প্রেমনোঙর_ফেলে,০৪,০৫

0
509

#প্রেমনোঙর_ফেলে,০৪,০৫
#লেখনীতে-মিথিলা মাশরেকা
#পর্ব-৪

-সবে কয়েকদিন হলো দেশে ফিরেছো। এখনই রাত দুটো বাজে বাসায় ফিরতে শুরু করেছো ইচ্ছে? এটা বিদেশের তোমার সেই রঙিন পৃথিবী না ,যে যখন খুশি,যেভাবে খুশি চলবে! এখানে রাত দুটো অবদি কোনো ভদ্রঘরের মেয়ে বাসার বাইরে থাকে না! এটা বুঝতে হবে তোমাকে! নেক্সটদিন থেকে সন্ধ্যের আগেই সব ঘোরাঘুরি শেষ করে বাসায় ফিরবে তুমি। বুঝেছো?

বাসায় ঢোকার সময়ই এসব কথা শুনে পা থেমে গেলো ইচ্ছের। কাধে থাকা গিটারের ব্যাগের ফিতা শক্তমুঠোয় ধরলো ও। কথাগুলো শাষন হলে খুশিখুশি মেনে নিতো ও। কিন্তু এ কথাগুলো ওকে কন্ট্রোল করার উদ্দেশ্যে বলা। সেটা বক্তা,ও দুজনেই খুব ভালোমতোন জানে। অন্যসময় হলে এই ভদ্রমহিলার একটাএকটা শব্দের জবাব দিতো ইচ্ছে। কিন্তু আজ কিছু না বলেই পা বাড়াচ্ছিলো ঘরের দিকে। নিজের কথায় কোনো প্রতিত্তর না পেয়ে অবাক হলেন নাফিজা বেগম। তার জানামতে,এই মেয়ে তার কথার জবাব না দিলে দম আটকে মারা পরবে। তবুও আজ জবাব কেনো দিলো না? ইচ্ছের হাতে থাকা গিফটবক্সে নজর গেলো তার। কি এমন আছে ওই‌ বক্সে,যে ইচ্ছে তাকে প্রতিত্তর করলো না? ওই বক্সে কি ইচ্ছের এতো খুশি হওয়ার কিছু থাকতে পারে? তড়িঘরি করে এগিয়ে এসে বললেন,

-তোমাকে কিছু বলেছি ইচ্ছে!

-গিয়ে ছিলে তো কনসার্টে। পেমেন্ট চেইকের পরিবর্তে গিফটবক্স নিয়ে ফিরছো। তা কোন ফ্যান কি গিফট করলো তোমাকে,আমিও তো শুনি? রাত দুটো অবদি তাকেই সময় দিয়ে আসলে বুঝি?

এটুকো শুনে সিড়িতে আরেকবার থামলো ইচ্ছে। বেশ বুঝতে পারছে ভদ্রমহিলা অকারন ঝামেলা তৈরী করতে চাইছে। এসব কথায় ইচ্ছে রিয়্যাক্ট করলেই সে নওশাদ সাহেবকে বলতে পারবে,ইচ্ছে বেয়াদবি করেছে তার সাথে। তারপর ওরই বাবা ওকে ভুল বুঝবে। এমনটাই হতো এতোগুলো বছর হলো। বিদেশ থেকে ফেরার পর তা আবার শুরু হয়েছে। তাই এসবে নিজেকে অভ্যস্ত করে নিয়েছে ইচ্ছে। পেছনদিক না তাকিয়ে বললো,

-তোমার এসব ননসেন্স শোনার মুডে আমি এখন নেই এস এম। জবাবের মুডও নেই। রুমে যাচ্ছি। বাকিটা সকালে শুনিয়ে দিও।

ইচ্ছে সিড়ি বেয়ে উপরে নিজের ঘরে চলে গেলো। আরেকদফায় অবাক নাফিজা বেগম। আজ এতোগুলো বছরে প্রথমবার ইচ্ছে বললো ওর জবাব দেওয়ার মুড নেই। আবার বললো বাকিটা পরে শুনিয়ে দিতে। মাথায় জট পাকাতে লাগলো বেশকয়েক প্রশ্ন। পা চালিয়ে উনিও নিজের রুমে চলে গেলেন। নওশাদ সাহেব তখন ঘুমে আছন্ন। আস্তেধীরে গিয়ে স্বামীর পাশে শুয়ে পরে হঠাৎই ইচ্ছে বলে চেচিয়ে উঠে বসলেন নাফিজা বেগম। ধরফরিয়ে উঠে বসলেন নওশাদ সাহেব। আবছা আধারে স্ত্রীকে অস্থিরভাবে শ্বাস নিতে দেখে আগে টেবিলল্যাম্প জ্বালিয়ে দিলেন। পাশ থেকে চশমাটা নিয়ে চোখে দিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

-কি হলো নাফিজা? ঠিক আছো তো তুমি? কি হয়েছে?

নাফিজা বেগম অস্থিরচিত্তে বললেন,

-ই্ ইচ্ছে!

-হ্যাঁ। কি হয়েছে ইচ্ছের? এমন করছো কেনো তুমি?

