#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলামপর্ব-১৩
অবশেষে আমার মন থিতু হলো। ঠিক করতে পারলাম আমি আসলে কী চাই। সত্যি বলতে, এতদিন দুজনের মাঝে পড়ে থাকতে থাকতে নিজেরও অসহ্য লাগছিল। সত্যিকারের নদীতে ছুটে চলা দুই নৌকোর মাঝে পিষে যাওয়ার মতো।
তবে স্বপক্ষে কিছু বলারও আছে আমার। দু’জনের সাথেই আমি কথা বলতাম বন্ধু হিসেবে। বেশি কিছু নয়। তাই আমি তাদের ঘোরাচ্ছি কথাটা একেবারেই সত্যি নয়। এখন আমাকে রাশিক বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, এবার সঠিকভাবে ভাবার একটা পথ পাওয়া গেছি। তবে পথটা পেয়েছি উল্টোদিকে। মানে রাশিকের পথ ধরে সঠিক পথটা চিনেছি, যেটা বর্ষণের পথ।
শুরু থেকে বলি।
সেদিন বর্ষণের সাথে ঝগড়া মিটে যাওয়ার পর আবার আগের মতো কথা হতে শুরু করল। দেখতে দেখতে কুরবানির ঈদ চলে এলো। আমি আবার ছুটিতে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখি বর্ষণ তার বোনদুটোকে দুই কান ধরে নিয়ে যাচ্ছে। দেখেই হেসে ফেললাম৷ ওদের সামনে গিয়ে রিকশা ছেড়ে দিয়ে নেমে পড়লাম।
জিজ্ঞেস করলাম, “ঘটনা কী?”
বর্ষণ রিনির কান ছেড়ে নিজের কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, “দুটোই ক্লাসে সব পরীক্ষায় ফেল করেছে। খাতায় লেখেইনি, পাশ করবে কেমন করে? জিজ্ঞেস করাতে এখন বলে লিখতে নাকি ইচ্ছে হয়নি। এখন ওদের নিয়ে যাচ্ছি স্কুলের মাঠে সবার সামনে বেঁধে রাখব।”
দুটিতে তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দিল। বর্ষণও একটু অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিল, সেই সুযোগে এক দৌড়ে কোথায় চলে গেল দুটিতে আর দেখা পাওয়া গেল না।
আমি একটু সৌজন্য বিনিময় শেষে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
হঠাৎ মনে হলো, আমার খুব শান্তি লাগছে, আনন্দ লাগছে। অনেকদিনের অস্থিরতা দূর হয়েছে। বর্ষণকে কতদিন পর দেখলাম! কতদিন পর! মনটা এতদিন কোথায় যেন আটকে পড়েছিল। আমি মুক্তি পেলাম এবার।
ঈদের দিন বিকেলে বাড়িতে বলে দু’জন ঘুরতে গেলাম। সারাদিন সে গরু কাটাকুটির কাজ করেছে বলে একটু ক্লান্ত৷ তবু আমাকে নিয়ে বের হয়েছে। আমরা আজ গেলাম স্কুলের মাঠের দিকে। পিচঢালা নির্জন পথটা চলে গেছে অনেকদূর। একধারে ঘন ঝোপঝাড়।
আমার বেশ লাগছিল! আমি বর্ষণকে বললাম, “একটা কথা বলব তোমায়।”
সে বলল, “বলো।”
“ফেসবুকে একজনের সাথে আমার অনেক কথা হয়। সে আমাকে প্রপোজ করেছে।”
আমি স্পষ্ট খেয়াল করলাম বর্ষণের মুখ কালো হয়ে গেছে। বেশ ক্ষুন্ন গলায় বলল, “তুমি কী বললে?”
“কিছু বলিনি এখনো।”
“কী বলতে চাও?”
“জানি না।”
“তার মানে মানা করবে না?”
ওর অস্থিরতা দেখে আমি হেসে ফেললাম। “না করব কেন? আমার তো কোনো পিছুটান নেই।”
বর্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, “নেই?”
“আছে?”
“তুমি বড্ড নিষ্ঠুর ধারা! করো যা খুশি।”
“তুমি আমাকে কী করতে বলো?”
“কিচ্ছু না। তোমার লাইফে আমি কী বলব?”
“ছেলেটার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে না?”
“আগ্রহ নেই। তোমার কি ওকে খুব পছন্দ?”
“মানুষ হিসেবে পছন্দ, তবে সারাজীবন থাকতে পারব কি না জানি না।”
এতক্ষণে তার মুখের অন্ধকার দূর হলো। বলল, “তাকেই বিয়ে করা উচিত যে তোমাকে সারাজীবন ভালো রাখবে।”
“এমন কাউকে কোথায় পাব?”
সে উত্তর না দিয়ে সোজা হাঁটতে লাগল। আমি গেলাম পিছু পিছু। আকাশটা একটু আঁধার করে আসছে। ভালো বাতাস দিচ্ছে। সে পথের পাশ থেকে একটা জংলি ল্যান্টানার গোলাপী রঙের ফুল ছিঁড়ে আমার হাতে দিয়ে বলল, “চোখ থাকলে সব চেনা যায়৷ চিনতে শেখো।”
“তুমি কি আমাকে প্রপোজ করছ বর্ষণ?” বুঝলাম বলতে বলতে রক্তাভ হয়ে গেছে আমার মুখ।
সে অসম্ভব গভীর গলায় বলল, “প্রেম নিবেদন সবসময় করতে হবে তা নয়। চোখে চোখে অনেক কথা হয়ে যায় যা মুখের কথার চাইতেও অনেক স্পষ্ট।”
দুজনের থেকেই ফুল পেলাম। কি অদ্ভুত কান্ড! অবশ্য অত বেশি অবাক হবারও কিছু নেই। চিরকাল এটাই হয়ে আসছে, ছেলেরা মেয়েদের ফুল দেবে।
★
রাতে রাশিককে বললাম তাকে আমি বিয়ে করতে পারব না। বলতে খুব খারাপ লাগল, কিন্তু আমার আর কিছুই করার নেই।
রাশিক একবারের জন্যও হয়তো ভাবেনি আমি তাকে মানা করে দেব। সে অনেকক্ষণ পর বলল, “আপনি কি ভেবে বলছেন?”
“হ্যাঁ। আপনার কথা রাখতে পারছি না বলে আমি দুঃখিত।”
রাশিক আবারও জিজ্ঞেস করল, “আর ইউ শিওর? মজা করছেন না তো?”
জোর দিয়েই বললাম, “না।”
“ওহ।” আবার কিছু সময়ের জন্য বাক্যহারা হয়ে গেল রাশিক। আবছাভাবে বলল, “সেদিন আমি কি ভুল কিছু করেছি?”
“না সেটা নয়। আসলে আমার অন্য একজনকে পছন্দ।”
রাশিক এই কথাটা শুনে আরও বেশি অবিশ্বাসের সুরে বলল, “সত্যিটা বলুন! আপনার প্রেমিক থাকলে সেদিন আমার সাথে সারাদিন ঘুরলেন কেন? আর আপনি জানতেন আমি আপনাকে পছন্দ করি। তাহলে আমি কিছু বলার আগে একটা হিন্টস পর্যন্ত দিলেন না যে আপনি অন্য কাউকে পছন্দ করেন?”
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। রাশিক এত রেগে যাবে সেটাও ভাবিনি। ঠান্ডা গলায় বোঝানোর চেষ্টা করলাম, “আসলে আমি সেদিনও বুঝিনি যে আমি বর্ষণকে পছন্দ করি…”
রাশিক ফোন কেটে দিল। একটু পর তার নাম্বার থেকে একটা এসএমএস এলো, “একটা মিথ্যে ঈদের দিন উপহার দেবার জন্য অনেক কৃতজ্ঞতা ধারা। আশা করি ভালো থাকবেন পছন্দের মানুষকে নিয়ে।”
আমার মন প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। আমি কি তবে বিশ্বাস ভঙ্গ করলাম? খুব কষ্ট দিলাম রাশিককে? কিন্তু আমি তো কোনো কমিটমেন্ট করিনি তার কাছে। তাহলে জবাবদিহি কেন করব? নিজের কাছেই যুক্তি, পাল্টা যুক্তি দিতে দিতে রাত পার করে দিলাম।
তখন যদি জানতাম পরদিন এত বড় একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে আমার জন্য!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু