প্রেমনোঙর_ফেলে,সূচনা পর্ব

0
1011

#প্রেমনোঙর_ফেলে,সূচনা পর্ব
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা

দেহের সামনের দিকে পুরুষালি হাতের ধাক্কায় দু পা পিছিয়ে গেলো ইচ্ছে। অগনিত মানুষের পদচারনায় ব্যস্ত মহাসড়কের ঠিক মাঝখানে দাড়িয়ে,কোনো ছেলের এমন স্পর্শ কোনো মেয়ের কাছে সেটা কতোটা লজ্জার,তা শুধু সে মেয়েটিই জানে। রাগে,দুঃখে,অপমানে চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগলো ইচ্ছের। শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো ও। সিক্ত পাপড়িতে চোখ চুলকাতে শুরু করেছে। ওদিকে একটা ছেলে হয়ে,কোনো মেয়ের সম্মুখদেহে ধাক্কা দেওয়ার মতো জঘন্য কাজ করেও সামনের মানুষটার কোনো খেয়ালই নেই। সে তো মার লাগাতে ব্যস্ত! বাবার বয়সের লোকটাকে বাজেভাবে মেরেই চলেছে অনবরত। আর সেই মারপিট বন্ধ করতে গিয়েই এভাবে অপমানিত হতে হলো ইচ্ছেকে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে পিছিয়ে আসতে হলো এই বাজে স্পর্শের দরুন। রাগে হাত মুঠো করে নিলো ইচ্ছে। দাতে দাত চেপে এবার আবারো এগোলো সামনে। মানুষটার কাধ চেপে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে সশব্দে চড় লাগিয়ে দিলো তার গালে।

থমকে আছে পুরো জায়গাটা। তীক্ষ্ম অনুভবে দুপুরের রোদটাও যেনো চড়া হয়ে উঠলো! রাস্তার কাকগুলো ডানা ঝাপটাচ্ছে। গাড়ির হর্নের শব্দ থেমে গেলো কিয়দক্ষনের জন্য। পথচারীদের পা থেমে স্থিরতার সঙ্গা লেপ্টে দিচ্ছে চারপাশে। স্তব্ধতায় আশপাশের সবার আটকে থাকা শ্বাসে এক বিমুঢ়তা আঁকা। পরিচিত মুখগুলোতে রাগ অথবা বিস্ময়। রাগটার কারন ওদের প্রিয় কারো গায়ে হাত ওঠা। আর বিষ্ময়ের কারন সে প্রিয়র নিরবতা। আরেকটা কারন আছে বিস্ময়ের। চড়দাতার দুঃসাহস! শ্বাসরুদ্ধ সে এক তীব্র অনুভব এ ভীড়ের মাঝে। সাদমান ইনাব প্রাপ্ত’র গালে চড় মেরেছে কেউ!

গালে হাত দিয়ে নিচদিক তাকিয়ে নিরবে আটকে আছে প্রাপ্ত। যেনো পাথর হয়ে গেছে ও সেকেন্ড পাঁচেকের ব্যবধানে। ওর গায়ে ফুলের টোকাটা পরলেও তার ভয়ানক দাম চুকাতে হয়,এটাই নিয়ম। প্রাপ্তর নিয়ম! সেখানে কেউ চড় মেরেছে ওকে! হিসাবে তিলপরিমান খাদ থাকতে দেবে না তো ও! অগ্নিশর্ম রাগ নিয়ে যেইনা মাথা তুলতে যাবে,দ্বিতীবারের মতো চড় পরলো ওর গালে। অপমানিত হওয়ার রাগ সামলে না উঠতে পেরে আবারো ওকে চড় মেরেছে ইচ্ছে। প্রাপ্তকে এবারেও মাথা তোলার সুযোগ না দিয়ে সোজা ওর কালো চেইকের শার্টটার কলার চেপে ধরলো। রীতিমতো ঝাকি দিয়ে চেচিয়ে বললো,

-তোর সাহস কি করে হলো ইচ্ছেকে ব্যাড টাচ করার? হাউ ডেয়ার ইউ!

পাশ থেকে জনপাঁচেক প্রায় হুমড়ি খেয়ে পরতে যাচ্ছিলো ইচ্ছের উপর। কিন্তু প্রাপ্ত দুহাত ছড়িয়ে ওদের থামতে বুঝাতেই থামলো ওরা। চড়দাতার দিকে চোখ তুলে তাকালো প্রাপ্ত। ওর মুখ থেকে ইঞ্চিপাঁচেক দুরুত্বে বেশ ফর্সামতোন এক মেয়ের চেহারা। তবে ফর্সা আর নেই এখন সে মুখটা। লালাভ হয়ে আছে। হয়তো রাগে। নাকের ডগা,চোখ রক্তিম হয়ে গেছে একদম। কান্নার দরুন ভিজে ওঠা পাপড়ি এতোটা কাছ থেকে প্রচন্ড ঘন দেখাচ্ছে। একদম সোজা চুলগুলোর সামনে কিছু ছোট করে কাটা বলে গালে এসে লেগে গেছে। হয়তো চোখের পানিতে ভিজে,নয়তো বা ঘামে। কানের বড় দুলটা চুড়ির সাইজের বড়। গলায় থাকা কালো চোকারে গিটার শেইপের লকেটটায় রোদ পরে চোখে লাগলো প্রাপ্তর।‌ আস্তেকরে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো ও। আর ওকে অন্যদিক ফিরতে দেখেই যেনো গায়ে আগুন লেগে গেলো ইচ্ছের। আবারো ওর কলার ঝাকিয়ে বললো,

-চোখ খোল বাস্টার্ড! অন্যদিক কেনো ফিরছিস তুই? চোখ কেনো বন্ধ করছিস? চোখ খোল! হাউ ডেয়ার ইউ টু টাচ মি লাইক দ্যাট! হাউ ডেয়ার ইউ?

ফু দিয়ে একটা শ্বাস ছাড়লো প্রাপ্ত। ইচ্ছের দিকে না তাকিয়ে শান্তভাবে এবার ওর হাতে নিজের শার্টের কলারটার দিকে তাকালো ও। কলার দেখার পরিবর্তে চোখ গেলো মেয়েটার হাতের দিকে। মুঠো করা হাত দুটোই কাপছে। বা হাতে থাকা কালো রঙের আংটি,ব্রেসলেট দুটোতেই টোন সিম্বল। কব্জিতে ছোট করে টোন সিম্বলের ট্যাটুও করানো। প্রাপ্ত হাত তুলে ওর মুঠো থেকে নিজের কলারটা ছাড়িয়ে নিলো। রাগে সর্বশক্তিতে কলার ধরে ছিলো ইচ্ছে। কিন্তু প্রাপ্ত এতো সাবলীলভাবে কলারটা ছাড়িয়ে নিলো,এতে আরেকদফায় রাগ হলো ওর। কিছু বলার আগেই প্রাপ্ত ইচ্ছের দিকে ফিরলো। ওর দুকাধ দুহাতে ঠেলে আরো পিছিয়ে দিয়ে আপাদমস্তক দেখে নিলো ইচ্ছেকে।

বয়সটা বাইশ তেইশের বেশি হবেনা মেয়েটার। পরনে কালো টপস্,জিন্স,উচু হিল। শার্টের হাতার মতো হাতাটা গুটিয়ে ভাজ দেওয়া। পুরোপুরি ছেলেদের মতোন করে।‌ একটা ক্ষুদ্রশ্বাস ফেললো প্রাপ্ত। মারপিটের সময় বাধা দিতে আসা,এমন শার্ট পরিহিত হাতটা কোনো মেয়ের হবে,মাথাতেই আসে নি ওর। কোনোদিক না তাকিয়ে ধাক্কা মেরেছে সে হাতের মালিককে। ফলশ্রুতিতে স্পর্শটা বেশ বাজেই হয়ে গেছে মেয়েটার জন্য। অবশ্য ওরও দোষ নেই। যেখানে এখানকার কোনো ছেলেই প্রাপ্তর সামনে দাড়ানোর সাহস পায় না,কেনো কোনো মেয়ে আসতে যাবে ওর কাজে বাধা দিতে? আর যখন রেগে থাকে,এমনিতেও কোনোকিছুর হুশ থাকে না প্রাপ্তর। তাই ওর কাজে বাধা দিতে আসা দোষ এই মেয়েরই। কলার ধরা,চড়দুটো তো আছেই! নিজেকে নির্দোষ অধিষ্ঠিত করে দুহাত পকেটে পুরে দাড়ালো প্রাপ্ত। গা ছাড়া ভাবে বললো,

-দোষটা তোমারই। প্রাপ্তর কাজে বাধা দিতে আসাটা উচিত হয়নি তোমার।

প্রাপ্ত। নামটা না চাইতেও ইচ্ছের মস্তিষ্কে বারকয়েক হানা দিলো। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের,সুঠাম দেহের অধিকারী মানুষটার যেকোনো কিছু প্রাপ্তির পুরোটা অধিকার আছে,এমন ভাবের ঝলক আছে চেহারায়। উচ্চতার সাথে মানানাই গরন তার। ভ্রুযুগল বেশ ঘন। কপালের সামনের চুলগুলোর নড়চড় বেশিই বলে মনে হয়। কালো চেইকের শার্টের কলারের কাছে খোলা বোতামদুটোর আদলে গলার দৃশ্যমান রগ ছুইয়ে ঘাম গরাচ্ছে। হাতে থাকা মোটা ফিতার ঘড়িটার চেয়ে ঘামে সিক্ত লোমগুলোর নিমীলিত শয়ন বেশ আকর্ষক বলে মনে হলো ইচ্ছের।

-তোমার ভুলে,তোমাকে সরিয়ে দিতে গিয়ে যেটা ঘটেছে,সেটা আমার আকস্মিকতায় ঘটেছে। আর তার বিপরীতে তুমি আমাকে একটা নয়,পরপর দু দুটো চড় মেরেছো! হিসাবটা কিন্তু এখানেই বাড়তি মিস। কিন্তু তাতেও থেমে থাকো নি তুমি। কলারও ধরেছো আমার। এখনো ভদ্রতা দেখাচ্ছি। সাদমান ইনাব প্রাপ্ত প্রথমবারের মতো আজ হিসাবে পাওনা রাখবে। বিনিময়ে দুটো কাজ করো জাস্ট। সে সরি,এন্ড লিভ।

কথাটা বলে পাশে তাকালো প্রাপ্ত। ওর অনবদ্য ধারনা,ইচ্ছে ভয়ে ওকে সরাসরি সরি বলতে পারবে না। তাই পাশ ফিরলো ও। সামনে দুটো ছেলে এক লোককে ধরে রেখেছে। পাশে তিনটে‌ মেয়েসহ আরো চারটে ছেলে। মেয়েদের একজন,ছেলেদের দুজন বেশ রাগী চেহারা করে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে। প্রাপ্ত ঘাড় নাড়িয়ে ইশারায় বুঝালো,আমি ঠিকাছি। বা হাতে ডানহাতাটা টান মেরে চোয়াল শক্ত করে এগোচ্ছিলো ধরে রাখা মানুষটাকে মারবে বলে। একজন একটা হকিস্টিক এগিয়ে‌ দিলো‌ ওর‌ দিকে। ওটা নিয়ে লোকটাকে‌ মার‌ লাগাবে বলে উদ্যত হলো প্রাপ্ত। কিন্তু থেমে যেতে বাধ্য হলো আবারো। আবারো বাধা পরেছে ওর কাজে!

প্রাপ্তর হাতের হকিস্টিক পেছন থেকে ধরে রেখেছে ইচ্ছে। রাগে ওর সবপ্রকার বোধ লোপ পেয়েছে যেনো। এই লোকটা আবারো স্পর্শ করেছে ওকে! ধাক্কা দিয়ে পিছিয়ে দিয়েছে। নিজে ভুল করেও দোষটা ওকেই দিচ্ছে। সরি বলার নুন্যতম ভদ্রতা না দেখিয়ে ওকেই সরি বলতে বলছে। আর তো‌ আর এতোটা‌ নিষ্ঠুরভাবে এই মধ্যবয়স্ক লোকটাকে‌ হকিস্টিক দিয়ে মারতে যাচ্ছিলো। দাতে দাত চেপে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মানুষটাকে একবিন্দু পরোয়া না করে একটানে হকিস্টিকটা কেড়ে নিয়ে পাশের নর্দমায় ফেলে দিলো ইচ্ছে। প্রাপ্তর পাশ থেকেই একটা মেয়ে এগিয়ে বললো,

-তোমার সাহস কি করে হয় প্রাপ্তর স্টিক ড্রেনে ফেলে দেওয়ার?

-অরি? থাম!

প্রাপ্তর শান্তস্বরে অরিত্রা থামার পরিবর্তে অস্থির হয়ে পরলো আরো যেনো। কোনাকুনিভাবে প্রাপ্তর দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বললো,

-তুই কিছু বলবি না প্রাপ্ত?

-প্রাপ্তকে কিছু বলতে হবে না। আমরা‌ দেখছি এই মেমকে। প্রাপ্ত? তুই এটাকে দেখ!

মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটিকে ধাক্কা‌ মেরে অন্যদুজনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সাফোয়ান ইচ্ছের দিকে এগোচ্ছিলো। প্রাপ্ত থামালো না ওকে। চুপচাপ ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে রইলো শুধু। ইচ্ছের তুখোড়‌ চাওনিটায়‌ রাগের সাথে বিস্মিতও‌ হয়েছে ও। এবার‌ দেখার‌ পালা,সাফোয়ানের কাজে কি জবাব দেয় এই‌ মেয়ে। অরিত্রা পাশ থেকে‌ বুকে হাত গুজে বললো,

-আজকের‌ জন্য না‌ হয় ওকে ট্রাফিকপুলিশ বানিয়ে দে‌ সাফোয়ান? সিটি মার,সিটি মার‌ সিটি মার…

অরিত্রার গান শুনে রাগটা তরতর করে‌ বেড়ে গেলো ইচ্ছের। আশেপাশে তাকালো ও। প্রাপ্তর গালে চড় মারা অবদি জায়গাটায় অনেকেই ছিলো। এখন আর কেউই নেই। প্রাপ্ত আর দুটো মেয়ে ছাড়া ওর‌ সাথের‌ বাকি সবাই ওকে দেখে অদ্ভুতভাবে হাসছে। সাফোয়ান কিঞ্চিত বাকা হেসে এগোলো ওর‌ দিকে। হাতের বাশিটা তুলে ধরে বললো,

-চলো মেমসাহেব? ট্রাফিক পুলিশকাকুর আজকে ছুটি পরে গেছে। তোমাকেই এখন তার দায়িত্ব নিতে হবে।

ইচ্ছে তীক্ষ্মচোখে তাকিয়ে রইলো সাফোয়ানের দিকে। তারপর তাকালো প্রাপ্তর দিকে। প্যান্টের দু পকেটে দুহাত গুজে তার শীতল চাওনি ওর দিকেই নিবদ্ধ। সাফোয়ান আবারো ইচ্ছেকে বাঁশিটা নেওয়ার‌ জন্য ইশারা করলো। ইচ্ছে ওটা নিয়ে তীব্র রাগে ছুড়ে মারলো নর্দমায়।‌ তারপর প্রাপ্তর দিকে এগোলো দুপা। চেচিয়ে বললো,

-রাস্তার মাঝে গুন্ডামি করতে,একটা মেয়েকে এভাবে হ্যারাস করতে লজ্জা করে না?

