#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলামপর্ব–৫
আজ বৃষ্টি নেই। তবে উজ্জ্বল দিনও নয়। গ্রীষ্মের ছুটিতে বর্ষা পালন করছি, ব্যাপারটা খারাপ না। উঠোনের ঘাসগুলো ভিজে নেই, তবে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। হাঁটছি আপনমনে। পেছনের দিকে পুরানো আমগাছটার গায়ে শ্যাওলা পড়ে গেছে। এই গাছটায় সবচেয়ে মিষ্টি আম হয়। গাছের ডালে উঠে আগে রুবার সাথে গল্প করতাম৷ ও উঠত ওদের পানির ট্যাংকের ছাদে। ওই ছোট্ট ছাদটুকু এখনো আছে। আমি কী মনে করে গাছের ডালে চড়ে বসলাম। ওপাশে বর্ষণদের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। উঠোন ফাঁকা। সামনে কয়েকটা বেলীফুলের গাছ। সুবাস এই পর্যন্ত চলে এসেছে।
আবোল তাবোল আরও অনেক কথা মাথায় আসছে। আসলে মন মেজাজ খারাপ বলেই কিছু ভালো লাগছে না। দুদিন কথা না বললে কেউ এতদিনের বন্ধুত্ব নষ্ট করে? এভাবে ব্লক করে? আর কতগুলো কথাও শুনিয়েছে! আমি কি তার কেনা নাকি যে সে ছাড়া আর কারও সাথে কথা বলতে পারব না!
গা জ্বলছে খুব! ভাবলাম গোসল করলে কমবে। নেমে গেলাম সেখান থেকে। ঘরের দিকে যেতেই মা চিৎকার করে বললেন, “তোর জামার মধ্যে এত ময়লা কোত্থেকে আসল?”
আমার মেজাজ আরও গরম হলো। সেই মেজাজ খারাপ কমল বাথরুমে ঢুলে একগাদা পানি মাথায় ঢালার পর।
গোসলের পর একা ঘরে চুপচাপ বসে আছি। হঠাৎ বর্ষণের মেসেজ। “আজকে লাইব্রেরিতে যাবা?”
বর্ষণের সাথে সম্পর্ক সেদিনই ‘তুমি’-তে চলে এসেছে। তার মেসেজ পেয়ে ভালো লাগল। মনে হলো সত্যিকারের বন্ধু।
লাইব্রেরি থেকে আনা বই পড়া হয়নি একটুও। কি খটোমটো বইরে বাবা! ফেরত দিয়ে আসা যাবে। বললাম, “যাব।”
বিকেলে লাইব্রেরিতে গেলাম। বই ফেরত দিয়ে বের হবার পর বর্ষণ বলল, “আমার বই পড়ে এত সুন্দর ফিডব্যাক দিলা, তোমাকে কিছু খাওয়াব। কী খাবা বলো।”
আমি মাথা চুলকে বললাম, “ফুচকা।”
“আচ্ছা।”
লাইব্রেরি থেকে ডানে গিয়ে গলির মোড়ে একটা ফুচকাওয়ালা বসে। কী যে মজা করে ফুচকা বানায়! আমি সবসময় চেটেপুটে খাই। আজও খেলাম। তবে বর্ষণ তেমন খেতে পারল না ঝালের চোটে। তার নাকচোখ দিয়ে ক্রমাগত জল পড়তে শুরু করল। তবুও সবটা খেল। দেখলে মনে হবে ছোটো বাচ্চাকে জোর করে খাওয়াচ্ছে, সে কাঁদতে কাঁদতে খাচ্ছে! আমার এত হাসি পেল, কোনোমতে হাসি চেপে রাখলাম৷
ফুচকার সামনে থেকে সরে গিয়ে চেপে রাখা হাসিটা হেসে ফেললাম। “তোমাকে যা লাগছিল না! হিহিহি।”
সে নাক টেনে বলল, “এত ঝাল বাপের জন্মে খাইনি। তুমি খেলে কিভাবে? তবে ফুচকাটা মজা ছিল।”
“হুম। চলো তো রাস্তার ওই পাড়ে যাই।”
বর্ষণ ঝালে অস্থির। ওপাড়ে কী আছে দেখলও না৷ আমি গিয়ে দুটো আইসক্রিম কিনলাম। একটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, “খাও, ঝাল কমবে।”
ঝালের প্রকোপ কমে এলে বর্ষণের চোখের ঘোলাটে ভাব দূর হলো। আইসক্রিম শেষ করে বলল, “থ্যাংস।”
“শুধু থ্যাংস বললে হবে না, আরেকদিন ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে এসো।”
“আচ্ছা আচ্ছা। আপাতত এটা নাও।” সে পকেট থেকে একটা নীল অপরাজিতা বের করে দিল।
“বাহ পকেটে ফুল নিয়ে ঘোরো দেখছি। তুমি কি কবিতাও লেখো নাকি?”
“আরে না। কবিতা খুব কঠিন জিনিস। এটা চিনি ছিঁড়ে ফেলেছিল। আমি তাই পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। ওদের কাছে থাকলে এটার ভর্তা হতো, নয়তো কুচিকুচি তরকারি। সাধের ফুলের ওই অবস্থা সহ্য হয়!”
আমি হেসে ফুলটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলাম। সকালের মন খারাপ ভাবটা কেটে গেছে বলেই মনে হচ্ছে।
★
রাতে শুরু হলো ঝোড়ো হাওয়া। কোথাও একটা কালবৈশাখী ঝড় হচ্ছে, এখানে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ধুলোমাখা ঠান্ডা বাতাসের প্রথম ঝাপটার সাথে সাথে কারেন্ট চলে গেল। ডুবে গেলাম আঁধারে।
মায়ের কাছে গিয়ে দেখি নামাজ পড়ছে। মা একা থাকতে ভালোবাসে, আমিও। আমরা গল্প করি, একসাথে কাজ করি। তবু কিছু সময় যেন আমাদের নিজেদেরই। আমরা একে অপরের এই নিজস্ব সময়টুকু নষ্ট করি না। আমি সচরাচর এ সময় বই পড়ে কাটাই। আজ তো বইও পড়া যাবে না। সেদিনের মতো মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়তে কেন যেন ইচ্ছে করছে না।
মোবাইলে একটা এসএমএস এলো, “ধারা, তোমার ফোনে ব্যালেন্স আছে?”
বর্ষণের নাম্বার থেকে মেসেজটা এসেছে।
উত্তর দিলাম, “আছে।”
“তাহলে আমাকে ফোন করো। আমার মোবাইলে বেশি টাকা নাই।”
আমি ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, “খুব জরুরি কোনো দরকার?”
“হ্যাঁ। আমি একটা কাজ করব, তুমি আগে প্রমিজ করো রাগ করবে না?”
আমার কেমন যেন সন্দেহ হলো। কী করবে সে?
একটু ভয় নিয়েই বললাম, “কী কাজ?”
“আরে বাবা খারাপ কিছু না। প্রমিজ করো আগে।”
“আচ্ছা প্রমিজ।”
“কিছু নাও হতে পারে, আবার হতেও পারে।”
“কী হবে?”
“এখন বলব না। কাল জিজ্ঞেস করলে জানতে পারব। কাজ করছি।”
“কিন্তু কী কাজ?”
“উফ তুমি সেটা এমনিতেই বুঝতে পারবে। এখন নরমালি কথা বলো।”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “এমন সাসপেন্স রেখে কে নরমালি কথা বলতে পারে?”
“আরেহ শোনোই না, একটা নতুন গল্প মাথায় এসেছে। তোমাকে শোনাতে চাই।”
“ঠিক আছে, শোনাও।”
“একটা পোড়োবাড়ির ঘটনা। ওই বাড়ির পাশেই একটা ছোট্ট বাড়িতে থাকতে গেছে নবদম্পতি। তারা দূরের শহর থেকে চাকরিসূত্রে এসেছে, পাশের বাড়িটা সম্পর্কে জানে না বললেই চলে। এমনকি বাড়িটা উল্টোদিকে হওয়ায় তারা এটাও জানে না যে সেটা পোড়োবাড়ি। রোজ রাতে শুয়ে পড়ার পর তারা শোনে পাশের বাড়ি থেকে হাড়ি পাতিলের শব্দ আসছে, গ্লাসের টুংটাং, লোকজনের কথাবার্তা, যেন পার্টি চলছে। প্রথমে সব স্বাভাবিক মনে হয়েছিল তাদের। বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর প্রথম মেয়েটা অস্বাভাবিকতা আবিষ্কার করল। দিনের বেলা বাড়িটা এত শুনশান থাকে কেন? একটা জনপ্রাণীর টু শব্দও হয় না। অথচ রাতে থালাবাসনের কনসার্ট হয় যেন! তাহলে কি সবাই চাকুরিজীবী?
দিনে মেয়েটা একা থাকে বাসায়, স্বামী চলে যায় অফিসে। প্রথম দু’দিন খেয়াল হওয়ার পর তৃতীয়দিন বিকেলে মেয়েটা সেই বাড়িটা দেখতে যায়। উল্টোদিকের পথ ঘুরে বাড়ির সামনে এসে দেখে গেটে তালা দেয়া। তালাটা পুরানো, জং ধরা। বহুদিন ব্যবহার হয় না যেন!
মেয়েটার তেমন সন্দেহ তখনো হয়নি। ভাবল হয়তো অন্য দরজা দিয়ে বাড়ির লোক যাতায়াত করে। বড় বাড়ি, কয়েকটা গেট থাকা স্বাভাবিক।
সত্যি সে আরেকটা গেট পেয়ে গেল। ঠিক গেট নয়, ইট ভাঙা একটা জায়গা, পাতার বেড়া দেয়া সেখানে।
কৌতুহলবশত সে পাতার বেড়া ঠেলে ঢুকে গেল ভেতরে। ঝোপঝাড় এড়িয়ে দালানের সামনে চলে গেল। আর তখনই বুঝতে পারল বাড়িটা পরিত্যক্ত। এত নোংরা ভাঙাচোরা বাড়িতে মানুষ থাকতেই পারে না। পাতাভর্তি উঠোন, ভাঙা দরজা জানালা, আর মাকড়সার জাল তাকে জানিয়ে দিল বহুদিন এখানে মানুষের পা পড়েনি।
মেয়েটা কিন্তু ঘাবড়ে গেল না। ছোটোবেলা থেকে ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়ে বড় হয়েছে। তার বদ্ধমূল ধারণা হলো বাড়িতে কোনো স্মাগলারের দল লুকিয়ে আছে। চোরাপথে ঢোকে, রাতে কাজ সেরে দিন হওয়ার আগে চলে যায়। কাছেপিঠে বাড়িঘর নেই বলে রাতে অত শব্দ করে।
তাদের ধরিয়ে দেয়ার একটা প্রবল নেশা চেপে বসল মনে। গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকল সে। প্রথমেই প্রবল কাশি চলে এলো। ধুলো হাত দিয়ে যথসম্ভব সরিয়ে বাড়ির আরও ভেতরে চলে গেল মেয়েটা। ঠিক তখনই বাইরে প্রবল ঝড় শুরু হলো। প্রকৃতিতে যেন তান্ডব শুরু হয়েছে, অথচ এমনিতে বাতাসের চিহ্নও ছিল না।
মেয়েটার হঠাৎ মনে হলো আশরীরীরা তাকে ঘিরে ধরেছে। ছোটাছুটি করছে বাড়িময়। চারদিকে প্রচন্ড অন্ধকার। পায়ের তলায় মনে হচ্ছে ভূমিকম্প শুরু হলো। ভয়ানক পরিস্থিতি।
এক পর্যায়ে মেয়েটাকে কে যেন কোলে তুলে নিল। কে সেটা মেয়েটা দেখতেও পেল না। ওকে তুলে নিয়ে গেল জানালার ধারে। বাইরে আচমকা রাত হয়ে গেছে। চকচকে চাঁদের আলো ঢুকে পড়ছে বাড়িতে। থেমে গেছে ঝড়। মেয়েটা মূর্ছা যাওয়ার আগ মুহূর্তে দেখল এক সুদর্শন ছেলে তাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার সব সুন্দর, শুধু চোখদুটো আগুনের মতো জ্বলছে। সেই আগুনের চোখে কামনার ছায়া।
মেয়েটার স্বামী অনেক খুঁজেও স্ত্রীকে না পেয়ে পুলিশের কাছে গেল। প্রায় সপ্তাহখানেক খোঁজাখুঁজির পর মেয়েটার লাশ পাওয়া গেল পোড়োরবাড়ির পেছনে ঝাড়ের মধ্যে।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী মেয়েটা মারা গেছে এক সপ্তাহ আগে। কিন্তু ওর চেহারা দেখে তখনো মনে হচ্ছিল ঘুমিয়ে আছে পরম সুখে।
এরপর থেকে ছেলেটার সাথে অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটতে লাগল। সে যেখানেই যাক, যেখানেই থাকুক, ঝড়ের দিনে তার জানালায় কে যেন এসে শো শো আওয়াজ করে। ফিসফিস করে ডাকে, “এই এসো…শুনে যাও….এসো….”
শেষে মেয়েটার ডাক বর্ষণ এমন করে বলল যেন মনে হলো সত্যি! আমার চোখ চলে গেল জানালার দিকে। মনে হলো কে একটা দাঁড়িয়ে। এমনিতেই আঁধারে গা ছমছম করছে। ভূতের গল্প শুনে শরীর ঠান্ডা হয়ে এলো।
তবু সাহস করে বললাম, “শেষ?”
সে নাঁকি সুরে বলল, “হ্যাঁ।”
“এভাবে কথা বলছ কেন?”
“আমিই সেই মেয়ে…”
“ধুরর!”
ফোন কেটে দিলাম আমি। সত্যি ভয় লাগছে। বাইরে প্রচন্ড শব্দে একটা গাছের ডাল ভেঙে পড়ল। আমি পড়িমরি করে ছুটলাম মায়ের কাছে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু