প্রেমনোঙর_ফেলে,২২,২৩

0
431

#প্রেমনোঙর_ফেলে,২২,২৩
#লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

২২.

-তুমি মিষ্টিঘরে ফিরে যাও খই।

রাকীনের কথা শুনে কিছুক্ষন নিরবে ওর‌ দিকে‌ তাকিয়ে রইলো খই। রাকীনের শান্ত চাওনি। খই চোখ সরিয়ে দুহাতে দুগাল মুছলো নিজের। কিসব বলে রাকীনকে দুর্বল করে দিতে যাচ্ছিলো‌ ও? রাগ হলো‌ ওর নিজের উপর। নাক টেনে বললো,

-হ! ত্ তুমিও বাড়ি ফিরা যাও নকশাদার। আসতাছি।

একমুহুর্ত দেরি না করে উল্টোপথে হাটা ধরলো খই। যেখানে দায়ভার হয়ে থাকবে না বলে সাদিক সাহেবের বাসা থেকে ও বেরিয়ে এসেছিলো, সেখানে রাকীনের কাছে নিজের বলা কথাতে ওকে দায় করে‌ দিতে যাচ্ছিলো ও। আজ নিজেই নিজেকে অপমান করেছে ও। রাকীন পেছন থেকে ওর এক হাত ধরে‌‌ বললো,

-খই আমি…

খই‌ ছাড়িয়ে নিলো‌ নিজের হাত। একটা জোরপুর্বক হাসি দিয়ে বললো,

-ফিরা‌ যাও নকশাদার। আ্ আমি অনাথআশ্রমে‌ যাইতাছি। চিন্তা করন লাগবো না তোমার। আ্ আমি ঠিক আছি। জানিনা তহন কি হইছিলো, পাগল হইয়া গেছিলাম হয়তো। তয় ওহন ঠিক আছি। তুমি যাও।

রাকীন ওর সামনে এসে দাড়ালো। খইয়ের দুহাত মুঠো করে নিয়ে, মাথা নিচু করে বললো,

-আমাকে ক্ষমা করে‌ দিও খই। জানিনা এটুকো সময়ের ব্যবধানে, ভাঁদুলগাও থেকে শুধুমাত্র তোমার কথা ভেবে ঢাকা চলে আসার এতো সাহস কি করে আসলো আমার‌ মাঝে। তবে এটা জানি, এই‌মুহুর্তে তোমাকে পরিচয় দেওয়ার‌ সাহস আমার নেই‌। তাই…

খই বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো রাকীনের দিকে।‌ রাকীনের চেহারায় তীব্র আত্মগ্লানি। খইয়ের নিজের উপরও রাগ হলো। টের পেলো, অনেকবেশি আবোলতাবোল বকেছে ও। যার‌ জন্য এই‌ লোকটা এতোটা দ্বন্দে পরে গেছে। কিন্তু ও তো সেভাবে বলতেই চায়নি। আপনার ভেবে, দুঃখটাকে উগড়ে দিতে গিয়ে বলে দিয়েছিলো কথাগুলো। ও তো কারো দায়বদ্ধতা হতে চায়ই‌ নি। সেখানে ওর‌ কথাতেই রাকীন দায়বদ্ধতায় পরে যাচ্ছিলো। যেখানে ওর চেয়ে শতসহস্র ভালো কিছুর দাবিদার এই‌ মানুষটা, ও‌ কি করে তার‌ কাছে দাবি রাখতে পারে? মুচকি‌ হেসে রাকীনের হাতে হাত রেখে বললো,

-খই নিজের পরিচয়ে বাচবো নকশাদার। তুমি দেইখো। আমার মায়ে যা চাইছিলো, তাই হইবো। তুমি নিজের উপরে কোনো দায় নিও না। ভালো থাইকো।

রাকীন চোখ তুলে তাকালো। সুন্দর একটা হাসি দিয়ে খই‌ হাত ছাড়িয়ে নিলো নিজের। অন্ধকারে চলে গেলো সে পথে, যে পথ দিয়ে এসেছিলো। মাথার চুলগুলো একহাতে উল্টে ধরে আকাশের দিকে মুখ তুললো রাকীন। চোখ বন্ধ করে নিতেই জল গরালো ওর চোখের কোনা বেয়ে। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে ওর ছায়ার সাথে হৃদয়ের চাপা কষ্টগুলোর প্রতিধ্বনি স্পষ্টতর হতে লাগলো। প্রতিটা প্রশ্বাস যেনো তীব্র যন্ত্রনাসমেত বলছে,
“যে জায়গাটা এতোগুলো বছরে ইচ্ছেকে দিতে পারিনি, সে জায়গাটা কি করে তোমায় দিয়ে দেবো খই? যে সেই ছোটবেলা থেকে রাকীনের সবটা জুড়ে আছে, তোমার সাথের এই দুদিনের সাক্ষাতে কি করে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবো বলো? খেয়া যেখানেই থাকুক না কেনো, আমি তো জানি, আমার সবটা জুড়ে শুধু ওই আছে। ওর অনুপস্থিতি কেউ পুরন করতে পারবে না। আমি দেবো না কাউকে সে অধিকার। দিতে পারবো না!”

রেকর্ডিংয়ের জন্য বাসা থেকে বেরোলো ইচ্ছে। আজও ব্রেকফাস্ট করেনি বলে নওশাদ সাহেবের অসহায় আর্জি আর নাফিজা বেগমের বিব্রত চাওনি দেখতে হয়েছে ওকে। সেসব মাথা থেকে ঝেরে, গাড়িতে বসে ডিরেক্টরের এসিসটেন্টের লাস্ট কলের সময় দেখবে বলে মোবাইলের কললিস্ট স্ক্রল করছিলো ইচ্ছে। হঠাৎই একটা আননোন নম্বরে চোখ আটকালো ইচ্ছের। সময়, তারিখ আর আননোন নম্বর লিস্টে দেখে একটা ঘটনাই মনে পরলো ওর। পিয়ালীর সে সন্ধ্যার ঘটনাটা। পুরো নম্বরটা কয়েকবার চোখ বুলালো ইচ্ছে। কি ভেবে বাটন ফোনটা বের করলো ও। ঠিকঠাকমতো নম্বরটা তুলে কল করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু তার আগে উঁকি দিয়ে একবার দেখে নিলো পাশের টমিকে। চোখ বুজে শুয়ে আছে টমি। মুচকি হেসে ইচ্ছে একহাতে ওর গায়ে হাত বুলালো। নড়েচড়ে আরো আরাম করে শুয়ে পরলো টমি। ঠোট কামড়ে হেসে নম্বরটা ডায়াল করলো ইচ্ছে। কি হলো ওর, রিং হবার আগেই কেটে দিলো কলটা। কিছুক্ষন ইতস্তত করে, একটা জোরে শ্বাস ফেলে আবারো নম্বরটায় কল লাগালো ও।
ফোনের আওয়াজে চোখ মেলে তাকালো প্রাপ্ত। হাত বাড়িয়ে ফোনটা কানে নিলো। নম্বর না দেখে রিসিভ করলো কলটা। ঘুমুঘুমু গলায় বললো,

-হ্যালো?

প্রতিত্তরে কুকুরের আওয়াজ শুনে তখনতখন চোখের ঘুম গায়েব প্রাপ্তর। ইচ্ছে চোখমুখ খিচে বন্ধ করে নিলো টমিকে আওয়াজ করতে শুনে। কল কেটে দিলো তৎক্ষনাৎ। সরু চোখে তাকিয়ে রইলো টমির দিকে। টমি লেজ নেড়ে আদর বুঝালো ওকে। ইচ্ছে কড়া গলায় বললো,

-শব্দ করলি কেনো?

টমি সিটের উপর রাখা ইচ্ছের অন্য ফোনের স্ক্রিনে থাকা প্রাপ্তর নম্বরে সামনের পা রাখলো। ইচ্ছের মুখ হা হয়ে গেলো আপনাআপনিই। বললো,

-ওই লোকটা মোবাইলের ওপাশ থেকে হ্যালো বলেছে, সেটাও কানে গেছে তোর?

টমি আবারো শুয়ে পরলো আরাম করে। ইচ্ছে ওর গা ছাড়া ভাব দেখে বললো,

-সরি ডুড, ভুলেই গিয়েছিলাম। আমাদের তুলনায় তো তোর শ্রাব্যতার সীমা অনেক বেশি। ঠিক বুঝে গেছিস কার নম্বরে ডায়াল করেছি।

টমি আরো দুবার ডাকলো। যেনো আরো বেশি ভাব বুঝালো ও। ইচ্ছে শব্দ করে হেসে দিলো এবার। টমিকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো। গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

-ইউ‌ নো হোয়াট টমি? মিস্টার গ্যাংস্টারের প্রতি তোর এই বিহেভটা আমি এন্জয় করতে শুরু করেছি। পারিসও তুই!

টমি কিছুই বললো না। মনেমনে হয়তো চাপা ঈর্সা পুষতে শুরু করলো প্রাপ্তর প্রতি। এদিকে টমির গলা চিনতে কষ্ট হলেও ভুল হলো না প্রাপ্তর। উঠে বসে হা হয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। ঠিকই শুনেছে কিনা ঘুমের ঘোরে, সেটাও একটা বিষয়। টমি ওর নম্বর কিভাবে পাবে, ওকেই‌ কেনো কল করবে, সর্বপরি কিভাবে কল করবে ভেবে সকালটাই উল্টেপাল্টে গেলো প্রাপ্তর। নম্বরটা পড়ে নিলো কয়েকবার। মোবাইল বিছানায় রেখে ঢুকে গেলো ওয়াশরুমে। ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে দেখে ড্রয়িংরুমে সোফায় পিয়ালী, সাদিক সাহেব আর মিষ্টিঘরের আরেক অভিভাবক বাকের কাকা সবাই বসে। হাতের ঘড়িটা পরতে পরতে পুরো ড্রয়িংরুমের পুরোটা চোখ বুলিয়ে এককোনে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকা খইকেও‌ দেখতে পেলো রাকীন। পিয়ালী‌ বললো,

-কোথায় যাচ্ছিস ভাইয়া?

-এমনি, মাহীমদের ওদিকে…

প্রাপ্তকে শেষ করতে না দিয়ে সাদিক সাহেব উঠে দাড়িয়ে বললেন,

-খই মিষ্টিঘরে চলে যেতে চায় প্রাপ্ত।

প্রাপ্ত অবাকচোখে তাকালো খইয়ের দিকে। খই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সেভাবেই নিচদিকে তাকিয়ে আছে ও। পিয়ালী বললো,

-সকালবেলা উঠেই‌ আমাকে বলছে এ বাসায় থাকবে না। আমি অনেক বললাম এখানে…

প্রাপ্ত এগিয়ে গেলো খইয়ের দিকে। খই অনড়। মেয়েটার চেহারা শুকিয়ে গেছে একদম। চোখ কোঠরে বসে গেছে। প্রাপ্ত বললো,

-এ বাসায় থাকতে চাওনা তুমি?

-না।

খইয়ের স্পষ্ট জবাব। সাদিক সাহেব এগিয়ে আসলেন ওর দিকে। বললেন,

-কিন্তু খই…

-এই বাড়িতে আমার দমবন্ধ লাগে কাকা। আমারে আশ্রমে যাইতে দাও। ওইহান থাইকা‌ পড়তে চাই আমি। নিজের পরিচয়ে বাচবার‌ চাই। বাধা দিও না কাকা। পায়ে পরি তোমার। আমারে আশ্রমে যাইতে‌ দাও।

প্রাপ্ত কি‌ বলবে, বুঝে উঠতে পারলো না। বেশ অনেকক্ষন খইয়ের আকুতি শোনার পর সাদিক সাহেব হার মানলেন খইয়ের কাছে। উনি ভালোমতোই জানেন, এই‌মুহুর্তে খইয়ের আত্মসম্মানই ওর কাছে বড়। এদিক দিয়ে ওকে জোর করা হলে, হিতের বিপরীত হবার সম্ভবনাই বেশি। আর তাছাড়া উনি নিজেও‌ চান, খই নিজের দিকগুলো বুঝে বাচতে শিখুক যতো‌ দ্রুত সম্ভব। প্রাপ্তর দিকে তাকিয়ে বললেন,

-তুমি কি বলো প্রাপ্ত?