-ই্ ইচ্ছেকে নিয়ে আমি বাজে স্বপ্ন দেখিছি নওশাদ! ম্ মেয়েটা এখনো ফিরলো কি না,কে জানে! তোমাকে কতো করে বললাম ওকে যেতে দিও না কনসার্টে। শুনলে না। রাত দুটো বাজে নওশাদ! আমার ভয় হচ্ছে মেয়েটার জন্য!

-আচ্ছা শান্ত হও তুমি। ইচ্ছে ঠিক আছে। তুমি জানো ও কেমন। এভাবেই চলাফেরা করে অভ্যস্ত ও। কিছুই হবে না ওর। রিল্যাক্স।

নওশাদ সাহেব পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন স্ত্রীকে। দুচুমুক খেয়ে গ্লাস সরিয়ে দিলেন নাফিজা বেগম। বললেন,

-কিভাবে পারো তুমি এভাবে থাকতে নওশাদ? আমার তো প্রতিনিয়ত ভয় হয় তোমার মেয়েকে নিয়ে। আর তুমি…

-আমাদের মেয়ে নাফিজা। ইচ্ছে আমাদের মেয়ে।

নাফিজা বেগম থামলেন। মনের মধ্যে থাকা কোনো এক হিংস্র সত্ত্বা যেনো জ্বলে উঠে বলছে,আমার মেয়ে না ও! পেটে ধরিনি ওকে আমি! বরং ওর জন্য যাকে পেটে ধরেছি,সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ইচ্ছেকে কষ্ট দিলেই শান্তি মিলবে সে সত্ত্বার। অন্যকিছুতে না। নাফিজা বেগম মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,

-হ্যাঁ! আমাদের মেয়ে!

নওশাদ সাহেবও মৃদ্যু হাসলেন। বললেন,

-ওকে নিয়ে এতো ভেবোনা। ঘুমিয়ে পরো। গুড নাইট।

মাথা নেড়ে শুয়ে পরলেন নাফিজা বেগম। স্ত্রীর গায়ে ঠিকঠাকমতো চাদর জরিয়ে দিয়ে নওশাদ সাহেব নিজেও শুয়ে পরলেন। তবে চোখ বন্ধ করতে কষ্ট হচ্ছে নাফিজা বেগমের। এই বাড়ি,গাড়ি,টাকা পয়সা সব অস্বীকার করে,অভিমান করে তার নিজের মেয়েটা চলে গেছে। মনে পরতেই বুকজুড়ে হাহাকার চলে তার। এরমাঝেই গিটারের টুংটাং। টের পেলেন,প্রতিরাতের মতো আজও পাশেই নিজের ঘরের ব্যালকনিতে বসেছে ইচ্ছে। বাবাকে জানান দিচ্ছে,বাসায় এসেছে সে। বালিশ খামচে রইলেন নাফিজা বেগম। তার নিরব আহাজারিতে এই গিটারের সুর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা ছাড়া আর কিছুই নয়!

ইচ্ছে ব্যালকনির দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কোলে গিটারটা নিয়ে বসেছে। গিটারে কোনো এক সুর তুলতে তুলতে,একধ্যানে তাকিয়ে আছে পাশের দেয়ালের দিকে। ওখানে ওর ভাঙা গিটারের প্রতিটা টুকরা অতিযত্মে লাগানো। এমনভাবে সাজিয়ে লাগিয়েছে,তাতে ‘মা’ শব্দটা স্পষ্টতর। ভাঙা গিটারের তারটা একটা বেশ পুরনো পেন্সিলে পেচিয়ে পাশেই ঝুলিয়ে দিয়েছে। একটা সাদা ওড়না গিট দেওয়া পাশের বেতের দোলনায়। ইচ্ছের মাথার উপর আকাশ ভর্তি তারা ঝিকিমিকি করছে। সামনে থাকা রাতের শহরও মিটমিট আলোতে সজ্জিত। কোনোদিকে চোখ গেলো না ইচ্ছের। মৃদ্যু বাতাসে সাদা জর্জেটের ওড়নাটা উড়ে এসে গালে লাগতেই চোখ আবেশে বন্ধ করে নিলো ইচ্ছে। গাইতে লাগলো,

Will you ever come and find me(ii)
Will you ever be mine?
Need you now,oh hold me closer(ii)
Stop the wheels of time…
When I,close my eyes
You’re here, by my side(ii)
All I ever really need is your love
Nothing I could say would ever be enough
Stay a little longer with me,hmm hmm
Won’t stay a little longer with me?
Just stay a little longer with me,hmmm
Won’t stay a little longer with me…

চোখের কোনা বেয়ে জল গরালো ইচ্ছের। গিটারের সুর ছেড়ে ফুপিয়ে কেদে বলে উঠলো,

-মা…

হুহু করে কাদতে লাগলো ইচ্ছে। পেছন থেকে কাধে কারো স্পর্শ পেয়ে কান্না হিচকিতে পরিনত হলো ওর। নওশাদ সাহেব এসে ওর পাশে বাবু হয়ে বসলেন। ইচ্ছের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ইচ্ছে নিজেকে সামলে নিতে লাগলো আস্তে আস্তে। কান্না শেষ করে শুধু নাক টানতে লাগলো একসময়। নওশাদ সাহেব অসহায়ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলেন এতোক্ষন। একসময় বলে উঠলেন,

-তোর এস এম,তোর স্টেপ মম কেনো তোর মা হতে পারে না ইচ্ছে? কি দোষ করেছে সে?

ইচ্ছে চোখ তুলে বাবার দিকে তাকালো। কিছুক্ষন নিরবে তাকিয়ে থেকে,উঠে দাড়িয়ে গিটারটা নিয়ে ঘরের এককোনে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রেখে বললো,

-আই উইশ,তোমাকে বুঝাতে পারতাম বাবা।

-ইচ্ছে…

-ঘুমোও গিয়ে। একা থাকতে চাই।

-মা রে….

ইচ্ছে হেডফোন কানে নিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসলো। নওশাদ সাহেব বুঝলেন,তার বলা আর একটা বর্নও কানে তুলবে না ইচ্ছে। চুপচাপ বেরিয়ে আসলেন ঘর থেকে। বাবা বেরিয়ে গেলে কান থেকে হেডফোন নামিয়ে ঠোট কামড়ে ধরে কান্না সংবরন করলো ইচ্ছে। ফলে রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো আবারো। মায়ের রেখে যাওয়া শেষ চিহ্নটা একটা রাস্তার গ্যাংস্টার এসে এক মুহুর্তে শেষ করে দিলো! মনেমনে একপ্রকার প্রতিজ্ঞা করে বসলো ইচ্ছে,এই প্রাপ্ত নামের মানুষটাকে অপ্রাপ্তির যন্ত্রনায় নিঃশেষ করে দিয়ে,তবেই থা‌মবে ও! তার আগে নয়!

খাবার টেবিলে খাবার সাজিয়ে বইয়ে মুখ গুজে বসে আছেন সাদিক সাহেব। বয়স,দৈহিক গঠন সবদিক দিয়ে বেশ আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্ব এই পঞ্চাশোর্ধ মানুষটার। স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক তিনি। ভার্সিটিতে তার গুরুগম্ভীর রুপেই সবাই পরিচিত। কিন্তু বাসায় সে তার ছেলেমেয়ের কাছে এক বটের ছায়া! বৃহৎ আদরবলয়! তার পাশেই পেট চেপে ধরে বসে আছে পিয়ালী। সামনে এসএসসি পরীক্ষা বলে বেশ অনেকরাত অবদিই জেগে পড়তে হয়েছে ওকে। কোথায় খেয়েদেয়ে সুখের একটা ঘুম দেবে,তা না এক নবাবপুত্তুরের জন্য বসেবসে অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাকে। অবশ্য কেউ জোর করেনি অপেক্ষা করতে। সাদিক সাহেব চশমার উপর দিয়ে চোখ তুলে তাকালেন মেয়ের দিকে। ওর বেহাল দশা দেখে আবারো বইয়ে মন দিয়ে বললেন,

-খেয়ে নিলেই তো পারো।

-তুমিও তো খেয়ে নিলেই পারো।

-খেয়ে ঘুমোতে যাও পিয়ালী। অনেক রাত হয়েছে। এভাবে থাকলে,খুদা,নির্ঘুমে অসুখ করবে।

-সেইম টু ইউ। আমার খিদে নেই। ঘুমও পায়নি। অসুখও‌ হবে না।

শব্দ করে বইটা টেবিলে রাখলেন সাদিক সাহেব। পিয়ালী নির্ভয়ে,শান্তদৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো। সাদিক সাহেব বেশ রাগী গলায় বললেন,

-আজকে আসুক এই ছেলে! আজকে তার একদিন কি আমার একদিন!

পিয়ালী বিরক্তি নিয়ে মাথা খাবার টেবিলে ঠেকালো। ছেলে বাড়ি ফেরার আগে এই আগ্নেয়গিরির মতো রাগ,আর ঘরে ঢুকলেই আইসক্রিমের মতো গলে যাওয়াটা সাদিক সাহেবের অভ্যাস। এরমাঝেই শার্টের কলারের কাছের বোতাম একহাতে খুলতে খুলতে ধীরস্থিরে বাসায় ঢুকলো প্রাপ্ত। সাদিক সাহেব ওর ঘর্মাক্ত চেহারা দেখেই সবেমাত্র বলা কথাটা ভুলে গেলেন যেনো। এগিয়ে গিয়ে নরম গলায় বললেন,

-কিরে বাবা? এভাবে ঘেমেছিস কেনো? হেটে আসলি? বাইক নিয়ে যাসনি?

বাবার স্বর শুনে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে রেখেই হাসলো পিয়ালী। সব রাগ হাওয়া ওর বাবার। মাথা না তুলে বললো,

-তোমার ছেলের গায়ের ঘামগুলো বোতলজাত করে রাখো বাবা! কতো মুল্যবান সেগুলো! প্রফেসর সাদিকের রাগকে গলিয়ে দেয় বলে কথা!

