এক মুঠো রোদ পর্ব-১৭

0
1036

#এক_মুঠো_রোদ
#Writer_নৌশিন_আহমেদ_রোদেলা
#part_17
#collected Sk Galib
টেবিলে ঠেস দিয়ে, একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রোজা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। রোজার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে মৃন্ময়। চোখদুটো লাল আর মুখেজুড়ে রহস্যময়ী হাসি। রোজার দৃষ্টি মৃন্ময়ের হাতের দিকে। মৃন্ময়ের ডান হাতে কালো রঙের একটি রিভলবার।হাতের রিভলবারটা নিয়ে খেলতে খেলতে কপালে পড়ে থাকা হালকা ব্রাউন চুলগুলোতে ক্রমাগত আঙ্গুলি চালাচ্ছে সে। রোজাকে তার হাতের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো মৃন্ময়ের ঠোঁটে।
— মিস. এ..লি… না। আর ইউ থিংকিং এবাউট মি? এক্চুয়েলি এটা আপনার বেডলাক। আমার সম্পর্কে যারা ভাবে তারা জাস্ট ভ্যানিশ হয়ে যায়….হাওয়া!
কথাটা বলে আবারও হাসলো মৃন্ময়। টেবিলের উপর ওঠে চেয়ারে পা রেখে আরাম করে বসলো সে। মধ্য আঙ্গুলে রিভলবারটি আটকিয়ে চরকার মতো ঘুরাতে ঘুরাতে বলে উঠলো,
— প্রথম দিন আপনার অস্থিরতা আর উল্টো ম্যাগাজিন পড়া দেখিই বুঝতে পেরেছিলাম সামথিং ইজ ফিশি! সেকেন্ড দিন রুম থেকে বেরোনোর আগে বাবার বেডরুমের দরজার সামনে তালার ঝংকারের গুড়ো আর ধুলোমাখা পায়ের ছাপ পড়ে থাকতে দেখে বুঝলাম, এখানে কিছু একটা চলছে। নিচে নেমে ফ্লোরে এবং সিঁড়িতে জুতোর ধুলো আর সেই ধুলোই আপনার গাউনের নিচের দিকে লেগে থাকতে দেখে ব্যাপারটা একদমই পরিষ্কার হয়ে গেলো আমার চোখে। আপনার কি ধারনা সবকিছু এতো ইজি? উহুম! সবকিছু খুবই টাফ বাট আপনার জন্য ইজি ছিলো বিকজ পুরো ব্যাপারটাকেই আমি আপনাকে ইজি করে দিয়েছিলাম। আই জাস্ট ওয়ান্ট টু নো এবাউট ইউর মোটিভ।
তো? কার হয়ে কাজ করছিলেন আপনি?হোয়াট ইজ ইউর মোটিভ? স্পিক আপ..
মৃন্ময়ের ধমকে চমকে উঠলো রোজা। ডান হাতের উল্টো পৃষ্ঠায় কপালের ঘামটা মুছে নিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো সে। কিন্তু পালানোর কোনো পথই চোখে পড়লো না তার।
রোজাকে চুপ করে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো মৃন্ময়। রিভলবারটা রোজার কপাল বরাবর তাক করে নিয়ে বলে উঠলো,
— ওক্কে ফাইন। আপনি যেহেতু বলবেন না সো গুড বাই মিস.এলিনা…
কথাটা বলে মুখের চোয়াল শক্ত করে ট্রিগারে আঙ্গুল রাখলো মৃন্ময়। তার মুখে এতোক্ষণ যে ভয়ানক হাসি ছিলো সেই হাসিটাও মিলিয়ে গিয়েছে এবার। হাসিহীন মুখটা আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো মুহূর্তেই। রোজা দ্রুত ভাবার চেষ্টা চালাচ্ছে, কি করে বাঁচা যায়? কি করে? শেষ রক্ষাটা কি সে করতে পারবে না এবার? দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছে রোজা। চোখের মণি ক্রমাগত এপাশ-ওপাশ ছুটে চলেছে, পালানোর একটি সুযোগ যদি পাওয়া যায়! মৃন্ময়ের হাতটা ট্রিগারে চাপ দেওয়ার পূর্ব মুহূর্তেই মুখ খুললো রোজা,
— আমি কারো হয়ে কাজ করছিলাম না। আর না, আমি আপনার কোনো ক্ষতি করছিলাম।
রোজার কথায় দমফাটা হাসিতে ভেঙে পড়লো মৃন্ময়। নিজেকে কোনোরকম শান্ত করে বলে উঠলো,
— ওহ! রিয়েলি? আপনি কি আমাকে বোকা মনে করেন মিস.এলিনা? আমার বাড়িতে চুপিচুপি গোয়েন্দাগিরি করছেন অথচ আমার ক্ষতি করছেন না, স্ট্রেঞ্জ!
— বিলিভ মি। আমি সত্যিই আপনার ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে আসি নি। আমি তো এসেছি আপনার বাবার সম্পর্কে ইনফরমেশন কালেক্ট করতে। একজন টেলেন্টেড এন্ড ফেমাস ব্যাক্তি তো এভাবে হারিয়ে যেতে পারে না। আমি উনার এই বিলপ্তির কারণটায় খুঁজছি শুধু। আর কিচ্ছু না। ট্রাস্ট মি, মিষ্টার.আরিয়ান।
রোজার কথায় চোয়াল শক্ত হয়ে এলো মৃন্ময়ের। ফর্সা মুখে রাগের লাল লালিমাও স্পষ্ট হয়ে উঠলো। তার সাথে স্পষ্ট হয়ে উঠলো মৃন্ময়ের প্রতি রোজার ভয়। ভুল কিছু বলে ফেলে নি তো সে? ডানহাতে নাকের উপরের ঘামটুকু মুছে নিয়ে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো রোজা। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। চোখদুটোও ভয়ে অস্থির। ভয়মাখা চোখেই একরাশ সাহস জুগিয়ে মৃন্ময়ের চোখের দিকে তাকালো সে। প্রায় সাথে সাথেই ডানহাতটা চেপে ধরে বুকে রিভলবার ঠেকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো মৃন্ময়,
— ভুল! অনেক বড় ভুল করে ফেলেছেন মিস. এলিনা। আপনার এই গোয়ান্দা গোয়ান্দা খেলাটা আমাকে নিয়ে হলেও বেঁচে যেতেন আপনি তবে…বাবাকে নিয়ে! নো, নো.. এবার তো আপনার বেঁচে যাওয়াটা বড্ড মুশকিল হয়ে পড়লো মিস.এলিনা। আপ…
এটুকু বলতেই হঠাৎ থেমে গেলো মৃন্ময়। কপালে হালকা ভাজ ফেলে একদৃষ্টে রোজার ডানহাতটির দিকে তাকিয়ে রইলো সে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হাতের বাঁধনটা হালকা হয়ে এলো তার। চোখে-মুখে বিস্ময় ভাবটা ফুটে উঠলো প্রবলভাবে। উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে রোজার চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো,
— মিস.রোজা!
“রোজা” নামটা শুনেই চমকে উঠলো রোজা। চোখ দুটোতে রাজ্যের প্রশ্ন নিয়ে অবাক চোখে মৃন্ময়ের দিকে তাকালো সে। এলিনায় যে রোজা সে কথাটা কিভাবে জানলো মৃন্ময়? কিভাবে? রোজার হাজারো প্রশ্নের ইতি টেনে বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো মৃন্ময়,
— আপনি মিস. রোজা?
মৃন্ময়ের এই প্রশ্নের জবাবে কি উত্তর দেওয়া যেতে পারে জানা নেই রোজার। সে কি সরাসরি বলে দিবে, হ্যা আমি রোজা। নাকি বলবে না? তার এই দু’মনা প্রশ্নের মাঝপথেই চোখের চশমাটা টেনে খুলে দিলো মৃন্ময় তারসাথে খুলে নিলো লাগানো জোড়া দুটো ভ্রু। মৃন্ময় বুঝতে পেরে গেছে বুঝতে পেরে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে বামহাতে আগলা চুলের বহরটাও খুলে আনলো সে। সাথে সাথে লম্বা চুলে ছোঁয়ে গেলো পুরো পিঠ। মৃন্ময় দু’পা পিছিয়ে গেলো। হাতের বন্ধুকটা দেয়ালে ছুঁড়ে ফেলে নলটা ভেঙে ফেললো সে। রোজার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে চেয়ারে মাথা নিচু করে বসলো। চোখ-মুখের রঙটাও পাল্টে গেলো ধীরে ধীরে। রোজা মাথা তুলে মৃন্ময়কে একনজর দেখেই চোখে লাগানো লেন্সগুলো খুলে ফেললো। ধীর পায়ে মৃন্ময়ের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
— আমি সত্যিই আপনার কোনো ক্ষতি করতে আসি নি মিষ্টার.আরিয়ান। আমি শুধু আপনার বাবার হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার কারণটাই খুঁজছিলাম জাস্ট। মিডিয়া থেকে একজন মানুষকে এভাবে মিশিয়ে ফেলার পেছনে কাদের হাত আছে তাই জানতে চাই আমি। আপনার ক্ষতি করার ইচ্ছে কোনো কালেই ছিলো না না এখন আছে। প্লিজ, ট্রাস্ট মি!
