প্রেমনোঙর_ফেলে,৩০,৩১

0
375

#প্রেমনোঙর_ফেলে,৩০,৩১
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা

৩০.

-রকস্টার ইচ্ছের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে প্রাপ্ত।

প্রাপ্তর পা থেমে গেলো তৎক্ষনাৎ। রোবটের মতো পেছন ফিরলো ও। ওর অবিশ্বাসী চাওনি। মাহীম জলভরা চোখে কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর এগিয়ে এসে মোবাইলটা বের করে এগিয়ে দিলো প্রাপ্তর হাতে। আস্তেধীরে মোবাইলে থাকা নিউজটায় চোখ বুলিয়ে নিলো প্রাপ্ত। রকস্টার ইনায়াত নিক্কন ইচ্ছে আর ইনিশা বিল্ডার্সের উত্তরসুরী রাকীন শাফায়াতের বিয়ের খবর। একটু চুপ থেকে হঠাৎই হেসে উঠলো প্রাপ্ত। শব্দ করে হাসতে হাসতে বিছানায় গিয়ে বসলো ও। মাহীম নির্বাক। ও বুঝে উঠতে পারছে না, ঠিক কি বলে প্রাপ্তকে সামলাবে। প্রাপ্ত হাসি থামালো। হাটুতে কনুই ঠেকিয়ে বসে আবারো কিছুক্ষন একধ্যানে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো,

-এমনটাই তো হওয়ার ছিলো। তাইনা রে মাহীম?

-নিজেকে সামলা প্রাপ্ত।

-সামলানোর কি আছে এখানে মাহীম? কিছুই নেই তো সামলানোর। এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিলো। দোষটা তো আমারই। যে মনটাকে সযত্মে গুছিয়ে রেখেছিলাম, তাকে দেখার পর, সে মনটাকে আমি আর সামলাতে পারি নি। যেখানে দুজনার মিল কোনোদিনও হবার নয়, সেটা ভুলেও‌ ভালোবেসে ফেলেছি তাকে। অনুভব হয়, বারবার, প্রতিবারের দেখায় প্রেমে পরেছি তার। আর তার চেয়েও বড় কথা, যাকে আমি ভালোবাসলাম, সে যে অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারে এ কথাটা অবদিও ভুলে গিয়েছিলাম আমি। একবারও ভাবি নি, ইচ্ছে নিজে থেকে কখনো আমাকে অনুভব করায় নি, ও ভালোবাসে আমায়। বারবার দেখা হওয়াটা‌ তো শুধু কো-ইন্সিডেন্স ছিলো মাত্র! আর প্রতিবার সেই দেখা হওয়ায় ওর হাসিটা দেখার বদৌলতে ভুলে গেলাম, ওর মতো সেলিব্রিটির লাইফে আমার মতো অহরহ মানুষের আনাগোনা। অনেকেই আমার মতো এভাবে ভালোবেসে ফেলেছে ওকে। আর ওউ হয়তো সেই ভালোবাসাগুলোর একটাকে স্বীকৃতি দিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই।

মাহীম এগিয়ে এসে প্রাপ্তর কাধে হাত রাখলো। কথাগুলো বলে মাথা নিচু করে‌ছিলো প্রাপ্ত। কাধে মাহীমের‌ হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ তুলে তাকালো ও। ওর‌ চোখ দেখে এতোক্ষনে আঁতকে উঠলো মাহীম। ছলছল করছে প্রাপ্তর চোখ। যখন তখন অস্রুবর্ষন হবে তুমুলভাবে। ওকে অবাক করে দিয়ে ঠোটে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে প্রাপ্ত বললো,

-এতোটাই বেশি ভালোবেসেছি যে, শুধু ওকে ভেবে বাকিসব ভুলে গিয়েছি মাহীম। এমনকি আমার সে‌ কল্পকন্যাকেও। ও আমাকে নিজেরসত্ত্বাতেই আটকে নিয়েছে রে। প্রেমনোঙরে। আমি কি করবো বল? ওর ভালোবাসার জোয়ারে ভাসতে চাওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি। দোষটা আমারই।

মাহীম কিছু বলতে যাচ্ছিলো। ওকে সুযোগ না দিয়ে উঠে দাড়ালো প্রাপ্ত। একফোটা চোখের‌ জলও পরতে দেয়নি নিজের চোখ থেকে। ঠিকঠাকমতো দাড়িয়ে গলা ঝেরে বললো,

-এখানে যা যা কথা হলো, ভুলে যা। কেউ‌ জানবে না এসব কিছু। মাথায় রাখিস‌ কথাটা।

-প্রাপ্ত?

