১৩
অরিত্রিকা আহানা
আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো জীবন সম্পর্কে নিজের উপলব্ধি। জীবনে সুখের মানে আমার কাছে একেক বার একেক রকম হয়ে দাঁড়ায়। আমি এখনো জানি না ঠিক কি করলে প্রকৃত সুখ নামক জিনিসটার সন্ধান পাওয়া যায়।
কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমার মনে হচ্ছে প্রাপ্তির মত মেয়েগুলোই জীবনে সুখি হতে পারে। কারণ ওরা ভালো খারাপ সব দিক মিলিয়ে ব্যালেন্স করতে জানে। কিন্তু আমি জানি না।
পাঁচবান্ধবীরদের যেই গ্রুপটার কথা আমি বলেছিলাম সেখানে আমার বাকি তিন বান্ধবীদের সঙ্গে স্বভাবচরিত্র, পড়াশোনার যথেষ্ট অমিল ছিলো।
এতদিন আমি বুঝতে পারি নি। ভেবেছিলাম বাচ্চাকাল থেকে ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব তাই এত এত অমিল থাকা সত্ত্বেও সম্পর্কটা টিকে আছে। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি ওদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা টিকে থাকার আসল কারণটা ছিলো প্রাপ্তি। ও আমার আর আমার বাকি তিন বান্ধবীদের মাঝখানে মধ্যস্থতার দেওয়াল হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিলো। ব্যালেন্স করে দিতো সবকিছু।
জীবনে ভারসাম্য ছাড়া চলাটা আসলে খুবই মুশকিল। একতরফা কোনকিছুই ভালো নয়। এখন আশেপাশে তাকালেই দেখি আমার মতন অনেক উচ্চশিক্ষিত, লেখাপড়া জানা মেয়েরা বাইরে কাজ করছে। আবার সংসারও সামলাচ্ছে। খুব সুন্দরভাবে দুটো দিক ব্যালেন্স করে চলছে ওরা। ওদের সবার স্বামীই যে স্ত্রীদের চাইতে উচু স্তরের কর্মচারী এমন কিন্তু নয়। অনেকেই আছেন স্ত্রীদের অধীনস্থ হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু তারপরেও ওরা সুখি।
কারণ, ওরা লোকে কি বলে এসব নিয়ে থোড়াই কেয়ার করে না। ওদের কাছে নিজের জীবন, নিজের সংসার, নিজের সুখ সবার আগে।
অথচ এতদিন এসব আমার নজরে পড়ে নি। এতদিন আমি বড় বড় বাড়িওয়ালা, গাড়িওয়ালা, স্বামীদেরই যোগ্য ভেবে এসেছি। যাদের টাকাপয়সা, পদমর্যাদাই ছিলো স্ত্রীদের একমাত্র অহংকারের কারণ।
আসলে মানুষ এমনই। যা সে ভাবে, তাই দেখে। এতদিন আমার অবচেতন মন ভেবেছিলো এসব নেই বলেই আমি অসুখী। তাই এসবই আমার চোখের সামনে এসেছে।
কিন্তু আসল কথাটা হলো, আমি যদি সত্যিকার অর্থে নিজেকে সুখি ভাবতে পারতাম তাহলে আশেপাশে চোখ বোলালেই দেখতে পারতাম এমন হাজারো সুখি দম্পতি যাদের কাছে সুখ মানে অন্যের তাক লাগানো বাড়িগাড়ির বহর নয় বরং স্বামী স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা, বোঝাপড়া এবং শ্রদ্ধাবোধ। এসবই মাঝেই ওরা প্রকৃত সুখ খুঁজে পেয়েছে।
এইসব সুখি দম্পতিগুলোই হতে পারতো আমার কাছে ভালো থাকার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
কিন্তু আফসোস! তখন আমি নিজেকে সুখি ভাবতে পারি নি। আমি ব্যর্থ! নিজেকে সুখি ভাবতে, সুখি করতে আমি ব্যর্থ! সবাই আসলে সব কিছু পারে না।
