#প্রেমনোঙর_ফেলে,৩৬,৩৭
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা
৩৬.
-মিস ইনায়াতের এক্সিডেন্টের প্রায় ছ ঘন্টা পার হয়ে গেছে মিস্টার রাকীন। আর তার মাথায় আঘাতটাও ঠিক তখনই লেগেছে। ব্রেইনে ব্লিডিং শুরু হয়েছে তখন থেকেই। শুরুর দিকে বলে তিনি হয়তো তৎক্ষনাৎ টের পাননি। কান দিয়ে আসা অল্পবিস্তর র’ক্তকে ইগ্নোর করেছেন। এখন এতোটা সময় পর ব্লিডিং বেড়েছে। পুরো দিন না খাওয়া উনি। ফিজিক্যালি উইক হয়ে ব্লাডও ডোনেট করেছেন দু ব্যাগ।
এটুকো বলে ডক্টর থামলেন। সামনের মানুষগুলোর বিদ্ধস্ত রুপ দেখে আরও বলার পুর্বে তার সাহস সঞ্চার করা প্রয়োজন। জ্ঞান হারানোর পর ইচ্ছেকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রক্তক্ষরন থেমেছে। তবে জ্ঞান ফেরেনি ইচ্ছের। ডক্টরের সামনের চেয়ারে রাকীন, নওশাদ সাহেব অসহায়ের চাওনি নিয়ে বসে। আর এককোনে দুহাত মুঠো করে, মেঝেতে দৃষ্টিস্থির করে প্রাপ্ত দাড়িয়ে। হাতের তালুর উপরপিঠ থেকে র’ক্ত ঝরছে ওর। ইচ্ছেকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়ার সময় ওর করা পাগলামিতে, করিডরের দেয়ালেও লেগেছে সে র’ক্ত। কথাগুলো শোনার পর আরো প্রাপ্ত আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে পরবে, তা বেশ বুঝছেন উনি। ডক্টর উঠে দাড়ালেন। উঠে দাড়ালো রাকীন আর নওশাদ সাহেবও। নওশাদ সাহেবের সামনে গিয়ে ডক্টর বললেন,
-ব্লিডিং আপাতত না থাকলেও, মিস ইনায়াতের এখনো সেন্স ফেরেনি। রেসপন্স করছেন না উনি। আমাদের আর কিছুই করার নেই মিষ্টার নওশাদ।
-আমার মেয়েটা আর বাচবে না। তাইনা ডক্টর?
নওশাদ সাহেবের ফাকা দৃষ্টি। খেয়াকে তো আগেই হারিয়েছিলেন। ওর অভাবে ভালোবাসা নামক অনুভূতিও যেনো হারিয়ে ফেলেছিলো ইচ্ছে। কোনোদিনও ভালোবাসা বোঝে নি তার। আজ যখন খেয়া ফিরেছে, দুই মেয়েকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেওয়ার সুযোগ এসেছে, তখন দুজনকেই এই হসপিটালে দেখে কোন বাবা ঠিক থাকবে? নাফিজা বেগমকে ইচ্ছের ইমারজেন্সির দরজা থেকে সরানোই যায় নি। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় পিতা বলে মনে হচ্ছিলো নওশাদ সাহেবের। রাকীন বললো,
-শান্ত হও আঙ্কেল। ইচ্ছের কিছু হবে না। ডক্টরের সাথে আমি কথা বলছি।
রাকীন সরিয়ে নিয়ে আসলো ডক্টরকে। যন্ত্রের মতো বসে রইলেন নওশাদ সাহেব। রাকীন বললো,
-ইচ্ছে কেমন আছে ডক্টর?
-উনি ভালো নেই মিস্টার রাকীন। মিস্টার নওশাদ ভুল আন্দাজ করেন নি। এভাবে সেন্সলেস থাকলে হয়তো ইনায়াতকে আমরা ব্…
কথা শেষ করার আগেই ঝড়ের বেগে ছুটে এসে ডক্টরের এপ্রোন দুহাতে চেপে ধরলো প্রাপ্ত। তবে ওর রক্তবর্ন চোখ আর শক্ত চোয়াল দেখে নমনীয়তা হারালেন না ডক্টর। ইচ্ছেকে ওর বাহুডোর থেকে সরানোর পর থেকেই এএন পাগলামো করে চলেছে এই ছেলেটা। প্রাপ্ত ডক্টরের এপ্রোন ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে বললো,
-এই ডক্টর! আমার ইচ্ছের কিছু হবে না! ওর কিছু হলে আমি কিন্তু কাউকে বাচতে দেবো না! শেষ করে দেবো সব! প্রাপ্ত ওয়াদা করছে এটা! আমি…
রাকীন ঝারা মেরে ডক্টরকে ছাড়িয়ে নিলো প্রাপ্তর হাত থেকে। অবাকচোখে তাকালো প্রাপ্ত। রাকীন শক্ত গলায় বললো,
-এটা তোমার গুন্ডামো দেখানোর জায়গা না প্রাপ্ত! এট হসপিটাল। আর উনি একজন ডক্টর!