-আমি বলেছি কেউ কিছু জানবে না মানে জানবে না।

মাহীম থামলো। প্রাপ্ত কি করে নিজেকে‌ সামলাবে সেটা ও‌ জানে না। তবে এই কথাগুলো কাউকে জানিয়েও যে কোনো লাভ নেই, তা ও বেশ ভালোমতোই‌ জানে। যেখানে ইচ্ছেরই‌ বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, সেটা অবশ্যই ওর‌ সম্মতিতেই হচ্ছে। প্রাপ্তকেই ওর একপাক্ষীক ভালোবাসা ভুলতে হবে। আর কথা বাড়ালো না মাহীম। রুম থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে আসলো প্রাপ্ত। ড্রয়িংরুমে ততক্ষনে খই‌ আর মিষ্টি এসে বসেছে সাদিক সাহেব আর পিয়ালীর সাথে। প্রাপ্তকে দেখে দাড়িয়ে গেলো খই। একপলক ওর দিকে তাকিয়ে, প্রাপ্ত সুস্পষ্ট গলায় বলে দিলো,

-এ মাসের পনেরো তারিখে আমার আর খইয়ের এনগেইজমেন্টের ব্যবস্থা করো‌ বাবা। পরের এক সপ্তাহের মধ্যেই চাকরি কনফার্ম করে ফেলবো আমি। বিয়েটা আমার এপয়েন্টমেন্ট লেটার পাবার‌ পরেই হবে। আমি খই-কেই বিয়ে করতে চাই।

পাথরের মতো দাড়িয়ে রইলো খই। ঠিক কি শুনেছে, তা বুঝে উঠতেই পারলো না যেনো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সাদিক সাহেবের দিকে। তার চেহারার হাসিটা বলে দিলো, প্রাপ্তর সাথে ওর বিয়ে হোক, এমনটাই চান তিনিও। শ্বাস আটকে একপা দুপা করে পেছোতে লাগলো ও। সাদিক সাহেব ইশারা করতেই পিয়ালী আর মিষ্টি উঠে দাড়িয়ে গেলো। মিষ্টি খইয়ের কাধে হাত রেখে বললো,
নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ ” নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ” এবং ফলো করে সাথেই থাকুন।
-তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি আমি। চলো।

জলভরা চোখে মিষ্টির দিকে তাকালো খই। যন্ত্রমানবীর মতো চলে আসলো পিয়ালীর ঘরে। মিষ্টি মৃদ্যু হেসে বললো,

-আসলে পিয়ালীর মা ছিলেন গ্রামের মেয়ে। সাদিক আঙ্কেলের কোনো এক থেসিস চলাকালে তার সাথে দেখা হয়। প্রেমের বিয়ে ছিলো দুজনের। হয়তো এ কারনেই প্রাপ্তর বরাবরের ইচ্ছে ছিলো, গ্রামের প্রানবন্ত কোনো মেয়েকেই বিয়ে করার। ওর লাইফে তেমন করেই কেউ আসুক, যেমনটা ওর বাবা মায়ের সাথে হয়েছিলো। তোমাকে দেখার পর আমাদের সবারই মনে হয়েছে, প্রাপ্তর মনে সে জায়গাটা তুমিই করে নিতে পারবে। এমনকি তুমি করেও নিয়েছো। এখন তুমি নিজের মতো করে এ শহরে মানিয়ে নিতে শিখেছো খই। তোমার চেষ্টায় পড়াশোনাতেও তুমি অনেকদুর এগিয়েছো। সাদিক আঙ্কেল তো সবসময়ই তোমার পাশে ছিলেন। আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। তবুও যেহেতু প্রাপ্তর তোমাকে পছন্দ, তাই উনি চান তোমাদের দুজনের বিয়েটা সেরে ফেলে তোমাকে এ বাসায় নিয়ে আসতে।

খই নির্বাক। সাদিক সাহেবের দায়িত্ববোধটা এতো বেশি হবে যে, নিজের ছেলে বউ করে ওকে নিজের কাছে রাখবেন উনি, এমনটা ধারনাতেও ছিলো না ওর। তবে যদি প্রাপ্ত ওকে ভালোবেসে ফেলে, সেদিক‌টাও ভাববেন উনি। এটাও স্বাভাবিক। কিন্তু তা বলে ওর মতো অনাথকে? অবশ্য ও যে অনাথ সেটা বিবেচনার মন মানসিকতা সাদিক সাহেবের নয়, ও এটাও জানে। প্রাপ্ত কি করে ওকে ভালোবাসে? কেউ আগে থেকেই কেমন মানুষকে ভালোবাসবে সেটা নিশ্চিত করে রাখতে পারে বুঝি? এই ভালোবাসার প্রতিত্তর কি হওয়া উচিত ওর? ও তো ভালোবাসে না প্রাপ্তকে। তাহলে কাকে? যার কথা ভেবে ভেবে ও নিজেকে সাজাচ্ছে, তাকে নয় তো? ওর নকশাদার! ওর? মাথার চুলগুলো উল্টে ধরলো খই। ওর দিশেহারা অবস্থা দেখে পিয়ালী আর মিষ্টি একে অপরের দিকে তাকালো। পিয়ালী এগিয়ে এসে বললো,

-তুমি কি চাও খই? তুমি চাওনা এই বিয়েটা হোক?

ওর জিজ্ঞাসুদৃষ্টির জবাব খুজে পেলো না খই। কিন্তু ওকে তো জবাব দিতেই হবে। মিষ্টি আবারো বললো,

-বলো খই? তোমার মতামত ছাড়া তো আর বিয়েটা সম্ভব না। তোমার মত নেই এই বিয়েতে?

মত নেই! কথাটা বলার কারন খুজতে লাগলো খই। কিন্তু খুজে পেলো না। যতোটা ভালোবাসা এখানে ও পেয়েছে, তার সীমা জানা নেই‌ ওর। অমক করবে কার জন্য? যে মানুষটার সাথে কিছুটা সময়ের সাক্ষাৎ ওকে নতুন করে বাচতে শিখিয়েছে, তার জন্য? কিন্তু সে তো আপনজন হওয়ার কোনো আশ্বাস দেয়নি ওকে। সেদিনের পর আর দেখা পর্যন্ত করতে আসেনি সে মানুষটা। তবে তার জন্য কেনো ও ভাবছে? কেনো তার জন্য এই পরিবারটাকে অস্বীকার করবে ও? তা কি করে হয়? একটা শ্বাস ছেড়ে খই চোখ বন্ধ করে বললো,

-আমি রাজি।

পিয়ালী জড়িয়ে ধরলো খইকে। মিষ্টি কি বুঝে কিছুক্ষন অনুভবের চেষ্টা করলো ওর কথাটা। বললো,

-সত্যিই কি তুমি রাজী খই?

-হ্যাঁ। অমতের তো কোনো কারন নেই আমার মিষ্টি আপু। আমি রাজি।

-কিন্তু খই…

-আজ মা থাকলে…

কথা শেষ না করে তাচ্ছিল্যে হাসলো খই। মুলত মিষ্টির সন্দিহান কথাগুলো থামাতে মায়ের কথাটাকেই মনে করিয়ে দিলো ও। মিষ্টি মৃদ্যু হেসে ওর কাধে হাত রেখে বললো,

-উনি যেখানেই আছেন, ভালো আছেন খই। তোমার সিদ্ধান্তে খুশিই হয়েছেন। প্রাপ্ত অনেক ভালো রাখবে তোমাকে। অনেক ভালোবাসবে।

খই নিমীলিত দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। ও তো ভালোবেসে ভালোবাসার আশা করেছিলো। সে সৌভাগ্য হলো না। এবার ভালোবাসাকেই ভালোবাসার চেষ্টা করবে না হয়!

মায়ের পুরোনো একটা গয়না খুজতে খুজতে নিজের পুরো রুমটা তছনছ করে দিয়েছে ইচ্ছে। যেখানে আর কিছু হোক বা না হোক, মায়ের জিনিসগুলো সবসময় নখদর্পনে থাকে ওর। মাথার চুলগুলো উল্টে চেপে ধরে ধপ করে বিছানায় বসে পরলো ও। বিয়েতে রাজী কথাটা রাকীনকে বলার পর থেকেই মাথা কাজ করছে না ওর। টমি মুখ দিয়ে মেঝেতে পরে থাকা দুটো ফাইল খানিকটা সাইডে রেখে দিলো। কিছু জামাকাপড়ও একপাশে টেনে রাখলো। ঘর গোছানোর চেষ্টা হয়তোবা। অতঃপর ইচ্ছের কাছে এগোলো। ওর পায়ে প্যাঁচ লেগে গেছে কিছু একটা। ইচ্ছের অস্থিরতা বুঝে ওকে নিজের দিকে মনিযোগী করার চেষ্টা শুরু করলো টমি। ওর গা ঘেষা, পা মুড়িয়ে থাকা। ইচ্ছেও বুঝলো, টমি ওর পা মুড়িয়ে থাকা জিনিসটা ছাড়িয়ে দিতে বলছে ও। কিছুক্ষন পাত্তা না দিয়ে মাথা ধরে বসে রইলো নিজের মতো। টমি হার মানতে নারাজ। যেনো ইচ্ছের মনোযোগ এখন ওর চাইই চাই! পেরে না উঠে ইচ্ছে একসময় চেচিয়ে বলে উঠলো,

-ওটা প্রাপ্তর ছেড়া স্কার্ফ না‌ টমি! সো‌ প্লিজ স্টপ এনোয়িং মি!

বলে দিয়ে নিজেই আটকে গেলো ইচ্ছে। টমি ওর ধমক শুনে নুইয়ে বসে গেলো মেঝেতে। ঠোট কামড়ে ধরে আশেপাশে তাকালো ইচ্ছে। আজ বাদে কাল রাকীনের সাথে ওর বিয়ে। বাকিসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলোর মতো, আজ এই মুহুর্তেও প্রাপ্তর নামটাই ওর মাথায় ঘুরছে। নিজের ওপর প্রচন্ডরকমের বিরক্ত হলো ও। একটা অচেনা মানুষকে নিয়ে কখনো এতোটা ভেবেছে কিনা মনে পরলো না ওর। মাথা থেকে এসব ভাবনা সরানো জরুরি ভেবে বাটন ফোনটা হাতে নিলো ইচ্ছে। ডাবল ট্যাপে লাস্ট ডায়ালড্ নম্বরে না দেখেই কল লাগালো ও। ওপাশ থেকে শান্তশিষ্ট এক আওয়াজ,

-হ্যালো কে বলছেন?

গলার স্বর শুনেই চমকে উঠলো ইচ্ছে। কান থেকে ফোন নামিয়ে নম্বরটার দিকে তাকালো। আননোন নম্বর। অথচ ওই ফোনে ওর বাবা আর রাকীনের ছাড়া অন্যকারো নম্বর থাকার কথা না। আর রাকীনকেই কল করতে‌ চেয়েছিলো ও। কিন্তু এই অচেনা নম্বরধারীর স্বর চেনা ওর। এটা প্রাপ্ত। মনে পরলো, এই ফোন থেকে লাস্ট কল ও প্রাপ্তকেই করেছিলো। হুট করেই চোখ ভরে উঠতে লাগলো ইচ্ছের। ওপাশ থেকে আবারো প্রাপ্ত বলে উঠলো,

-হ্যালো?

চোখের পানিকে বেরিয়ে আসার সুযোগ দিলো না ইচ্ছে। কল কেটে দিয়ে মোবাইলটা ঢিল ছুড়লো বিছানায়। তারপর সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার অন করে দিলো ও। বসেবসে ওর অবস্থাটা দেখলো টমি। উঠে গিয়ে বিছানায় থাকা বাটন ফোনটা মুখে নিয়ে কামড়াতে লাগলো। তবে নষ্ট করার মতো করে না। ওটা ইচ্ছের কাজের জিনিস। তবে এর জন্য রাগ উঠেছে ইচ্ছের। তাই ওকে শাস্তি দেওয়াই চলে। টমির কামড়ে আবারো কল চলে গেছে। ওপাশ থেকে হ্যালো শব্দটা শুনতেই টমি আরো জোরে শব্দ করে উঠলো এবার। ও বুঝে গেছে। ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটা অন্য কেউ‌ না, ওর সেই চরম অপছন্দের মানুষ। প্রাপ্ত!

#চলবে…

#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা

৩১.

ইচ্ছের বিয়ে। নওশাদ সাহেব মনের কতো করে সাজিয়েছেন পুরো বাসাটাকে। উজ্জল রোদে বাড়িটার সাজ আরো আকর্ষনীয় লাগছে যেনো। গার্ডেনে স্টেজ করে সেখানে ইচ্ছেকে বসিয়ে হলুদ-মেহেদী লাগানো হচ্ছে। গানবাজনা পর্বও‌ চলছে। হাতে সময় কম থাকায় আলাদা আলাদা দিনে অনুষ্ঠানগুলো না করে বিয়ের দিন সকালেই করা হচ্ছে সবটা। তাছাড়া ইচ্ছে, রাকীন দুজনেরই অমত ছিলো। আলাদা করে একটা দিনে ঝামেলা চায়নি কেউই। বিয়েটা নিয়ে কথা‌ বলে ইচ্ছে প্রেসমিডিয়ার হিসাব মিটিয়ে দিয়েছে আগেই। যাতে ওকে বিয়েরদিন আলাদা করে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে না হয়। তবুও সবাই এসেছে। ছবি তুলছে, নিউজ করছে নিজেদের মতো করে। নওশাদ সাহেবের আত্মীয়স্বজন বলতে শুরু দুটো বোন, একটা ভাই আর ইচ্ছের কিছু কাজিন। বাকিসব ইচ্ছের সংঙ্গীতাঙ্গনের পরিচিতরা। বাসার সামনের দিকের ব্যালকনিতে দাড়িয়ে শক্তমুঠে রেলিং ধরে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে রইলেন নাফিজা বেগম। ওই‌ জায়গায় আজ তার মেয়ের থাকার কথা ছিলো। আর যে যাই বলুক না কেনো, রাকীন তো সবসময় খেয়াকেই বেশি প্রাধান্য দিতো। আজও ও‌ খেয়াকেই‌ ভালোবাসে। এটাও‌ নিশ্চিত উনি। চোখ ফেটে জল গরিয়ে পরলো নাফিজা বেগমের। চলে আসলেন ওখান থেকে। সবাই হলুদ ছোয়াচ্ছে ইচ্ছেকে। রাকা পাশে দাড়িয়ে আছে শুধু। কিছুই বলছে না। ও মানতেই পারছে না, ইচ্ছে বিয়েটাতে রাজি হয়ে গেছে। মেহেদী দেওয়ার সময় ইচ্ছের পাশে থাকা বাটন মোবাইলটা বেজে উঠলো। তখনই মেহেদী পরাতে থাকা মেয়েটি জিজ্ঞাসা করলো,

-কি নাম দেবো?

ইচ্ছের দৃষ্টি মোবাইলে। আর মোবাইল স্ক্রিনে সেই আননোন নাম্বার। ইচ্ছে বিস্ময়ে সেদিক তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বললো,

-প্রাপ্ত…?

বাজতে বাজতে কেটে গেলো কলটা। প্রাপ্ত নিজের ফোনটাই বিছানায় ছুড়ে মারলো এবার। দু দুবার এই নম্বরে টমির গলা শুনেছে ও। এটা ইচ্ছেরই নম্বর। ও তো ইচ্ছেকে কল করেনি। তবে তো এটাই দাড়ায়, ইচ্ছেই কল করেছিলো ওকে। কিন্তু আজ ওর বিয়ে। ওকেই বা কেনো কল করতে যাবে ইচ্ছে? সন্ধ্যায় খই আর ওর আংটিবদল। আর এখন এই কল। করনীয় বুঝে না উঠে অস্থিরভাবে প্রাপ্ত ফোন নিয়ে আবারো কল লাগালো ইচ্ছের নম্বরে। মোবাইলে আবারো একই নম্বর থেকে কল আসতে দেখে উঠে দাড়ালো ইচ্ছে। বেপরোয়াভাবে অনুষ্ঠানের মাঝ পর্যায়েই স্টেজ থেকে ছুটে নেমে আসলো ও। গায়ের হলুদগুলো যেনো মরিচের প্রলেপ হয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে ওর পুরো শরীর। শাওয়ার অন করে সমস্ত শরীর থেকে হলুদ তুলতে শুরু করে দিলো ও। নখের আঁচড়ে কেটেও গেছে কয়েকজায়গায়। এতোক্ষন গায়ে জোর থাকলেও হাতের মেহেদী তুলতে গিয়েই পাথর হয়ে গেলো ইচ্ছে। তালুতে লেখা নামটা দেখে শ্বাস আটকে আসতে লাগলো ওর। মনে পরলো, প্রাপ্তর কলটা যখন আসে মেহেদীর ডিজাইনার কি নাম লিখবে, প্রশ্ন করেছিলো ওকে। ওর মুখ দিয়ে তখন প্রাপ্তর নামই বেরিয়েছে। ফলস্বরুপ হাতের মেহেদীতে ওর হবু বর রাকীনের নামের পরিবর্তে স্পষ্টাক্ষরে লেখা, “প্রাপ্ত”
নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ ” নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ” এবং ফলো করে সাথেই থাকুন।

দিন গরিয়ে সন্ধ্যে নামলো। টকটকে লাল লেহেঙ্গা, ভারীভারি গয়নায় সাজানো হলো ইচ্ছেকে। এই প্রথমবার ওর চুলগুলো খোপা করা হয়েছে হয়তোবা। গলায় আটকানো চোকারটার পরিবর্তে হার, কানের বড়বড় স্টাইলিস্ট এয়াররিংগুলোর পরিবর্তে স্বর্নের ঝুমকো, নাকে বড় নথ, কপাল জুড়ে থাকা টিকলি, হাতভর্তি চুড়ি। সে এক অন্য ইচ্ছে। সবাই বসেবসে প্রশংসা করছে ওর সাজের। ইচ্ছে নিশব্দে বসে আছে বিছানায়। হুট করেই একজন এসে বললো, বর এসেছে। ব্যস! বর দেখতে ছুটলো সবাই। রাকা পুরোটা সময় দুরে থাকলেও একা পেয়ে ইচ্ছের কাছে বসেছিলো কিছুক্ষন। কি ভেবে ওউ চলে গেছে। আপাতত শুধু টমিই রয়ে গেছে রুমটাতে। ইচ্ছের দৃষ্টি ব্যালকনির পর্দার দিকে স্থির। বাইরে থেকে আসা শীতল বাতাসে শুভ্র পর্দাগুলো উড়ছে মৃদ্যুছন্দে। তার ফাঁকফোকড়ে পূর্নচাঁদটাও দেখা যায়।

হাতের তালুটা সামনে তুলে ধরলো ইচ্ছে। সময়ের সাথে মেহেদীর রঙ গাঢ়তর হয়েছে। আরো বেশি রঙ পেয়েছে প্রাপ্তর নামটা। হাত ধোয়ার সময় অনেক ডলেছে। ওঠেনি সে নাম। যেমনভাবে ওই মানুষটার প্রতি ওর অনুভব গাঢ় হতে শুরু করেছে, তেমনভাবেই হাতের মেহেদীতেও ওর নাম গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ। চোখ ভরে উঠলো ইচ্ছের। টুপটাপ দু ফোটা চোখের জল গরিয়ে তালুতে পরলো ওর। দম বন্ধ লাগছে ওর এই সাজে। চিৎকার করে কান্না পাচ্ছে ওর। মায়ের কথা মনে পরছে প্রচন্ড। আজকে ওর মা নেই বলে ওকে সামলানোর জন্য কেউই নেই, করনীয়টা বোঝানোর জন্য কেউই নেই। নিজেকে সামলাতে না পেরে আকস্মাৎ কেদে দিলো ইচ্ছে। অস্ফুটস্বরে কাদতে কাদতে বললো,

-মা!

সারাদিন কিছুই খাওয়া হয়ে ওঠেনি ইচ্ছের। টমি জানে সেটা। ও শোয়া থেকে উঠে দাড়ালো ইচ্ছেকে কাদতে দেখে। খানিকক্ষন ঘরের মেঝে শুকে টি টেবিলে পানি দেখলো শুধু। গিয়ে টেবিলের কাছে দাড়িয়ে শব্দ করতে লাগলো। ইচ্ছে নাক ডলে বললো,

-খিদে নেই আমার টমি।

টমি আবারো ডাকলো। ইচ্ছে আর কিছুই বললো না। টমি এদিকওদিক দেখে হাটা লাগালো ব্যালকনির দিকে। ইচ্ছে তখনও ঠোট কামড়ে ধরে ফুপাচ্ছে। টমি কামড় লাগালো ব্যালকনির পর্দায়। টেনে ছিড়তে লাগলো পাতলা পর্দাটা। ইচ্ছে তৎক্ষনাৎ কান্না থামিয়ে চোখ মুছে বললো,

-টমি স্টপ।

টমি যেনো শুনলোই না। ইচ্ছে আবারো বললো,

-টমি প্লিজ স্টপ। আজকে না প্লিজ! প্লিজ টমি।

টমি বাধ মানলো না। পর্দার নিচের দিকটা ছিড়ে ফেলেছে ও। ইচ্ছে বিছানা ছেড়ে নামলো এবার। ব্যালকনিতে‌ গিয়ে মেঝেতে দু হাটু ঠেকিয়ে, টমির দিকে হাত বারিয়ে বললো,

-টমি কাম? প্লিজ জেদ করিস না।

ইচ্ছের গলায় অসহায়ত্ব। যেনো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে ওকে। আর কোনো কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা নেই‌ ওর। টমিকে না থামতে দেখে আরো জোরে বললো,

-টমি প্লিজ! এভাবে প্রাপ্তর মতো পাগলামি কেনো করছিস তুই?

প্রাপ্তর নাম নিয়ে কথা বলেছে এটা মনে পরতেই আবারো কপাল চেপে ধরে কেদে দিলো ইচ্ছে। টমির থামার নামই নেই। এবার লাফিয়ে উঠে দেয়ালে আটকানো ভাঙা গিটারটাকেই মেঝেতে ফেলে দিলো ও। ইচ্ছে থমকে গেছে ওর কাজে। দু দন্ড স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে পাগলের মতো করে জরিয়ে ধরলো গিটারটা। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে টমির দিকে তাকিয়ে চেচিয়ে বললো,

-সমস্যা টা কি তোর? কি সমস্যা?আমি ওই ছেলেকে ভুলতে চাইছি। আর তুই বারবার কেনো মনে করিয়ে দিচ্ছিস ওকে? বারবার আমার লাইফে ওর উপস্থিতির কথা মনে করিয়ে দিয়ে, কি প্রমান করতে চাস কি তুই? কি?

-কোন ছেলেকে ভুলতে চাইছিস তুই ইচ্ছে?

রাকীনের গলা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো ইচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে রুমের দরজায় তাকালো ও। সাদা-সোনালীর সংমিশ্রনের শেরওয়ানী পরনে রাকীন দাড়িয়ে। ঠিক ওর পেছনেই রাকা। ইচ্ছে উঠে দাড়ালো। চোখমুখ মুছে রাকীনের থেকে‌ চোখ‌ সরিয়ে বললো,

-তুই এখানে?

-রাকা বলছিলো তুই‌ নাকি সারাদিন কিছু খাসনি?

ইচ্ছে জবাব দিলো না। রাকীন এগোলো। ইচ্ছের হাত থেকে ভাঙা গিটারটা নিয়ে বললো,

-এটা ভাঙলো কি করে?

-তোর গিটার কে ভেঙেছে ইচ্ছে?

-নামটা বলছিস না কেনো?

ইচ্ছে একপা দুপা করে পেছোতে লাগলো। ওর চারপাশে‌ শুধু একটাই নাম বাজতে শুরু করেছে। প্রাপ্ত। ফুপাতে ফুপাতে বুকের মাঝে আকড়ে ধরে থাকা ভাঙা গিটারের দিকে তাকালো ইচ্ছে। বুঝলো, ও‌ পাগল হয়ে যাচ্ছে ওই নামের জন্য, এই নামধারী মানুষটার জন্য। তাকে ছাড়া অসহ্য লাগছে ওর সবটা। কয়েকমুহুর্ত সবটা মনে করে নিজের মস্তিষ্কের নিউরনগুলোকে অদৃশ্য জোর খাটাতে লাগলো একেরপর এক। কি হলো ইচ্ছের, চোখ তুলে রাকীনের দিকে তাকিয়ে একশ্বাসে বলে দিলো,

-আমি প্রাপ্তকে ভালোবাসি রাকীন।

অবাকচোখে তাকালো রাকীন। ইচ্ছের উত্তর না প্রশ্নের‌ সাথে যায়, না পরিস্থিতির সাথে। তবে এই ভালোবাসি শব্দটা তো চিরন্তন। নিজেকে স্বেচ্ছায় ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করা যে ইনায়াত নিক্কনকে ও চেনে, সেই কঠোর মেয়েটিও ভালোবেসেছে শুনে স্বস্তিতে চোখ বন্ধ করে নিলো রাকীন। তা যাকেই হোক না কেনো। ঠোটের‌ কোনে হাসি ফুটেছে ওর। এই‌মুহুর্তে আর কোনো প্রশ্ন করলো না ও ইচ্ছেকে। ওর হাসি দেখে ইচ্ছে নিজে কি বলেছে, সেটা অনুভব করলো। আবারো বিস্ময়ে তাকালো ওর‌ ভাঙা গিটারটার দিকে। গিটার কে ভেঙেছে, তার উত্তর কি করে “তাকে ভালোবাসি” হয়? কেউ ওর সবচেয়ে ভালোবাসার জিনিসটাকে আঘাত করে কি করে ওর ভালোবাসার কেউ হয়ে যেতে পারে? ওর ভেতরের অদৃশ্য সত্ত্বা হয়তো জবাব দিলো, ভালোবাসা এমনই। আর যাই হোক, নিজমুখে উচ্চারন করা ভালোবাসিকে এখন আর অস্বীকার করতে পারবে‌ না ও। হ্যাঁ ভালোবাসে ও প্রাপ্তকে। এই স্বীকারোক্তিতে যদি এতো সুখ থাকে, সে সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে পারবে না ও। রাকীনের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে কাদতে কাদতে বললো,

-আমি প্রাপ্তকে ভালোবাসি। রাস্তায় গুন্ডামো করা ওই গ্যাংস্টারকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি রাকীন। এই বিয়ে আমি করতে পারবো না রে! এই বিয়ে আমি করতে পারবো না!

রাকীন মৃদ্যু হাসিটা ঠোটে রেখে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। ইচ্ছের কাছে হাসিটা তাচ্ছিল্য বলে মনে হলো। ও‌ কাদতে কাদতেই বললো,

-জানি কথাগুলো তোকে বলতে অনেকটাই দেরি করে ফেললাম। কি করবো বল? আমার নিজেরই বুঝতে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু এখন বেশ বুঝতে পারছি, ওকে ভালোবাসি। ওকে ছাড়া আর কাউকে জীবনে মানতে পারবো না আমি। আমাকে তোকে এক করার ভুল ধারনা নিয়ে, খেয়া যেভাবে নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়েছিলো, আমি সেভাবে নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিতে পারবো না রাকীন। আমি প্রাপ্তকে ভালোবাসি। তোকে বিয়ে করতে পারবো না। এই বিয়ে হবে না রাকীন। আমি বিয়েটা করছি না। ক্ষমা করে দিস আমাকে। আ’ম, আ’ম সরি!

কথা শেষ করে ইচ্ছে একমুহুর্তও দাড়ালো না। ছুট লাগালো। রাকীন জানতো, ওর মতের জন্য অপেক্ষা করবে না ইচ্ছে। তাই দাড়িয়ে রইলো চুপচাপ। কিন্তু ইচ্ছেকে হাত ধরে দরজায় আটকে দিলেন নওশাদ সাহেব। পুরোটা না শুনলেও, ইচ্ছের বলা শেষের তিন লাইন স্পষ্ট শুনেছেন তিনি। ইচ্ছের হাত ধরে রেখে বললেন,

-এসব তুমি কি বলছো ইচ্ছে? আজকে তোমার বিয়ে! রাকীন? তুমি কেনো কিছু বলছো না? কি বলছে ও এসব? কোথায় যাবে তুমি ইচ্ছে?

-ওকে যেতে দাও আঙ্কেল। আজ ওকে আটকিও না।

রাকীনের কথায় অবাকই হলেন নওশাদ সাহেব। এভাবে ইচ্ছে বেরিতে গেলে ওর আর ওর বাবার সম্মানটা কোথায় গিয়ে দাড়াবে ,তার ধারনা আছে তার। কিন্তু রাকীনের সে পরোয়া নেই। ইচ্ছে রাকীনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

-থ্যাংকস্। আমি জানতাম তুই বুঝবি আমাকে।তবে আজ চাইলেও কেউ ইচ্ছেকে আটকাতে পারবে না। আসছি।

গায়ের জোরে বাবার হাতের মুঠো থেকে ঝারা মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো ইচ্ছে। রাকীন হেসে দিয়ে নিজের গাড়ির চাবিটা ছুড়ে মারলো ইচ্ছের দিকে। চাবিটা ক্যাচ করে, লেহেঙ্গা খানিকটা উচিয়ে ধরে উচ্ছ্বাসে দৌড় লাগালো ইচ্ছে। থমকে দাড়িয়ে থেকে বিয়ের কনেকে দৌড়াতে দেখলো পুরো বাড়ি। সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে, ড্রয়িংয়ের একগাদা মানুষজনের দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে, গার্ডেনের আকাশে জ্বলা আতশবাজির আলোতে মরিচবাতিতে সাজানো রাস্তা দিয়ে দৌড়ে এসে গাড়িতে উঠলো ইচ্ছে। টমিও ওর পেছনপেছন দৌড়ে এসে গাড়িতে উঠেছে। সিটবেল্ট লাগাতে‌ লাগাতে টমিকে আরেকহাতে আদর করে দিলো ইচ্ছে। অতঃপর স্টার্ট দিলো‌ গাড়িটা। গন্তব্য…প্রাপ্ত!

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here