প্রাপ্ত একপলক বোনের দিকে তাকিয়ে বাবাকে হতাশভাবে বললো,

-খেয়ে নিলেই পারো বাবা।

কিছুটা অন্যদৃষ্টিতে তাকালেন সাদিক সাহেব। পিয়ালীর সাথে দুষ্টুমি না করে প্রাপ্ত আজকে এভাবে কথা বলছে দেখেই কিছুটা অন্যরকম লাগলো তার। বললেন,

-কোনোদিনও খেয়েছি? যে আজ খাবো? কিন্তু তোর চোখমুখ এমন কেনো দেখাচ্ছে? কি হয়েছে প্রাপ্ত?

-এবার আমি খিদেয় মরেই যাবো বাবা! ছেলের উপর পরে স্নেহবর্ষন করিও! আগে খেতে দাও!

প্রাপ্ত বাবাকে ইশারায় বসতে বলে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। একটা অফ হোয়াইট টিশার্ট আর নেভি ব্লু ট্রাউজার পরে নিলো। রুম থেকে বেরিয়ে দেখে বাবা,বোন খেতে বসে গেছে। সাদিক সাহেব পিয়ালীকে খাইয়ে দিচ্ছেন। প্রাপ্তকে দেখে উনি খাবার মাখাতে মাখাতে বললেন,

-আজকে লাউ চিংড়িটা খুব মজা হয়েছে। তাইনা পিয়ালী?

-ইয়াপ!

ঠোটে হাসি ঝুলিয়ে পাশের চেয়ার টেনে বসে গেলো প্রাপ্ত। সাদিক সাহেব পরের লোকমা ওর মুখে তুলে দিয়ে বললেন,

-দেখতো খেয়ে! রুই আর ডালও রেধেছি। তবে আগে এটা টেস্ট কর!

প্রাপ্ত তৃপ্তি নিয়ে খেতে খেতে বললো,

-আপনি অধ্যাপনা ছেড়ে সাদিকস্ কিচেন খুলে বসুন জনাব! ইটস্ ইয়ামিয়েস্ট!

সাদিক সাহেব ভাব নিয়ে হেসে বললেন,

-দেখতে হবে তো! বাপটা কার!

-ইয়াহ্! পিয়ালীর বাবা বলে কথা!

পিয়ালীর মাথায় চাটি লাগালো প্রাপ্ত। বললো,

-কিচেনে গেছিস কোনোদিন? এসেছে শেইফ সাজতে! বাবা কথাটা দিয়ে প্রাপ্তর বাবা বুঝিয়েছে!

-এসেছে ক্রেডিট নিতে! আর রইলো কথা কিচেনে যাওয়ার? আমি কেনো যাবো কিচেনে? এখন তো বাবা খাওয়াচ্ছে। তুই তো কোনোদিন খাওয়াবি না রেধে। তবে ভাবি আসুক! সব উশুল করে নেবো!

-কিন্তু পিয়ালী,তোর ভাবি যদি রান্না না জানা কোনো মেম হয়? তখন?

হেসে দিলো পিয়ালী। সাথে সাদিক সাহেবও। কিন্তু বাবার কথা শুনে খাবার চিবোতে থাকা মুখ আপনাআপনি থেমে গেলো প্রাপ্তর। পিয়ালীর সাথে করা দুষ্টুমির হাসিটাও নেই আর ওর ঠোটে। মুহুর্তেই ইচ্ছের চেহারা ভেসে উঠেছে ওর সামনে। গ্লাসের পানি শেষ করে কোনোমতে নিজেকে সামলে বললো,

-আর খাবো না বাবা। ঘুম পেয়েছে।

পিয়ালী,সাদিক সাহেব দুজনেই বুঝলো প্রাপ্তর মনে এই মেমসাহেবের উল্টো প্রতিচ্ছবি আকা। তাই এই আলোচনা পছন্দ হয়নি ওর। সাদিক সাহেব বললেন,

-ডোন্ট ওয়ারী প্রাপ্ত,আমি এটলিস্ট তোমার অপছন্দের কাউকে বউমা করে আনার জন্য কোনোদিন বলবো না তোমাকে!

প্রাপ্ত মুচকি হেসে বললো,

-জানি বাবা!

সাদিক সাহেব হাত ধুয়ে উঠে দাড়ালেন। তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে বললেন,

-দেন? নিজেকে বুঝতে শেখো। তাতেই হবে। আর দুদিন পর ডিপার্টমেন্ট থেকে ট্যুরে‌ যাচ্ছি। সোলার এনার্জী নিয়ে আলাদা কিছু করার প্লান আছে আমাদের। গ্রামের নাম ভাদুলগাঁও। একেবারে প্রত্যন্ত এলাকায়। তোমাদের ছেড়ে প্রথমবার এতোদুর যাবো। কিভাবে থাকবো জানিনা,তবে ইটস্ আ মাস্ট প্রাপ্ত!

