প্রেমনোঙর_ফেলে,০৬,০৭

0
460

#প্রেমনোঙর_ফেলে,০৬,০৭
#লেখনীতে-মিথিলা মাশরেকা
#পর্ব-৬

মোটামুটি আধঘন্টা যাবত রাকীন রেস্ট্রুরেন্টে বসে জুসের গ্লাসের স্ট্র নেড়ে চলেছে। এক চুমুকও দেয়নি ওতে। ইচ্ছের সাথে দেখা করবে বলে এখানে আসা। সে মেয়ের এখনো খবর নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মোবাইল বের করলো ও। ফোনেই নিজের কিছু এক্সপেরিমেন্টাল ডকুমেন্টস্ গোছাতে‌ লাগলো। বেশ অনেকটা সময় পর অনুভব হলো কেউ ওর সামনে এসে দাড়িয়েছে। মুচকি হেসে মোবাইল থেকে চোখ তুলে তাকালো রাকীন। গাঢ় বেগুনি আর সাদা রঙের টপস্ পরে‌ খোলা চুলে ওর সামনে দাড়িয়ে ইচ্ছে। বেগুনি রঙেরই একটা স্কার্ফ গলায় পেঁচানো ওর। চোখের কালো সানগ্লাসটা ফর্সা চেহারায় বেশ মানানসই। ইচ্ছের বরাবর চোকারের প্রতি ঝোঁক। গিটার শেইপের লকেটটা এখনো রইয়েই গেছে ওর গলায়। ওটা দেখে হাসিটা প্রসারিত হলো রাকীনের। উঠে দাড়িয়ে মোবাইল পকেটে পুরতে পুরতে বললো,

-এতোক্ষনে আসার সময় হলো তোর হবু বউ?

-এটুকো অপেক্ষা করতে না জানলে কিসের হবু বর তুই? বাই দ্যা ওয়ে,কল‌ মি আপনি! তোর আপনি সম্বোধনের ম্যাসেজটা মনে ধরেছে!

ভাবলেশহীনভাবে কথাটা বলে ইচ্ছে এর কপালের চুল আটকে রাখা ছোট ক্লিপটা খুলে দিলো। তারপর রাকীনের সামনের টেবিলে দুহাত রেখে দাড়ালো বেশ আরামের ভঙিমায়। রাকীন হেসে দিলো। বিদেশে থেকেও স্বভাব আচরন এতোটুকোও বদলায়নি এই মেয়ের। নিজের মাথার চুলগুলো উল্টে ধরে ভাব নিয়ে বললো,

-আবার আপনিতে যেতে চাস? সেই ছোটবেলা থেকে অপেক্ষায় রেখেছিস ইচ্ছে! এখনো এভাবে অপেক্ষায় রাখলে তোকে কিন্তু বিয়েই করবো না বলে দিচ্ছি!

ইচ্ছে মৃদ্যু হেসে চেয়ার টেনে,পায়ের উপর পা রেখে বসে গেলো। সানগ্লাসটা খুলে টেবিলে রেখে চুইংগাম চিবোতে চিবোতে লাগলো নির্বিকারভাবে। ভাবখানা এমন,তুই বল,তোর মুল্যহীন কথা আমি অতি মনোযোগ দিয়ে শুনছি। রাকীন অবাক হলো না। এই মেয়ের স্বভাবচরিত্র বেশ ভালোমতোই জানে ও। ফু দিয়ে একটা শ্বাস ছাড়লো। ইচ্ছের সামনের চেয়ারটায় বসে গিয়ে বললো,

-আধঘন্টা হলো বসে আছি।

-আধঘন্টাতে একটা জুশও শেষ করতে পারিস নি। আর আমাকে বিশ্বাস করতে বলছিস তোর এই আধঘন্টার কাহিনী? সিরিয়াসলি?

প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বুকে হাত গুজে বসলো ইচ্ছে। আর যুক্তি দেখানোর মন চাইলো না রাকীনের। অতিবেশি আগ্রহ নিয়ে ও দুহাত টেবিলে রেখে তাতে মুখ গুজে বললো,

-ওসব ছাড়! আগে দেখতে দে তোকে! কতো বড় হয়ে গেছিস তুই ইচ্ছে! সেই এইটুক খরগোশের সাইজের দেখেছিলাম তোকে! বিদেশে গিয়ে ভাতের পরিবর্তে হরলিক্স আর কমপ্লান খেয়ে বড় হয়ে আসলি নাকি?

ইচ্ছে আরো আরাম করে হেলান দিয়ে বসলো চেয়ারে। বললো,

-রাজীব আঙ্কেল তো আর কোনো খরগোশের বাচ্চাকে ছেলেবউ করবে না। তাই এই নিন্জা টেকনিক।

চোখ মারলো ইচ্ছে। রাকীন হেসে দিলো। ইশারায় মেনুকার্ড দেখিয়ে বললো,

-আগে খাওয়া। আর বিল আজকে তুই পে করবি ওকে? আমিও তো দেখি,সেলিব্রিটি বউ আমাকে খাওয়াতে পারবে কি না?

-তোর মতো হাজারটা রাকীনকে‌ খাওয়ানোর সামর্থ্য রাখে ইনায়াত নিক্কন। শুধু বিয়েতে একবার রাজি হয়েই দেখনা! একদম ননীর পুতুল করে রাখবো!