প্রিন্স চলে যাওয়ার পর আমি জাপানে পিএইচডি করতে এসেছি আজকে প্রায় চার বছর। এই চারবছরে আমি একদিনের জন্যেও নিজের করা ভুলের কথা ভুলি নি।
শরীরের প্রতিটা রক্ত কণিকার মত এই ভুলগুলোকে প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছি।
★
আমার রিসার্চ পেপারের কাজ মোটামুটি শেষ। আগামী সপ্তাহে দেশে ফিরবো।
কিন্তু আগের মত সেই উচ্ছ্বাস কাজ করছে না। দেশে ফিরতে হবে তাই ফিরবো। এটুকুই। তাছাড়া বয়সটা আর ছোট নেই। না চাইতেও গাম্ভীর্য চলে এসেছে।
শুনেছি প্রিন্স আমেরিকার স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করছেন। আমার আগে উনার কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু উনি দেশে ফেরেন নি। হয়ত আর কোনোদিনই ফিরবেন না।
আমি একা! ভীষণ একা! মাঝেমাঝে একা একা কাঁদি।একা একা হাসি! আর ভাবি প্রিন্স আমাকে এই অবস্থায় দেখলে কি করতেন! তবে এখন আর আগের মতন কাউকে উনার খবর জোগাড় করে দেওয়ার জন্য বিরক্ত করি না। এখন নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি। শুধু উনি ভালো থাকুক। খুব ভালো থাকুক।
মা মাঝেমধ্যেই ফোন করে আমার খোঁজখবর নেন। প্রতিবারই উনি কথার বিষয়বস্তু বিয়েতে গিয়ে থামে। মায়ের উদ্দেশ্যে দেশে ফিরলে উনি আবার আমার বিয়ে দেবেন।
বিয়ে!
আমি মনে মনে হাসি। বিয়ের ভার সইবার মতন শক্তি আর আমার মাঝে নেই। আমি নিঃস্ব, নিঃশক্তি। জীবন যুদ্ধে পরাজিত, ক্লান্ত সৈনিক।
★
রবিবার আমার প্রফেসরের সাথে দেখা করে এসে সবকিছু গোছগাছ করছিলাম। সন্ধ্যায় ফ্লাইট। এমন সময় হঠাৎ চেয়ারম্যান স্যার ফোন করে বসলেন। আমি হাতের কাজ রেখে বারান্দায় হয়ে দাঁড়ালাম।
রিসিভ করে হ্যালো বলার সময়টুকু পর্যন্ত পেলাম না। তার আগেই উনি উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললেন,’খবর শুনেছো কিরণ?’
চেয়ারম্যান হয়ত নতুন কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা বলবেন। আমি বিশেষ আগ্রহ বোধ করলাম না। এখন আর কোনো খবর, কোনো আনন্দ উচ্ছ্বাস শুনতে ইচ্ছে করে না। কি লাভ শুনে? আমার জীবন থেকে সব আনন্দ, উৎসাহ তো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। তবুও স্যারের সম্মানার্থে সামান্য হেসে জিজ্ঞেস করলাম,’কি স্যার?’
স্যার বেশ আগ্রহের সহিত বর্ণনা শুরু করলেন,’বিজ্ঞানীরা আয়োডিনের আরো একটা নতুন রেডিওআইসোটোপ আবিষ্কার করেছে কিরণ। ঐ আইসোটোপের বিশেষত্ব হচ্ছে এটা একই সাথে বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার সেলকে সিলেক্টিভলি ডেস্ট্রয় করতে পারে। বিষয়টা মেডিক্যাল সাইন্সে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।’
চেয়ারম্যান স্যার গবেষণা পাগল মানুষ। সারাদিন গবেষণা নিয়ে পড়ে থাকেন। তাই বিজ্ঞানীদের গবেষণাপ্রসূত কোনো ফলাফল উনার অজানা থাকে না। কীভাবে যেন সবার আগে উনিই খোঁজ পেয়ে যান। আমি হালকা হেসে বললাম,’বাহ! তাহলে তো এবার আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান অনেকদূর এগিয়ে যাবে!’