-যেটা খই চায়, সেটা করাই উচিত হবে বাবা।

একটা ক্ষুদ্রশ্বাস ফেলে‌ বাকেরের সাথে সবধরনের ফর্মালিটি মিটিয়ে‌ নিলেন সাদিক সাহেব। খই শক্ত করে নিলো নিজেকে। বাকের কাকার সাথে বেরিয়ে এলো প্রাপ্তদের বাসা থেকে। বেরোনোর সময় সাদিক সাহেব ওকে পেছনডাক দিলেন। খই থামলো। সাদিক সাহেব ওর‌ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

-অনেকঅনেক দোয়া তোমার জন্য। শুধু বাসাটা বদলেছে। তোমার প্রতি আমাদের ভালোবাসা না। সবসময় আমরা পাশে আছি তোমার। নিজেকে প্রস্তুত করো খই। এই বাসা, বাসার মানুষগুলো এক নতুন তোমার‌ স্থায়ী আগমনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো কিন্তু!

খই প্রাপ্তর দিকে তাকালো একপলক। প্রাপ্তর শান্তস্থির চাওনি। দুজনের মনে আচমকাই অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড়ের আভাস হানা দিতে লাগলো। এ যেনো নতুনের শুরু নয়, অন্তিমের পুরোনো ট্যালি…

#চলবে…

#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

২৩.

অনেকক্ষন যাবত ল্যাপটপ কোলে নিয়ে কাজে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করছে রাকীন। কিছুতেই পারছে না। বারবার ভুল করে বসছে ছোটছোট বিষয়েই। পাশেই বিছানার উপর‌ রাখা স্কেচের কাগজপত্র ফ্যানের বাতাসে খচখচ শব্দ তুলেছে। রাগ নিয়ে ল্যাপটপ কোল থেকে সেই কাগজের উপরই রাখলো রাকীন। দাতে দাত চেপে, চোখ বন্ধ করে জোরেজোরে শ্বাস নিলো কয়েকবার। বন্ধ চোখের পাতায় সেই চেনা মুখ। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে, একদম কাছে এসে যে ঠোটজোড়া ওর‌ ঠোট ছুইয়ে দিয়েছিলো, সেই ঠোঁট। সেই শ্যামবর্নের মুখশ্রীর টানাটানা চোখজোড়া। খই! রাকীন চোখ মেললো। উঠে দাড়িয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি ছিটালো কয়েকবার। খইকে ভুলতে চায় ও, এমনটা নয়। তবে খই ওর ভাবনা এতো গাঢ়ভাবে জরিয়ে যাক, এমনটাও চায়না ও। আপাতত কাজে মনোযোগ ধরে রাখাটা বেশি জরুরি। রুমে মাকে কফি নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো রাকীন। তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে এগোলো টেবিলের দিকে। বললো,

-কফি চাইনি মা।

-মা হই তোর! তুই কখন চাইবি, সে অপেক্ষায় থাকতে পারি না আমি রাকীন! আমি জানি তোর কখন কি প্রয়োজন!

মিসেস মাহমুদের অভিযোগের স্বর। রাকীন থামলো। মায়ের দিকে ফিরে তাকানোটা শ্রেয় বলে মনে হলো না ওর। মিসেস মাহমুদ কফি রাখলেন টেবিলের উপরে। রাকীনের কাধে হাত রেখে বললেন,

-তোর খেয়াল রাখবে, এমন কাউকে তোর প্রয়োজন রাকীন।

-এভাবে চলে এলি গ্রাম থেকে? ওদিকের সব ঠিক আছে তো বাবা?

-বেঠিক হবে এমনটা কেনো ভাবছো মা? ডোন্ট ওয়ারী। এখান থেকেই বাকিটা সামলে নেওয়া যাবে। সব ঠিক আছে।

-শুধু তুই ঠিক নেই। তাইনা রাকীন?

