#আমার_ভুলপর্বঃ৬
অরিত্রিকা আহানা
তিনমাস পর রেজাল্ট দেওয়ার কথা থাকলেও দুমাসের মাথায় আমাদের রেজাল্ট বেরিয়ে গেলো। মানে আমার বিয়ের প্রায় পনেরো দিন পর।
আমি ব্যাচের মধ্যে সেকেন্ড হয়েছি। ফার্স্ট হয়েছে আমাদের ক্লাসের আবু বকর নামের একটা ছেলে। ও ভীষণ মেধাবী। পড়েও অনেক। ওর রেজাল্ট থ্রি পয়েন্ট নাইন নাইন। আর আমার থ্রি পয়েন্ট নাইন এইট। ব্যবধান খুবই কম।
এই নিয়ে আমার কোন আফসোস নেই। কারণ অভার অল হিসেব করলে এখনো আমার রেজাল্টই সবার চাইতে ভালো। শুধু ভালো বললে ভুল হবে অনেক ভালো। চেয়ারম্যান স্যার তো বলছেন একেবারে আউটস্টান্ডিং রেজাল্ট!
সবার আগে আব্বাকে সালাম করে খবরটা জানালাম। আব্বা ভীষণ খুশি হলেন। বারবার করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলছিলেন। আমি মিষ্টি হেসে মাকে সালাম করতে গেলাম। মা আমাকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন,’আমার মেয়ের চেষ্টা আজকে সফল হয়েছে। আমি খুব খুশি মা। অনেক বড় হ তুই।’
স্মেহের সহিত আমার কপালে চুমু খেলেন। আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’ওর শ্বশুরবাড়িতে ফোন করে একটা খবর জানাও। ওদের আসতে বলে দাও। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে হবে তো।’
আব্বাকে আপত্তি করলেন না। সেদিনই প্রিন্স ভাইয়াদের বাসায় ফোন করে উনাদের আসতে বলে দিলেন।
আমার রেজাল্টের খবর শুনে আংকেল মিষ্টি নিয়ে আসলেন একগাদা। উনাদের আত্মীয়স্বজন, প্রিন্স ভাইয়া, প্রান্ত, সবাই এসেছে। আমাদের আত্মীয়স্বজনরাও আছে। সবাই ভীষণ খুশি।
আলোচনা দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর শুরু হবে। আব্বা প্রিন্স ভাইয়াকে ডেকে উনার পছন্দসই একটা ডেইট জেনে নিলেন। সম্ভবত সেই ডেটটাই ঠিক করবেন।
প্রিন্স ভাইয়া সকাল থেকে আমার সঙ্গে একবারও আলাদা করে কথা বলতে পারেন নি। চারদিকে মেহমানরা ঘিরে আছে। কাজিনরা গোল হয়ে আমার রুমে বসে আছে।
দুপুরের দিকে মা সবাইকে ধমক দিয়ে বের করে দিলেন। ভাবিকে ডেকে বললেন প্রিন্স ভাইয়াকে আমার রুমে নিয়ে আসার জন্য।
জামাই মানুষ দুপুর বেলা খেয়ে একটু রেস্ট নেবে। তার উপায়ও নেই। সব ভীমরুলের চাকের মতন রুম দখল করে আছে। এসব বলে কাজিনদের সবাইকে একধাপ ঝাড়লেন।
আমি মায়ের রুমে বসে ছিলাম। মা আমাকেও ঠেলে রুমে পাঠিয়ে দিলেন। ধমক দিয়ে বললেন,’জামাই ঐ রুমে একা একা বসে থাকবে? তুই যা রুমে। ওর কি লাগে দেখ।’
আমার মন চাইছিলো মাটি খুঁড়ে তার ভেতরে ঢুকে যাই। এত লজ্জা লাগছিলো। লজ্জায় আমি মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারলাম না। তবুও উনি আসার আগে চুপচাপ রুমে গিয়ে বসে রইলাম।
উনি ভেতরে ঢুকে আরাম করে আমার পড়ার চেয়ারে বসলেন। চারপাশে চোখ বুলিয়ে আমার রুমটা দেখলেন। আমি মিথ্যে কাজের বাহানায় উল্টোদিকে ঘুরে বই পুস্তক নাড়তে শুরু করলাম। উনি প্রথনে জিজ্ঞেস করলেন আমি লাঞ্চ করেছি কি না। তারপর জিজ্ঞেস করলেন বিয়ের অনুষ্ঠান বাইশ তারিখ হলে আমার কোন সমস্যা হবে কিনা।
আমি দুটো প্রশ্নের উত্তরই মাথা নাড়িয়ে দিলাম। প্রথমটাতে উপরে নিচে মাথা নাড়ালাম। আর দ্বিতীয়টাতে ডানে বামে। উনি সামান্য হাসলেন। মুচকি হাসি। উনাকে আমি কখনো উচ্চশব্দে হাসতে দেখি নি। প্রাপ্তির বিয়েতেও না।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে ফের প্রশ্ন করলেন,’তুমি কি আমকে দেখে লজ্জা পাচ্ছো? উল্টোদিকে ফিরে আছো কেন?’
আমি জবাব দিলাম না। আমার চেহারায় স্পষ্টত লজ্জা ভেসে উঠেছে। জীবনে আমি এই অদ্ভুত রকমের লজ্জা আমি কারো সামনে পাই নি। আগেই বলেছি আমার লজ্জা কাউকে হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে দুর্বল করে দিক সেটা আমি কখনো চাই নি। তাই লজ্জা প্রকাশের ক্ষেত্রে সবসময় সংযত থেকেছি। কিন্তু উনার সামনে এই সংযম বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলাম না। সৃষ্টিকর্তা একেবারে লজ্জার ঘড়াসহ ঢেলে দিলেন। লজ্জার উনার দিকে ফিরতে পর্যন্ত পারলাম না।
প্রসঙ্গ পরিবর্তনের চেষ্টা করে বললাম,’চা খাবেন?’
এই দুপুরবেলা ঘুমের সময় চা খাওয়ার প্রস্তাবটা কতটা যুক্তিসংগত আমি জানি না। তবুও আমি নিঃসংকোচে বলার জন্য এই একটা কথাই খুঁজে পেলাম। উনি মাথা নাড়িয়ে বললেন,’না। এখন চা খাবো না।’
-‘তাহলে কফি বানিয়ে দেই?’
-‘না। কফিও খাবো না।’
এরপরে আমি আর কোন শব্দ খুঁজে পেলাম না। সৌজন্য মূলক কথাবার্তাও মুখ দিয়ে বেরোলো না। চা, কফি এগুলো ছিলো উনার সামনে থেকে নিস্তার পাওয়ার বাহানা। কিন্তু উনি খাবেন না বলায় বেশ বিপাকে পড়ে গিয়েছি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে কি করবো সেটাও বুঝতে পারছি না। উনি বোধহয় আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছেন। স্মিত হেসে বললেন,’এভাবে মুখ ঘুরিয়ে রাখলে কিন্তু আমি যাবো না। আজকে এখানে থেকে যাবো।’
আমার মনে হলো এভাবে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সত্যিই অভদ্রতা দেখায়! তাই আমি সামনে ফিরে সবে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম এমন সময় হঠাৎ পাশের রুম থেকে আতসবাজি ফুটে উঠার মতন উচ্চশব্দে বেজে উঠলো,’ড্যাডি মাম্মি হ্যায় নেহি ঘার্ পে, পিছলে কামরে মে ঘুসকে, কুছ তো কারেঙ্গে ছুপকে মিল যারা…!’
কোন বেয়াদবে যেন গান ছেড়ে দিয়েছে।
ইজ্জতের আর কিছু বাকি রাখলো না! আব্বা ড্রয়িংরুম থেকে জোরেসরে গলা খাঁকারি দিলেন। বোঝাই যাচ্ছে গান বন্ধ করতে বলছেন। কিন্তু বেয়াদবের দল গান বন্ধ করতে পারছে না। বোধহয় রিমোট কাজ করছে না। উপায়ান্তর না পেয়ে আব্বা আমার ছোটভাই কনকের নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। ভেতরে মুরুব্বিরা সবাই বসে আছে। কি বেইজ্জতি কারবার! এমন রক্ষণশীল পরিবারের ছেলেমেয়েরাও কিনা এসব গান শোনে!
প্রিন্স ভাইয়া হাতের মুঠোয় ঠোঁট চেপে ধরে আমার দিকে চেয়ে আছেন। আমি লজ্জায় তাড়াতাড়ি উনার সাথে কথা শুরু করতে চাইলাম যাতে গানের লিরিক্স উনার কানে না যায়। কিন্তু পারলাম না। কোন কথাই মুখে এলো না। ব্যক্কল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
উনি অনেক চেষ্টা করলেন হাসি চেপে রাখার কিন্তু পারলেন না। আমার অবস্থা দেখে হেসে দিলেন। উঠে গিয়ে আমার জানালার গ্রিল ধরে নিঃশব্দে শরীর দুলিয়ে হাসতে শুরু করলেন।
কনক দৌঁড়ে গিয়ে টিভির প্লাগ খুলে দিলো। রিমোট খারাপ হয়ে যাওয়ায় কাজিনরা হঠাৎ কি করবে বুঝতে পারছিলো না। সবাই মিলে রিমোট নিয়েই গুঁতোগুঁতি করছিলো। গান শুরু হওয়ার সাথে সাথে প্লাগটা খুলে দিলে এই লজ্জাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।
আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এছাড়া আর কি করার আছে! মানইজ্জত তো সব ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রিন্স আমার ব্যক্কলের মতন চেহারাটা দেখে নিয়েছেন।
ড্রয়িংরুম থেকে আংকেলের হাস্যরত কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম। আব্বা বিব্রত হয়েছেন বুঝতে পেরে উনি আব্বাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। ভরাট হেসে বললেন ,’বোনের বিয়ের খুশিতে ভাইবোনেরা আনন্দ করছে ভাইসাহেব। খেয়াল করে নি। আপনি এত রাগ করবেন না।’
আংকেলের কথা শুনে আব্বা শান্ত হলেন। নইলে আজকে আমার কাজিনদের সবার খবর ছিলো।
★
প্রিন্স ভাইয়া যতক্ষণ আমার রুমে ছিলেন আমি দূরে থেকেই উনার সঙ্গে কথা বলেছি। লজ্জায় কাছে যেতে পারি নি।
অবশ্য কাছে যাওয়া তো বহুদূরের কথা ঠিকমতো তাকাতেও পারি নি। কখনো মাটির দিকে তাকিয়ে, কখনো দরজার দিকে তাকিয়ে, কখনো বা নিজের হাতের আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে থেকে কথা বলেছি।
উনার সামান্য কোন কথাতেই অনেক বেশি লজ্জা লেগেছে। উনি যাওয়ার সময় আমাকে কাছে ডাকলেন। দুষ্টু হেসে বললেন,’এদিকে এসো কিরণ! তোমাকে আমি খেয়ে ফেলবো না। তারজন্য দিন ঠিক করা হচ্ছে। আমার অতো তাড়া নেই!’
আমি তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি পকেট ফোন বের করে আবার ডাকলেন,’এদিকে এসো তোমার একটা ছবি তুলি। মা তোমাকে দেখতে চেয়েছেন।’
আমার ইচ্ছে হলো বলি,’না আসবো না। মুখ দিয়ে যেই বোমা বিস্ফোরণ করেছেন তাতেই লজ্জায় আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আর কাছে গেলে কি করবেন সেটা আল্লাহই জানে।’ কিন্তু বলতে পারলাম না। সসংকোচে দাঁড়িয়ে রইলাম।
উনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে প্রান্তর নাম ধরে ডাক দিলেন। প্রান্ত ড্রয়িংরুমে আংকেলের সাথে বসে ছিলো। ভাইয়ের গলার আওয়াজ পেয়ে উঠে এলো। আমাদের দুজনকে দেখে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,’জি ভাইয়া?’
-‘তোর ফোন থেকে তোর ভাবীর কয়েকটা ছবি তোল। আমার ফোনে চার্জ নেই।’
প্রান্ত ওর ফোন বের করে আমার বেশ কয়েকটা ছবি তুললো। উনি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। প্রান্ত উনাকে উদ্দেশ্য করে বললো,’তুমিও ভাবীর পাশে গিয়ে দাঁড়াও ভাইয়া। তোমাদের দুজনের একটা ছবি তুলে দিই।’
উনি চট করে আমার দিকে চাইলেন। মনে হলো সম্মতি চাইছেন। আমি সলজ্জ হাসলাম। প্রান্তর সামনে কোন এক্সট্রা ছেলেমানুষি করলাম না।
উনি আমার পাশে এসে দাঁড়ালে প্রান্ত আমাদের বেশ কয়েকটা ছবি তুলে দিলো। ছবি তুলে দিয়ে ও বেরিয়ে যাচ্ছিলো। উনি বাধা দিয়ে বললেন,’কোথায় যাচ্ছিস? দাঁড়া। ভাইয়াও যাবো।’
প্রান্ত দূরত্ব বজায় রেখে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ও সরে গেলে উনি আমাকে উদ্দেশ্য মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললেন,’কংগ্রাচুলেশনস মাই ডিয়ার ওয়াইফ। ইউ হ্যাভ মেইড আ ভেরি ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট! আই ফিল সো প্রাউড অফ ইউ। ইউ ট্রুলি ডিজার্ভ দিস হ্যাপিনেস।’
তারপর হাসিমুখে বেরিয়ে গেলো দুইভাই। যাওয়ার সময় প্রান্ত মিষ্টি হেসে বললো,’ভাবী আসি? ট্রিট টা কিন্তু পাওনা রইলো।’
আমিও মুচকি হেসে ওর কথায় সায় জানালাম। ওরা চলে গেলে চুপিচুপি ড্রয়িংরুমের দিকে চাইলাম। উনি আংকেলের পাশে গিয়ে বসেছেন। হঠাৎ করেই একধরণের ভালোলাগা কাজ করছে ঐ মানুষটার প্রতি। উনার বলা কথাগুলোর প্রতি। উনার হাসিহাসি স্নিগ্ধ সুন্দর মুখখানার প্রতি। মনে হচ্ছে আমি একমুহূর্তেই ভীষণরকমভাবে উনার প্রেমে পড়ে গেছি!