#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলাম পর্ব-১৮

0
228

#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলাম পর্ব-১৮

একদিন ছাদে বসে আছি। বারবার অকারনে চোখ চলে যাচ্ছে বর্ষণদের বাড়ির দিকে। দেখলাম চিনি রিনি মুখ বের করে আমার দিকে তাকাচ্ছে, আবার দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। ওদের কথা এই ঝামেলায় মনেই ছিল না৷ আমি ওদের ডাকলাম, ওরা এলো না৷ এলো বর্ষণ। করুণ চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আমি ওর দৃষ্টির কাছে পরাস্ত হলাম না, তবে ভীষণ দুর্বল লাগতে লাগল। ছুটে নিচে নেমে গেলাম৷

দলামোচড়া হয়ে কষ্টগুলো গলার কাছে আটকে আছে যেন! শরীর অবশ লাগছে। পরপর কয়েক গ্লাস পানি খেয়েও তৃষ্ণা মিটছে না। বুকে ব্যথা করছে।

তখনই মেসেজটা এলো, “ধারা, কেমন আছ?”

রাশিক! কতদিন পর ওর মেসেজ! সেই যে মানা করে দিয়েছিলাম, তারপর আমার সাথে আর কথা বলেনি৷ একদিন দেখেছিলাম ব্লক করে দিয়েছে। আজ হঠাৎ মেসেজ দিল কী মনে করে?”

আমি সত্যি কথাটাই লিখলাম, “ভালো নেই আমি।”

সে জিজ্ঞেস করল, “কেন? কোনো সমস্যা? তোমার কি বিয়ে হয়ে গেছে?”

“হ্যাঁ, সেটা বিচ্ছেদের পথে।”

মেসেজটা সীন হলো, কিন্তু উত্তর এলো না। একটু পর ফোন এলো রাশিকের নাম্বার থেকে। সে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করার পর আমিও সব ঘটনা খুলে বললাম।

রাশিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কী থেকে কী হয়ে গেল অল্প ক’দিনের ব্যবধানে!”

কান্নার বেগ সামলে বললাম, “কপালে এই ছিল!”

মনে মনে শুধু বললাম, “আমি ভুল মানুষকে বেছে নিয়েছিলাম রাশিক। ভুলের ফল কখনো ভালো হয় না৷ আপনি আমার কাছে নিজের সব জানালা খুলে দিয়েছিলেন। পরিবার-পরিজন-বিস্তৃতি সব জানিয়েছিলেন! আমি গুরুত্ব দেইনি। আর সে আমার কাছে সবটা লুকিয়ে শুধু মন ভোলানো কথা আর ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে আমার সর্বনাশ করে ছাড়ল!”

রাশিক সান্ত্বনার সুরে বলল, “ইটস ওকে! সবসময় সময় নিজের অনুকূলে যায় না। তুমি এই শোক ঠিক কাটিয়ে উঠতে পারবে দেখো।”

ফোন রেখে আমি অনেকক্ষণ কাঁদলাম। আমাদের মন একটু সহানুভূতির জন্য সবসময় কাঁদে। সেটা পেয়ে গেলে হালকা হয়ে যায়। কারো সাথে দুঃখ ভাগ করে নিলে দুঃখের বোঝা বিশ মণ পাথরের মতো ভারী আর থাকে না।

ডিভোর্স হওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টা রাশিক আমাকে সান্ত্বনা দিল। মনোবল বজায় রাখতে খুব সাহায্য করল। আমার মধ্যে জীবনের প্রতি হতাশার যে বীজ জন্ম নিয়েছিল সেটা আর যেন না বাড়ে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা সে করে গেল।

ডিভোর্স যেদিন ফাইনাল হলো, সেদিন সে একগাদা মিষ্টির ছবি পাঠিয়ে বলল, “সেলিব্রেট করো ধারা!”

আমি লিখলাম, “সেলিব্রেট করার মতো কিছু তো হয়নি। বলা যায় একটা অঙ্গহানি হলো। সেটা উৎযাপন করতে বলছেন?”

“বলছি। কারন অক্টোপাসের খপ্পর থেকে বের হয়েছ।”

“কিন্তু অক্টোপাসটা এখন আরেকটা মেয়েকে ধরবে। সেটা ভেবেছেন?”

“এক্স্যাক্টলি! তুমি মুক্ত হয়েছ, এবার অন্যদেরও মুক্তির ব্যবস্থা করবে।”

“কী করে?”