কফিমগ হাতে নিতে গিয়েও থেমে গেলো রাকীন। পুরোটাই লক্ষ্য করলেন মিসেস মাহমুদ। ছেলেকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললেন,

-তুই জানিস রাকীন, তোর বাবা কোনোদিনও মুখ ফুটে তুই কেমন আছিস জানতে চাইবে না। কিন্তু তুই তো এটাও জানিস, তোকে কতো ভালোবাসে সে। তোর ভালো চায়। তোকে ভালো দেখতে চায়। এভাবে আর কতোদিন বাবা? আর পারছি না তোকে অতীত আঁকড়ে এভাবে দেখতে! পারছি না!

কাদতে লাগলেন মিসেস মাহমুদ। রাকীন জরিয়ে ধরলো মাকে। ওর বলার কিছুই নেই এখানে। সন্তানকে সুখী দেখতে চাওয়া প্রতিটা বাবা মায়ের অধিকার। সে অধিকার থেকে ও বঞ্চিত করেছে ওর বাবা,মাকে। তাই এই অভিযোগ ওকে শুনতেই হবে। মিনিটদুয়েক পর কানে আসলো,

-কাল ইনিশাতে খেয়া হাউজিং নিয়ে মিটিং ডেকেছি। চায়না থেকে কিছু বিল্ডার্স আসছে।

রাকীন তৎক্ষনাৎ পেছন ফিরলো। রাজীব মাহমুদ দরজায় দাড়িয়ে বলেছেন কথাগুলো। রাকীন বিস্ময়ে বললো,

-কাল মিটিং মানে? হাউজিংয়ের মিটিং তো আরো দুমাস পর হওয়ার কথা!

-সেটা তো তোমার আরআইপি’র পরে হওয়ার কথা ছিলো। এখন তুমি যখন এসেই গেছো, আর দেরি করতে চাইছি না।

-কিন্তু বাবা…

-কিসের কিন্তু রাকীন?

রাকীন চুপ রইলো। রাজীব মাহমুদ বললেন,

-আমি ভাবছিলাম কাল হাউজিং প্রজেক্টের পুরোটার দায়িত্ব আমি নেবো।

এটুকো শুনেই রাকীন কি বলবে, বুঝে উঠতে পারলো না। এই প্রজেক্ট ওর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন প্রজেক্টের একটি। তা যদি রাজীব মাহমুদ নিজে লিড দিতে চান, তারমানে সে প্রজেক্ট সুন্দরতম রুপ নেবে। কোনো সন্দেহ নেই তাতে। ও নিজে লিড করবে না, এই খারাপ লাগার চেয়ে, ওর বাবা লিড করছে,এটাই ওর কাছে সবচেয়ে খুশির। রাকীন কিছু বলার আগেই রাজীব মাহমুদ বললেন,

-খেয়া হাউজিংয়ে ইনিশা থাকছে। তবে ইনিশা বিল্ডার্সের তরফ থেকে তুমি এই প্রজেক্টের লিডে থাকছো না রাকীন। ইচ্ছেকে বলে দিও কাল ও যেনো ইনিশায় পৌছে যায়। মিটিংয়ে ওকেও এটেন্ড করতে হবে।
নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ ” নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ” এবং ফলো করে সাথেই থাকুন।
রাকীন মাকে ছেড়ে ছুটে এসে শক্তকরে জরিয়ে ধরলো ওর বাবাকে। আলতোভাবে ছেলের গায়ে হাত রাখলেন রাজীব মাহমুদ। বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো এক দীর্ঘশ্বাস। যেখানে ছেলের ভালো করার সুখের চেয়ে, সে ছেলেকে ঠকানোর গ্লানি সুস্পষ্ট। দেরি না করে বেরিয়ে গেলেন রাজীব মাহমুদ। মিসেস মাহমুদও ঠোটে মুচকি হাসি ফুটিয়ে চলে গেলেন রুম থেকে। খুশিমনে ইচ্ছেকে কল করলো রাকীন। কল রিসিভ হতেই বললো,

-কাল হাউজিং প্রজেক্ট নিয়ে মিটিং আছে ইচ্ছে!

আচমকাই রাকীনের কল পেয়ে ইচ্ছে যতোটা না অবাক হয়েছিলো, হাউজিংয়ের কথা শুনে আরো অবাক হলো ও। বিস্ময় নিয়েই বললো,

-কি বলছিস কি তুই রাকীন?

