#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলামপর্ব-২০
আমি লিখছি বাসে বসে। দু’ধারে সারি সারি গাছপালার মাঝ দিয়ে হাইওয়ে। আকাশ আজ মেঘলা। শীত আসন্ন। বিকেল হতেই কুয়াশারা উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছে৷ আবছা আলোয় সাদা ডায়েরির পাতা ধূসর দেখাচ্ছে। আমি লেখার ফাঁকে ফাঁকে চেয়ে দেখছি দূরে চলে যাওয়া পথটা। কতদূরের পথ এটা? কোথায় আমার গন্তব্য? আমি যাচ্ছি কার কাছে? যাকে আমি চিনেও চিনি না? যাকে চিনতাম তার রূপ আমাকে নতুন করে পৃথিবী দেখতে শিখিয়েছে। আর যাকে দূর থেকে দেখেছি সে নতুন করে চেনা পৃথিবীটা আবার বদলে দেবে না তো?
রাশিকের কথা অনেক কিছুই লিখতে ইচ্ছে করছে। তার সাথে আমার চমৎকার কিছু স্মৃতি আছে। সেসব লিখে রাখতে দোষ কী? কখনো ঘটনাগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি, তবে আজ মনে হচ্ছে। মানুষটা ঠিক আমার মনের আদলে গড়া একথা সত্য৷ মাঝে বর্ষণের মোহে পড়ে তাকে ভুলতে বসেছিলাম।
এক ভোরের কথা। তখনো আমি বর্ষণের সাথে পরিচিত হইনি। রাশিকের সাথে সদ্য পরিচয় হয়েছে। ভোর পাঁচটার দিকে ঘুম ভেঙেছে অকারণেই। তখন শীতকাল। মাঘ মাসের প্রচন্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে নির্ঘুম আমি বসে আছি। কী করব ভেবে না পেয়ে নেট অন করে ভিডিও দেখছি, কিন্তু অস্থির লাগছে।
রাশিক সে সময় মেসেজ দিল, “এত সকালে আপনাকে কখনো অনলাইনে দেখিনি তো!”
“ঘুম ভেঙে গেছে।”
“কেন? তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলেন?”
“না। কেন জানি না।”
“ভালো লাগছে না?”
“না।”
“তাহলে উঠে পড়ুন।”
“উঠে কী করব?”
“আপনি বলেছিলেন আপনাদের ক্যাম্পাসের পাশে গ্রাম্য এলাকা আছে। ওদিকটা ঘুরে আসুন। একাই।”
“এই শীতে? পাগল?”
“আসুন, মন ভালো হবে গ্যারেন্টি দিচ্ছি।”
আমি তার গ্যারেন্টি শুনলাম না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর উসখুস করতে লাগলাম। ভালো লাগে না কিছুই। উঠে পড়লাম অতঃপর। মোটা চাদর গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গ্রামের দিকটায় ঘন কুয়াশা একেবারে লেপ্টে আছে। কিছুই দেখা যায় না। আলো সবে ফুটেছে। চারদিক স্পট হচ্ছে। আমি আঁকাবাঁকা ধানক্ষেত ধরে অনেক দূর গেলাম। লজ্জাবতী ফুল ছুঁয়ে দিলাম, বুকভরে নিঃশ্বাস নিলাম, সাদা বকের দলকে তাড়া করলাম, ক্ষেতের পাশে পাম্পের বরফ শীতল পানিতে হাত ডুবিয়ে বসে থাকলাম।
মনের জড়তা কেটে গেল। রাশিককে ফিরে এসে ধন্যবাদ দিলাম। কিন্তু সেই বেরসিক লোক জবাব দিল, “ঠান্ডা লাগতে পারে৷ এত রোমান্টিক হতে তো বলিনি। ঔষধ রেডি রাখবেন হাতের কাছে। আমার কাজ আছে পরে কথা বলব।”
তখন খুব মেজাজ খারাপ হয়েছিল। এখন লিখতে লিখতে হাসছি। কি আজব একটা লোক!
আরেক বসন্তের সন্ধ্যায় প্রচন্ড গরম দিনের শেষে একটু ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। আমি কফির মগ হাতে জানালার ধারে বসে পড়া রিভিশন দিচ্ছিলাম। পরীক্ষা ছিল সামনে।
রাশিক একটা অ্যাপসের লিংক পাঠিয়ে লিখল, “এটা মানুষের পার্সোনালিটি টেস্টিং অ্যাপ। আপনি কত পার্সেন্ট নারী সেটা ডিটেক্ট করতে পারবে এই অ্যাপ। ট্রাই দিস।”
“হাস্যকর। আজেবাজে অ্যাপ।”
“মোটেও না! আপনি ট্রাই করে দেখুন।”
“আপনি করেছেন?”
“না পরে করব। আগে আপনি।”
“কেন?”
“কারন লেডিজ ফার্স্ট।”
এরকম অদ্ভুত কথার কোনো কারন খুঁজে পেলাম না। লিংকে ঢুকে অ্যাপে লগইন করলাম রাশিকের দেয়া নাম্বার দিয়ে। বুঝলাম জয়েন্ট একাউন্ট হয়েছে। কিছু প্রশ্ন আসবে, সেসবের উত্তরের ভিত্তিতে অ্যানালাইসিস করে তারা পার্সেন্টেজ জানাবে।
জেন্ডার সিলেক্ট করে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলাম। ওরা জানাল আমি ৩৪% নারী। খুবই বিরক্ত হয়ে রাশিককে বললাম, “আপনার অ্যাপ বলেছে আমি অল্প নারী, বেশি পুরুষ।”
রাশিক গম্ভীর হয়ে জবাব দিল, “হতেই পারে! নারীদের মধ্যে পুরুষালি স্বভাব থাকা অস্বাভাবিক নয়।”
“এবার আপনার পালা।”
রাশিকও প্রশ্নোত্তর দিল এবং তার ক্ষেত্রে অ্যাপ বলল, সে ৩৯% পুরুষ।
এটা দেখার পর রাশিক আর মেসেজের উত্তর দিল না। অফলাইন হয়ে গেল। যাওয়ার আগে অ্যাপটাও ডিলিট করে দিয়ে গেল।
আমি বইপত্র ফেলে হাসতে শুরু করলাম। এরপর অনেকদিন তাকে কথাটা নিয়ে ক্ষেপিয়েছি।
এখনও হাসি পাচ্ছে, তবে তখন যেটা বুঝিনি সেটা এখন বুঝতে পারছি। অ্যাপটা পুরুষত্বকে নম্বরিং করত তাদের গাম্ভীর্য, কঠোরতা, অগোছালো, ভবঘুরে ইত্যাদি স্বভাবের দ্বারা৷ এদিকে রাশিক অমায়িক, খুব গোছালো আর ঘরকুনো স্বভাবের। তার নম্বর কম হওয়ারই কথা৷ এখন এগুলোই একটু একটু করে দুর্বল করে তুলছে আমাকে।
আরেকদিনের কথা। সে আমাকে একটা লিংক পাঠিয়ে লিখল, “এই ভিডিওটা দেখবেন না প্লিজ।”
কিন্তু সে মেসেজ দিতে দিতে আমি ভিডিওর কিছুটা দেখে ফেলেছি। রাশিকের ইউনিভার্সিটির সময়কালের ভিডিও। র্যাগ দিচ্ছে সিনিয়ররা৷ সে গাছের গুড়ির ওপর দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে বেসুরো গলায় গাইছে, “ও প্রিয়া…তুমি কোথায়?”
পোস্টটা তার বন্ধু করেছিল। এখন নতুন করে কেউ কমেন্ট করায় চলে এসেছিল সামনে। আমি এমনিতেও সেটা দেখতাম না। রাশিকের বন্ধু আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড নয়। অথচ সে দেখার ব্যবস্থা নিজেই করে দিল।
আমি যখন সেটা বললাম তখন খুব রাগ করে বলল, “দেখতে নিষেধ করার পরেও একটা জিনিস দেখা বেয়াদবি। আপনার সাথে তিনদিন কথা বলব না আমি।”
বুঝলাম খুব লজ্জা পেয়েছে। আমিও আর ঘাটাতে গেলাম না। রাতে দেখি সে মেসেজ দিয়েছে, “নতুন সিরিজটা দেখেছেন? ‘দ্য হন্টেড ট্রি’?”