বাবার কথায় মন খারাপ করে ফেললো পিয়ালী। কিন্তু প্রাপ্ত মাথা নেড়ে আশ্বস্ত করলো বাবাকে। বাবা ছাড়া ওরা দুজনই অসম্পুর্ন। তবু কিছুই করারও নেই। সবাই নিজনিজ ঘরে চলে গেলো। রুমে ঢুকে প্রাপ্ত চিৎ হয়ে শুয়ে পরলো বিছানায়। মনটা হঠাৎই এলোমেলো লাগছে ওর। অস্থির লাগছে অকারনে। সারাদিনে যা যা ঘটেছে,সবকিছুর সাথে অপরিচিত ও। জীবনের নতুন ঘটনাগুলো বড় অদ্ভুত! আর তারচেয়ে বড় কথা,যা কিছু নতুন,যা কিছু প্রথমবার ঘটে,নিয়তি তাতে অবশ্য অবশ্যই ব্যতিক্রম কিছু লিখে রাখে যে!

#চলবে…

#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে-মিথিলা মাশরেকা
#পর্ব-৫

একহাতে কুড়োল,আরেকহাতে মাথায় থাকা কাঠের টুকরোর বোঝা ধরে বাড়ির দিকে পা চালাচ্ছে খই। সকালে পুবের কাঠবাগানে গিয়ে কাঠ কেটে,বাড়ি বয়ে এনে তবেই খাবার মুখে তোলে ও। তার আগে না। আজকে কুড়োল‌‌ নিতে গিয়ে হাড়িভর্তি পান্তা দেখেছে ও। বাড়ির নিচে নামতেই ছোট্ট ভিটেটায় লাউ কুমড়োর গাছের সাথে কয়েকটা মরিচগাছ বুনেছে ওর মা। কাঠবাগানে যাওয়ার সময় চকচকে চোখে গাছের মরিচগুলোতে চোখ বুলিয়ে গেছে খই। বাড়ি ফিরে ওই‌ মরিচ দিয়ে পান্তা সাবার করবে বলে। বাড়ির সামনের ঢালু বেয়ে উঠতে গিয়ে শুকনো এক শামুক খালিপায়ে বিধলো খইয়ের। একটু দাড়িয়ে পা উচিয়ে দেখলো একপলক ও সেটা। কুড়োলটা গলা,কাধে ভারসাম্য করে একহাতে পা থেকে খুলে ফেললো শামুকের টুকরো। বেশ অনেকটা গভীরে থেকে রক্ত বেরোতে লাগলো জায়গাটার।

বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে ঘাসে পা ডলা মারতে শুরু করে দিলো খই। বিরবিরিয়ে বার দুয়েক পড়লো,’কাটা বাধায় শঙ্খিনী,দুব্বাঘাসে কাদম্বিনী। কাটা বাধায় শঙ্খিনী,দুব্বাঘাসে কাদম্বিনী!’ মিনিটখানেকের মধ্যেই জ্বালাটা কমেছে। জ্বালা কমানোর এই অমোঘ মন্ত্র খই ওর মায়ের কাছ থেকে শিখেছে। মায়ের কথা আসলেই মিথ্যে হয়না! ব্যথা পুরোপুরি ভুলে,কাঠ মাথায় করে,হেলেদুলে বাড়িতে উঠলো খই। কাঠ নিচে রেখে মাটির বারান্দায় বসে গেলো। পায়ের উপর পা তুলে দেখার চেষ্টা করলো কতোটা কেটেছে শামুকে। সাহেরা বানু দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা গোবরলাঠিগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলো। মেয়েকে দেখে বললো,

-কিরে? পায়ে কি হইছে?

-শামুক বিন্দাইছে মা।

সাহেরা তড়িৎবেগে ছুটে আসলো মেয়ের কাছে। পায়ের কাছে বসে গেলো মেয়ের। খই পা সরিয়ে ব্যস্তভাবে বললো,

-আরে আরে মা! করো কি? দুব্বায় ডলা দিছি,ঠিক হইয়া গেছে তো! পা থাইকা উডো তুমি! উডো!

সাহেরা আগে খইয়ের পা টেনে পরখ করে নিলো কতোটা কেটেছে। রক্তক্ষরন নেই। তবে ক্ষতটা গভীর। নিজেও খইয়ের পাশে রোয়াকে বসে গেলো এবার। পুরোনো কাপড়টার ছেড়া আঁচল কোমড়ে গোজা ছিলো। আঁচল কোমড় থেকে ছাড়িয়ে খইয়ের চোখমুখ মুছিয়ে দিয়ে বললো,

-খিদা লাগে নাই? ক্যান যাস সকালে কাঠতলায়? আমিই যাইতাম নয়?

-তুমি তো জানোই মা,কাঠ না বইলে আমার খিদা লাগে না। ওহন খুব খিদা লাগছে। চারডা বিন্দিমরিচ তুইলা আনি গাছ থাইকা?

সাহেরা কপাল কুচকে বললো,

–ক্যান? বিন্দিমরিচ দিয়া ক্যান খাবি তুই? ঘরে তো পটল আর বড়মাছের তরকারী আছে। আমি তর লাগি মাছের মুড়ো রাখছি খই!

-বুবু তো সকালে যাওনের সময় মাছের মুড়োডা আমারে দিয়া দিছে বানু মা!

জ্বিভ কেটে বসে ছিলো খই। এই মরিচের কথা বলা মোটেও‌উচিত হয়নি ওর। কিন্তু মাকে সামলাতে ওর কিছু বলার আগেই পাশ থেকে বছর ছয়েকের এক মেয়ে কথাটা বলে উঠলো। সাহেরা মেয়েটার দিকে বড়বড় চোখে তাকালো। শব্দ করে নিজের কপালেই চড় লাগালো খই। আজকে আবার শনি আছে পুঁটির কপালে। সাহেরা বিস্মিত কন্ঠে বললো,

-মুড়ো তরে দিছে মানে? তুই না রাইতের বেলা আইলি পুঁটি? তরেও তো একটা বড়মাছের চাকা দিছিলাম আমি! আবার সকালে আইসা বুবুর মুড়ো নিছোস তুই?

সাহেরার গলা শুনে গলা শুকিয়ে গেলো পুঁটির। আশেপাশে মার লাগানোর মতো কিছু খুজলো সাহেরা। একছুট লাগিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো পুঁটি। এবার অগ্নিচক্ষু করে খইয়ের দিকে তাকালো সাহেরা। খই কথা ঘোরানোর জন্য বললো,

-ও্ ও মা! খিদা লাগছে! দেও না বিন্দিমরিচ আইনা! যেই গরম পরছে! পান্তা নেতায়া যাইবো কইলাম!

-ক্ কইতাছি যে,আমার পুতুলডার কাইল বিয়া। ব্ বদুকাকারে দাওয়াত দেই?

-ও্ ওমন করো ক্যান মা? পুঁটিটার ম্ মুড়ো পছন্দ! তাই দিছি! ওর মা তো এতোবড় মুড়ো দিবার পারবো না ওরে! আমি আরেকদিন খামুনে। না খাইয়া তো মইরা…

সাহেরা তৎক্ষনাৎ চড় লাগিয়ে দিয়েছে খইয়ের গালে। গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো খই। আর সাহেরা মুখে আঁচল গুজে কাদছে। গালে ব্যথা না পেলেও মায়ের কান্না দেখে বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠছে খইয়ের। মায়ের দিকে এগিয়ে বসে আদুরে গলায় বললো,

-ও মা? মা? কান্দো ক্যান তুমি? ও মা?

-কতোবার কমু তরে? কতোবার কেমনে কেমনে বুঝামু? আমার কথার অমান্য হইস না খই! আমি যা কই,তর ভালোর লাইগাই কই! মন তো চায় তরে আসমানের তারা দিয়া সাজাই,মন তো চায় তরে জমিদারবাড়ির খাওন খাওয়াই,মন তো চায় তরে রাজকন্যার মতন কইরা কোনো প্রাসাদে রাখি! কিন্তু কি করমু ক? তর মায়ে তো অক্ষম! তর মা তো কিছুই পারে না! এল্লাগাই তো তুই মরার কথা কস তাইনা মুখপুড়ি? তুই ছাড়া তো এই সাহেরাও বাচবো না! তাতেই শান্তি তোর তাইনা? তাইলে হুন! পরেরবার মরার কথা কওনের আগে আমারে কইস! আমি কলস নিয়া শুকমরায় ডুব দিমু! তুইও বাচবি,আমিও মইরা শান্তি পামু!

রোয়াকের বাঁশ জরিয়ে হুহু করে কাদতে লাগলো সাহেরা। খই ফাকফোকর খুজে,শিশুর মতো মায়ের বুকে মুখ গুজলো আস্তেধীরে। সাহেরা কান্না থামিয়ে ফোপাতে লাগলো। এই মেয়ে ওর কোলে মাথা রাখলেই ওর কোল জুড়িয়ে যায়। খই গোজাস্বরে বললো,

-মরার কতাখান আর কোনোদিনও কমু না মা! এইবারের মতো মাফ কইরা দেও?

মুহুর্তেই সব দুঃখ বিলীন সাহেরার। আঁচলে ও চোখমুখ মুছলো নিজের। উঠে গিয়ে পান্তার সাথে নিজের জন্য রাখা মাছ নিয়ে আবারো খইয়ের সামনে বসলো। খই‌ বললো,

-এইডা তো তুমি খাইবা!

-একলগে খাই। নে হা কর!

মেয়েকে খাওয়াতে খাওয়াতে নিজেও খাচ্ছিলো সাহেরা। খই‌ খুশিমনে খেতে লাগলো। সাহেরা বললো,

-কাইল মুন্সীবাড়ি শহর থাইকা লোকজন আইবো। তুই কাইল থাইকা মুন্সীবাড়ির ওইদিক যাবি না। গেরোস্তবাড়িতেও যাইবি না। মনে থাকবো?

খাবার না চিবিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো খই। এই পুরো গ্রামে পাখির মতো উড়ে বেরানোর অনুমতি আছে ওর। কিন্তু মাঝেমধ্যেই যখন কোনো কাছারীবাড়িতে শহুরে কেউ আসে,মা তখনই ওকে ঘরবন্দি করে‌ দেয়। কেনো এমনটা করে, কতোবার জিজ্ঞাসা করেছে ও মাকে। জবাব মেলেনি। আজও মিলবে না। ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে আবারো ভাত চিবোতে লাগলো। মেয়ের মনভারি দেখে সাহেরা বললো,

-গোলাম মুন্সী কইলো,হ্যাগো রান্দনের লোক লাগবো নাকি। ভাবতাছি আমি যামু।

খইয়ের চোখ চকচক করে উঠলো। সাহেরা স্বাভাবিককন্ঠে বললো,

-কেউ যদি চাঁদ দেখা ম্যাশিন আনে,আমি লইয়া আনুমনে তর লাইগা। এবার খুশি?

-হ হ! মেলা খুশি!

চেচিয়ে মাকে খুশিতে জাপটে জরিয়ে ধরলো খই। এই একটাই শখ ওর। যবে থেকে স্কুলের কাজল আপা চাঁদকে কাছ থেকে দেখা যায় ওমন মেশিনের নাম বলেছে,মন প্রান সব ওই মেশিনের নামেই করে দিয়েছে খই। যে করেই হোক,কাছ থেকে চাঁদ দেখা চাই ওর। মেয়ের পাগলামি দেখে মৃদ্যু হাসলো সাহেরা। পরপরই হাসি মিইয়ে গেলো তার মুখ থেকে। এটুকোতেই খুশি হয়ে যাওয়া এই মেয়েকে কিছুই দিতে পারলো না ও। মনে হয় এই আফসোসগুলো আস্তেআস্তে জড়ো হয়ে ওকে দমবন্ধ করে মেরে দেবে একসময়। কঠোর বাস্তবতা আর নিজের মৃত্যুতে ভয় নেই সাহেরার। ভয়টা একজায়গায়। ওর কিছু হয়ে গেলে,তখন খইয়ের কি হবে? কে দেখবে খইকে?

সারারাত ভর জেগে জেগে,লিখনের প্রেজেন্টেশন কভার করে,সকাল এগারোটায় বাসায় ফিরলো রাকীন। গাড়ি পার্ক করে কপাল দু আঙুলে চেপে ধরে ভেতরে ঢুকলো ও। ড্রয়িংরুমে রাজীব মাহমুদ পেপারে মগ্ন ছিলেন। ছেলেকে বাসায় ঢুকতে দেখে স্বাচাবিক গলায় বললেন,

-সারারাত ইনিশাতে ছিলে রাকীন?

রাকীন চমকে উঠে সোফার দিকে তাকালো। এ সময় ওর বাবার বাসায় থাকার কথা না! প্রতিদিনই ইনিশায় ন’টার মধ্যে পৌছে যান রাজীব মাহমুদ। আজকে যাননি দেখে বিস্মিত না হয়ে পারলো না রাকীন। শার্টের হাতাটা টেনে বোতামটা লাগাতে যাচ্ছিলো ও। রাজীব মাহমুদ বললেন,

-ফ্রেশ হয়ে নাও গিয়ে। আমি খাবার রুমেই পাঠাতে বলছি তোমার মাকে। খেয়ে ঘুম দেবে। বুঝেছো?

রাকীন ঠোট কামড়ে হাসলো। ও কতোটুকো বুঝেছে,সেটা বিষয় না। বিষয়টা হলো,ওর বাবা ওকে কতোটা বোঝে। বেশ টের পেয়েছে ওর ওপর দিকে ঠিক কতোটা গেছে যার জন্য সারারাত ইনিশাতে থাকতে হয়েছিলো ওকে। আর এজন্যই এসব বললো ওর বাবা। ওর গর্ব হয় ওর বাবাকে নিয়ে। অঢেল সম্পত্তির উত্তোরাধিকার কথার বিপরীতে,মানুষ হতে গেলে যা যা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়,সবটা ওর বাবা ওর জন্য তৈরী করে রেখেছে। এজন্যই রাজীব মাহমুদ এক সম্মানের নাম। এক শ্রদ্ধার নাম। আসছি বলে চলে আসছিলো রাকীন। রাজীব মাহমুদ বলে উঠলেন,

-প্রেমের বয়স পার করে বিয়ের বয়স হয়ে গেলো। প্রেম তো করলে না। বিয়েটিয়ের কথা কি ভেবেছো? নাকি ইনিশাকে নিয়েই সংসারধর্ম পালন করবে?

রাকীন থেমে গেলো। বাবার দিকে না ফিরে হেসে দিলো ও। কপালে হাত রেখে খানিকক্ষন নিশব্দে হেসে পেছন ফিরে বললো,

-আমার যে বিয়ের বয়স হয়েছে,সেটা ইচ্ছে দেশে ফেরার পর কেনো তোমার মনে পরলো তোমার বাবা?

-আমি বিয়ের কথা বলতেই তুমি তার সাথে ইচ্ছের দেশে ফেরাকে কেনো রিলেট করছো রাকীন? তাছাড়া ভুল কি বললাম আমি? সত্যিই কি বিয়ের বয়স হয়নি তোমার?