-হ্যাঁ! ঠিকই বলছি! বাবা নিজে কনফার্ম করেছে আমাকে! এইমাত্র!

শ্বাস ছেড়ে দাড়ানো থেকে বিছানায় বসে গেলো ইচ্ছে। রাকীনের গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে, অনেকটা খুশি ও। ইচ্ছে বললো,

-তোকে ছাড়াই মিটিং?

-হ্যাঁ! কাল একটু কাজ পরে গেছে আমার। বাট নো নিড টু ওয়ারি! গেইস হোয়াট? বাবা নিজে লিড করবে প্রজেক্টটা!

আরেকদফায় অবাক ইচ্ছে। চোখ ভরে উঠলো ওর। অবশেষে সেই‌ কাঙ্ক্ষিত সময়! রাকীনের লালন করা খেয়ার স্বপ্ন। খেয়া হাউজিং! নিম্নবিত্তদের মাথার উপর তাদের‌ নিজস্ব ছাদ। ইচ্ছেকে চুপ থাকতে দেখে রাকীন বললো,

-কিরে? চুপ করে‌ গেলি যে?

-হুম? ক্ কিছুনা! এটা বল, তুই‌ গ্রাম থেকে কবে‌ আসছিস? ওদিকের কাজ কতোদুর?

রাকীন এবার চুপ করে গেলো। যেখানে খইয়ের‌ জন্য ভাদুলগাও‌ ছেড়ে ঢাকায় চলে‌ আসলো ও, সেখানে এই মেয়েটাকে‌ বলাও হয়নি ও ঢাকায় এসেছে। ইচ্ছে আবারো বললো,

-কিরে? এবার তুই চুপ কেনো?

-মিস করছিস আমায়?

ইচ্ছে আবারো নিরত্তর। সত্যিই কি এতোটুকোও মিস করেছে ও রাকীনকে? এতোগুলো দিনে একবারও মনে পরেছে ওর রাকীনের কথা? রাকীন উত্তরের অপেক্ষা করলো না। কথা ঘুরানোর জন্য বললো,

-কাল সময়মতো ইনিশায় চলে‌ আসিস। মিটিংয়ে‌ তোর থাকা‌কে বাবা আবশ্যক বললো।

হুম বলে‌ কল কাটলো ইচ্ছে। টমি আগেই ঘুমিয়ে গেছে বিছানায়। শুন্যদৃষ্টিতে ব্যালকনিতে তাকালো ইচ্ছে। বাইরে শীতল হাওয়া বইছে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এ বাতাস কি মনকে শীতল করতে এসেছে? নাকি কোনো তান্ডবের পুর্বাভাস? স্বস্তি নাকি দীর্ঘশ্বাস, তা আজও প্রশ্নবিদ্ধ!

সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে ছিলেন নওশাদ সাহেব। নাফিজা বেগম রান্নাঘরে ছিলেন। ইচ্ছে রেডি হয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখে টমি ডাইনিংয়ের মেঝেতে বসে নিজের খাবার খাচ্ছে। আজ ওর আগেই নিচে নেমে গেছে টমি। নওশাদ সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন শুধু। প্রতিদিন বলা সত্ত্বেও বাসায় ব্রেকফাস্ট করে না ইচ্ছে। আর প্রতিবারই মনে করিয়ে দিয়ে যায়, ওকে খেতে বলার অধিকারও তার নেই। ইচ্ছে বেরিয়ে না গিয়ে সোজা ডায়নিংয়ে বসে গেলো। বড়বড় চোখে তাকালেন নওশাদ সাহেব। উৎফুল্লভাবে বললেন,

-ইচ্ছে তুমি…নাফিজা? ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসো। আজ ইচ্ছে আমাদের সাথে খাবে।

নওশাদ সাহেবের কথাটা শুনে মোটেও খুশি হননি নাফিজা বেগম। অবশ্য অবাক হয়েছেন। এ মেয়ে আজ কেনো বাসায় খেতে বসলো? কিছু না বলে চুপচাপ খাবার বাড়ছিলেন উনি। ইচ্ছে মোবাইলে দৃষ্টি রেখে উচুস্বরে বললো,

-খাবার এনো না এস এম। ব্রেকফাস্ট করবো না আমি।

নাফিজা বেগম থামলেন। বিরবিরিয়ে নাটক‌ শব্দটা উচ্চারন করে নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন উনি। নওশাদ সাহেব আশাহতের মতো করে বলতে যাচ্ছিলেন কিছু। ইচ্ছে ফোন ছেড়ে একপলক রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে বললো,

-রাকীন বলছিলো খেয়া হাউজিং প্রজেক্টটা নিয়ে আজ ইনিশায় বোর্ড মিটিং আছে। তুমি যাবে এস এম?