-‘তা তো যাবেই। তবে গৌবরের কথা হচ্ছে এই গবেষণার সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশের একজন গবেষক যুক্ত ছিলেন।’
কে কি আবিষ্কার করলো না করলো এই নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি নিজের কাজ গুছিয়ে নিয়েছি এবার দেশে যাবো ব্যস! চেয়ারম্যান স্যারের কথাগুলো কিছুটা মনোযোগ, কিছুটা অমনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম।
কিন্তু চেয়ারম্যান স্যার থেমে রইলেন না। উনি নিজের মত করে বলে গেলেন। স্যারের বলা কথাগুলোর বিষয় সংক্ষেপ হলো মোট চারজন বিজ্ঞানী এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এদের মধ্যে তিনজন আমেরিকান আর একজন বাংলাদেশী। বাংলাদেশী যেই গবেষকটি এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন উনার নাম ড.শাহরিয়ার আজাদ প্রিন্স। আমার স্বামী!
আমি থমকে গেলাম! নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো। স্যারের বলা পরের কথাগুলো আর আমার শ্রুতিগোচর হলো না!
স্যার নিজের কথা শেষ করে ফোন রেখে দিলেন। আমি স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছিলো। দেরী না করে তখনই স্টেট ইউনিভার্সিটর অফিসিয়াল ওয়েবপেইজে ঢুকলাম। হাত পা কাঁপছিলো!
কিন্তু ভেতরে ঢুকে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। তিনজন আমেরিকান প্রফেসরের সঙ্গে প্রিন্সের হাসিমাখা ঝলমলে ছবি! চারজনের গলাতেই ইউনিভার্সিটির আইডি কার্ড ঝোলানো!
হেডলাইনে সবার নাম সহ অবিষ্কারের বিষয়বস্তু দেওয়া আছে। কমেন্ট বক্স দেশি বিদেশী চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের শুভেচ্ছাবার্তা বইছে। সন্দেহের আর কোন অবকাশ রইলো না!
ইয়েস! দ্যে ডিড দ্যাট!
আমার বুকের রক্ত ছলকে উঠলো! সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ বইতে শুরু করলো মন মস্তিষ্কে!
আমি চোখ বন্ধ করে মৃদু শ্বাস নিলাম। উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে। ফোন রেখে দুহাতে মুখ চেপে ধরলাম। এদিক ওদিক পায়চারী করে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালালাম। কিন্তু উত্তেজনা কিছুতেই কমছে না।
পুনরায় কম্পিত হস্তে উনার ছবিটা বের করে দেখলাম! একজন সফল মানুষের হাসি ! আমার হৃদপিন্ড শীতল হয়ে গেলো! আলতো করে ফোনের ওপর দিয়েই ছুঁয়ে দিলাম। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের হাসি ফুটে উঠলো!
আমার মনে পড়লো, প্রাপ্তি একদিন দুষ্টুমি করে বলেছিলো,’আমার ভাইয়া তোর মত সারাদিন বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকে না। ও তোদের মত পড়াশোনা করলে কেউ ওর ধারেকাছে দিয়েও যেতে পারতো না।’
সেদিন নেহায়েত দুষ্টুমি মনে হলেও আজ বুঝতে পারছি প্রাপ্তি ভুল বলে নি। হার ব্রাদার ইজ ট্রুলি আ জেম! চেয়ারম্যান স্যারের ভাষায় যাকে বলে এক্সট্রা অর্ডিনারিলি মেরেটোরিয়াস! আমি আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। আমার শরীরে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যাচ্ছিলো! অন্যরকম সুখ অনুভব করছিলাম বুকের ভেতর!
আসলে মেধা আর পরিশ্রম যখন একসাথ হয় তখন সেটা রীতিমত ব্লাস্ট ঘটায়। প্রিন্স ব্লাস্ট ঘটিয়ে দিয়েছেন। আমি তো খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছি! কি করে নিজেকে সামলাবো। যতই দূরত্ব থাকুক না কেন ঐ মানুষটা যে আমার স্বামী! আমি এখনো উনাকে ভীষণ ভালোবাসি।
(বিঃদ্রঃ গল্পের চরিত্রের যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলার সুবিধার্থে আমি আমার নিজের মস্তিষ্কপ্রসূত কিছু তথ্য মেডিকেল সাইন্সের রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করেছি ( আমি আবারও বলছি এটা সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব চিন্তাধারা থেকে উপস্থাপিত।) তাই এই বিষয়টা সবাইকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। তবে আমরা আশাকরি আমাদের দেশের মেডিকেল সাইন্টিস্টরা এর চাইতে অনেক বড় কিছু সাধন করবেন ইংশা আল্লাহ। কারণ জাতি হিসেবে আমরা মেধাবী।)