রাকীন পা বাড়ালো। রাজীব মাহমুদ বললেন,

-উত্তর না দিয়েই যাচ্ছো যে? মৌনতাকে সম্মতির লক্ষ্মন ধরবো?

-ঘুমোতে বললে না? যাই! স্বপ্নযোগে আগে তোমার বউমার সাথে আলোচনা করে আসি। উভয়পক্ষের মতামত তো জরুরী তাইনা?

রাকীন নিজের ঘরে চলে আসলো। শাওয়ার শেষ করে খালি গায়ে শুধু ট্রাউজার পরে বিছানায় বসলো। ভেজা চুল একদমই মোছে নি। মুচকি হেসে আগে মোবাইলটা হাতে নিয়ে টেক্সট করলো ইচ্ছেকে। পরে ফোনটা পাশে ছুড়ে মাথায় তোয়ালে চালিয়ে ব্যালকনির দিকে এগোলো। বাগানের ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে গতি কমে আসলো ওর হাতের। মৃদ্যু হাসি ঝুলিয়ে রাকীন চেয়ে রইলো ফুলগুলোর দিকে। হাজাররঙা রঙিন ফুলগুলোর মতো,সত্যিই জীবনেরও অনেক রঙ। কখনো লক্ষ্যকে চিনতে শেখা,কখনো লক্ষ্যের পেছনে ছোটা,কখনো লক্ষ্যকে ভালোবাসা,কখনো ভালোবেসে লক্ষ্যচ্যুত হওয়া,কখনো বা লক্ষ্যকে খুজতে গিয়ে ভালোবাসা পাওয়া। শেষের দুটোর কোনোটাই ঘটেনি রাকীনের সাথে। এই দুটোর অপেক্ষাতেই আছে ও। তবে দুটোতে কমন যেটা,সেটা হলো ভালোবাসা। এই শব্দকে খুজে পেতে গিয়ে রাকীন প্রথমটায় গা ভাসাবে,নাকি দ্বিতীয়টায় প্রেমনোঙর ফেলবে,সেটা তো নিয়তিই জানে…

ঘুমের ঘোরে ম্যাসেজের শব্দ কানে আসলো ইচ্ছের। চোখ তুলে তাকালো ও। বাটন ফোনটায় দুটো কল আর একটা আনরিড ম্যাসেজের নোটিফিকেশন। কলদুটো বাবার। ব্রেকফাস্টের এলার্ম যাকে বলে। আর ম্যাসেজটা রাকীনের। এই মোবাইলে কল ম্যাসেজের সুযোগ হাতেগোনা কয়েকজনের আছে। তারমধ্যে রাকীন একজন। ওয়াইফাই বন্ধ করে অন্য মোবাইল এরোপ্লেন মোডে রেখে ঘুমিয়ে যায় ও। তাই সে সময়টায় এই বাটন ফোনে শুধু কয়েকজনই যোগাযোগ করতে পারবে ওর সাথে। উঠে বসে রাকীনের ম্যাসেজটা ওপেন করলো ইচ্ছে। ওতে সুন্দরমতো লেখা,

‘এইযে ইংলিশ মেম? ঘুম ভাঙেনি আপনার? এদিকে আপনার আর আমার বিয়ের তোড়জোড়ে পাড়া প্রতিবেশীর যে ঘুম হারাম সে খবর কি আপনি রাখেন? ইনিশার পর সেইযে আপনার ইন্জেরী গালির প্রেমে পরলাম,আর কোনোদিকে মন বসাতেই পারছি না! আর আমার বাবা সেটা টের পেয়ে আমাকে সেই গালির রাজ্যের শেহজাদা করে দেবে বলে তালুতে তালু ঘষে চলেছে। এবার আপনিই বলুন,আমার কি করনীয়? দেশে ফিরে তো একবারও দেখা করলেন না। আমার বেচারা হৃদয়খান যে কতোশত টুকরায় টুকরায়িত হয়ে গেলো,তার কি হবে? তো তার দায় নিতে হলেও একবার দেখা করবেন কেমন? এখন আমি ঘুমোতে যাবো। সন্ধ্যায় দেখে হচ্ছে। ততোক্ষন ভালো থাকিয়েন হবু বউটাহ্! আপনার দিনটি সুখময় হোক!’

নিশব্দে হেসে দিলো ইচ্ছে। এই ছেলেটা পারেও। ম্যাসেজ দেখে মন ভালো হয়ে গেছে ওর। খুশিমনে বিছানার পাশে হাত বাড়িয়ে গিটার খুজলো প্রতিদিনের মতো। খুজে না পেয়ে ধক করে উঠলো ওর ভেতরটা। পাশ ফিরে বসলো ইচ্ছে। মনে পরলো,আগেরদিন প্রাপ্ত ওটা ভেঙে ফেলেছে। নিমিষেই বিস্বাদ নেমে আসলো ওর চেহারায়। শক্ত চোখমুখে ফুটে উঠলো প্রতিত্তরের তীক্ষ্মতা।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here