#তোমার_পিছু_পিছুপর্ব-২৮ (শেষপর্ব)
তামান্নার মাথা ভন ভন করছে…… চোখ জ্বালা করছে….. চোখের কোণা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে….বার বার মুছলেও থামছে না…. কি আশ্চর্য্য!!!!! এভাবে চোখের পানি পড়ার কি কারন!!!! তামান্না শুয়ে থেকে পাশ ফিরলো……..ভিতর ভিতর এতোটা খারাপ লাগার কি কথা ছিলো….. তামান্না জানে ও প্রচুর বাস্তববাদী মেয়ে…….বাস্তবতার কাছে আবেগ ওর কাছে কিছুই ছিলো না…… ও ১০০% নিশ্চিত ছিলো…… প্রয়োজনের বস্তু নিয়ে তামান্না কখনো অবহেলা করে না……. কিন্তু সব…… সবকিছু উল্টাপাল্টা হয়ে গেলো….. সবকিছু……
তামান্না হাত ভাজ করে চোখের উপর রাখল……. আবার চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে শুরু করল….. কি জ্বালা!!!!
আচ্ছা….. কতদিন যাবৎ মা’র সাথে কথা হয় না….. একবার গ্রামে ফোন করা দরকার……
আচ্ছা…. গ্রামে চলে গেলে কেমন হয়!!!!!
শোয়া থেকে উঠে বসল তামান্না………।
👇👇👇
আজ ঠিক ২ সপ্তাহ পর বর্ন অফিসে এলো…… নিজের লেদার চেয়ারটায় বসে তাকিয়ে আছে কাচের গ্লাসের অপর পাশে তামান্নার ডেস্কের দিকে……. যেদিকটায় তাকিয়ে থেকে ও একসময় ঘন্টার পর ঘন্টা সময় পার করে দিতে পারতো……..
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বর্ন তাকালো নিজের ডেস্কের উপর…… দুইটা সাদা রং-এর খাম রাখা আছে…… একটা তামান্নার রেসিগনেশন লেটার…. অন্যটায় শুধু “মি. বর্ন” লিখা….. আর কিছুই না!!!!
রেসিগনেশন লেটারটা কিছুক্ষন আগে এসে ম্যানেজার সাহেব দিয়ে গেলেও…… অন্য চিঠিটা আগেই এখানে রাখা ছিলো…..বর্ন রেসিগনেশন লেটার বাদে অপর চিঠিটা পকেটে ভরলো….. এবং সাথে সাথে উঠে দাড়ালো……
👇👇👇
নীলময়ী বসে আছে নিজের বিছানায়….. কোমড় পর্যন্ত ব্লাংকেট টেনে বসে আছে…. চুলগুলো এলোমেলো অবস্থায় চোখে মুখে পড়ে আছে… ও মাথা নিচু করে হাতের রুবিক্স কিউবটা মিলানোর চেষ্টা করছে…….
বর্ন ওর বিছানার সামনে রাখা সিংগেল সোফায় বসে একনাগাড়ে পা নাচিয়ে যাচ্ছে……
অনেক….. অনেকক্ষন চুপ থাকার পর বর্ন শুরু করল…….
-নীলময়ী.……
-হুম…….
-আমি……. আমি……. আমি সবসময় আপনার পাশে থাকবো……
-হুম….
-আমি কখনো আপনাকে অবহেলা করবো না…. কোন প্রকার কষ্ট দিবো না.……….
-হুম……
-এবং নীলময়ী..…. আমি আপনাকে বিয়ে করবো…..অবশ্যই বিয়ে করবো…..
-আচ্ছা……..
-আমি থাকবো… দেখবেন….. আমি ঠিক আপনার সুপারম্যান হয়ে আপনার সামনে ঢাল হয়ে থাকবো…….
-আচ্ছা……..