“সেটা ভাবতে হবে।”

“আপনার তো অনেক বুদ্ধি। একটু ভেবে বলুন না!”

“অনেকদিন ধরেই ভাবছি ধারা। একটা প্ল্যানও আছে। তোমাকে বলব।”

“এখনই বলুন।”

“দাঁড়াও, আরেকটু গুছিয়ে নেই প্ল্যানটা।”

এর সপ্তাহখানেক পর রাশিক তার প্ল্যানটা আমাকে খুলে বলল। বলার আগে ছোটোখাটো একটা বক্তৃতা দিয়ে নিল।

“প্রত্যেকটা মানুষেরই মনের দুটো দিক আছে। একটা ভালো দিক, আরেকটা খারাপ। আমরা যে দিকটা হাইলাইট করি সেটাই সবার সামনে প্রকাশ পায়৷ আমরা যারা এভারেজ মানুষজন, তারা ভালো খারাপ মিলিয়েই। কিন্তু কেউ দেখবে খুব ভালো আবার কেউ খুব খারাপ। খুব ভালোর মধ্যেও যেমন খারাপ প্রবৃত্তি লুকানো থাকে, তেমনি খুব খারাপের মাঝেও ভালোর অস্তিত্ব থাকে। আমরা ভাবি তার সব বিবেক মরে গেছে। আসলে বিবেক কখনো মরে না, সুপ্ত থাকে কেবল। সেটা জাগিয়ে দিতে পারলেই কাজ হয়ে গেল। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা পরানোটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। কী করে বর্ষণের বিবেক জাগিয়ে তোলা যায়, অনুতপ্ত করা যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। শারীরিকভাবে তাকে শাস্তি দেয়া যায় কিংবা অপমান অসম্মান করে তার ওপর প্রতিশোধ নেয়া যায় ঠিকই, কিন্তু তাতে তার কৃতকর্মের শাস্তি হবে না। তার একমাত্র সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে আত্মগ্লানি। এটা এমনই একটা জিনিস যেটা কঠিনতর বস্তুকেও গলিয়ে দিতে পারে।

বিবেক জাগানোর জন্য আগে জানতে হবে সে কোন কাজটা ঠিক মন থেকে করে? তার চরিত্রের ভালো দিক কোনটা? কোন জিনিসটা তাকে ব্যথা দেয়?”

আমি বললাম, “কী করে জানব বলুন এসব! জানার সুযোগ তো পাইনি খুব একটা৷ যতটা সময় সে আমাকে দিয়েছে পুরোটাই মিথ্যের জালে জড়ানো ছিল।”

“মনে করার চেষ্টা করো ধারা। ভাবো। কোন জায়গাটায় সে দুর্বল? সবচেয়ে বেশি দুর্বল?”

আমার প্রথমেই মনে পড়ল চিনি রিনির কথা। বললাম সেটা রাশিককে।

“ওর ছোটো বোনদুটো তো বেশিই ছোটো। তাদের দিয়ে কী করা যাবে? অন্যকিছু ভাবো। হয়তো তোমাকে গল্পে গল্পে বলেছে…”

হঠাৎ মনে পড়ে গেল। “বর্ষণ সবচেয়ে অপছন্দ করে বাড়ির বাইরে গিয়ে থাকা। মানে পরিবার থেকে দূরে থাকা।”

রাশিক একটু অবাক হয়ে বলল, “তাহলে সে তার স্ত্রীর.. মানে প্রথম স্ত্রীর থেকে দূরে আছে কেমন করে?”

“সেটা তো বাধ্য হয়ে।”

“আচ্ছা বর্ষণ কি তার প্রথম স্ত্রী মানে…কী যেন নাম?”

“টুম্পা।”

“টুম্পাকে সে ভালোবাসে?”

“মনে হয় না। মেয়েটা ওকে সুপথে ফেরানোর অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু সে আসেনি। উল্টো মেয়েটাকে অনবরত কষ্ট দিয়ে গেছে…”

রাশিক আমাকে মাঝে থামিয়ে দিয়ে বলল, “স্যরি টু সেয় ধারা, একটা কথা বলব…”

“বলুন!”

“টুম্পা ওকে সুপথে ফেরানোর চেষ্টা করেছে, কারণ সে তার স্ত্রী ছিল। তুমিও তো বর্ষণের স্ত্রী ছিলে, তুমি একবারও সেই চেষ্টা করেছ?”

এবার আমি একটু থমকে গেলাম। সত্যিই তো! আমি বর্ষণকে নিজের কাছে রাখার বা ভালো পথে ফেরানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করিনি। আমার পুরো প্রচেষ্টা ছিল ওর থেকে নিজেকে মুক্ত করার। ওকে ভালো করে তোলার কোনো ইচ্ছে আমার একবারও হয়নি৷ কিন্তু টুম্পার হয়েছে।

বললাম, “মানলাম, আমি করিনি। তার একটা বড় কারণ ও বিবাহিত ছিল।”

রাশিক একটু চুপ থেকে বলল, “আসলে এটা কারণ নয়। কারণটা হলো…”

“বলুন!”

“হয়তো তুমি কষ্টও পেতে পারো, তবু বলছি। বর্ষণ তোমাকে কখনোই মন থেকে ভালোবাসেনি। এমনকি তুমি নিজেও তাকে পুরোপুরি ভালোবাসতে পারোনি। তার কারণ তোমার লাইফে সেটেল হওয়ার একটা ব্যাপার ছিল, বিয়ে করতে হতো বলে করা এরকম একটা চিন্তা। তারচেয়ে বড় কথা মানুষ ততটাই আবেগ একটা সম্পর্কের জন্য দিতে পারে যতটা সে অপরপক্ষ থেকে পায়। বর্ষণের ভালোবাসা মেকি ছিল। তোমার সাব কনশিয়াস মাইন্ড সেটা হয়তো ধরতে পারছিল। তাই তুমি কখনোই তাকে গভীর আবেগ দিয়ে ভালোবাসতে পারোনি। আল্টিমেটলি তোমাদের সম্পর্কটা একটা বিয়ের কন্ট্রাক্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যেখানে যোগ হয়েছিল বর্ষণের মিথ্যে প্রেম আর তোমার তার প্রতি তীব্র আকর্ষণ। মনে রেখো, আকর্ষণ আর ভালোবাসা এক নয়।

আর টুম্পার দিকটা পুরোটাই ভালোবাসা। ছোটোবেলার প্রেম। সে বর্ষণকে মন থেকে ভালোবাসতো বলেই তার প্রতি দায়িত্ববোধ মেয়েটার প্রবল। তোমার কী মনে হয়, সে শুধু তোমাকে বাঁচাতে কল করে তোমার কাছে সব স্বীকারোক্তি দিয়েছিল? না, তার একটা সুপ্ত বাসনার অংশ ছিল তোমার সাথে বর্ষণের ডিভোর্স করিয়ে দেয়া। যাতে বর্ষণ এদিক থেকে মুক্ত হয়। টুম্পা মেয়েটা মনে মনে এখনো আশা করে বসে আছে বর্ষণের সাথে হয়তো কখনো তার আবার সংসার হবে। টুম্পার এমন ভালোবাসার বিপরীতে কি বর্ষণের ভালোবাসাও কাজ করছে না? সে যদি শুরু থেকেই অবহেলা করত, বা তার সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য থাকত টুম্পাকে কষ্ট দেয়ার তাহলে টুম্পার এখন পর্যন্ত এত আবেগ অবশিষ্ট থাকত?

তুমি কি বুঝতে পারছ আমার কথা?”

আমি বললাম, “আমাকে একটু সময় দিন।”

“আচ্ছা যাও দিলাম। একটু পর ফোন করছি। তুমি ভাবতে থাকো।”

আমি ফোন রেখে ঝিম ধরে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। বাথরুমে গিয়ে একবার মাথায় পানি দিয়ে এলাম। সত্যি কি আমার দিক থেকে পুরোটা আকর্ষণ ছিল? ভালোবাসা ছিল না?

আমার মনে পড়ে গেল সেদিন ছাদ থেকে দেখা বর্ষণের করুণ দৃষ্টি। আমি যদি তাকে সত্যি ভালোবাসতাম তাহলে সেই দৃষ্টির সামনে টিকতে পারতাম? নাকি সে যখন আমার ঘরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কত কথা বলেছিল তখন নিজের আবেগ সংযত রাখতে পারতাম? আমি কিন্তু পেরেছি। তার কারণ আমি মন দিয়ে নয়, মস্তিষ্ক দিয়ে সবসময় বিবেচনা করেছি। সেটা ভুল নয়, আমি সঠিক কাজটাই করেছি। কিন্তু এই কাজটাই আমার ভালোবাসাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। উফ! পাগল হয়ে যাব আমি!

সময় নিয়ে ভেবে মনে হলো রাশিক খারাপ কিছু বলছে না। যৌক্তিক কথাই বলছে। আর যার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে তার প্রতি কী আবেগ ছিল সেটা এখন বিশ্লেষণ না করলেই বা আমার কী?

অনেকটা ধাতস্থ হয়ে আমিই রাশিককে ফোন করলাম।

বললাম, “বলুন কী করা যায়।”

রাশিক বলল, “তুমি ঠিক আছ?”

“হুম। একদম।”

“তাহলে বলি। বর্ষণ যদি সত্যি টুম্পাকে ভালোবেসে থাকে তাহলে সে নিশ্চয়ই কষ্ট পাচ্ছে, কারন তুমি বলেছ বর্ষণ কাছের মানুষের থেকে দূরে থাকতে ঘৃণা করে। কথাটা সে তোমাকে জোর দিয়ে বলেছে। কাজেই সেটা শুধু ছোটোবেলার আবগ নয়, এখনকার মনের অস্থিরতার কথাও বটে!”

“কিন্তু সে নিজে কষ্ট পাচ্ছে এমন কাজ করছে কেন?”

“করছে কারন সে ছোটোবেলা থেকে কষ্ট পেয়ে এসেছে। শৈশবে কষ্ট ছিল বাবার দূরে থাকা, বাবা ফেরার পর কৈশরের কষ্ট জমেছিল বাবা মায়ের মধ্যে অশান্তির দ্বারা। আর শেষ পর্যন্ত প্রেমে ব্যর্থ দুই বন্ধুর সংস্পর্শে আসে সে। তাদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পায় অন্যকে কষ্ট দেয়ার। শুধু নিজে কষ্ট পাওয়া কেন? এজন্য সে টুম্পাকে ভালোবাসা সত্ত্বেও কষ্ট দিয়েছে। নিজের মায়ের সাথে ঘটা ঘটনা টুম্পার সাথে পুনরাবৃত্তি করেছে।”

“ও কি পাগল?”

“না ধারা। বর্ষণ পাগল না। সে একটা ভ্রমের মধ্যে আছে, যেটা কাটাতে হবে।”

“কী করে কাটাব সেটা? আর তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই, করার ইচ্ছেও নেই।”

“আহা! তুমি আগে শোনো তো কথা!”

“বলুন।”

“তুমি টুম্পার সাথে কথা বলো। শিওর হও তার আর বর্ষণের সম্পর্কের গভীরতা সম্পর্কে।”

“তারপর?”

“যদি দেখো আমার ধারণা মিলে গেছে, তাহলে টুম্পাকে একটা খুব কঠিন কাজ করতে হবে যদি সে স্বামীকে ফেরত পেতে চায়, মানে পাওয়ার একটা চান্স নিতে চায় আরকি… প্ল্যান একশভাগ কাজ নাও করতে পারে…”

“আরেহ প্ল্যানটা বলুন তো!”

“টুম্পাকে সুইসাইডের অভিনয় করতে হবে। বর্ষণকে লম্বা একটা চিঠি লিখতে হবে, তারপর ওর পরিবারের মাধ্যমে বর্ষণদের কাছে খবর পৌঁছুতে হবে যে টুম্পা মারা গেছে।”

“তাতে লাভ?”

“শোনো আগে পুরোটা! বলা হবে টুম্পা মরার আগে বলে গেছে তার মৃত্যুর কারণ সে নিজেই। বর্ষণকে যেন কিছু বলা না হয়। কিন্তু এর আগেই সে বর্ষণকে করুণ চিঠিটা পাঠিয়েছিল যা শুধু বর্ষণই জানে। তার মানে সে শিওর হয়ে যাবে টুম্পা তার জন্যই মরে গেল। কিন্তু মরে গিয়েও তাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল। সে যদি ওকে ভালোবেসে থাকে তাহলে বড় একটা ধাক্কা খাবে সন্দেহ নেই।”

“আপনি শিওর ওর মতো একটা জানোয়ার এই ধাক্কায় সোজা হয়ে যাবে?”

“জানি না। তবে যেটা বলেছিলাম, ঘুমন্ত বিবেক, সেটাতে যে আঁচড় লাগবে সন্দেহ নেই।”

“তারপর সে যখন জানবে টুম্পা বেঁচে আছে তখন?”

“তখন আরও ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটবে ধারা। তুমি আমার ওপর ভরসা করো। আর এই কাজ করতে টুম্পাকে রাজি করাও ব্যাস!”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here