রাকীন হেসে দিলো। এই রাজী হওয়া টপিকটা একে ওপরের উপর চাপিয়ে আসছে এতোগুলো বছর হলো। রাজীব মাহমুদ আর নওশাদ সাহেবের কবে কিভাবে পরিচয় কে জানে,তবে সেই ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে আর রাকীনকে একসুত্রে বাধার চিন্তাভাবনা দুজনেরই। মোটামুটি একসাথেই বড় হয়েছে রাকীন ইচ্ছে। আর তাতে ওদের সম্পর্কটা গাঢ় হয়েছে প্রতিনিয়ত। এখনো হচ্ছে। তবুও পরিবারের কথাকে পাত্তা না দেওয়ার দলে ওরা। তবে দুজনেরই বিশ্বাস,ওরা দুজন দুজনে এতোটাই বোঝে,একে ওপরের জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত কাউকে হয়তো কোনোদিন পাবে না। আর সম্পর্কে বুঝতে শেখাটাই বড় বিষয়। তাই বেশ চলে যাচ্ছে এই হবু বর,হবু বউ সম্পর্ক। অনেকটা সময় হাসিখুশির সাথে পার করলো দুজন। এরমাঝে হঠাৎই ফোন বেজে ওঠে রাকীনের। কল রিসিভ করে,ওপাশ থেকে কিছু শুনে রাকীন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অনেকটা বেশিই খুশি হয়ে গেলো। খুশি উপচে পরছে ওর চোখমুখে। রাকীন ফোন কেটে তাড়াহুড়ো করে উঠে দাড়িয়ে বললো,

-তুই খুব লাকি ইচ্ছে! দেখনা! তুই আজই আমার সাথে দেখা করতে আসলি,আর আজই হয়তো আমার পেশা আর প্যাশন এক হতে চলেছে! ফাইনালি!

লাকি কথাটা শুনে তাচ্ছিল্য আসলো ইচ্ছের। সেরকম কিছু প্রকাশ না করে বললো,

-হবু বউকে ছেড়ে পেশা এন্ড প্যাশন নিয়ে পরছিস রাকীন? নট ফেয়ার!

-বউকে খাওয়ানোর জন্য তো নিজের রেকোগনেশন থাকা জরুরি তাইনা?

ইচ্ছে কথা বাড়ালো না। ও জানে রাকীন অকারনে এতো খুশি হয়নি। নিজের জীবনে তো কোনোদিন এতো সুখ দেখলো না,রাকীনের খুশি দেখেই ভালো লাগছে ওর। বললো,

-আচ্ছা। আয় তুই!

-তুই এখানে একাকী বসে বসে কি করবি?

ইচ্ছে ইশারা করলো কিঞ্চিত পেছনের টেবিলদুটোর দিকে। আসার পর থেকেই দুটো গ্রুপে আসা ছেলেমেয়েরা ওর দিকে তাকিয়ে কথা বলার সুযোগ খুজছিলো শুধু। হয়তো এগিয়ে কথা বলার সাহস করে উঠতে পারেনি। রাকীন বুঝলো,ওদেরকে সময় দেবে বলে ঠিক করেছে ইচ্ছে। সুটটা হাতে ঝুলিয়ে বললো,

-ওহ্! পাঙ্খাগন্স! থাক তুই তোর বাতাসাপার্টি নিয়ে। আর হবু বরকে এতো সহজে হাতছাড়া করার পরিনাম ভোগ করার জন্য প্রস্তুত থাকিস।

-আমি ছাড়া আর কাউকে নিজের মনে বা তার মনে নিজেকে ধরাতে পারলে বলিস!

নির্বিঘ্নে কথাটা বললো ইচ্ছে। কারন ও জানে রাকীন কেমন। রাকীন টেবিলে হাত রেখে ঝুকে দাড়ালো। বাকা হেসে বললো,

-যদি পেয়ে যাই?

-নিজে দাড়িয়ে থেকে বিয়ে দেবো তোদের।

রাকীন হেসে সোজা হয়ে দাড়ালো। হাটা লাগিয়ে বললো,

-হাজবেন্ড শেয়ারিং কই তুমসে সিখে মেরি জান! অবশ্য তুই ছাড়া মনে হয়না কাউকে ধরতে পারবো! সেদিক থেকে তোর কনফিডেন্স লেভেল হাই থাকা অস্বাভাবিক কিছু না।

-বলছিস আমি শেয়ারিং জানি?

-অভিয়াসলি!

-তাহলে খেয়া যা করেছিলো,সেটাকে কি বলবি তুই?

রাকীন বেরিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু আকস্মাৎ ইচ্ছের এমন কথার জন্য প্রস্তুত ছিলো না ও। পা থেমে গেছে ওর ওই একটা নামে। কাতর চাওনি ফ্লোরের দিকে রেখে ও থেমে রইলো দু দন্ড। ইচ্ছে বললো,

-সত্যিই খেয়ার কথা তোর মনে পরে না রাকীন?

রাকীন পেছন না ফিরে বললো,

-যে মনে রাখেনা,তাকে মনে রাখতে নেই ইচ্ছে। স্মৃতির দরিয়ায় নোঙর ফেলার চেয়ে,বর্তমানের উত্তল স্রোতে গা ভাসানো শ্রেয়। স্রোতের চেয়ে স্মৃতি বেশি ভয়ানক!

রাকীন বেরিয়ে গেলো। বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ইচ্ছের। আজই হঠাৎ এভাবে ওর কথাটা বলা একদমই উচিত হয়নি। তবুও বলে ফেললো। কিছুকিছু ঘটনার সাপেক্ষে আমাদের বুঝে ওঠার ইন্দ্রিয় কাজ করা বন্ধ করে দেয়। আর এমনটাই ঘটেছে ইচ্ছের সাথে। অনেকক্ষন যাবত ও খেয়াল করছিলো,পাশেই একদল মেয়ে বসে ওদের মাঝের খানিকটা চাপা গায়ের রঙের একজনকে ওর গায়ের রঙ নিয়ে মজার ছলে অনেককিছু শুনিয়ে চলেছে। মেয়েটা চুপ করে শুধু শুনছে। কখনো নিজেও জোরপুর্বক হাসছে। আর সেটা দেখেই এক চেনা অনুভুতি শুরু হয়েছিলো ইচ্ছের। ওর কথার পিঠে উত্তর দিয়েই রাকীন চলে গেছে। ইচ্ছে উঠে দাড়ালো। অনধিকারচর্চার জন্য এগোবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো ও। এই গায়ের রঙ নিয়ে বলা কৌতুকের জবাব দেওয়াটা জরুরি। এমনই মজার পরিনতি যে ওদের জীবনে অনেক বাজেভাবে দাগ কেটে গেছে। অনেক বাজেভাবে!