-ওকে বলো আমার ইচ্ছেকে সুস্থ্য…
-কিসের তোমার ইচ্ছে? তোমার না ইচ্ছে! বরং এসবের জন্য তুমিই দায়ী! এতোই যদি ভালোবাসো, কেনো বলোনি ভালোবাসো? যে মেয়ে এতোবড় সেলিব্রিটি হয়েও তোমাকে সময় দিতো, তোমার কাজগুলোতে তোমাকে বাধা দিতো না, তোমার একটাবারের জন্যও মনে হয়নি, সে মেয়ে তোমাকে নিয়ে কিছু তো ফিল অবশ্যই করে? একবারো ভাবনায় আসেনি সে কথা? হোক তা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে, তবুও বারবার কাছে এসেছিলো ও তোমার। কেনো বলোনি ভালোবাসো ওকে? তাহলে আজ আমাদের কাউকেই এইদিন দেখতে হতো না। না ইচ্ছে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হতো, না তুমি জেদ ধরে খেয়াকে আংটিবদল করতে রাজি হতে। কোনোটাই ঘটতো না!
চোখ নামিয়ে নিলো প্রাপ্ত। একবর্নও ভুল বলেনি রাকীন। তবে রাকীন নিজেও এভাবে বলতে চায়নি। যেটুকো ভাগ্যে লেখা, তা তো হওয়ারই ছিলো। এভাবেই ওদের চারজনের জীবন বহমান হওয়ার ছিলো। একা প্রাপ্তর তো দোষ না এতে। তবে প্রাপ্তকে থামাতে এসব বলতেই হতো ওকে। সত্যিই থেমে গেছে প্রাপ্ত। রাকীন এগোচ্ছিলো ওকে সামলাবে বলে। ধপ করে মেঝেতে বসে পরলো প্রাপ্ত। দুহাত জোর করে জলভরা চোখে ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বললো,
নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ ” নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ” এবং ফলো করে সাথেই থাকুন।
-ইচ্ছেকে প্লিজ সুস্থ্য করে দিন ডক্টর। ওকে প্লিজ ঠিক করে দিন। বাচবো না ওকে ছাড়া আমি। বাচতে পারবো না। প্লিজ ওকে বাচান ডক্টর। প্লিজ!
চোখ বন্ধ করে মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়লো রাকীন। ইচ্ছে যখন বলেছিলো, গ্যাংস্টারকে ভালোবাসি, কৌতুহল থেকে রাকার কাছে শুনেছে ও প্রাপ্তর বিষয়ে সবটা। রাকার ভাষ্যমতে যে ছেলে মারপিটের ভাষা ছাড়া অন্যকোনো ভাষায় বুঝাতে জানে না, আজ সে হাতজোর করে কাদতে কাদতে কথা বলছে। নত হচ্ছে। হবেই বা না কেনো? ভালোবাসার কেউ যখন মৃত্যুমুখে, তখন নিজেকে সামলানো কতোটা কষ্টের, ও নিজেও সে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। ইচ্ছের অসুস্থ্যতার কথা খেয়া জানার পর ওর অবস্থায় গুরুতর হয়ে গিয়েছিলো। দুজনকে নিয়ে সমান ভয়ে ছিলো সবাই। আপাতত ঘুমের ঔষুধ দিয়ে রাখা হয়েছে খেয়াকে। ডক্টর প্রাপ্তকে তুলে দাড় করালেন। ওর কাধে হাত রেখে বললেন,
-আমি বুঝতে পারছি আপনার অবস্থা মিস্টার প্রাপ্ত। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করছি মিস ইনায়াতকে ঠিক করার। বর্তমানে মেডিকেল সাইন্স অনেক উন্নত। এক্সিডেন্টাল স্ট্রোকের ক্ষেত্রে উন্নতদেশে ব্রেইন অপারেশন সিস্টেম চালু করা হয়েছে। এখানে আমাদের নিউরো হসপিটালেও কিছু স্পেশালিস্ট এমন অপারেশন করেছেন। আপনারা চাইলে আমরা মিস ইনায়াতের অপারেশনের ব্যবস্থা করবো।
একটুখানি স্বস্তির শ্বাস ফেলে, ঠোট কামড়ে নিশব্দে কাদছিলো প্রাপ্ত। ডক্টর একপলক রাকীনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-বাট ব্রেইন অপারেশন সাকসেসফুল হওয়ার পসিবিলিটি খুব কম মিস্টার প্রাপ্ত। এ পর্যন্ত হওয়া সবগুলো অপারেশনে, প্রতি দশজনে একজনকে বাচাতে পেরেছে ডক্টরেরা। বাকি নয়জন ওটিতেই…
-কি বলছেন আপনি ডক্টর? সবেই তো আশার আলো দেখালেন। এখন বলছেন অপারেশন সাকসেসফুল না হলে ওটিতেই…
বিস্ময়ে বললো রাকীন। ডক্টর মাথা নিচু করে নিলো। রাকীন চুলগুলো উল্টে ধরলো নিজের। এবার ওরও ভয় করছে। ডক্টর বললেন,
-জ্বী। বিষয়টা এমনই। অপারেশন না হলে মিস ইনায়াত অসুস্থ্যতা নিয়ে হাতেগোনা কিছুদিন সার্ভাইভ করবেন। অপারেশন সাকসেসফুল হলে সুস্থ্য হয়ে যাবেন। আর না হলে ওটিতেই… এবার আপনাদের সিদ্ধান্ত নেবার পালা মিস্টার রাকীন। তবে যদি আপনারা অপারেশন করাতে চান, যা করার দ্রুত করতে হবে। নইলে মিস ইনায়াত আরো বেশি অসুস্থ্য হয়ে পরবেন। তখন আমাদেরও করার কিছু থাকবে না।
রাকীন বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে। এই অপারেশনের কথা কিভাবে বলবে নওশাদ সাহেবকে? উনি কোনোদিনও রাজী হবেন না এতো ঝুকিপুর্ন অপারেশনের জন্য। বরং অপারেশন ব্যতিরেকেই ইচ্ছেকে আরো কিছুদিন ভালোবাসার সুযোগ নেবেন সে। অপারেশন করাবে না এটা বলবে বলে জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে নিলো রাকীন। প্রাপ্ত হঠাৎই শান্তস্বরে বললো,
-আপনি অপারেশনের ব্যবস্থা করুন ডক্টর। ইচ্ছের কিছুই হবে না।
অবাকচোখে ওর দিকে তাকালো রাকীন। প্রাপ্তর দৃষ্টি মেঝের দিকে স্থির। প্রাপ্ত চোখ তুলে বললো,
-দেরি করবেন না প্লিজ ডক্টর। যা ব্যবস্থা করার, করুন। ইচ্ছের অপারেশন হবে।
ডক্টর বললেন,
-আপনার অনুমতিতে অপারেশন হবে না মিস্টার প্রাপ্ত। পেশেন্টের বাবা অথবা পরিবারের কারো অফিসিয়াল অনুমতি চাইবে হসপিটাল অথোরিটি। বোনসাইন ছাড়া এতো ঝুকিপুর্ন অপারেশন কোথাও কেউই করাবে না।
-নওশাদ আঙ্কেল কখনোই এই অপারেশনে অনুমতি দেবে না প্রাপ্ত। তাকে চিনি আমি। খেয়াকে সবে খুজে পেয়ে ইচ্ছেকে হারানোর এতোটুকো ঝুকি নেবেন না তিনি এই মুহুর্তে।
রাকীনের কথায় দু দন্ড চুপ করে রইলো প্রাপ্ত। অপারেশন হবে না এমন সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো রাকীন। আচমকাই প্রাপ্ত বলে উঠলো,
-বাবার পরিবর্তে পেশেন্টের বর অনুমতি দিলে হবে?
বিস্ফোরিত চোখে ওর দিকে তাকালো রাকীন। ডক্টরের চাওনিতেও আকাশসম বিস্ময়। প্রাপ্ত একদম স্বাভাবিক গলায় বললো,
-বলুন না ডক্টর? বিয়ের পর মেয়েদের বড় অভিভাবক তো স্বামীই হয়। নওশাদ স্যারের পরিবর্তে ইচ্ছের বর যদি বোনসাইন করে, অপারেশন করাবেন না আপনারা?
রাকীন খানিকটা জড়ানো গলায় বললো,
-কি করতে চাইছো তুমি প্রাপ্ত?
-আজ তো ইচ্ছের বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। ইচ্ছের বিয়ে হবে আজ। তারপর ওর বর ওর অপারেশনের জন্য বোনসাইন দেবে। অপারেশন হবে ইচ্ছের। কেউ আটকাতে পারবে না।
স্পষ্টভাষায় জবাব দিলো প্রাপ্ত। রাকীন কপাল চেপে ধরলো নিজের। একবার ভাবলো, প্রাপ্তকে থামাবে। বলবে এমন পাগলামি না করতে। পরপরই নিজেকে এর জায়গায় বসিয়ে ভাবলো, আজ ইচ্ছের জায়গায় খেয়া থাকলে, এমনটা করতে দুবার ভাবতো না ও। এমনকি বন্ধু হিসেবে এখনো ও এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কিন্তু সে সম্পর্কটা না ও চায়, নাইবা ইচ্ছে, খেয়া, প্রাপ্ত বা ওদের পরিবারের কেউ। রাকীন এগিয়ে প্রাপ্তর কাধে হাত রেখে করুনভাবে বললো,
-জেনেশুনে এতোবড় সিদ্ধান্ত নিচ্ছো, পরে যদি ইচ্ছের কিছু…
-ইচ্ছের কিছুই হবে না মিস্টার রাকীন। ও তো প্রাপ্তর প্রাপ্য! কেড়ে নেওয়ার অধিকারবোধ খাটাবে না সৃষ্টিকর্তা।
এটুকো বলেই প্রাপ্ত নওশাদ সাহেবের দিকে এগোলো। সে পাথর হয়ে চেয়ারে বসে। প্রাপ্ত তার সামনে গিয়ে হাটু গেরে মেঝেতে বসে বললো,
-আমি,ইচ্ছে, দুজন দুজনকে ভালোবাসি স্যার। আপনি অনুমতি দিলে, আমি ইচ্ছেকে এই মুহুর্তে বিয়ে করতে চাই।
নওশাদ সাহেব অবুঝের মতো তাকালেন প্রাপ্তর দিকে। নিজের সুদীর্ঘ জীবনে অনেক প্রেমের কাহিনী দেখেছেন। নিজেও প্রেমে পরেছেন। একবার নয়, দু দুবার। কিন্তু জীবনমরনের সন্ধিক্ষনে কেউ কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চায়, আজ প্রথমবার দেখছেন। প্রাপ্তর দিকে মুগ্ধচোখে চেয়ে রইলো রাকীন। ডক্টরের চাওনিতেও রাজ্যের বিস্ময়। মৃত্যুমুখী জেনেও যে প্রিয় মানুষটাকে বিয়ের কথা বলতে পারে, তারচেয়ে বড় ভালোবাসার প্রমান আর কি হতে পারে? যেখানে কোনো কামনা-বাসনার সুযোগ নেই, কোনো নতুন শুরুর নিশ্চয়তা নেই, সেখানেই কি করে বিয়ে নামক বাধনে বদ্ধ হবার উন্মাদনা? সেখানেই কি করে শুভ প্রেমপরিনয়ের অস্থিরতা? হয়তো ভালোবাসা আছে বলেই! হয়তো প্রেম আছে বলেই! আর এজন্যই, ভালোবাসা পবিত্র, ভালোবাসা সুন্দর…
#চলবে…
#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা
৩৭.
ইমারজেন্সির বেডে নিশ্চুপভাবে শুয়ে আছে ইচ্ছে। ওর নাকে অক্সিজেন পাইপ, হাতে স্যালাইন, মাথায় কিছু সেন্সর লাগানো। দরজা খুলে আস্তেধীরে ভেতরে ঢুকলো প্রাপ্ত। কলিজা যেনো কেউ টুকরো টুকরো করে কাটছে ওর। ডক্টর বলে দিয়েছে, ইচ্ছে নিজেই রেসপন্স করছে না। আর এমন চলতে থাকলে চাইলেও অপারেশন করা তাদের পক্ষে সম্ভব না। নওশাদ সাহেব, নাফিজা বেগম, রাকীন একেএকে সবাই এসে দেখে গেছে ইচ্ছেকে। ইচ্ছে সাড়া দেয়নি। মনে সাহস সঞ্চার করে কেবিনে ঢুকলো প্রাপ্ত। এগিয়ে এসে ঝুকলো ইচ্ছের দিকে। অসহায়ের চোখে মনভরে দেখে নিলো ওকে। তারপর মৃদ্যুভাবে ইচ্ছের কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,
-কেনো এমন করছো ইচ্ছে? আর কতো শাস্তি দেবে আমায়?
…
-ডক্টর বলছে তুমিই নাকি রেসপন্স করছো না? কিন্তু তা কি করে হয় ইচ্ছে? সবেই তো নতুন করে শুরু করবো আমরা। তুমি তো পিছিয়ে যাওয়ার মেয়ে নও ইচ্ছে। সাহস করে তুমিই তো প্রথমে এগিয়েছিলে। সবকিছু ছেড়েছুড়ে। এখন ওরা বললে আমি কি করে বিশ্বাস করি বলো?
…
-তোমার বাবা, মা, বোন, বন্ধু সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে ইচ্ছে। একটাবার চোখ মেলো? একটাবার তাকাও?
ইচ্ছের সাড়া নেই। প্রাপ্ত ওর দুহাত মুঠো করে চুমো দিলো। ওর চোখের জলে সিক্ত হলো ইচ্ছের হাত। প্রাপ্ত কাদতে কাদতে বললো,
-তোমার ভালোবাসা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে ইচ্ছে। তোমার পাগলামীর স্রোতে গা ভাসাবে বলে। তাকে আর একটাবার সুযোগ দাও ইচ্ছে? একটাবার?
মৃদ্যু নড়েচড়ে উঠলো ইচ্ছের হাত। কিঞ্চিত শক্তিতে প্রাপ্তর হাত চেপে ধরলো ইচ্ছে। চমকে উঠে উচ্ছ্বাসে ওর দিকে তাকালো প্রাপ্ত। ইচ্ছে চোখ খুললো আস্তেধীরে। নিজচোখে দেখে নিলো উন্মাদপ্রায় প্রাপ্তর চেহারার হাল। মৃদ্যুস্বরে বললো,
-আমি বরই নির্লজ্জ প্রাপ্ত। জীবনে খুব কম ভালোবাসা পেয়েছি তো! তাই ভালোবাসার ডাক শুনলে আটকাতে পারি না নিজেকে।
প্রাপ্ত ইচ্ছেকে তুলে জরিয়ে ধরলো। পাগলের মতো একাধারে চুমোতে ভরিয়ে দিলো ইচ্ছের চোখমুখ। ইচ্ছে বাধা দিলো না। প্রাপ্ত একটু থামলে বললো,
-কি হয়েছে আমার? বাচবো না আমি আর?
-কিছুই হয়নি তোমার। সব ঠিক হয়ে যাবে ইচ্ছে।
প্রাপ্তর শীতল স্বর। ইচ্ছে মৃদ্যু হাসলো। অনেকটা সময় পর প্রাপ্ত ওকে বেডে শুইয়ে দিলো আবারো। নাক টেনে ঠোটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বললো,
-আজ আমাদের বিয়ে ইচ্ছে।
থমকে গেলো ইচ্ছে। কম্পিতকন্ঠে বললো,
-ক্ কি বলছো তুমি এসব?
-ঠিকই বলছি। আমি আজ এই মুহুর্তে বিয়ে করতে চাই তোমাকে।
-পাগল হয়ে গেছো তুমি? এসব…
-প্রাপ্ত ঠিকই বলছে ইচ্ছে। আজই বিয়ে হবে তোদের।
ইচ্ছে চোখ সরিয়ে দরজায় তাকালো। খেয়া এসেছে। ওর হুইলচেয়ারের পেছনে রাকীন দাড়িয়ে। নওশাদ সাহেব, নাফিজা বেগমও আছেন। ইচ্ছে বললো,
-কিসব বলছিস তুই খেয়া? এখন এভাবে…
-আমরা সবাই এমনটাই চাই ইচ্ছে। প্রেসমিডিয়া জানুক, তোমার আজ বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো, বিয়েটা হয়েছে।
-কিন্তু বাবা…
প্রাপ্ত পাশ থেকে একটা কাগজ তুলে দিলো ইচ্ছের কোলে। ওর একহাতে কলম ধরিয়ে দিয়ে, আরেকহাতে চুমো দিয়ে বললো,
-ভালোবাসি তোমাকে মিস রকস্টার। আমার ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দাও?
বাবা, মা, বোনের দিকে একপলক তাকিয়ে সবার চোখমুখে পড়ে নিলো ইচ্ছে। অতঃপর নির্দ্বিধায় রেজেস্ট্রি পেপারে সাইন করে দিলো । ওর সব কারন, প্রশ্ন এসে প্রাপ্তর কথাতেই শেষ হয়ে যায়। প্রাপ্ত ওর দুর্বলতা। আর যাই হোক, কোনোদিনও ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা যে ওর নেই, তা ভালোমতোই জানে ইচ্ছে। সাইনটা পেয়ে প্রাপ্ত শ্বাস ফেললো। কপালে চুমো একে দিলো ইচ্ছের। বললো,
-ওয়েলকাম টু মাই লাইফ ইচ্ছে। তোমার একান্ত গ্যাংস্টারের মিসেস গ্যাংস্টার হয়ে।
•
কেবিনে নাফিজা বেগম ইচ্ছের ঔষুধপত্র গোছাচ্ছেন। থরথর করে সমানে হাত কাপছে তার। ইচ্ছের অপারেশনের সময় ঘনিয়ে আসছে ক্রমশ। স্বামী হিসেবে ইচ্ছের সব সিদ্ধান্ত প্রাপ্তই নিয়েছে। নওশাদ সাহেবকে এখনো কিছু জানায়নি প্রাপ্ত বা রাকীন। কি হবে সে চিন্তায় নাফিজা বেগম অস্থির হয়ে পরেছেন। ইচ্ছে আধশোয়া হয়ে বসেবসে মাকে দেখে চলেছে। বিয়েটা হয়ে যাওয়ার পর, আর একবারের জন্যও খেয়া আসেনি ওর কেবিনে। নাফিজা বেগমের অবস্থাও স্বাভাবিক না। কিছু বলতে যাবে, তখনই গিটারের ব্যাগ কাধে কেবিনে ঢুকলো প্রাপ্ত। পেছনে আরেকটি মেয়ে। নাফিজা বেগম জলভরা চোখে তাকালেন মেয়েটার দিকে। ব্রেইন অপারেশনের জন্য চুল কাটা হবে ইচ্ছের। এজন্যই মেয়েটিকে নিয়ে এসেছে প্রাপ্ত। প্রাপ্তকে দেখলেন শক্ত হয়ে দাড়িয়ে থাকতে। তার সব কাজে শুধু একটাই প্রতিত্তর, ইচ্ছের অপারেশন হবে, ঠিক হয়ে যাবে ইচ্ছে। ঠোট চেপে ধরে কান্না আটকে, নাফিজা বেগম বেরিয়ে গেলেন কেবিন থেকে। ইচ্ছে ইশারায় প্রাপ্তকে জিজ্ঞাসা করলো, মেয়েটা কে। প্রাপ্ত একটা টুল টেনে গিটার কোলে নিয়ে বসতে বসতে বললো,
-তোমার চুলের অবস্থা ভালো না। নতুন বউকে এতো এলোমেলো চুলে ভালো দেখায় না। তাই ভাবলাম একটু কেটে ছোট করে দেই।
ইচ্ছে ঠোট টিপে হেসে বললো,
-আসল ঘটনা বলুন মশাই। বাচ্চাদের কাহিনী কাকে শোনাচ্ছেন?
প্রাপ্ত একশ্বাসে বললো,
-তোমার চুল আমার পছন্দ না ইচ্ছে।
ইচ্ছে শব্দ করে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,
-একদম ন্যাড়া করে দাও।
তারপর প্রাপ্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
-আর এইযে! গিটার এনেছো যখন, গান গেয়ে শোনাও! জলদি!
অবাকচোখে তাকিয়ে রইলো প্রাপ্ত। ওর কাজগুলোকে এতো সহজতর করে কেনো দিচ্ছে ইচ্ছে? এতোটা বাচ্চামো কেনো করছে? ইচ্ছে ভ্রু নাচিয়ে আবারো গাইতে বললো ওকে। প্রাপ্ত গিটারে সুর তুলে ওর দিকে তাকিয়ে গাইতে লাগলো,
” হতে পারে রুপকথার এক দেশের
রাতের আকাশের একফালি চাঁদ
তোমার আমার চিরকাল…
তুমি আমি হাতে রেখে হাত
ছুয়ে দিয়ে আঙুলে আঙুল
দেখতে পারো কিছু আদুরে সকাল।
হতে পারে এ পথের শুরু
নিয়ে যাবে আমাদের অজানায়
তুমি আমি আমাদের পৃথিবী
সাজিয়ে নেবো ভালোবাসায়…
ভালোবাসি বলে দাও এবার
বলে দাও হ্যাঁ সব কবুল
তুমি শুধু আমারই হবে
যদি করো মিষ্টি এ ভুল।
হাতে হাত রাখতে পারো
সন্ধি আঙুলে আঙুল
ভালোবাসা বাড়াতে আরো
হৃদয় ভীষন ব্যাকুল…”
ইচ্ছে চোখ সরালোই না প্রাপ্তর থেকে। মুগ্ধচোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলো ওকে। ভুলে গেলো পারিপার্শ্বিক। যে মেয়েটা ইচ্ছের চুল কাটতে এসেছিলো, অজান্তেই কখন ওর চোখ থেকে জল গরিয়েছে, নিজেও জানেনা। এমন ভালোবাসা চোখের সামনে দেখাটাও সৌভাগ্যের বিষয়। তরিঘড়ি করে চোখের পানিটুক মুছে নিজের কাজে মন দিলো ও। ইচ্ছের মাথার ঝলোমলো চুলগুলো দেখে আরেকদফায় কান্না আসছিলো ওর। এইতো সেদিনের এক কনসার্টে, ছাড়া চুলে, জিনস্ টপস্ পরে স্টেজে উঠেছিলো ইচ্ছে। প্রতিবার গান গাওয়ার সময় যখন চুলগুলো চোখেমুখে এসে লাগতো, কতো সুন্দরভাবে তাতে আঙুল চালিয়ে সরিয়ে দিতো ইচ্ছে। ঠোট কামড়ে ধরে নিজেকে শক্ত রেখে মেয়েটা সবগুলো চুল কেটে দিলো ইচ্ছের। ঠিকঠাকমতো সবকিছু গুছিয়ে পেছন থেকে মৃদ্যু ইশারা করলো প্রাপ্তকে। ইচ্ছে তখনো প্রাপ্তর গানের মোহে আছে যেনো। প্রাপ্তও ইশারায় মেয়েটাকে বুঝালো চলে যেতে। মেয়েটা চলে গেলে, শেষ করলো গান। ধ্যান ভাঙলো ইচ্ছের। ঠোটে মুগ্ধতার হাসি বহাল রেখে বললো,
-অনেকভালো গাও মিস্টার গ্যাংস্টার। সিঙিংয়ে আসলে না কেনো?
প্রাপ্ত গিটার পাশের দেয়ালে ঠেস দিয়ে রেখে বললো,
-আমি সিঙিংয়ে গেলে, তুমি মিস রকস্টার থেকে মিসেস গ্যাংস্টার কিভাবে হতে শুনি?
ইচ্ছে হাসলো। প্রাপ্ত একধ্যানে ওর হাসিটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ওই হাসি দেখে ইচ্ছের একদম কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করছে ওর। আদর করতে ইচ্ছে করছে। পরিস্থিতি ঘোরাতে উঠে দাড়িয়ে শেলফের কাছে চলে গেলো। ইচ্ছের ঔষুধপত্র দেখতে দেখতে বললো,
-মেডিসিন নিয়েছো? আমি আসার আগেই আন্টি দিয়ে দিয়েছে মেডিসিন?
ইচ্ছে যেনো পুরোটাই বুঝলো। হাতের স্যালাইন খুলে ফেললো আস্তেধীরে। প্রাপ্ত উল্টোপাশ হয়ে ফিরে তখন। বেড থেকে নেমে, প্রাপ্তর পিঠে মাথা ঠেকিয়ে ওকে জরিয়ে ধরলো। প্রাপ্ত চমকে উঠে পেছন ফিরতে যাচ্ছিলো। ইচ্ছে ওর বুকের শার্ট খামচে ধরে বললো,
-রিল্যাক্স। নিজে উত্তেজিত হয়ে আমাকেও উত্তেজিত করো না প্লিজ!
-ইচ্ছে?
-আই লাভ ইউ।
-তোমার রেস্টের দরকার ইচ্ছে। তুমি…
ইচ্ছে প্রাপ্তর সামনে এসে দাড়ালো। প্রাপ্তর হাত দু গালে রেখে বললো,
-আমি তোমার বউ প্রাপ্ত। ভালোবাসো আমাকে। আদর করে দাও মন ভরে।
-এসব…চলো বেডে চলো।
প্রাপ্ত সরিয়ে আনছিলো ইচ্ছেকে। ঠায় হয়ে দাড়িয়ে রইলো ইচ্ছে। একচুলও নড়লো না। প্রাপ্ত দীর্ঘশ্বাস মিনতির স্বরে ফেলে বললো,
-তুমি কেনো জেদ করো ইচ্ছে? এটা জেদের সময়?