হাত থেমে গেলো নাফিজা বেগমের। তার ছোট্ট মেয়েটার ছোটছোট ইচ্ছেগুলোকে ছোট করে দেখেনি রাকীন। রাকীনের কাছে কখনোই ইচ্ছে-রাকীনের মাঝের সম্পর্ক খেয়া-রাকীনের সম্পর্কের উর্ধ্বে ছিলো না। তারপরও তার মেয়েটাই সবকিছু থেকে আজ বঞ্চিত। কোথায় আছে, কেমন আছে, আদৌও আছে কি না…দাতে দাত চেপে নিজেকে সামলালেন নাফিজা বেগম। আজ খেয়া নেই বলেই ইচ্ছের কাছে হাউজিংয়ের কথা শুনতে হচ্ছে। খেয়াকে প্রাধান্য দেখিয়ে মহান সাজতে চাইছে ইচ্ছে। নাফিজা বেগম শান্তস্বরে বললেন,

-যাবো না।

ইচ্ছে ক্ষুদ্রশ্বাস ছাড়লো। ও জানতো নাফিজা বেগম কখনোই রাজি হবেন না। উঠে দাড়িয়ে বললো,

-ফাইন। আসছি।

এই বলে ইচ্ছে বেরিয়ে আসলো। ইনিশায় পৌছে রাকীনকে দেখতে পেলো না কোথাও। রাজীব মাহমুদ নিজেই হাউজিংয়ের মিটিংয়ে সবটা সামলেছেন। সবটা দেখে মনেমনে অনেকটা শান্তি মিলেছে ইচ্ছের। মিটিং শেষে বেরিয়ে রাজীব মাহমুদের সাথে কথা বলতে গিয়ে অনেকটা দেরি হয়ে যায় ওর। রাকীন অন্য প্রজেক্টে আছে বলেই নাকি এটাতে লিড দিচ্ছে না, এমনটাই বললেন রাজীব মাহমুদ। ইচ্ছে বুঝলো, পুরোটাই ওকে বোঝানোর চেষ্টা, রাকীন খেয়াকে ভুলে মুভ অন করতে চাইছে। কিছু না বলে শুধু সৌজন্য হাসিতে পাশ কাটিয়েছে ও রাজীব মাহমুদকে।

বেশ অনেকটাই দেরি হয়ে গেলো ইচ্ছের বেরোতে। ইনিশার কর্মদিবস ততোক্ষনে শেষ। লিফটে এসে কোনোদিক না তাকিয়ে গ্রাউন্ডফ্লোরের জন্য বোতাম চাপলো ইচ্ছে। চোখ মোবাইলে থাকলেও প্রচন্ড ক্ষুধায় মাথা ঘুরতে শুরু করেছে ওর। লিফট নামতে শুরু করার কয়েকসেকেন্ড পরেই আচমকা অন্ধকার হয়ে আসলো ওর চারপাশ। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। ইচ্ছের অন্ধকারে ফোবিয়া আছে। এমনিতেও ক্ষুধা, তার উপর অন্ধকার, এরপর ভেন্টিলেশনে সমস্যা। দুবার চেচিয়ে,দরজায় হাত দিয়ে বারি লাগালো ইচ্ছে। পেছন থেকে কেউ হয়তো কিছু বললো। কিন্তু নিজের ওপর আয়ত্ব রাখতে পারলো না ইচ্ছে। পরে যেতেই অনুভব হলো, কারো বাহুডোর আগলে নিয়েছে ওকে। গালে কারো স্পর্শের সাথে কানে বাজলো,

-হেই মিস রকস্টার? আর ইউ ওকে? মিস রকস্টার?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here