দুপুর দুটোর দিকে ডিপার্টমেন্টের মেধাবী মুখগুলো নিয়ে ভাদুলগাঁওয়ে পৌছেছেন সাদিক সাহেব। গ্রামের তুলনামুলক বেশি জমিজমাধারী মানুষটা হলেন সুজন মুন্সী।‌ এখানেই পৌছাতেই ওনাদের আপ্যায়নের জন্য গোটা দশেক জনবল নিয়ে স্টেশন পৌছে গেছে সে। তার বাড়িতে থাকার জন্য অনেক জোরাজুরি করেছে। কিন্তু আতিথেয়তা নিতে নারাজ ছিলেন সাদিক সাহেব। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গ্রামের স্কুল বিল্ডিংয়ের সামনে ক্যাম্প করেই আছেন। তার মতে,ক্যাম্পিংয়ে থাকলেই গ্রামের দুর্দশা ভালোমতোন অনুভব হবে সবার। ছাত্রছাত্রীরা বিনাবাক্যে মানলেও এ বিষয়টা বেশ গায়ে লেগেছে সুজন মুন্সীর। তার লক্ষ্য ছিলো শহুরে ছেলেগুলোর সামনে নিজের চার মেয়েকে উপস্থাপন করা। কিন্তু সাদিক সাহেব তা আর হতে দিলো কই? সুজন মুন্সী একেবারে হাল না ছেড়ে কাছারীবাড়িতে একবেলা খাওয়ার জন্য বলেছে ওদেরকে। এদিক দিয়ে আর মানা করতে পারেননি সাদিক সাহেব। ফেরার পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাকিসবাই ঘুমোচ্ছিলো ক্যাম্পে। কিন্তু সাদিক সাহেবের ঘুম এলো না। কিছুক্ষন বিশ্রাম শেষে করেই গ্রাম দেখার জন্য বেরিয়ে পরেছেন তিনি।

গ্রামের মুল রাস্তাটা কাচা। রাস্তার একধারে পাড়া গা,আরেকধারে বিস্তৃর্ন ক্ষেত। ঘরগুলো,গাছ আর হলুদ খড়ের গাদা একদম ছবির মতো সাজানো। বসন্তের এ সময় বোধহয় এদিকে ধান বোনার মৌসুম। পুরো সবুজ দিগন্তে একটু বাতাসের দোলেই ঢেউয়ে নুইয়ে পরে ধানের চারার লম্বালম্বা ডগাগুলো। একপাশে ভুট্টা আর গমের আবাদও দেখা যায়। কেউকেউ ভুট্টার শীষ না আসা গাছগুলো কেটে আলগা করে দিচ্ছে ক্ষেত। ওগুলো গো খাদ্য হিসেবে এই কাচা রাস্তা দিয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেটাও আবার গরুর গাড়িতে করে। এটুকো সময়ে চার চারটে গরুর গাড়ির দেখা মিলেছে সাদিক সাহেবের। তার অনুভব হলো,আধুনিকতা আর প্রযুক্তি থেকে সত্যিই অনেকটা পিছিয়ে ভাদুলগাঁও। গাড়ির পেছন থেকে ভুট্টাগাছ নিয়ে,গাড়ির সামনে চালক গরুকে খাইয়ে দিচ্ছে। হেসে দিলেন সাদিক সাহেব। একেই পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলে মেকানিজম অফ আ ইন্জিন। তেল খাদক ইন্জিন যেমন তেলেরগাড়িকে এগিয়ে নিয়ে যায়,এখানে ভুট্টাখাদক গরু ওর ভুট্টাবহনকারী গাড়িকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

কেউ কেউ অবশ্য বোঝা মাথায় নিয়েও ফিরছে। তাদের সুঠাম কৃষ্ণবর্ণের দেহের দিকে তাকিয়ে একপা দুপা করে এগোতে লাগলেন সাদিক সাহেব। হঠাৎই কারো সাথে ধাক্কা লাগে তার। সে ব্যক্তি একরকম ঝড়ের বেগে আসছিলো সামনে থেকে। তাই ধাক্কায় জোরটাও বেশি ছিলো। নিজের হাতে খানিকটা ব্যথা পেলেও সরি বলতে বলতে সামনের জনের দিকে তাকালেন সাদিক সাহেব। গায়ে শক্তপোক্তকরে প্যাচানো কাপড়,চুলগুলো ফিতে দিয়ে দুটো বিনুনিতে বাধা,গলায় কালো সুতোর ধানতাবিজ,বেশ চাপা বর্নের এক যুবতী। গ্রাম্য মেয়েদের শ্যামবর্ন চেহারায় আলাদাই মাধুর্য আছে। মেয়েটাকে দেখে মনেমনে কথাটা আওড়াতে ভুললেন না সাদিক‌সাহেব। আঁচলে বাধা ফলগুলো মাটিতে পরে গেছে মেয়েটার। যুবতী শশব্যস্ত হয়ে মাটিতে বসে ফল কুড়োতে কুড়োতে বললো,

-দিলা তো সব ফালাইয়া? দিলা তো আরো দেরি কইরা? আল্লা! পুঁটিরা জানি ওহন না আসে এইহানে! আল্লা গো! পায়ে পরি তোমার! ওগো এইদিকে আইনো না! আইনো না!

অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলেন সাদিক সাহেব। খই চোখ তুলে একপলক তাকিয়ে আবারো নিজের মতো ফল কুড়োতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। সাদিক সাহেব দেখলেন নিচে ডালিমের দানার মতো‌ ছোটছোট টকটকে লাল রঙের ফল,আবার একই সাইজের সবুজ খোলসের ফল,কয়েকটা জগাফল,কয়েকটা পেয়ারা,আর কয়েকটা ঢ্যাঁপ। মুহুর্তেই আরো চারপাঁচটা বাচ্চা কোত্থেকে এসে খইয়ের সাথেই ফল কুড়োতে লাগলো। খই চেচিয়ে বললো,

-একটাও নিবি না কেউ! একটাও নিবি না কইলাম! আইজকার নাটার ভাগ আমি কাউরে দিমু না! সবগুলান বাড়িত লইয়া যামু! বেতুরগুলানও কাউরে দিমু না! পরের তিনদিন ঘরে বইয়া বইয়া এইগুলান খাওন ছাড়া আর কোনো কাম নাই আমার। এগুলান নিস না কেউ! নিস না!

কে শোনে কার কথা! সাদিক সাহেব বিমুঢ় হয়ে দেখলেন শুধু। তুলনামুলক বয়সে বড় এই মেয়েটার এমন বারন,ধমক,কোনো কিছুর পরোয়া করলো না বাচ্চাগুলো। অর্ধেকের বেশি ফল তুলে নিয়ে ছুটে পালালো সবগুলো। খই ঠোট উল্টে আঁচলের অল্পকিছু ফল দেখে তীক্ষ্মচোখে তাকালো সাদিক সাহেবের দিকে। বললো,

-সব দোষ তোমার!

আরো বোকাবনে গেছেন সাদিক সাহেব। মেয়েটা নিজেই তো না দেখে ছুটছিলো। অবশ্য গ্রামের মেয়ে,হরিণীর মতো ছুটবে,এতেই ওকে বেশি মানাবে। একটু মুচকি হেসে আদুরে স্বরে বললেন,

-আচ্ছা। তাহলে এবার কি আমাকে শাস্তি পেতে হবে?

ইচ্ছে ভাষা শুনে ঠিকঠাকমতো তাকালো। সাদিক সাহেবের বেশভুষায় বুঝতে কষ্ট হলো না ওর,মানুষটা শহর থেকে এসেছে। খইয়ের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। ও কি জানতো শহুরের মানুষদের কেউ আজই এই রাস্তায় বেরোবে? সাহেরার কথা মনে করে একটা শুকনো ঢোক গিললো খই। আঁচল ছেড়ে ছুট লাগালো ‘আল্লা বাঁচাইয়ো,আল্লা বাচাইয়ো’ বলতে বলতে। নিচে পরে থাকা ফলগুলোর দিকে একপলক,খইয়ের দিকে একপলক তাকালেন সাদিক সাহেব। কি ঘটলো কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না উনি। এরইমাঝে ফোন বেজে উঠলো তার। প্রাপ্তর নম্বর। মুচকি হেসে কল রিসিভ করলেন সাদিক সাহেব। ছেলের সাথে কথা বলতে বলতে,পা বাড়ালেন ক্যাম্পের দিকে।

#চলবে…

#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে-মিথিলা মাশরেকা
#পর্ব-৭

রেস্ট্রুরেন্টে সবার সাথে কুশলবিনিময়,সেলফি আর অটোগ্রাফ পর্ব সেরে বেরিয়ে আসছিলো ইচ্ছে। সবাইকে অনেক কষ্টে মানিয়েছে ওকে ছাড়ার জন্য। খোলা চুলগুলোর একগোছা সামনে দিয়ে যেইনা দরজা ঠেলে খুলেছে,একঝাক বাচ্চা হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢোকা শুরু করে দিলো। একেবারে আচমকাই এতোগুলো বাচ্চা সামনে থেকে দৌড় লাগানোতে খানিকটা ভরকে গিয়েছিলো ইচ্ছে। পরপরই ঘটনা বুঝতে নিজেকে সামলে বাচ্চাগুলোর দিকে তাকালো ও। মোটামুটি জন বিশেক হবে। জীর্ণশীর্ণ দেহ,ময়লা ছেড়াতালির পোশাক,খালি পায়ে,গায়ে নোংরা,উশকোখুশকো চুল সবমিলিয়ে বোঝাই যাচ্ছে এরা পথশিশুর দল। এতোবড় রেস্ট্রুরেন্টে ওদেরকে এতো সাচ্ছন্দ্যে ঢুকতে দেখে বেশ অনেকটাই অবাক হলো ইচ্ছে। বেরোনোর পরিবর্তে বিস্ময়ে দেখতে লাগলো ছেলেমেয়েগুলোর কাজ।

ওরা ভেতরে ঢুকতেই পাঁচজন ওয়েটার মিলে দ্রুতগতিতে চারটে টেবিল পরিষ্কার করে দিলো। হুলস্থুল বাধিয়ে বাচ্চাগুলো যে যার মতো যেখানে খালি চেয়ার পেয়েছে,টেনে নিয়ে টেবিলগুলোর সামনে বসে যেতে লাগলো। রেস্ট্রুরেন্টে আসা বাকি সব নামিদামি লোকজন থ হয়ে বসে দেখছে সবটা। ওয়েটারেরা ছোটাছুটি করছে খাবার নিয়ে। মেনুকার্ডের ছবি দেখিয়ে একের পর এক ওর্ডার ছুড়ছে বাচ্চাগুলো। যেনো এখানকার রাজা ওরা। বিষয়টা কিছুতেই মাথায় বসাতে পারছিলো না ইচ্ছে। হোটেল ম্যানেজার কাছেরই ডেস্কে বসে কোনো হিসাব মেলাচ্ছিলেন মনোযোগ সহকারে। ইচ্ছে একপা এগিয়ে বললো,

-এক্সকিউজ মি?

ম্যানেজার চোখ তুলে ইচ্ছেকে দেখে দাড়িয়ে গেলেন। ইচ্ছেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলেন উনি। হিসাবের চক্করে ও যে মাঝপথে থেমে গেছ,খেয়ালই করেনি তা। ম্যানেজার উৎসুকভাবে বললেন,

-ইয়েস ম্যাম? আপনার কি আর কিছু…

-নো,রিল্যাক্স। দাড়িয়েছেন কেনো আপনি? আমি আপনার বয়সে ছোট। এভাবে দাড়িয়ে গিয়ে আমাকে নিচু করে দেবেন না প্লিজ! বসুন।

ম্যানেজার বসে গেলেন। ইচ্ছে বললো,

– ইফ ইউ‌ ডোন্ট মাইন্ড,কিছু জানার ছিলো আমার।

-শিওর ম্যাম! বলুন প্লিজ!

-একচুয়ালি,এই বাচ্চাগুলো…

-ও! ওরা? ওরা সবাই রাস্তার ছেলেমেয়ে। এখানকার কিছু ছেলেমেয়ে মিষ্টিঘর নামের একটা অনাথআশ্রম তৈরী করেছে। সেটা এদের জন্যও উন্মুক্ত। মিষ্টিঘরের ফাউন্ডার যারা আছে,তারাই সপ্তাহে একবার দুইবার এইসব বাচ্চাদের খাওয়াতে এখানে নিয়ে আসে। ওরাই টাকা দিয়ে দেয় সব খরচের।

ইচ্ছের মুখে হাসি ফুটলো। পৃথিবীতে মানুষের মাঝে মায়া, মনুষত্ব্য এখনো আছে। আরেকবার মুগ্ধ হয়ে তাকালো ছেলেমেয়েগুলোর দিকে। ওদেরকে খাবার ভাগাভাগির আনন্দ করতে দেখে মন ভরে গেছে এর। সেদিক তাকিয়েই বললো,

-ওদের বিল আজকে যদি আমি পে করি?

-সরি ম্যাম। প্রাপ্…

ইচ্ছে খেয়াল করলো বছর পাঁচেকের একটা বাচ্চা মেয়ে শুধু চুপচাপ এর ওর দিকে তাকাচ্ছে। চেহারায় তীব্র অভিযোগ,ওর সঙ্গীরা এতোটাই ব্যস্ত যে ওকে পাত্তাই দিচ্ছে না। উচু চেয়ারটায় বসতেও পারছে না ও। মুচকি হেসে ম্যানেজারের কথা না শুনেই ও মেয়েটার কাছে চলে গেলো। ওকে নিজে কোলে করে বসিয়ে দিলো চেয়ারে। সবাই বিস্ময়ে তাকিয়ে ইচ্ছের দিকে। যেখানে সবাই অবজ্ঞায় সরে বসছিলো বাচ্চাগুলো থেকে,ইচ্ছে এতোবড় একটা রকস্টার হয়েও নোংরাপোশাকের মেয়েটাকে এভাবে কোলে তুলে নিলো? ইচ্ছে মেয়েটার সামনে হাটু গেরে বসে বললো,

-কি খাবে তুমি?

-দ্যাটস্ নান অফ ইউর বিজনেস মিস রকস্টার।

পুরুষালি কন্ঠে ইচ্ছে ঘাড় পেছনে ঘুরালো। প্রাপ্ত হাত পেছনের চেয়ারে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে। ওর পাশে অরিত্রা বসেবসে আইসক্রিম খাচ্ছে। সাফোয়ান,মাহীমও আছে। ওদের আগমনে রেস্ট্রুরেন্টের পরিবেশেও থমথমে একটা ভাব।আর প্রাপ্তর গা ছাড়া ভঙিমা দেখেই ইচ্ছের বিষাক্ত লাগতে শুরু করেছে সবটা। মিষ্টি ইচ্ছের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,

-কেমন আছো ইচ্ছে? এ্ এলার্জী একেবারে সেরেছে?

-জ্বী।

সোজাভাবে জবাব দিলো ইচ্ছে। তারপর প্রাপ্তর দিকে তাকিয়ে বললো,

-এন্ড ইউ! আই নো মাই বিজনেস ভেরি ওয়েল মিস্টার। সেটা তোমাকে বলে দিতে হবে না! ইফ আ’ম নট রং,তুমি নিশ্চয়ই এখানে নিজের বিজনেস দেখাবে বলেই এসেছো রাইট? তো কাকে মারবে আজ?

প্রাপ্ত সোজা হয়ে দাড়ালো। চোখমুখ শক্ত করে এগিয়ে গেলো ইচ্ছের দিকে। ইচ্ছে ভাবলেশহীন। ওর সবচেয়ে মুল্যবান জিনিসটা আগেই নষ্ট করে দিয়েছে প্রাপ্ত। আর কিছুই হারানোর ভয় নেই ওর। তাই‌ নির্বিকারচিত্ত্বে দাড়িয়ে রইলো শুধু। তবে প্রাপ্তর ভঙিমা দেখে মাহীম কিছুটা জবুথবু হয়ে বসলো। প্রাপ্তকে দেখে বেশ অনেকটাই ভয় পায় ও। অরিত্রা আইসক্রিমে কামড় দিতে গিয়ে থেমে গেছে। বিরবিরিয়ে বললো,

-এ মেয়ে আজও প্রাপ্তর সাথে এভাবে কথা বলছে? এত্তো সাহস কিভাবে পায় ও? আজকে যে কি কপালে আছে ওর!