-তোমায় বলেছি আমাকে ভালোবাসতে। আগে জানলে বিয়েটা কোনোভাবেই করতাম না আমি। কিছুক্ষন আগে চুপিচুপি আমার রিপোর্টস্ দেখে জানলাম, কাল ওটি থেকে আমার রিকভারির পসিবিলিটি খুব কম। বেশ বুঝতে পারছি, এখনো অবদি বেচে আছি, তোমাকে ভালোবাসি বলে। সে ভালোবাসাকে আরো গভীরভাবে অনুধাবন করার আগে, তোমার কাছে আসার আগেই যদি এভাবে মর্…
ইচ্ছের মুখ চেপে ধরলো প্রাপ্ত। একহাতে ওর কোমড় জরিয়ে রেখে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,
-হুশ! চুপ! এভাবে বলো না ইচ্ছে! প্লিজ এভাবে বলো না! ভালোবাসা তো ভালোবাসাই হয়। গভীরভাবে, মৃদ্যুভাবে অনুভবের কিছুই নেই এতে। আমি সবরক পরিস্থিতিতে শুধু তোমাকে চাই। তুমি কেনো ভুল বুঝছো আমাকে? কেনো আমাকে বারবার অপরাধী করে দিচ্ছো তোমার কাছে? কিছুই হবে না তোমার। কিছুই হবে না!
প্রাপ্ত চোখ বন্ধ করে রেখেছিলো। ইচ্ছে তাকিয়ে তাকিয়ে ওকে দেখে চলেছে। কিছুটা সময় পর পাশের শেলফে থাকা মোবাইলটা নিলো একহাতে। “লাগ যা গালে” গানটা বাজিয়ে দিলো ওতে। প্রাপ্ত গানের কথাগুলো শুনতেই চোখ মেললো। বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিলো ও গানটা। ইচ্ছে বাধা দিয়ে বললো,
-আমরা কতোদিন বাচি, কতোক্ষন বাচি, সেটা কিন্তু গুরুত্বপুর্ন না। গুরুত্বপুর্ন বিষয় হলো, বেচে থাকার মুহুর্তগুলোতে আমরা কতোটুকো বাচি, কতোটুকো উপভোগ করি আমাদের জীবন। মেয়ে, বোন হিসেবে জীবন দেখে নিয়েছি আমি প্রাপ্ত। কাল ওটিতে ঢোকার আগ অবদি আমি তোমার স্ত্রী হিসেবে বাচতে চাই! ওটিতে যাওয়ার আগ অবদি, তোমার কাছে থেকে তোমার শরীরের ঘ্রান নেবো, তোমায় ভালোবাসবো, আমার থেকে এই সৌভাগ্যটা কেড়ে নিও না প্রাপ্ত! প্লিজ!
-ইচ্ছে…
প্রাপ্তকে বলার সুযোগ দেয় নি ইচ্ছে। গোড়ালি উচিয়ে, একহাতে প্রাপ্তর গলা জরিয়ে ধরে, ঠোটের স্পর্শে আটকে দিলো ওর ঠোট। আটকে ছিলো প্রাপ্তও। আস্তেধীরে নেমে ওর বুকে মুখ গুজলো ইচ্ছে। জোরেজোরে শ্বাস নিয়ে প্রাপ্তর গায়ের ঘ্রান অনুভবের চেষ্টা করলো। তবে নাকের পাইপের জন্য পারলো না কিছু অনুভব করতে। অশ্রুবিসর্জন দিতে লাগলো নিরবে। প্রাপ্ত পাথর হয়ে গেছে। টপটপ করে জল গরাতে লাগলো ওর চোখ বেয়েও। জানালা দিয়ে বাইরের রুপালী থালার মতো চাঁদটা দেখা যায়। প্রেমানুরাগের এ মুহুর্ত শুধু ওদের দুজনেরই হওয়ার কথা। কিন্তু মিলনের মহৌৎসবের পরিবর্তে বরং আজ সুর উঠেছে, “ফির আপকে নাসিব মে, ইয়ে বাত, হো না হো…শায়েদ ফির ইস জানামমে, মুলাকাত হো না হো….”
#চলবে…