#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলাম পর্ব- ১

0
878

#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলাম পর্ব- ১

বৃষ্টিস্নাত বিকেলের আকাশটা স্বর্নালী আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু বের হবার উপায় নেই। রাস্তা ডুবে আছে পানিতে। দাঁড়িয়ে আছি যাত্রীছাউনির নিচে। আশেপাশে আরও কয়েকজন। জনৈক অতি উৎসাহী আগন্তুক বেশ অনেকক্ষণ হলো পাশে দাঁড়িয়ে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে। তাকে বিরক্ত লাগছে, আবার লাগছে না। সে কথা বললে গা জ্বলে যাচ্ছে, আবার চুপচাপ থাকলে মনে হচ্ছে কথা কেন বলে না। অদ্ভুত এক মনের টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি দুপুর থেকে বিকেল। আশ্চর্য ব্যাপার হলো পুরো সময়ে ছেলেটার দিকে একবার তাকাইনি পর্যন্ত! শুধু চোখের কোণা দিয়ে যতটুকু দেখা যায় দেখেছি।

এই লম্বা বৃষ্টিতে ঢাকার রাস্তায় জলাবদ্ধতা হবে না তাই কখনো হয়? ডুবো পানিতে যানবাহনও ডুবে ডুবে যাচ্ছে। আমি ডুবে যাচ্ছি হতাশায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে কী করব? কোন ভূতে পেয়েছিল যে আজ শাড়ি পরে বের হয়েছি?

এসব যখন ভাবছি, আচমকা অচেনা ছেলেটা বিরাট সাহসের সাথে আমায় হ্যাচকা টানে কোলে তুলে নিল! আমি ভয়ে, বিষ্ময়ে কাঠ হয়ে গেলাম। সে রাস্তায় নেমে পড়ল আমাকে নিয়ে। তখনই আবার ফোটা ফোটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ছেলেটার চুল থেকে পানি ঝরে পড়ছে আমার মুখে। আমি তখনো কিছুই বলতে পারলাম না, কিচ্ছু না। ওর মুখটা স্পষ্ট দেখিনি এখনো। শুধু থুতনির নিচের কাটা দাগটা! দাগটা সুন্দর আবার বিষাদের, আজকের দিনের মতো।

ঘোরগ্রস্থের মতো হয়ে গেছি আমি। হঠাৎ ছেলেটার পা পিছলে গেল। হুড়মুড় করে পড়ে যেতে যেতে উঠে পড়লাম আমি।

স্বপ্ন ছিল! ইয়া খোদা!

বিছানায় বসে রইলাম পাক্কা বিশ মিনিট। আমার স্বপ্নগুলো সাদাকালো হয়। এটা ছিল রঙিন। ভুতুড়ে স্বপ্নের মতো রঙ। তবু অদ্ভুত সুন্দর! শুধু একটা আফসোস! মুখটা দেখতে পারিনি!

***

দিনটা ভ্যাপসা গরম। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি। আকাশটা আজ নীল রঙ পুরোপুরি বর্জন করে ফ্যাকাশে চেহারায় বসে আছে গুম হয়ে। কখন ফেটে পড়বে সেই নকশা তৈরি হচ্ছে মেঘে মেঘে।

আমি উঠোনের দিকের জানালার পাল্লাদুটো পুরোপুরি খুলে দিলাম। একফোঁটা বাতাস নেই কোথাও। গ্রীষ্মের ছুটি চলছে বলে বাড়িতে এসেছি। এক কাপ চা আর একটা গল্পের বই নিয়ে বসে গেলাম জানালার পাশে। কী যেন মনে আসি আসি করছে। বইতে মন বসতে চাইছে না। চা শেষ হচ্ছে দ্রুত, কিন্তু ভাবনাটা একটা বিন্দুতে জড়ো হচ্ছে না বলে অস্থির লাগছে।

গেট খোলা পেয়ে দুটো বাচ্চা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছে। লাল রঙের ছড়ানো ফ্রক পরা মেয়েদুটো দেখতে হুবহু এক। জমজ বোধহয়। আমাদের বিশাল ডালপালা মেলে দেয়া কৃষ্ণচূড়াটা এবারেও ছেয়ে গেছে রক্তলাল ফুলে। পড়ে থাকা সেই ফুল কুড়োতে এসেছে বোধহয় এরা।

ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে গেল। কৃষ্ণচূড়া ফুল নিয়ে কত খেলেছি! এ এমনই এক ফুল যার প্রতিটা অংশ নিয়ে খেলতে পারতাম। পাপড়ি দিয়ে তরকারি, পরাগরেণু দিয়ে ডিমভাজি, পরাগ দন্ড দিয়ে সেমাই। আর নিচের পাপড়িগুলোর ওপরের চামড়া তুলে ফেলে আঠালো অংশ নখে লাগিয়ে হতো ডাইনিদের মতো বড় বড় নখ! কী সব মজার খেলা!

মেয়েদুটোকে ডাক দিলাম, “এই শোনো…”

ওরা ঝট করে আমার দিকে তাকাল। তারপর ফুলটুল ফেলে হুড়মুড় করে দৌড়ে গেটের বাইরে। আমি পুরো অবাক। ভয় পেল কেন এরা? আমি কি দেখতে ভয়ঙ্কর?

আয়নার সামনে একটু দাঁড়ালাম। নাহ ঠিকই তো আছে!

গল্পের বই পড়া হচ্ছে না দেখে সেটা রেখে দিয়ে কম্পিউটারে বসে গেলাম৷ ছুটির পরেই পরপর কয়েকটা টিউটোরিয়াল দিতে হবে। আবার বন্ধের জ্বালা হিসেবে এসাইনমেন্ট দিয়ে রেখেছে। সেটাই করতে বসে গেলাম।

নেট কানেকশন অন করতেই রাশিকের মেসেজ এলো। ছেলেটার পুরো নাম রাশেদুল ইসলাম রাশিক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। খুবই সিরিয়াস এবং মেধাবী ছাত্র। দেখতেও ভালো। ভালো চাকরি করছে। পাশাপাশি প্রস্তুতি নিচ্ছে বিসিএস এর।

ফেসবুকেই পরিচয় তার সাথে। একটা বইয়ের গ্রুপে কুইজ জিতেছিলাম শুধু আমরা দু’জন। সেদিন সে মেসেজ করে জানিয়েছিল আমার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে নাকি দেশে কমই আছে। মাখন লাগানোতে গলে যাইনি, তবে ভালো লেগেছে।

ইদানীং কথাবার্তা শুনো বোঝা যায় আমাকে পছন্দ করে। আমার পছন্দ-অপছন্দ, বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তাভাবনা, পরিবার ইত্যাদি বিষয়ে নানা কথার ছলে জিজ্ঞেস করে। নিজের কথাও জানায়৷ আমার ভালোই লাগে ছেলেটাকে। মনে হয় এতদিনে ব্যাটে বলে মেলার মতো কাউকে পেয়েছি। এমনিতে ইউনিভার্সিটি লাইফে প্রপোজাল কম পাইনি, কিন্তু মনের মতো ছেলে, একটাও না!

সে লিখেছে, “কী করেন?”

“এসাইনমেন্ট করি। আপনি?”

“আমাদের তো আর আলাদা করে গ্রীষ্মের ছুটিফুটি নেই। চাকরি জীবনে ঢোকা মানে আরামটারাম সব উধাও!”

“সব কথা জোড়া জোড়া বলছেন কেন?”

“আরেহ এক নতুন বস এসেছে, তার মুদ্রাদোষ যে কোনো শব্দ জোড়ায় জোড়ায় বলবে। কথা-টথা, কাজ-টাজ, ভুল-টুল, ফাইল-টাইল! সকাল থেকে তার কথা শুনতে শুনতে আমারও এই হাল!”

“মজা তো!”

“কিসের মজা? মজা তো আপনাদের।”

“তা বলতে পারেন। যতদিন ইউনিভার্সিটিতে ছিলেন আপনিও মজা করেছেন।”

“সেটা ঠিক।”

“আজকের দিনটা কেমন যেন, খুব বেশি আদ্রতা, গরমে শেষ হয়ে যাচ্ছি।”

“আর এদিকে এলে কী করবেন? উত্তরবঙ্গের গরমে একেবারে সেদ্ধ কাবাব হয়ে যাবেন।”

“ওদিকে আমি যাবই না।”

“কপালে থাকলে আসতে হবে। কার ভাগ্যে কী হয় বলা তো যায় না।”

“তা অবশ্য ঠিক!”

“আচ্ছা বাই, হাতের কাজটা শেষ করে আবার কথা বলব। আপনি এসাইনমেন্ট শেষ করুন।”

“ওকে বাই।”

এসাইনমেন্টটা জঘন্য! যে টপিকে ইন্টারনেটে তেমন কিছু সাজিয়ে গুছিয়ে পাওয়া যাবে না, স্যার ইচ্ছে করে সেই টপিক থেকে দিয়েছে। এখন খুঁজতে হবে বই। অসহ্য লাগছে সবকিছু!

মেঘের ডাক শুনে কম্পিউটার বন্ধ করে উঠে গেলাম টেবিল থেকে। আবার গিয়ে বসলাম জানালার কাছে।আশ্চর্য, মেয়েদুটো আবার এসেছে! চুপি চুপি এদিক তাকিয়ে ফুল কুড়াচ্ছে। আমি আবার ডাকলাম, “এই মেয়েরা, ভয় পেও না, শুনে যাও…”

কে শোনে কার কথা! দুটিতে আবার ভোঁ দৌড়! ভারি মজা তো!

রান্নাঘরে মায়ের কাছে গিয়ে টুকিটাক কাজকর্মে হাত লাগালাম। ভালো লাগছে না কিছু। আজকের দিনটা কেমন যেন অদ্ভুত!

মেঘ ডাকাডাকি করলেও বৃষ্টি আসেনি। আকাশ সেই ফ্যাকাশে রয়ে গেছে দিনভর। বিকেলে ছাদে কাপড় তুলতে গিয়ে পাশের বাড়িতে চোখ পড়ল। আমাদের একতলার ছাদ থেকে পাশের বাড়ির উঠোন পরিষ্কার দেখা যায়। সেই মেয়েদুটো ছুটোছুটি করে কানামাছি খেলছে। তাদের সাথে খেলছে ফর্সামতো, ঢ্যাঙা একটা বেশ বড় ছেলে।

এরা নতুন এসেছে। এই জায়গাটা অনেকদিন পড়েছিল জঙ্গল হয়ে। আগে এখানে থাকল রুবারা। রুবা আমার চেয়ে বয়সে এক বছরের বড় হলেও খুব ভালো বন্ধু ছিলাম আমরা। একসাথে সারাদিন খেলতাম, একসাথে স্কুলে যেতাম, আর কত গল্প! যখন আমি ক্লাস সিক্সে, তখন ওরা জমি বিক্রি করে চলে গেল বিদেশ। ওদের যাবার দিন রুবা আর আমি গলাগলি করে আচ্ছামতো কেঁদেছিলাম। কথা ছিল যোগাযোগ ছিন্ন করব না কখনো। কিন্তু তখন তো আর এখনকার মতো সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ ছিল না, অতএব, অচিরেই আমাদের বন্ধুত্বের ইতি ঘটল।

প্রায় বছরখানেক আগে বাবার এক বন্ধু জমিটা কেনেন। বাড়ি করে গাছপালা লাগিয়ে হুলস্থুল অবস্থা৷ তারা যে বাড়িতে উঠেছে জানতামই না। আর জানবই কেমন করে? বাড়ি এলাম এই সেদিন।

রাতে খেতে বসে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার সেই বন্ধু পরিবারসহ দেখলাম উঠেছে বাড়িতে?”

বাবা কোনো এক বিচিত্র উপায়ে কাঁটাসহ মাছ খেতে পারেন৷ ইলিশ মাছের মাঝের কাঁটাটা সশব্দে চিবুতে চিবুতে বললেন, “হ্যাঁ গত সপ্তাহে এসেছে। তোদের নিয়ে একদিন যাব, প্রতিবেশী বলে কথা। পরিচিত হবি না?”

“আচ্ছা নিয়ে যেও।”

“তোর মা তো নিজে থেকে গিয়ে পরিচিত হতে পারবে না। এমন ঘরকুনো মহিলা বাংলাদেশে ক’টা আছে কে জানে!”

অন্যদিন হলে মা ছ্যাৎ করে উঠে কিছু একটা বলত। বাবা ইচ্ছে করে মাকে এসব বলে জ্বালাতন করে। মা অল্পতে রেগে যান। আবার অল্পতেই সেই রাগ ভাঙে। বাড়িতে এই বিনোদন চলতে থাকে সারাবছর।

আজ মা চুপচাপ হয়ে আছে, কারন সে একটা অঘটন ঘটিয়েছে। বাবার সবচেয়ে পছন্দের সাদা শার্টটা ধোওয়ার সময় ভিজিয়ে ফেলেছে তার নতুন সবুজ ওড়নার সাথে। সাদা শার্টের বুকের কাছে কটকটে সবুজ রঙ লেগে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও ওঠানো যায়নি। বাবা দেখলে কী করবে কে জানে!

রাতে ঘুমুতে গিয়ে রাশিকের মেসেজ পেলাম।

“গরমের কথা ওঠাতে আজকে গরম নিয়ে একটু পড়াশোনা করলাম।”

“গরম নিয়ে আবার কী পড়াশোনা?”

“ওই গুগল থেকে যা পেলাম আরকি। পৃথিবীতে সবচেয়ে গরম দেশ কোনটা জানেন?”

“সৌদি?”

“হয়নি।”

“তাহলে?”

“লিবিয়া। তারপর সৌদি।”

“ওহ।”

“লিবিয়াতে তাপমাত্রা ৫৫ ডিগ্রির ওপর চলে যায়।”

“বাঁচে কেমন করে তারা?”

“অভ্যাস হয়ে গেছে।”

“হুম। মানুষের অভিযোজন ক্ষমতা অসাধারণ।”

“ঠিক তাই। তবে নিম্নশ্রেনীর প্রানীর অভিযোজন ক্ষমতা আরও ভালো। যেমন ধরুন তেলাপোকা। পৃথিবীতে এর উৎপত্তি হয়েছে ডায়নোসরেরও আগো। অথচ এত বিশাল ডায়নোসরগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেল, তেলাপোকা বাবাজিরা বহাল তবিয়তে টিকে আছে। মানুষ বিলুপ্ত হয়ে গেলেও তেলাপোকা হবে বলে মনে হয় না।”

তেলাপোকার প্রসঙ্গ ওঠায় আমার কেমন শরীর ঘিনঘিন করে উঠল! তবু কথা চালিয়ে যেতে লিখলাম, “মানুষ কেমন করে বিলুপ্ত হবে? পৃথিবীতে মানুষ থাকতে থাকতেই তো কেয়ামত হয়ে যাবে।”

“ওই আরকি কথার কথা বললাম।”

“ওকে!”

“গুড নাইট। অনেক রাত হয়েছে। সকালে আবার উঠতে হবে।”

দুম করে সবুজ বাতি অফ হয়ে গেল। আজব পাবলিক! রাত সাড়ে এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বে, এদিকে পৃথিবী উল্টেই যাক আর পাল্টেই যাক না কেন! এমন স্বাস্থ্যসচেতন বান্দা আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। মাঝে মাঝে খুব ইন্টারেস্টিং আলাপের মধ্যেও হঠাৎ বাই বলে চলে যায়। কথা বলার সময় অত সময়ের হিসেব থাকে নাকি!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here