বর্ন একবার ঢোক গিলল…. তারপর মাথা নিচু করে বলল,,,,
-কিন্তু নীলময়ী……আমি…. আমি কখনো আপনাকে…………. ভালোবাসতে পারবো না………..কিন্তু……
-……..…
-কিন্তু আমি আপনাকে খুব খুব সুখে রাখবো…… ওয়াদা করছি………
-কেনো……
বর্ন মাথা তুলে নীলময়ীর দিকে তাকালো…… নীলময়ী ওর দিকেই তাকিয়ে……. চোখে মুখে কাঠিন্য নেই….. কিন্তু………..!!!!
-কেনো আপনি আমাকে সুখে রাখতে চাইছেন!!!!! যদি আপনি আমাকে ভালোই না বাসেন!?……
-কারন আপনি আমার অতি প্রিয় একজন ব্যাক্তি….. যাকে আমি কখনো কষ্ট দিতে চাই না……
-আর আমাকে বিয়ে করলেই কি আমি কষ্ট মুক্ত হয়ে যাবো!!???
-………………..
-বর্ন…… আপনি কি জানেন মানুষ তার জীবনের প্রথম ভালোবাসা কখনো ভুলতে পারে না…….তাই তো আমি আজও তাকে ভুলতে পারিনি…… হাজার হাজার চেষ্টার পরও,,,, আমি তাকে ভুলতে পারি নি…… আজও রাতে ঘুমাবার আগে আমার তার কথা মনে পড়ে……. আপনি জানেন বর্ন…… আমার সুইসাইডাল হওয়ার পিছনে “ও”-ই ছিলো মূল কারন……. ওর কাছ থেকে পাওয়া অবহেলাটাই আমার জন্য যথেষ্ট ছিলো সুইসাইড করার মত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য….. তারপরও…… আজও…. কেনো আজও ওর কথা মনে পড়লে বুকের ভিতর এভাবে চিনচিন ব্যাথা করে বলতে পারেন!!!!!
-নীলময়ী….. আমি…………..
-বর্ন,,,,,, প্রথম ভালোবাসার টান খুব শক্ত বুঝলেন….. কারন প্রথম ভালোবাসার মানুষটাই আমাদের প্রথম নতুন কিছু অনূভূতির সাথে পরিচয় করায়…… যা আমরা আগে কখনো অনুভব করি নি….. তাই প্রথম ভালোবাসাটা এতোটা সুন্দর আবার অসুন্দরও……… আর ভুলে থাকার বোঝা খুব ক্লান্তিকর তা জানেন………… এবং আমি চাই না….. আমার প্রথম প্রিয় একজন বন্ধু এই বোঝ বইতে বইতে আমার মত ক্লান্ত হয়ে পড়ুক…… অবশ্যই আমি তা চাই না………..
-আমি….. আমি……. আমি কিচ্ছু জানি না….. সত্যি আমি কিচ্ছু জানি না…..
বর্ন দুই হাতে মাথা চেপে ধরল…….
-বর্ন আপনি যদি এক্ষনি এখান থেকে না যান….. তবে আমি আপনার বুকের ঠিক এইখানটায় ছুড়ি ধরবো…. তারপর বলবো…” বল……. দেহো দিবি নাকি মন দিবি….. বল”
বর্ন তাকালো নীলময়ীর দিকে….. চোখে মুখে দুষ্ট হাসির ঝলক……….
-কিন্তু!!!!
-দেখুন….. আমি কিন্তু পরে আপনাকে দড়ি দিয়ে বেধে রেখে দিবো…. পরে কিন্তু আবার কান্নাকাটি করতে পারবেন না……..
বর্ন উঠে দাড়ালো…..দরজার কাছে যেয়ে ঘুরে তাকালো নীলময়ীর দিকে
-ধন্যবাদ নীলময়ী……
-হেই…. নো সরি এন্ড নো থ্যাংক ইউ…. ইন ফ্রেন্ডশিপ…..