ছোটোদের মতো স্বভাবের ছেলেটাকে ভালো লেগে যাচ্ছে নতুন করে। পুরানো স্মৃতিগুলো সব একের পর এক মনে পড়ে যাচ্ছে। জোড়া লেগে হয়ে যাচ্ছে স্মৃতির ট্রেন।
টুম্পার সাথে বর্ষণের মিল হওয়ার পরদিন, মানে যেদিন টুম্পা মরে যাওয়ার নাটক করল তার পরদিন এত বেশি খারাপ লাগছিল যে দরজা বন্ধ করে শুধু কেঁদেছি পুরোটা দিন।
রাশিক কেমন করে যেন বুঝেছিল। আমি না চাইতেই সান্ত্বনা দিচ্ছিল অনবরত। বলছিল কত কথা! বরফের দেশের এক ছোট্ট কুটিরে বাস করা এক দুঃখী বুড়ো লোকের গল্প বলেছিল সে সেদিন। যে সারাজীবন কাটিয়েছিল কাজ করে আর অবসর সময়ে দুঃখগুলো জিইয়ে রেখে। একদিন সে রাতে কফির মগ হাতে জানালার কাচ থেকে বরফ মুছে চেয়েছিল আকাশের নক্ষত্ররাজির দিকে। লান্টাইনো নামের নীল এক নক্ষত্র থেকে ভেসে এসেছিল অদ্ভুত সুর, বলেছিল এক বছর পর তার মৃত্যু হবে। এই এক বছর যেন সে বেঁচে নেয় ইচ্ছেমতো।
লোকটার বোধোদয় হয়েছিল তারপর। একটা মুহূর্তও এরপর সে নষ্ট করেনি। কাজ করেছে, অবসরে বাচ্চাদের সাথে মজার সব গল্প করেছে, খেলা করেছে বরফ নিয়ে। বরফজমা গাছ থেকে হিমশীতল বেরী ছিঁড়ে মুখে পুরে ক্ষয়ে আসা দাঁতে প্রচন্ড ঠান্ডার ধাক্কা সহ্য করে হাসিমুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভেবেছে, দিন কি ফুরিয়ে এলো?
শেষ দিনগুলোতে সে বুঝেছে বাঁচতে হবে বাঁচার মতো করে। জীবনের বেশিরভাগ দিন সে নষ্ট করেছে অবহেলা করে। জীবন তাকে কেন আর সুযোগ দেবে?
রাশিক বলেছিল, জীবন সবাইকে সুযোগ দেয়, সময় দেয়। সেসব হেলায় হারাতে হয় না। আজ যে দুঃখে মূল্যাবন সময় নষ্ট করছো কাল হয়তো তার কানাকড়ি মূল্য থাকবে না তোমার কাছে। এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলো। সব ভুলতে না পারো, ভোলার চেষ্টা করো। আনন্দ না করতে পারো, অন্তত কষ্ট পেয়ে সময়গুলো বৃথা যেতে দিও না।
আমি তখন তার কথা মন দিয়ে শুনতাম৷ কেমন যেন বিষাদ ভর করত। ইচ্ছে করত কারো কোলে মাথা রেখে শুয়ে লম্বা ঘুম দেই। যে ঘুমের পর সকাল আসবে ক্লান্তিহীন, দুঃখহীন, অতীতহীন।
রাশিককেই কি চাইছিলান মনে মনে? হয়তো!
★
বাস থেকে নামলাম রাত এগারোটায়৷ রাশিকের আসার কথা। কিন্তু কোথায় দেখলাম না তাকে। অল্প কিছু লোক বাস টার্মিনালে হাঁটাচলা করছে। গন্তব্য বোধহয় বাড়ির দিকে। রাত হলে সবার তাড়া থাকে নীড়ে ফেরার। আমি তাহলে এখানে কেন? আমিও কি নীড়ে ফেরার চেষ্টায় আছি। কোথায় আমার নীড়?
একটু পর জনশূন্য হয়ে গেল জায়গাটা। আমি রাশিককে একুশতম বারের মতো কল করলাম। সে কল না ধরে কেটে দিল।
প্রচন্ড ভয়ে অস্থির লাগছে। কাঁপা হাতে লিখছি৷ একটা সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে আছি। অদূরে এক মাঝবয়সী পাগল আমার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে দাঁত বের করে হাসছে।
রাশিক কি আসবে না? তবে আমাকে কেন আসতে বলেছিল? আমি কি কোনো হোটেলে উঠব? কিছুই চিনি না৷ একটা রিকশারও দেখা নেই। ঘড়ির কাটা দৌড়াচ্ছে মাঝরাতের ঘন্টার দিকে।
রাশিককে মেসেজ করলাম, “আসবে না তুমি?”
মেসেজ সীন হলো না, উত্তরও এলো না।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু