#প্রেমনোঙর_ফেলে,৩২,৩৩
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা
৩২.
হাতে দুটো ফাইল হাতে বিস্ময়ে থেমে আছে খই। খানিকটা সময় পর ওর আর প্রাপ্তর আংটিবদল। শাড়ি পরে মেঝেতে হাটু জরিয়ে বসে একধ্যানে বাইরে তাকিয়ে ছিলো ও। হুট করে মিষ্টিঘরের কেয়ারটেকারকে সাদিক সাহেবের বাসার দিকে ছুটতে দেখে সন্দেহ হলো খইয়ের। জিজ্ঞাসা করতেই সে ফাইলদুটো দেখালো ওকে। স্কুলের পুনর্নিমান কাজে দ্বিগুন টাকা চেয়ে মিষ্টিঘরে নোটিশ পাঠিয়েছে ইনিশা। সেটাও আজকের মধ্যেই। নইলে স্কুলটাকে ইনিশা নিজেদের করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে তার সবরকমের আইনি কাগজপত্রের প্রমানও পাঠিয়েছে নোটিশের সাথে। খইয়ের বিস্ময় কাটছেই না। যেখানে রাকীন নিজে এই কাজের দায়িত্ব ছিলো, সেখানেও এমন ছলচাতুরি সম্ভব বলে ধারনাতেও ছিলো না ওর। খই কেয়ারটেকারকে বললো,
-এসব কি মামা? এই নোটিশ?
-হ্যাঁ মা। আমিও তাই ভাবছি। এমন কোনো নোটিশ তো আসার কথা না। তাদের টাকা দেওয়ার তারিখও এতো দ্রুত শেষ হবার কথা না। আর টাকার এমাউন্টই বা এতো কেনো? নোটিশ পাঠানোর তারিখ যা দেওয়া আছে, সে তারিখে নোটিশ না পাঠিয়ে আজ লাস্ট ডেট দেখে নোটিশ পাঠানোর কি মানে? সবদিক দিয়ে মিষ্টিঘরকে হয়রানীর চেষ্টা। এসব কেনো করছে ইনিশা? শুধুমাত্র বেশি টাকা আদায়ের জন্য?
জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে নিলো খই। আপাতত কিছুই মাথায় ঢুকছে না ওর। কেয়ারটেকার বললো,
-ফাইলটা দাও খই। সাদিক সাহেব বা প্রাপ্তকে জানাতে হবে বিষয়টা। আজ রাত বারোটার মধ্যে এর একটা বিহিত না করলে কাল সকালে ইনিশা লোক পাঠাবে বলেছে।
উনি হাত বাড়িয়ে নিতে যাচ্ছিলেন ফাইলটা। খই হাত সরিয়ে নিয়ে শান্তভাবে বললো,
-কাউকে জানাতে হবে না মামা।
-জানাতে হবে না মানে? না জানালে এসব মিটবে কিভাবে?
-ইনিশার আর্কিটেক্ট জানে এসব?
-জানিনা। তবে ওনাকে দেখে যথেষ্ট ভালো মনে হয়েছিলো আমার। উনি জানলে এমনটা ঘটতে দিতেন বলে আমার মনে হয় না।
খই বুকে আঁকড়ে ধরলো ফাইলটা। আর কয়েকমুহুর্তে ওর জীবন অন্যকারো নামে হয়ে যাবে। শেষবারের মতো রাকীনকে দেখার লোভ কি করে সামলাবে ও? নিজেকে অন্যকারো নামে করে দিয়ে আর নকশাদারকে নিজের বলতে পারবে না যে। খই ধরা গলায় বলে উঠলো,
-আমি ইনিশায় যাবো মামা।
বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন ভদ্রলোক। মিষ্টিঘরে আসার পর থেকে খই মিষ্টিঘর আর সাদিক সাহেবের বাসা ছাড়া অন্য কোথাও পা রাখেনি। পড়াশোনা নিয়েই থেকেছে সবসময়। হুট করে এভাবে বেরোতে চাওয়া, তাও আবার আজকে এ সময়ে, ওর কথা শুনে ভদ্রলোক কড়া গলায় বললেন,
-কি বলছো কি তুমি? ইনিশায় যাবে মানে? আজ তোমার আর প্রাপ্ত বাবার এনগেইজমেন্ট!
-আজই নোটিশের লাস্ট ডেইট।
-তাই বলে তুমি এখন ইনিশায় যাবে? কোনো প্রয়োজন নেই তোমার যাওয়ার। ফাইলটা আমাকে দাও। আমি সাদিক সাহেবকে বলে সাফোয়ান বাবাকেদিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলবো। আর তুমি…
ধপ করে ভদ্রলোকের পায়ের কাছে বসে পরলো খই। আঁতকে উঠলেন ভদ্রলোক। খইয়ের চোখের জল পায়ের পাতার উপর পরেছে তার। খই মাথা নিচু রেখে মাটিতে দৃষ্টিস্থির রেখে বললো,
-আমার এই একমাত্র চাওয়াকে ফিরিয়ে দেবেন না প্লিজ মামা! আর কোনোদিনও কিছু চাইবো না আপনার কাছে। কোনোদিনও না! আমাকে মিষ্টিঘরের জন্য এটুকো করার সুযোগ দিন প্লিজ! ভরসা রাখুন আমার উপর। কাজ শেষেই ফিরে আসবো আমি। প্লিজ মামা! প্লিজ!
ভদ্রলোক নির্বাক। এভাবেও কেউ আকুতি করতে পারে, জানা ছিলো না তার। তবুও অনেকবার অনেকভাবে মানা করেছে সে খইকে। তাতে খইয়ের কান্না বেড়েছে শুধু। উপায় না দেখে উনি রাজি হলেন খইয়ের কথায়। উঠে দাড়িয়ে হাতের পিঠে চোখমুখ মুছলো খই। ঠোটে হাসি ফুটিয়ে, আসছি বলে, লোকচক্ষু এড়িয়ে বেরিয়ে আসলো মিষ্টিঘর থেকে। ওর যাওয়ার দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন কেয়ারটেকার। খইয়ের আকুতি কি শুধুই মিষ্টিঘরের জন্য ছিলো? নাকি বড়সর কোনো ভুল করে বসলেন তিনি?
•
ইনিশা’য় কেবিনে বসে নিজের ইচ্ছেমতো এই প্রথমবার ম’দ খেয়ে শান্তি পাচ্ছিলো নিজাম। রাকীন, রাজীব মাহমুদ দুজনেই আজকে বিয়েতে ব্যস্ত। ওকে আটকানোর কেউই নেই আজ। এই এতোবড় বিল্ডার্স কোম্পানির এতো ভালো পজিশনে থেকেও মনে শান্তি নেই ওর। নেশা করতে অভ্যস্ত বলে রাজীব মাহমুদ সবসময়ই কাজের চাপে রাখেন ওকে। আর এটাই ওর পছন্দ না। টাকা পয়সা দিয়ে যদি জীবনে শখ আহ্লাদই পুরন না করতে পারে, কি হবে সে টাকা দিয়ে? অনাথ হওয়ার পর থেকেই কাকার শাষনে বড় হতে হয়েছে ওকে। অন্যায়ের জন্য রাকীনের মারও কম খায়নি। এরা দুই বাবা ছেলে মিলে একদম অসহনীয় করে তুলেছে ওর জীবনটা। এসব ভেবেভেবে গ্লাসের পর গ্লাস ম’দ শেষ করে দিচ্ছিলো নিজাম। পরপর দুবার টেবিলে থাকা টেলিফোনটা বেজে উঠলো। বিরক্তি নিয়ে সেদিকে তাকালো ও। ওরই অধস্তন এক কর্মচারী। পরেরবার বাজতেই সে বিরক্তি রাগে পরিনত হলো নিজামের। রাগে ওটা রিসিভ করে বি’শ্রি এক গা’লি দিয়ে বলে উঠলি,
-শা’লা ***! তোদের জন্য শান্তিতে বসতে পারবো না কোথাও? চাকরিটা খোয়ানোর মন চেয়েছে?
ওপাশ থেকে ভরকে যাওয়া এক কন্ঠে আওয়াজ এলো,
-স্ সরি স্যার। আসলে একটা জরুরি বিষয়েই আপনাকে কল করা। রাকীন স্যারের…
অকথ্য এক গালিতে কল কাটলো নিজাম। লোকটা রাকীনের নাম নিয়েই রাগের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে যেনো। একশ্বাসে সামনে রাখা পুরো গ্লাস শেষ করলো ও। পরপর তিনবার খাওয়ার পর কপাল ঠেকালো সামনের টেবিলে। আজকে শান্তি লাগছে ওর প্রচন্ড। রাকীনের দায়িত্বে ছিলো বলে, মিষ্টিঘরের স্কুলটার কাগজপত্র উনিশবিশ করে দিয়েছে ও। কাজ শেষ হবার পর ইনিশা যতো টাকা পেতো, তার দ্বিগুন বাড়িয়ে লিখে আজকের লাস্ট ডেট বসিয়ে নোটিশ পাঠিয়েছে। যার ফলে টাকা আসবে বেশি, আত্মসাৎ করবে ও, আর দায় পুরোটা পরবে রাকীনের নামে। এমনিতেও খেয়া হাউজিং আর বিয়েটা নিয়ে বাবা ছেলের মাঝে যা চলছে, তাতে এ ঘটনার পর রাজীব মাহমুদ রাকীনকে ক্ষমা করবেন বলে মনে হয় না। মনেমনে খুশি হওয়ার আগে, নিজামের হঠাৎই হুশ আসলো, কর্মদিবস শেষ। এখন অকারনে নিশ্চয়ই কেউ খুজতে আসবে না রাকীনকে। আর তার উপর সে জানে না আজ রাকীনের বিয়ে। বাকা হাসলো নিজাম। নে’শায় বুদ হলেও উদ্দেশ্যহীন হলো না ও। ফোনটা নিয়ে পুনরায় কল করলো ও জামীলকে। বললো,
-কি বলতে চাইছিলি?
-একজন মেয়ে কল করেছিলো। বারবার রাকীন স্যারের সাথে কথা বলতে চাইছিলো।
-মেয়ে? কোন মেয়ে? আর ওয়ার্কিং আওয়ার শেষে, এখন রাকীনের সাথে কি বিষয়ে কথা বলতে চায়?
-মেয়েটা মনে হয় ওই অনাথ আশ্রমের। কি বলবে তা তো জানি না। তবে বারবার করে বলছে খুব জরুরি কথা আছে নাকি।
-ওকে আমার কেবিনে পাঠা। বাকিটা দেখছি আমি।
অনুমতি পেয়ে কেবিনে ঢুকলো খই। দেশের সবচেয়ে নামকরা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি, ইনিশা বিল্ডার্সের অফিস খুজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি ওকে। ট্যাক্সি করে চলে এসেছে সোজা। ততোক্ষনে ইনিশার কর্মদিবস শেষ। হাতেগোনা কিছু স্টাফ রয়ে গেছে শুধু। কেবিনে ঢুকে রাকীনকে আশা করলেও ড্রিংক বানাতে ব্যস্ত নিজামের দেখা মিললো। খই ফাইলটা বুকে আকড়ে রেখে বললো,
-রাকীন শাফায়াত কোথায়?
টলোমলো চোখ তুলে তাকালো নিজাম। শাড়ি পরিহিত মেয়েটার গায়ের রঙটা বেশ চাপা। বিনুনি করা চুল কোমড়ের নিচ অবদি এসেছে একদম। উঠে দাড়িয়ে টলতে টলতে এগোলো নিজাম। রাকীনের নামে এই প্রথমবার কোনো মেয়ে এসেছে ইনিশায়। আর যা রাকীনের নামে হয়, বরাবরই তার প্রতি কেনো যেনো লোভ কাজ করে ওর। নেশালো চাওনিতে আপাদমস্তক দেখে নিলো ও খইকে। খই লক্ষ্য করলো, ঠিকমতো দাড়াতেও পারছে না মানুষটা। এর কাছে স্কুল কেনো, রাকীনকে নিয়ে কথা বলেও লাভ নেই। নিজাম এগিয়ে এসে বিশ্রি একটা হাসি দিয়ে বললো,
-রাকীনকে কি দরকার তোমার?
-দরকারটা না হয় তাকেই বলবো? কোথায় সে?
-ওর তো আজ বিয়ে। ও নিজের দরকারে অন্য কাউকে খুজে নিয়েছে। আসো তোমার দরকারটা আজ আমিই পুষিয়ে দেই না হয়?
পুরোটার বদলে শুধু রাকীনের বিয়ে কথাটা কয়েকবার কানে বাজলো খইয়ের। স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো ও। আজ ও অন্যকারো হতে চলেছে। আর আজকেই রাকীন অন্যকাউকে জীবনসঙ্গীনি করতে চলেছে। এর চেয়ে বড় ঘটনাক্রম আর কি হতে পারে? তাচ্ছিল্যের এক হাসি ফুটলো ওর ঠোটের কোনে। নিজাম এবার আরেকপা এগিয়ে বললো,
-কি বলো? আমি পুষিয়ে দেই তোমার দরকার?
খই নিজেকে সামলালো। এখানে থাকার আর কোনো মানে হয়না ওর। যতো দ্রুত সম্ভব মিষ্টিঘর ফিরতে হবে ওকে। আংটিবদলের সময় হওয়ার আগেই। তাছাড়া এখানে রাকীনকে পাওয়ার কোনো উপায়ও নেই। তাই নোটিশটা সাফোয়ানকে দিয়ে দেওয়াই উচিত হবে। খই নিজামকে শান্তভাবে বললো,
-আপনি যে কোনোকিছু বোঝার অবস্থাতে নেই, তা বেশ বুঝতে পারছি। আর আপনাকে বোঝানোর অনুকুল অবস্থাও আমার না। সরি ফর ইনট্রাপশন। আসছি।
খই পা বাড়াচ্ছিলো চলে আসবে বলে। হুট করেই বলে ওর হাত ধরে পেছন থেকে টান লাগালো নিজাম। খই এমন পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। টান অনুভব করেই হাতের কাছে থাকা বড় ফুলের টবটা একহাতে তুলে ঘুরে উঠে বারি লাগিয়ে দিয়েছে ও। কাধে লেগেছে নিজামের। কাধ চেপে ধরে ওর দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো নিজাম। খই টেবিল থেকে পানির গ্লাসের পুরোটা নিজামের মুখে ছুড়ে মেরে বললো,
-নেশা কেটেছে?
মুহুর্তেই রাকীনের কথা মনে পরে গেলো নিজামের। যতোবার রাকীন ওকে নেশা করতে দেখেছে, ততোবার এভাবেই পানি ছুড়েছে ওর মুখে। খইও এটাই করলো। রাগ সর্বোচ্চসীমায় এবার নাজিমের। তেড়ে এগোলো ও খইয়ের দিকে। ওর ঘাড়ের চুল সর্বশক্তিতে মুঠো করে নিলো। খই ব্যথায় কুকড়ে উঠে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো ওর হাত। নিজাম একটা পৈশাচিক হাসি দিয়ে বললো,
-না কাটেনি নেশা। রাকীনকে খুজতে ইনিশা্ এসেছিলে না? রাকীনের স্টাইলে কাটাতে চাইছিলে আমার নেশা? তবে আজ তোমাকে দিয়েই নেশা কাটাবো যাও! গেট রেডি।
ওর বিদঘুটে হাসিটা দেখে ঘৃনায় বিষিয়ে উঠলো খই। একহাতে থাকা ফাইলদুটো ছেড়ে দিলো এবার। কোনোমতে হাতড়ে টেবিল থেকে পেপারওয়েট নিয়ে একদম কপাল বরাবর বারি লাগিয়ে দিলো নিজামের। আর্তনাত করে খইয়ের চুল ছেড়ে নিজের কপাল চেপে ধরলো নিজাম। কপাল কেটে রক্ত ঝরছে ওর। খই আর একমুহুর্তও দাড়ায়নি। ফাইলদুটো তুলে ছুটে বেরিয়ে আসলো কেবিন থেকে। কোনোদিক না তাকিয়ে, সিড়ি দিয়ে নেমে ইনিশা থেকে মুল সড়কে এসে দাড়ালো ও। নিজামও ছুটেছে ওর পেছনপেছন। ও ভালোমতোই জানে, এই মেয়েকে এভাবে ছাড়লে রাকীন ওকে স্বাভাবিকভাবে ছাড়বে না। আগেরবার লিখনের সাথে যা ঘটেছিলো, তারপর রাকীনের দেওয়া ধমকিগুলো এখনো ভোলেনি ও। নিচে নেমে নিজাম খইকে দেখলো সিএনজিতে চরে বসতে। টবের বারিতে বেকে যাওয়া কাধ আর ফাটা কপাল, দুটো নিয়ে ওউ গাড়ি নিয়ে বেরোলো খইয়ের পেছনপেছন।
#চলবে…
#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা
৩৩.
ড্রাইভিংয়ের পুরোটা সময় টমিকে লক্ষ্য করেছিলো ইচ্ছে। প্রাপ্তকে নিয়ে একাএকা অনেককিছুই বলে চলেছে ও এতোটা সময়। যেই টমি প্রাপ্তর নাম শোনা তো দুরে থাক, ওর ঘ্রান শুকলেই ক্ষেপে যেতো, সেই টমিই পুরোটা সময় ওর নামে বলা হাজারটা স্বীকারোক্তি বসে শুনে চলেছে। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ব্যাপারটা যেনো পছন্দ হলো না ইচ্ছের। টমিকে ক্ষে’পাবে বলে খানিকটা ঝুকে ওর কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
-তোকে কি বললাম এতোক্ষন? গ্যাংস্টারকে ভালোবাসি। মানতে পারবি তুই এটা?
টমির নিরবতা বলে দিলো, তুমি পারলে আমিও পারবো। এভাবেও যে প্রাপ্তকে টিজ করে জবাব দিচ্ছে টমি, সেটা বুঝতে ভুল হলো না ইচ্ছের। ও হেসে দিয়ে আবারো সিরিয়াস ভঙিমায় বললো,
-এভাবে চুপচাপ যদি প্রাপ্তকে মেনে নিস, ব্যাপারটা কি ভালো হবে টমি?
…
-তোর কিন্তু সত্যিই আদর কমে যাবে!
এবারে শব্দ করতে করতে উত্তেজিত হয়ে পরলো টমি। ঠোট টিপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করেও হাসি থামাতে পারলো না ইচ্ছে। শব্দ করে হেসে দিলো। টমি লাফিয়ে ওর কোলে উঠে সামনের দুপায়ে স্টেয়ারিংয়ে খামচি লাগালো। চোখ তুলে সামনে তাকালো ইচ্ছে। আচমকাই ওর গাড়ির সামনে চলে এসেছে কেউ। এজন্যই টমি ওমন করছিলো। সামনে কে সেটা লক্ষ্য করার সময় না নিয়ে স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে নিলো ইচ্ছে। কাজে দেয়নি তা। মানুষটাকে একপ্রকারে ধাক্কা লাগিয়ে গাড়িটা রাস্তার কিনারার দিকে ঘুরে গেছে। ইচ্ছে সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো ব্রেক করার। কিন্তু গাড়ি গিয়ে একটা গাছের সাথে বারি খেয়ে তবেই থামলো। গাড়ির সামনের কাচ ভেঙে একাকার।
গাড়ির হর্ন নিরবিচ্ছিন্নভাবে বেজে চলেছে। বেশ অনেকটা সময় পর স্টেয়ারিং থেকে আস্তেধীরে মাথা তুললো ইচ্ছে। জ্ঞান হারায়নি ও। তবে কপাল কেটে গেছে। পুরোটা বুঝে উঠতে কয়েকদন্ড পার করে দিলো ইচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম করছে ওর। কোলের উপর থেকে টমি সরে গিয়ে সামনের দিকটা থেকে ঢেকে দিয়েছে ওকে। ভাঙা কাচ ওর গায়ে লাগার উপায় রাখেনি টমি। ইচ্ছে তাড়াতাড়ি সিটবেল্ট খুলে নামালো টমিকে। সারা গা পরখ করে দেখে নিলো কোথাও ওর লেগেছে কিনা। দুটো জায়গায় কাচ ফুটেছে টমির। ইচ্ছে টমিকে ধরে কান্নাপ্রায় গলায় বললো,
-আ্ আ’ম সরি ডুড। আ’ম সরি!
টমি লেজ নাড়ালো। হুহু করে কেদে দিলো ইচ্ছে। কাপাকাপা হাত এগুলো টমির গা থেকে কাচ সরাবে বলে। পারলো না। টমি নিজে থেকেই গা ঝাড়া মারলো নিজের। ইচ্ছের গায়ে গা ঘেষে বুঝালো, ও ঠিক আছে। ইচ্ছে কাদতে কাদতে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো ওকে। বললো,
-ইউ ওকে? হুম?
টমি শব্দ করে ইচ্ছের কপালের দিকে মুখ উচিয়ে ধরলো। হাত তুলে স্পর্শ করে বুঝলো, অনেকটাই কেটে রক্ত ঝরছে কপাল থেকে। একটা ক্ষুদে শ্বাস ফেলে ড্রয়ার থেকে সেলোটেপ বের করতে যাচ্ছিলো ও। হঠাৎই মনে পরলো, গাড়িটা কাউকে ধাক্কা লাগিয়েছিলো। তৎক্ষনাৎ হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো ইচ্ছে। গাড়ির আশেপাশে খুজতে লাগলো তাকে। ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় লক্ষ্য করলো, কিছুটা দুরেই কেউ একজন রাস্তায় পরে আছে। ইচ্ছে লেহেঙ্গা উচিয়ে দৌড়ালো। টমিও নেমেছে গাড়ি থেকে। মানুষটার নিকটতর হতেই ইচ্ছে টের পেলো, ওটা কোনো মেয়ে। এগিয়ে গিয়ে রাস্তায়ই বসে পরলো ও। উপুর হয়ে পরে থাকা শাড়ি পরিহিত মেয়েটাকে কোলে সোজা করতেই দিশেহারা হয়ে গেলো ইচ্ছে।
শ্যামবর্নের মেয়েটার পরনে থাকা খয়েরী পাড়, সাদা শাড়ি র’ক্তে ছেয়ে গেছে একদম। অনেক বাজেভাবে মাথা ফে’টে গেছে। হাতেপায়ে স্ক্র্যা’চ। ইচ্ছে কি করবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। তাড়াহুড়োয় মোবাইলও আনেনি। পুরো জায়গাটা জনমানবশুন্য। সাহায্যের জন্য কারো কাছে যাবে, মেয়েটাকে একা ছাড়ার সাহসও হয়ে উঠলো না ওর। আবারো গাড়ির কাছে এসে গাড়ি স্টার্ট নেয় কিনা, সেটা চেইক করলো ইচ্ছে। গাড়ি তখনো চলার মতো ছিলো। থ্যাংক গড বলে একহাতে নিজের কপাল চেপে ধরে আরেকহাতে স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়ি নিয়ে মেয়েটার কাছে আসলো আবারো। কোনোমতে গাড়িতে মেয়েটাকে তুলে সোজা হসপিটালে চলে আসলো। নামার সময় টমিকে গাড়িতেই আটকে দিয়েছে ইচ্ছে। হসপিটালে যারা ছিলো, মোটামুটি সবাই চেনে ইচ্ছেকে। ইচ্ছে বলে দিয়েছে মেয়েটার সবরকমের চিকিৎসা করতে। বাকিসব ও দেখে নেবে। ওর কথামতোই হচ্ছিলো সবটা। মেয়েটার তখনো জ্ঞান ফেরেনি। অবস্থা গুরুতর দেখে মেয়েটাকে সরাসরি ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। কিন্তু মেয়েটা সেই যে হসপিটালে আসার পর থেকে ইচ্ছের হাত ধরেছে, আর ছাড়ছেই না। ইচ্ছে চেষ্টা করেছে নিজের হাত ছাড়ানোর। পারেনি। ওকে দেখে এক নার্স বলে উঠলেন,
-ম্যাম ইউ আর অলসো ব্লিডিং! আপনারও এইড প্রয়োজন!
জোরপুর্বক মেয়েটার হাত থেকে ইচ্ছের হাত ছাড়িয়ে দিলো নার্সটা। এতোক্ষন অজ্ঞান থাকলেও এবার দুটো ঢেকুর তুললো মেয়েটা। র’ক্তবমির সাথে অস্ফুটস্বরে উচ্চারন করলো,
-ই্ ইচ্ছে…
অবাকচোখে তাকালো ইচ্ছে। মেয়েটা ওর নাম কেনো নিলো? নাকি ওই ভুল শুনলো? নার্স ওকে এনে কেবিনে বসিয়ে দিলো। তারপর কপালে ঠিকঠাকমতো পরিষ্কার করে, ঔষুধ লাগিয়ে দিলো। কেবিনে স্থির থাকতে পারলো না ও। সারা শরীরে অস্বস্তি, অস্থিরতা। বিয়ের সাজ, মেয়েটার চিন্তা, প্রাপ্তর কাছে যাওয়ার ভাবনা। সবটা ভুলে করিডরে আসলো ইচ্ছে। আগে এই মেয়ের সুস্থ্যতার কোনো খবর পাক, তারপরই প্রাপ্তর কাছে যাবে ও। এরমধ্যে তিনজন পুলিশি পোষাক পরা লোক আসলো ওখানে। এগিয়ে এসে ইচ্ছেকে বললো,
-আপনার গাড়িতে এক্সিডেন্ট হয়েছে ম্যাডাম?
ইচ্ছে বুঝলো এক্সিডেন্ট কেইস বলে পুলিশ এসেছে ওকে ক্রসকোশ্শেন করতে। ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিয়ে নিচু গলায় বললো,
নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ ” নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ” এবং ফলো করে সাথেই থাকুন।
-জ্বী।
-কোথায়? কিভাবে?
ঘটনাক্রম বলে দিলো ইচ্ছে। পুলিশ মনোযোগ সহকারে সবটা শুনলো। ইচ্ছের বলা শেষে ওটি থেকে বেরিয়ে আসলো ডক্টর। আগ্রহ নিয়ে তাকালো ইচ্ছে। পুলিশ এগিয়ে গিয়ে বললো,
-পেশেন্ট কেমন আছে ডক্টর?
-অনেকটা ব্লাডলস হয়েছে। ব্লাড দিতে হবে এই মুহুর্তে! নইলে মেয়েটাকে বাচানো অসম্ভব।
বাচানো অসম্ভব শুনে একপা পিছিয়ে দেয়ালে লেপ্টে গেলো ইচ্ছে। মাকে হারানোর পর থেকে মৃত্যুতে বরাবর ভয় ওর। কেউ মারা গেলে, সে তো আর ফেরে না। কিন্তু এই পৃথিবীতে তার ভালোবাসার মানুষগুলো কতো যন্ত্রনা নিয়ে বেচে থাকে, সে ধারনা আছে ওর। ইন্সপেক্টর বললো,
-তো ব্লাড দিচ্ছেন না কেনো আপনারা?
-একচুয়ালী ইন্সপেক্টর, মেয়েটার ব্লাডগ্রুপ ও নেগেটিভ। আর আমাদের ব্লাডব্যাংকে এই ব্লাডগ্রুপের ব্লাড নেই বর্তমানে। আমরা…
-আমার ব্লাডগ্রুপ ও নেগেটিভ। আমি দেবো ব্লাড ওকে!
জোর গলায় বললো ইচ্ছে। উপস্থিত সবাই বিস্ময়ে তাকালো ইচ্ছের দিকে। ডক্টর বললেন,
-বাট ইনায়াত ম্যাম, আপনি…
-দেয়ার ইজ নো স্কোপ ফর ইউর বাট ডক্টর! আপনি আপনার কাজ করুন! মেয়েটাকে বাচান! যতো ব্লাড প্রয়োজন, আমি দেবো। আপনি ব্যবস্থা করুন!
ডক্টর পুলিশের দিকে তাকালেন একপলক। মাথা নেড়ে পুলিশ সম্মতি বোঝালে ইচ্ছেকে নিয়ে চলে গেলেন সে। সবরকম টেস্ট করিয়ে, দু ব্যাগ রক্ত দিলো ইচ্ছে। ডক্টর ব্লাড নিয়ে গেছে। এরমধ্যে একজন পুলিশ এসে পাশে বসেলো ইচ্ছের। বললেন,
-বাসায় জানিয়েছেন? প্রেসমিডিয়া?
-না। এক্সিডেন্ট নিয়ে এখনো কেউ কিছু জানে না। বিয়ের আসর ছেড়েছি, এটা নিয়েই ব্যস্ত আছে হয়তো। হসপিটালেও স্পেশাল রিকুয়েস্ট করেছি বিষয়টাকে এখনই পাব্লিক না করার জন্য।
মুচকি হেসে ইচ্ছে উঠে বসলো। নার্স এসে খানিকটা সেবাযত্ন করে গেলো ওর। পুলিশ আর কিছু বলেনি ওকে। বেশ খানিকটা সময় পর ডক্টর এসে হাসিমুখে বললেন,
-শি ইজ আউট অফ ডেন্জার। আধঘন্টার মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে বলে আশা করা যায়। তবে আরেকটু দেরি হলে বোধ হয় আরো খারাপ কিছু হয়ে যেতো। থ্যাংকস্ টু ইউ মিস ইনায়াত। আজকে আপনি যদি ব্লাড না দিতেন তবে হয়তো মেয়েটাকে বাচানো যেতো না।
স্বস্তির শ্বাস ফেললো ইচ্ছে। হুট করেই কানের ভেতর সুরসুর করতে লাগলো ওর। পাশের টেবিল থেকে টিস্যু নিয়ে কানের দিকটায় ডলা মেরে বললো,
-দেখা করা যাবে ওর সাথে?