ঝারি মারার সুরে কথাটা বলেই নীলময়ী ফিক করে হেসে দিলো।
👇👇👇
বর্ন গাড়িতে উঠেই সেলিম মিয়াকে বলল….
-ঢাকা শহরে কোথায় সাদা ধবধবে শাপলা ফুল পাওয়া যায়!!!! গাড়ি নিয়ে ওখানে চলুন……
গাড়ি চলতে শুরু করলে…….. বর্নপকেট থেকে তামান্নার দেওয়া চিঠিটা বের করল। সাদা কাগজে গোল গোল হাতের লিখা………
“বর্ন সাহেব,
কেমন আছেন আপনি? অবশ্যই ভালো…… হুম ভালো থাকারই কথা তাই না!!!…. বর্ন সাহেব আমি আজ আপনাকে কিছু কঠিন কথা বলতে চাই..….. যেই কথাগুলো আমি সরাসরি কখনোই আপনাকে বলতে পারতাম না…….কিন্তু বলা খুবই প্রয়োজনীয় ছিলো…….
আমি হচ্ছি নিতান্তই একজন গ্রামের মেয়ে..….. আমার বাবা ছিলেন অতি কর্মঠ, বলশালী, শক্তসমর্থ একজন মানুষ…… গাম্ভীর্য্যই ছিলো ওনার চরিত্র……..তাই আমি সবসময় ধরেই এসেছি যে পুরুষ মানুষ হতে হবে এমন গম্ভীর, দাপটে, বলশালী। কোন প্রকার হেবলা, ক্যাবলা, ভ্যাবলা ছেলেদের প্রতি ছিলো আমার ভয়ংকর রকম এলার্জী…. অর্থাৎ এমনটাইপ ছেলে দেখলেই আমার রাগ উঠে যেত……
কিন্তু সেদিন ঝুম বৃষ্টিতে নীলক্ষেতের বইয়ের গলির মাঝে সাদা শার্ট সাদা প্যান্ট পড়নে এক হেবলা ছেলে দেখলাম…… দেখে মনে হলো…. আচ্ছা উনি কি কোন রাজ্যের রাজপুত্র…. ভুল করে এখানে চলে এলেন….!!!!! কিন্তু তারপরও কেনো জানি এই হেবলা ক্যাবলা ভ্যাবলা ছেলেটাকে আমার মনে ধরে গেলো….. কিন্তু আবেগের কোন যায়গা নেই আমার জীবনে…. খুব কঠিনভাবে নিজেকে বুঝ দিতে লাগলাম.….এইসবের পাল্লায় পড়া যাবে না….. কিন্তু আমি যতই না করি মন যেন ততোই আপনার কাছে ছুটে……. মন এতোটাই জোরে ছুটে গেলো যে একসময় হাল ছেড়ে দিলাম…. আবেগের কাছে আমি পরাজিত হয়ে গেলাম…….. কিন্তু!!!!
ওইযে বলে না বামুন হয়ে চাঁদে হাত দিতে নেই….. কিন্তু আমিতো দিয়ে দিয়েছিলাম… পরিনাম হলো ভয়াবহ….!!!! মন ভাঙার এতো কেনো কষ্ট হয় বলতে পারেন!!!!
বর্ন সাহেব আপনার কি মনে আছে,,,,, আমি একবার আপনাকে একটা স্বপ্নের কথা বলেছিলাম,,,,আজ আমি আপনাকে স্বপ্নটা শুনাতে চাই………..আমি দেখলাম কি আমি আর আপনি নৌকায় চড়ে একটা ঝিলের মাঝে ঘুরছি….. আপনার হাতে বৈইঠা…. আর আমার হাত ভর্তি সাদা শাপলাফুল….. হঠাৎ মেঘ করতে শুরু করল,,,,আপনি আমায় বললেন “মিস তামান্না বৃষ্টি নামবে বোধহয়……. এই বৃষ্টিতে আমি আপনার সাথে এই ঝিলে চিৎ সাতার দিতে চাই” ….. তখন আমি মানা করলাম….. কিন্তু আমার মানা করার পরও আপনি ঝুপ করে ঝিলে নেমে গেলেন…… আমার কলিজা ধ্বক করে উঠল…… আমিও নামলাম…. কিন্তু কোথাও আপনাকে খুজে পাই না….. আমি বার বার ডুব দিয়ে পানির নিচে দেখছি আপনি কোথাও নেই…… আমার ভয় করতে লাগল,,,,আপনাকে কি তবে হারিয়ে ফেললাম………
স্বপ্নটাকে আমি খুব সুন্দর বলেছিলাম,,,,, কারন জানেন!!!!! কারন এই স্বপ্নটা আমায় চরম সত্যটা বুঝিয়ে দিলো…. যে আপনি কখনোই আমার হতে পারবেন না……………………..
আমি এই চাকরিটা শুরু করার আগে আপনার বাবাকে নিশ্চিত করেছিলাম যে আমি অবশ্যই প্রোফেশনালী কাজ করবো……. কিন্তু আমি আমার কথা রাখতে পারিনি….. তাই নিজেই নিজের যায়গা থেকে সড়ে এলাম,,,আর হয়তো কখনো দেখা হবে না….. যদি কখনো সখনো দেখা হয়েও যায়….. আপনি কি আমায় “মিস তামান্না” বলে ডাক দিবেন?? নাকি মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবেন বলুন তো!!!!!
মিস তামান্না
চিঠিটা ভাজ করে বর্ন আবার পকেটে ভরল…… মুখ ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকালো……সবকিছু এমন ঝাপসা লাগছে কেনো!!!!
👇👇👇
তামান্না বসে আছে ওদের ঘরের বারান্দায়….. সন্ধ্যা হয়েছে…… উঠানের আশেপাশের বাকি ঘর গুলোতে সন্ধ্যার আলো জ্বলছে….. ওর মা আর ছোট বোন একটু বাহিরে গেছে…… ওদের ঘর অন্ধকার….. তামান্না উঠি উঠি করেও বসে আছে…… এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে…….. মাঝে মাঝে আকাশ ডাকছে….. ঝুম বৃষ্টি নামবে বোধহয় আজ…….. হঠাৎ ওদের উঠানে এসে থামলো এক কালো প্রাইভেট কার….. তামান্না এই গাড়িটা খুব ভালো করে চিনে….…. ও সাথে সাথে বসা থেকে উঠে দাড়ালো……
গাড়ির ভিতর থেকে বর্ন নেমে দাড়ালো….. ওর হাত ভর্তি সাদা শাপলাফুল……. বর্ন ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে দাড়ালো ঠিক তামান্নার এক হাত দূরে…….. এক হাটু গেড়ে বসল তামান্নার সামনে…… তামান্না বড় বড় চোখ করে বর্ন কার্যক্রম দেখছে…….
বর্ন বসা থেকেই ফুলগুলো এগিয়ে ধরল তামান্নার সামনে…
-মিস তামান্না আমি আজীবন আপনার সাথে নৌকায় চড়ে শাপলা ফুল তুলতে চাই….. ঝুম বৃষ্টিতে একসাথে ভিজতে চাই…. পুকুরে চিৎ সাতার দিতে চাই……… কিন্তু আমিতো সাতার পারি না……. আপনি কি আমায় পুকুরে চিৎ সাতার দেওয়া শিখাবেন!!!! আজই………..
তামান্না দুইহাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কেদে চলছে…… বর্ন ঠায় নিজের যায়গায়……. কিছুক্ষণ পর মুখ থেকে হাত সড়ালো তামান্না…. বর্ন মুগ্ধ হয়ে তামান্নার মুখের কান্নামিশ্রিত হাসি দেখছে………কি অপূর্ব!!!!!
হঠাৎ মেঘ গর্জন করল…… ঝুম বৃষ্টির নামবে বোধহয়।
(সমাপ্ত)