মিষ্টি কিছুই বলছে না। ওর‌ চেনা প্রাপ্ত নির্দোষকে কোনোদিনও সাজা দেয়নি। ইচ্ছের কিছু না জেনে এইসব কথা বলাটা দোষের কিছু না। প্রাপ্তকে নিয়ে নিজের ধারনা পরখ করতে দাড়িয়ে রইলো ও। আশেপাশের সবাই ফিসফিসিয়ে বলাবলি করা শুরু করেছে। প্রাপ্তকে চেনে বেশিরভাগই। তাই ওর রাগটাও চেনে। ইচ্ছে বুঝলো ব্যাপারটা। তাই সবরকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত,এমনভাবেই দাড়িয়ে। ওকে অবাক করে দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো প্রাপ্ত। সোজা গিয়ে সার্ভ করতে ব্যস্ত এক ওয়েটারকে কলার ধরে টেনে দাড় করিয়ে সশব্দে চড় লাগিয়ে দিলো ওর গালে।
জায়গাটার থমথমে ভাব আরো বেড়ে গেছে শতগুনে। চোখ বন্ধ করে শ্বাস ফেললো মিষ্টি। ইচ্ছে বুঝে উঠতে পারলো না,ওর উপরের রাগটা ওই ওয়েটারের উপর দিয়ে গেলো,নাকি ওর প্রশ্নের জবাব দিতেই ওয়েটারকে চড় লাগালো প্রাপ্ত। এগোতে যাবে,প্রাপ্ত শার্টের হাতা টান মেরে আরো একটা চড় লাগালো ছেলেটাকে। এবার ছেলেটা টেবিলের উপর গিয়ে পরেছে। ইচ্ছে রাগ নিয়ে চেচিয়ে বললো,

-স্টপ ইট!

প্রাপ্ত শান্তদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো। ইচ্ছে উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে বললো,

-এই গুন্ডাটা ছেলেটাকে এভাবে মারছে,আর আপনারা সবাই চুপচাপ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন? মিনিমাম মনুষ্যত্ববোধ নেই আপনাদের?

নিরবতা ভাঙলো না কেউই। অরিত্রা বললো,

-এইযে মেমসাব? ভাষন পরে! আজ নতুন এসেছেন নাকি এই রেস্ট্রুরেন্টে?

-হ্যাঁ প্রথম আসলাম। এখানে এসেও তোমাদের উশৃঙ্খলা দেখতে হবে,জানতাম না!

উত্তর দিয়ে রাগী শ্বাস ফেলতে ফেলতে ইচ্ছে ম্যানেজারের কাছে গেলো। চড়া গলায় বললো,

-এই গুন্ডাটা আপনার এখানকার ওয়েটারকে এভাবে মারছে,এভাবে বিশৃঙ্খলা করছে,সেটা দেখেও আপনি চুপ করে আছেন?

-আসলে ম্যাম…

-কিসের এতো ভয় আপনাদের? হোয়াই ডোন্ট ইউ কল দ্যা পুলিশ? ওকে ফাইন! আমিই‌ কল করছি পুলিশকে! অনেক দেখেছি ওর গুন্ডামো! অনেক সেজেছে গ্যাংস্টার! আর না!

ইচ্ছে ফোন বের করে কল করতে যাচ্ছিলো পুলিশকে। পাশ থেকে সাফোয়ান বলে উঠলো,

-ও হ্যালো? এখানকার ইনচার্জের নম্বর লাগবে?

ইচ্ছে একবার তীক্ষ্মদৃষ্টি ছুড়ে ডায়াল করতে যাচ্ছিলো। সাফোয়ান ওর সামনে একটা কার্ড তুলে ধরলো। ওটা দেখে একপ্রকার হতভম্ব হয়ে রইলো ইচ্ছে। আইডিকার্ডটা সাফোয়ানের।ইচ্ছের কান থেকে ফোন,হাত নেমে আসলো স্বয়ংক্রিয় ভাবে। তীব্র অবিশ্বাসে ইচ্ছে আশেপাশে তাকালো ও। মুখ থেকে কোনোমতে বেরোলো,

-হ্ হাউ ক্যান ইউ বি দ্যা…

-আগেরদিন তমা খেতে এসেছিলো এখানে। ও তোকে ওর পরিবারের জন্য খাবার প্যাক করে দিতে বলেছিলো। আর তার জবাবে তুই ওকে কি বলেছিলি,বলতো আরেকবার? আমিও একটু শুনি?

প্রাপ্তর কথায় ইচ্ছে তাকালো ওর দিকে। টেবিলের উপর উঠে চেয়ারে পা রেখে বসেছে প্রাপ্ত। দুহাতের কনুই হাটুতে ঠেকিয়ে বেশ আগ্রহ নিয়ে ওয়েটারকে জিজ্ঞাসা করলো ও কথাটা। ওয়েটার ছেলেটা টালমাটাল হয়ে দাড়িয়ে। প্রাপ্তর দেওয়া চড়দুটো ওকে এলোমেলো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। তার উপর এই প্রশ্ন! ছেলেটা গালে হাত রেখে কম্পিকন্ঠে বললো,

-আ্ আমি কাউকে কিছু বলি নি প্রাপ্ত ভাই! ক্ কে তমা? আমি ওদের কারো নামটা অবদি জানিনা ভাই! কিছুই বলিনি!

-শিওর তুই? তমাকে‌ চিনিস না?

জোরেজোরে মাথা নেড়ে না বুঝালো ছেলেটা। প্রাপ্ত এককোনে দাড়িয়ে থাকা বছর পনেরো‌ ষোলোর এক মেয়েকে ইশারা করলো। পুরোনো জামা গায়ে পরা মেয়েটা মাথা নিচু করে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো ওর দিকে। ওয়েটারের চেহারায় ভয়। প্রাপ্ত কিছু বলার আগেই‌ হুড়মুড়িয়ে ওর পায়ে পরে গেলো ছেলেটা। বললো,

-ভ্ ভুল হয়ে গেছে ভাই! ভুল হয়ে গেছে! আপনি তো সবার ভাই হন! তমারও ভাই হন! আমি যা বলেছি,ভুল বলেছি ভাই! এবারের মতো ক্ষমা করে দেন! আর কোনোদিনও এমন হবে না ভাই! কোনোদিনও বলবো না এমন কিছু!

ইচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না। কি হয়েছে,কি হচ্ছে কিছুই না। প্রাপ্ত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,

-ও কি বলেছিলো তমা?

তমা কেদে দিলো এবার। মিষ্টি গিয়ে ওকে‌ ধরে দাড়ালো। তমা কান্না থামিয়ে চোখমুখ মুছে বললো,

-সেই ছোট থাইকা দেহি সাদিক কাকা সবাইরে এম্নে খাওয়ায়। প্রাপ্ত ভাইয়া খাওয়াইতে লাগছে কয়বছর হইলো। আমি আসি নাই মেলাদিন। আগেরদিন মা বলছিলো তার নাকি ভালোমন্দ খাইতে মন চাইছে। তাই আইছিলাম। আর এই নোংরা লোক আমারে…আমারে বলে এইসব খাওনের টাকা তো প্রাপ্ত ভাই দেয়,তার বিনিময়ে আমি তারে কি দেই। এই বদ লোকটা আরো মেলা‌‌ জঘন্য কথা শুনাইছে আমারে প্রাপ্ত ভাই!

ইচ্ছের বিস্মিত চাইনি বিস্ফোরিত চাইনিতে রুপান্তরিত হলো। বুঝতে কোনো অংশে বাকি রইলো না ওর,এই বাচ্চাগুলোর খাবারের দায়ভার সামলানো মানুষটা অন্য কেউ নয়,স্বয়ং প্রাপ্ত! ছেলেটাকে মার লাগানোরও যথেষ্ট ঘৃন্য কারন আছে। প্রাপ্ত পা সরিয়ে উঠে দাড়ালো। ছেলেটার কাধের টিশার্ট মুঠো করে তমার পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে বললো,

-প্রাপ্ত কেনো,কিসের বিনিময়ে কি করে,তা জানতে চাওয়ার তুই‌ কেউ‌ নস! আগে ওর কাছে ক্ষমা চা!

হাটুরবয়সী মেয়েটার পা ভিক্ষুকের মতো জরিয়ে ধরলো ছেলেটা। অস্থিরভাবে বললো,

-যা বলেছি,ভুল বলেছি বোন! ক্ষমা করে‌দাও আমাকে! আর কোনোদিনও বলবো না! ক্ষমা করে দাও! প্লিজ ক্ষমা করে দাও!

তমা সরে দাড়ালো। প্রাপ্তকে‌ বললো,

-ভাই,ওরে কিছু কইরো না। ওর কিছু হইলে ওর মায়ের কষ্ট হইবো। আর মাগো কষ্ট আমার সয় না।

মুচকি হাসলো প্রাপ্ত। তমার বিনুনি করা চুলে টান মেরে বললো,

-কপাল করে তোর মা তোর মতো‌ মেয়ে পেয়েছে তমা। ভালোভাবে পড়াশোনাটা শেষ কর। মাকে নিয়ে দেখা সব স্বপ্ন পুরন হবে তোর। দেখিস।

তমাও হাসলো। প্রাপ্ত ওয়েটারকে তুলে দাড় করিয়ে দিলো। টিশার্টের ধুলো ঝেড়ে দিয়ে‌ বললো,

-এরপর এমন কিছু শুনলে কৈফিয়ত দেওয়ার সুযোগ দেবো না তোকে। মনে রাখিস!

কথাদুটো বলে প্রাপ্ত একপলক ইচ্ছের দিকে তাকালো। তারপর সোজা গিয়ে বাচ্চাগুলোর সাথে খেতে বসে গেলো। এরওর প্লেট থেকে নিয়ে,দিয়ে আনন্দ করে খেতে লাগলো ওদের সাথে। সাফোয়ান,অরিত্রা,মাহীমও গিয়ে বসলো সেখানে। স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো ইচ্ছে। ওর ধারনার সবটা কেমন যেনো উল্টে‌ গেলো না?

-সেদিনও তোমার ধারনা আজকের মতোই‌ ভুল ছিলো ইচ্ছে।

মিষ্টির কথায় ইচ্ছে পাশ ফিরলো। মিষ্টি মৃদ্যু হেসে বললো,

-মিষ্টিঘরের ফাউন্ডার প্রাপ্তর বাবা সাদিক আঙ্কেল। ওই অনাথ আশ্রমের প্রথম দিকের অনাথ শিশুদের দলের মধ্যে আমি,অরিত্রা,সাফোয়ান, মাহীন আমরাও ছিলাম।

ইচ্ছের বিস্ময় বাড়লো আরো। এই মেয়েটা অনাথ! ওরা চারজনই‌ বাবা মা হারা। ভাবতেই কোথাও দম থেমে আসছে ওর। মিষ্টি বললো,

-জানিনা কেনো যেনো আঙ্কেলের আমার নামেই‌ আশ্রম খোলার ইচ্ছে ছিলো। এখনো অবদি মিষ্টিঘর আমার নামেই। আমরা অনাথ। তবে সাদিক আঙ্কেলের জন্য কোনোদিনও বাবামায়ের কমতি মনে হয়নি। অরি,সাফোয়ান,মাহীম আমরা একে অপরকে পুর্ন করেছি। এইযে সাফোয়ান? ও কিন্তু পুলিশে আছে। আর অফডিউটিতে আমাদের সাথে রাস্তায়। এইযে অরি? কলসেন্টারে জব করে। বাকিটা বকবক আমাদেরই‌ সাথে। ওই মাহীম! এই ব্যাটা৤ মোবাইল কোম্পানিতে চাকরি করে। আমিও এজ আ নার্স,ডিউটি পালন করি এখানকার হসপিটালেই।

এটুকো বলে থামলো মিষ্টি। তারপর প্রাপ্তর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টি আটকে বললো,

-আর এইযে সাদমান ইনাব প্রাপ্ত! ভার্সিটির আমাদের ব্যাচের টপার ও। রেজাল্টের গোল্ডমেডেলও আছে ওর। ইউএস থেকে চাকরির অফার এসেছিলো ওর জন্য! আর সে? সে সেই সব সোনালী ব্যাকগ্রাউন্ডকে পিশে,হীরকোজ্জ্বল ভবিষ্যতকে অবজ্ঞা করে দিয়ে,আমাদের সাথে এখানে! বাবার তৈরী মিষ্টিঘর চালাবে আর বাবার আদর্শের জন্য সমাজের অপকর্ম থামাবে বলে এখানেই পরে আছে।

কাধের ব্যাগের ফিতাটা শক্তকরে ধরলো ইচ্ছে। প্রাপ্তর ব্যাকগ্রাউন্ড এমন হতে পারে,কল্পনাতেও ছিলো না ওর। মিষ্টি বললো,

-সেদিন ওই বয়স্ক লোকটা এক ফুলকুড়োনিকে বাজে স্পর্শ করেছিলো বলে প্রাপ্ত তাকে মারছিলো। দোষটা ওই লোকের ছিলো ইচ্ছে। ওনার কাজ সহ্য হয়নি প্রাপ্তর। তাই…আ্ আসলে প্রাপ্ত ওর কাজে কারো ইন্টারফেয়ারেন্স পছন্দ করে না। তাই সেদিন ওভাবে তোমাকে ধাক্কাটা দিয়েছিলো। অবশ্য যদি বুঝতে পারতো তুমি কোনো মেয়ে,তাহলে ঘটনাটা এভাবে ঘটতো না। এজন্য তুমি সবার সামনে ওর কলার ধরেছো,দু দুবার ওর গায়ে হাত তুলেছো। সেটাও ওর ইগোকে হার্ট করেছে। তাই তোমার গিটারটাও…ওকে ভুল বুঝো না প্লিজ! পুরোটাই মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের জন্য ঘটেছে! দোষ হয় তোমাদের দুজনেরই। নয় তোমাদের কারোরই নয়! ডোন্ট মেক ইট মোর! প্লিজ ইচ্ছে? প্লিজ?

ইচ্ছে আস্তেধীরে ঘুরে প্রাপ্তর দিকে তাকালো। প্রাপ্ত লেগপিস নিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে ওর পাশে বসা বাচ্চাটাকে। ইচ্ছে সোজা গিয়ে ওর পাশে দাড়ালো। ইচ্ছে আবারো অপমান করতে এসেছে ভেবে প্রাপ্ত টিস্যু দিয়ে হাত মুছে উঠে দাড়ালো। ওকে অবাক করে দিয়ে ইচ্ছে বললো,

-ভুল বুঝে তোমার কাজে বাধা দেওয়ার জন্য সরি। তোমার অনিচ্ছাকৃত স্পর্শের দায়ে চড় লাগানোর জন্যও সরি। কিন্তু তার বিনিময়ে আমার গিটার ভেঙে ঠিক করোনি তুমি প্রাপ্ত। তখন তুমি আমাকে যদি উল্টে দুটো চড়ও মারতে,তোমার প্রতি আজকে এই রাগটা হয়তো থাকতো না। কিন্তু তুমি যা করেছো,তাতে এই রাগ মেটার নয়! প্রতিত্তর ব্যতিত অন্য কোনো কিছুতেই তা পোষানোর নয়! আসছি।

ইচ্ছের স্পষ্ট ভাষায় সবাই তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। কথা শেষ করে চলে গেলো ইচ্ছে। মিষ্টি প্রাপ্তর পাশ থেকে বললো,

-কারো আবেগকে আঘাত করতে নেই প্রাপ্ত। জানি না কেনো যেনো মনে হচ্ছে,তুই ওর সবচেয়ে বড় আবেগে আঘাত করেছিস। আর এর পরিনতিও ও তোকে একদিন না একদিন ঠিক ফিরিয়ে দেবে। তোর সবচেয়ে বড় আবেগে আঘাত করে। দেখিস!

দুহাত মুঠো করে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো প্রাপ্ত। ওর দৃষ্টি ইচ্ছের চলে যাওয়ার দিকে স্থির। ইচ্ছের বলা কথায় বিন্দুমাত্র বিচলিত নয় ওর। বরং অজানা কারনে আটকে আছে প্রাপ্ত। গতদিনও হৃদয়ের অবয়বকে ভাবতে গিয়ে এই মেয়েটার চেহারা ওর সামনে ভেসেছে। ভাবনাটা সেখানেই! দিনের পর দিন এই ইচ্ছে নামের মেয়েটা ওর জীবনে ঠিক কি হয়ে জড়াচ্ছে? কাঙ্ক্ষিত প্রতিহিংসা? নাকি অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিচ্ছবি? কোনটা?

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here