-যেহেতু পেশেন্ট সেন্সলেস, দেখা করেও লাভ নেই কোনো। ভেতরে একজন যেতে পারবেন।
ইচ্ছে কিছু বলার আগেই পুলিশ বলে উঠলো,
-আগে আমি দেখা করতে চাই ডক্টর!
বাধা দিলো না ইচ্ছে। ও চেয়েছিলো মেয়েটার সাথে দেখা করে প্রাপ্তর ওখানে চলে যাবে। কিন্তু পুলিশ তো তার ডিউটি করবেই। ইচ্ছের সম্মতি বুঝে একটা ক্ষুদে শ্বাস ফেলে উঠে দাড়ালো সাফোয়ান। ইচ্ছের হাতে হওয়া এক্সিডেন্ট কেস বলে কেউই আসতে চাইছিলো না। বাধ্য হয়ে ওকেই আসতে হলো হসপিটাল। কিন্তু এখানে রকস্টার ইচ্ছের তো আলাদাই এক রুপ। আস্তেধীরে ওটিতে গিয়ে পেশেন্টকে দেখে আরেকদফায় আতকে উঠলো সাফোয়ান। মেয়েটা আর কেউ না, খই! এনগেইজমেন্টের সাজের বদলে আজ ওর মাথাভর্তি ব্যান্ডেজ, হসপিটালের পোশাক পরনে, মুখে অক্সিজেন মাস্ক! মিষ্টিঘর বা প্রাপ্তদের বাসার পরিবর্তে ও ইচ্ছের গাড়ির সামনে, আর তারপর এই ওটিতে! কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না সাফোয়ান। তৎক্ষনাৎ কল লাগালো প্রাপ্তকে। সাফোয়ান বেরোতে সময় নিচ্ছিলো বলে চুপচাপ উঠে এলো ইচ্ছে। আগে গাড়িতে থাকা টমিকে আদর করে দিলো। তারপর রিসেপশনে গিয়ে জোরপুর্বক গায়ের কিছু গয়না খুলে দিয়ে দিলো। যদিও নিতে চায়নি কেউই। ইচ্ছেই বারন শোনেনি। রিসেপশনে দাড়িয়ে ক্লান্তস্বরে বললো,
-আমার একটা কল করা প্রয়োজন। ক্যান আই?
শিওর ম্যাম- বলে টেলিফোনটা এগিয়ে দিলো রিসেপশনে থাকা মেয়েটা। ইচ্ছে রাকীনের নম্বর তুললো ওতে। ওর মতে একদিকটা এখন একমাত্র রাকীনই সামলাতে পারবে। কল লাগাতেই রিসিভ হলো কলটা। ইচ্ছে বললো,
-হ্যালো রাকীন? ইচ্ছে।
-ইচ্ছে! তুই কোথায়? পৌছে গেছিস কি? তোর ফোন…
-রিল্যাক্স। ঠিক আছি আমি। তবে ছোট একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। তুই এক কাজ কর, নিউরো হসপিটালে চলে আয়, আমি…
আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো ইচ্ছে, ঠিক তখনই প্রাপ্তকে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে হসপিটালে ঢুকতে দেখলো ও। গায়ে খয়েরী রঙের পান্জাবী, হাতা গুটিয়ে কনুই অবদি তোলা। এতোগুলো দিন পর ওকে দেখে, এই অবস্থাতেও হাসি ফুটলো ইচ্ছের ঠোটের কোনে। প্রাপ্ত কোনোদিক না তাকিয়ে ওটির দিকে ছুটেছে। কল কেটে ইচ্ছেও ওর পেছনে এগোতে লাগালো। ওটির সামনের করিডরে এসে প্রাপ্তকে দেখে থামলো ইচ্ছে। খুশিতে রঙিন ওর চারপাশ। প্রাপ্ত তখন চোখ বন্ধ করে, দেয়ালে একহাতে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে। আর সাফোয়ান ওর কাধে হাত রেখে কিছু বলছে। একটুপর ফোনটা কানে নিয়ে সরে গেলো সাফোয়ান। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে প্রাপ্তকে ওখানে দেখে, কিছু যেনো মাথাতেই ছিলো না ইচ্ছের। দৌড়ে গিয়ে জাপটে জরিয়ে ধরলো ও প্রাপ্তকে। ওর বুকে মাথা ঠেকিয়ে একশ্বাসে বলে দিলো,
-আই লাভ ইউ মিস্টার গ্যাংস্টার! আই লাভ ইউ!
#চলবে…