এতোক্ষন‌ও শান্ত থাকার তীব্র চেষ্টা করছিলো প্রাপ্ত। কিন্তু এবার ওর‌ ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেছে। জোরেজোরে শ্বাস ফেলছে রাগে। ওর ভাব বুঝেই সাফোয়ান,অরিত্রা সরে দাড়ালো বাকিদের সাথে। ইচ্ছেকে এবার প্রাপ্তই দেখে‌ নেবে। প্রাপ্ত কিছু না বলে,ইচ্ছেকে পাশ কাটিয়ে কিছুটা দুরে পার্ক করে রাখা ওর বাইকের দিকে চলে গেলো। তারপর ওটার উপরে থাকা ঝলমলে কালো গিটারটা হাতে‌ নিলো। এটুকোতে কিঞ্চিত কেপে উঠলো ইচ্ছে। ওর কিছু বুঝে ওঠার আগে পাশের দেওয়ালে গিটারটা দিয়ে সর্বশক্তিতে বারি লাগিয়ে দিলো প্রাপ্ত। এর বারিতেই চুর্নবিচুর্ন হয়ে গেলো ওটা। তারপরও রাগ মেটাতে আরো দুটো বারি দিতে ভুললো না ও। গিটারটা একেবারে নিঃশেষ করে দিয়ে স্বাভাবিকভাবে হেটে এসে সেই লোকটাকে দুটো ঘুষি ছুড়লো। ঘলঘল করে রক্ত বেরিয়ে আসলো সে লোকের নাকমুখ দিয়ে। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পরে গেছে মানুষটা। প্রাপ্ত সরে গেলো ওখান থেকে। বললো,

-এরা দুটো যদি দু‌মিনিটে এখান থেকে না সরে,আজ এই **বাজারে দুটো খুন বা তারচেয়েও জঘন্য কিছু হয়ে যাবে সাফোয়ান।

লোকটা তৎক্ষনাৎ‌ উঠে দৌড় লাগালো। কিন্তু ইচ্ছে ওভাবেই ঠায়। মাটিতে পরে থাকা গিটারটার দিকে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে আছে ও। অবাধ জল গরাচ্ছে ওর চোখ দিয়ে। ওর সঙ্গীতাঙ্গন ওর‌ আবেগ,ভালোবাসা সবকিছু। আর তাকে এতো বাজেভাবে অপমান করলো প্রাপ্ত! এরমাঝেই কেউ একজন কোমলস্বরে বললো,

-কেদো না। বাসায় ফিরে যাও।

….

-কি হলো? বাসায় ফিরে‌ যাও প্লিজ! কোনো অঘটন চাই না আমরা। প্লিজ!

ইচ্ছে তাকায়নি কোনোদিক। কথাটা বলে মিষ্টি প্রাপ্তর দিকে তাকালো। সে নির্বিঘ্নে বাইকে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। আর সাফোয়ানদের সাথে কথা বলছে। যেনো কিছু ঘটেই নি এখানে। বাকি ছেলেগুলোকে কিছু বলায়,ওরাও চলে গেলো। মিষ্টির মায়া হলো ইচ্ছের উপর। কিন্তু কিছু করারও নেই। একটা মেয়ে‌ কোত্থেকে ছুটতে ছুটতে এসে বললো,

-কিরে ইচ্ছে? কাদছিস কেনো? কি হয়েছে?

মিষ্টি লক্ষ্য করলো মেয়েটাকে। চেনাচেনা লাগলো মেয়েটাকে ওর। মাথার চুল ছেলেদের মতো ছোট করে কাটা। চোখে চিকন ফ্রেমের চারকোনা চশমা। হাতে মোবাইল,এয়ারফোন আর দুটো টিকিট। পুরোপুরি চিনে উঠতে পারলো না মিষ্টি। ইচ্ছে‌র কান্নাটা নেই। তবে বিমুর্তের মতো ও ভাঙা গিটারটা দেখে চলেছে। মিষ্টি ‌বললো,

-তোমার নাম কি? আর তুমি চেনো ওকে?

-হ্যাঁ মিষ্টি আপু। আমি রাকা,ব্লক টু তে থাকি। আর ও আমার কলেজফ্রেন্ড ইনায়াত নিক্কন। ডাকনাম ইচ্ছে। বিদেশ থেকে মিউজিক নিয়ে পড়া শেষ করে বিডিতে ফিরেছে কয়েকদিন হলো। আজকের ভার্সিটিতে যে কনসার্ট,ওখানে গাইবে বলে ওকে ডাকা হয়েছে।

মিষ্টি বুঝলো ও না চিনলেও মেয়েটা ওকে চেনে। স্থানীয় হলে চেনাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ওদের কয়েকজনকে চেনে না,এমন মানুষ কমই আছে এ এলাকায়। বললো,

-ও আচ্ছা। এখন তুমি ওকে নিয়ে যাও এখান থেকে রাকা। প্লিজ!

-কিন্তু হয়েছে টা কি আপু বলুনতো? আপনি…

-হয়নি।‌ হবে।

প্রাপ্তর গলা শুনে‌ ওর দিকে তাকালো রাকা। প্রাপ্তর ব্যস্ততা চায়ের কাপে। কিন্তু ওকে চিনতেই শ্বাস আটকানোর মতো অবস্থা রাকার। ওর বোঝা উচিত ছিলো,মিষ্টি এখানে,মানে প্রাপ্তও এখানে কোথাও থাকতে পারে। রোবটের মতো ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে মনেমনে বুঝেই নিলো কিছু একটা ঘটিয়েছে ইচ্ছে। আর এজন্যই মিষ্টি মেয়েটা ওকে নিয়ে চলে যেতে বলছে। রাকা তড়িঘড়ি করে বললো,

-আ্ আসলে প্রাপ্ত ভাইয়া,ও্ ও এখানে ন্ নতুন। ক্ কিছুই‌ জানেনা আপনার বিষয়ে। আর…এইই ইচ্ছে? ক্ কি করেছিস তুই? সরি বল প্রাপ্ত ভাইয়াকে? বল?

-কিরে? সরি বল? বললল!

রাকা ধাক্কাতে শুরু করেছে ইচ্ছেকে। ইচ্ছে এখনো একধ্যানে কিছুটা দুরে পরে থাকা ওর ভাঙা গিটারটার দিকে তাকিয়ে। প্রাপ্ত চোয়াল শক্ত করে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে রইলো। মিষ্টি একটা ছোট শ্বাস ফেললো। রাকা যদি জানতো এখানে প্রাপ্তর কলার ধরা আর ওকে চড় দেওয়ার মতো কান্ড ঘটেছে,নির্ঘাত সব ছেড়েছুড়ে ছুটে পালাতো। এগিয়ে‌ বললো,

-তোমরা এসো রাকা। পরে‌ কথা হবে।

-কিন্তু আপু…

-আমি বলছি তো! এসো!

কাচুমাচু হয়ে মাথা নাড়লো রাকা। তারপর হাত টানতে টানতে নিয়ে গেলো ইচ্ছেকে ওখান থেকে। যতক্ষন দেখা যায়,ওই‌ভাঙা গিটারের‌ দিকেই তাকিয়ে থেকে টলতে টলতে চলে গেলো ইচ্ছে। ওরা চোখের আড়াল হতেই মিষ্টি প্রাপ্তর দিকে তাকালো। নিজের মতো করে ফোন স্ক্রল করছে প্রাপ্ত। অবাক না হয়ে পারলো না মিষ্টি। তুলনামুলক কমই ঘটেছে ইচ্ছের সাথে। তবুও যা ঘটেছে,একদমই ভালো ঘটেনি। বললো,

-বেশি রিয়্যাক্ট করে ফেললি না?

-প্রশ্নটা উল্টো হওয়া উচিত ছিলোনা?

দৃষ্টি ফোনে রেখেই বললো প্রাপ্ত। ঠিক,ঠিক! বলে বাকিসব সায় দিলেও মিষ্টি অবুঝের মতো করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। পারিপার্শিকের কাছে ঠান্ডা স্বভাবের বিচক্ষন মেয়ে হয়ে স্বীকৃতি পেলেও,এই একটা মানুষের কাছেই অবুঝ সাজতে চেয়েছে ও। সবসময়। প্রচন্ড নির্বোধ হতে চেয়েছে ও প্রাপ্তর কাছে। আর তা বুঝে বলেই আরো বেশি নির্বোধ হয়ে থাকে প্রাপ্ত। বন্ধুদের একজন মাহীন বললো,

-বুঝলাম না! আজকে কি হলো প্রাপ্ত তোর? ব্যাটাকে দুটো ঘুষিতেই ছেড়ে দিলি কেনো?

সাফোয়ান বললো,

-ঠিক বলেছিস মাহীন! তোর উল্টোপ্রশ্নের উত্তর তো আমরা সবাই জানি। আরো বেশি রিয়্যাক্ট করার কথা ছিলো তোর প্রাপ্ত! কিন্তু তোর বিহেভ দেখে প্রশ্নটা কয়েকডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে গেছে রে! নাও দ্যা কোশ্শেন ইজ,প্রাপ্ত কেনো কম রিয়্যাক্ট করলো?

অরিত্রা স্বতন্ত্রকন্ঠে বললো,

-আমার তো ভয় হচ্ছে ভাই! প্রাপ্ত ওর সেই অদৃশ্য অনুভবে থাকা গ্রামীন শ্যামাকন্যাকে এই ভীনদেশী শ্বেতাঙ্গী রকস্টারের মাঝে গুলিয়ে ফেললো কিনা কে জানে!

শব্দ করে হেসে দিলো তিনজনই। শুধু মিষ্টি আর প্রাপ্ত বাদে। মিষ্টি তাকিয়ে রইলো প্রাপ্তর দিকে। এই না দেখা মেয়েটার জন্য কতো ভালোবাসা গচ্ছিত করে রেখেছে প্রাপ্ত,দেখলে,শুনলে হিংসে হয় ওর। প্রাপ্ত মোবাইল পকেটে পুরলো। রাস্তার সামনের শিমুলগাছটায় অনেক ফুল ফুটেছে। সেদিক তাকিয়ে মৃদ্যু হেসে‌ বললো,

-সে গুলিয়ে ফেলার কেউ না অরি। সে তো অনুভবের কেউ! আর যেদিন তাকে অনুভব করবো,মনপ্রান উজার করে অনুভব করবো। আমার হৃদয় কেনো,চারপাশেও সেদিন একবিন্দু নিকষতা থাকবে না! ওই শিমুলের মতো রাঙা হবে সবটা। ট্রাস্ট মি! আপাতত চল এই রকস্টারের হিসাব মিটিয়ে আসি!

শেষ লাইনে পুরো স্বরই পাল্টে গেছে প্রাপ্তর। সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে পকেটে দুহাত গুজে পা বাড়ালো কনসার্টের দিকে। প্রাপ্তর ঠোটের অদ্ভুত হাসিটা দেখে মিষ্টি মাথা নামিয়ে নিলো। হতাশার শ্বাস বেরোলো ওর‌ ইচ্ছের কথা ভেবে।‌ আর কি কি অপমান অপেক্ষা করছে মেয়েটার জন্য,কে জানে?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here