রোজার কথায় মাথা তুলে তাকালো মৃন্ময়। চোখ দুটো দিয়ে যেন রক্ত ঝরছে তার। মৃন্ময়ের চোখ দুটো দেখে ভয় পেয়ে গেলেও নিজেকে শান্ত করলো রোজা। একবুক সাহস নিয়ে বলে উঠলো,
— আপনি উনার ছেলে হয়ে উনার হারিয়ে যাওয়ার কারণটা জানতে চান না? আমার তো ধারণা আপনি অলরেডি জানেন, কোথায় আপনার বাবা? কি তার ইতিহাস? (একটু থেমে) আপনি একজন ইন্টেলিজেন্ট পার্সন সেইসাথে যথেষ্ট সামর্থ্যবান তাহলে আপনি আপনার বাবার জন্য কিছু করলেন না কেন, মিষ্টার.হিরো? হুয়াই?
এতোক্ষণ একদৃষ্টিতে রোজার দিকেই তাকিয়ে ছিলো মৃন্ময়। হয়তো চোখের ভাষা বুঝার চেষ্টা করছিলো সে। রোজা চুপ করে গেলে আবারও মাথা নিচু করলো সে। মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
— আমি জানি না বাবা কোথায় আছে। ১৪ বছর আগে, বাবা যেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন সেদিন আমি ক্যারাটে ক্লাসে ছিলাম। দেখা হয় নি। ফোনে শুধু বলেছিলো উনি চলে আসবেন। খুব জলদি চলে আসবেন। তারপর কেটে গেলো এক সপ্তাহ, বাবা ফিরলেন না। শুধু ফিরলেন না তা নয়…উনার সাথে সব যোগাযোগই বন্ধ হয়ে গেলো। প্রথমে মাথা না ঘামালেও পরে বুঝতে পারলাম কিছু একটা হচ্ছে। কিন্তু সেই কিছু একটা যে কি তা বুঝতে পারি নি তখন। বাবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার একমাস পরে মা এখানে সেখানে খুঁজ নিতে লাগলেন কিন্তু কেউ সাহায্য করে নি সেদিন। বাবা কোথায় গিয়েছিলেন সেটাও বলে নি আমাদের এমনকি বাবাকেও না। আমার ছোট্ট মাথায় তখন অনেক এলোমেলো প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছিলো কিন্তু উত্তরগুলো ছিলো না। বাবা হঠাৎ কোথায় গেলেন, কেন গেলেন এসব কিছু মা কখনো সরাসরি বলে নি আমায়। বাবাকে হারিয়ে ফেলার চারমাসের মাথায় বদলে যেতে থাকে মা। অল্পতেই রেগে যেতেন, আমার সাথে কথা বলতে বিরক্ত হতেন। সবসময় বলতেন বাবা ফিরবে, বাবা ফিরবে। তখন থেকে রহিম চাচার সাথেই থাকতে শুরু করি আমি। অবশেষে ২০০৮ সালে বাবার হারিয়ে যাওয়ার দিনটিতেই মারা গেলেন মা। আমি আরেক বারের মতো এতিম হয়ে গেলাম। দুনিয়াটা কতোটা কঠিন সেদিন থেকেই বুঝতে শুরু করলাম আমি। টাকা-পয়সার অভাব না থাকলেও টিকে থাকার যুদ্ধ করতে হয়েছে আমায়। নিজেকে একদল লোভী আর স্বার্থপরদের ভীরে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় বাবাকে নিয়ে ভাবার সুযোগ হয়ে উঠে নি আমার। তারপর যখন বড় হলাম, সবটা সামলাতে শিখে গেলাম তখন খুঁজতে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু হাজারো রহস্যের ভেড়াজাল এখনও খুলতে পারি নি আমি। বাবা বাড়ি থেকে যাওয়ার দিন শাইয়াম চাং নামের একজন লোকের সাথে দেখা করেছিলেন উনি। আমার ধারনা লোকটি তার সাথেই ছিলো। লোকটি একজন আদিবাসী ছিলো। সিলেটের চা-বাগানে কাজ করতো লোকটি। আমি গিয়েছিলাম সেখানে, কিন্তু ততোদিনে লোকটি সম্পর্কে সব ইনফরমেশনই হারিয়ে গিয়েছিলো। চা বাগানের মালিকও চেঞ্জ হয়ে গিয়েছিলো। চেঞ্জ হওয়ারই কথা প্রায় ১৪ বছর আগের স্টাফ ছিলো লোকটি। বাবা কোথায় গিয়েছিলো এটা জানতে পারলে হয়তো কিছু…
মৃন্ময়কে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েই কথা বলে উঠলো রোজা,
— বান্দরবান! আপনার বাবা বান্দরবান গিয়েছিলেন মিষ্টার. হিরো।
রোজার কথায় অবাক চোখে তাকালো মৃন্ময়। বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো,
— আপনি কি করে জানলেন মিস.রোজা?
# চলবে….

#part_18
https://m.facebook.com/groups/459470204903112/permalink/943495649833896/

#part_16
https://m.facebook.com/groups/459470204903112/permalink/943495039833957/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here