#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলামপর্ব-৪
পরদিন দেখা ছাদ থেকে। আমি গিয়েছি একটু হাঁটাহাঁটি করতে। বৃষ্টির জন্য ঘরে বসে গা ম্যাজম্যাজ করছিল। দেখি সে সীমানা প্রাচীরের ওপর বসে। হাতে একটা ডায়েরি। কী যেন লিখছিল, আমাকে দেখে বন্ধ করে ফেলেছে।
বললাম, “ওখানে বসে আছেন যে দেয়াল ভেজা না?”
“হুম, সমস্যা নাই আমার।”
“ভালোই তো! সেদিন অত ভিজলেন ঠান্ডা লাগেনি?”
সে হেসে বলল, “অভ্যাস আছে।”
“গুড!”
“বই পড়েছেন?”
“না। অ্যাসাইনমেন্ট করেছি কাল সারাদিন। ঝামেলা ঝুলিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছিল না। কাল করে ফেলেছি, এবার ঝাড়া হাত পা! আজ ধরব বই।”
“ওকে!”
“আপনি কি বাড়িতে থাকেন সারাদিন?”
সে বোধহয় একটু লজ্জা পেল। খুব লাজুক মনে হচ্ছে! বলল, “তা বলতে পারেন। কাজ নেই তো…আবার সারাক্ষণ যে থাকি তাও না। নানা কাজে বাইরেও থাকি৷ আপনি আমার ফেসবুক আইডিটা নিয়ে নিন। মেসেঞ্জারে নাহয় বলে দেবেন।”
আমাদের ফেসবুক আইডি বিনিময় হলো। আবার মেঘ ডাকাডাকি শুরু করেছে।
বর্ষণ বলল, “চলে যান নিচে। এখুনি আবার নামবে!”
আমি নেমে গেলাম। প্রথমবার খেয়াল হলো আমাদের দু’জনার নামে বেশ মিল।
সন্ধ্যার পর লোডশেডিং হলো। আমি কী মনে করে মোমবাতি জ্বালিয়ে বর্ষণের বইটা নিয়ে বসলাম। শুরুতে ভেবেছিলাম প্রেমের গল্প। তারপর দেখি মোটেও তা নয়৷ রীতিমতো গা কাঁপানো থ্রিলার! প্রথমে ভৌতিক আবহ। একটা অদ্ভুত বাড়িতে দুটো পরপর মার্ডার। যে-ই সেখানে তাদন্ত করতে যায়, অশরীরীর গন্ধে টিকতে পারে না। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ফিরে আসে। অশরীরীর গন্ধ ব্যাপারটা বেশ ইউনিক মনে হলো, এই ভুত দেখা দেয় না, কথা কয় না, শুধু রক্তের আঁষটে গন্ধ নিয়ে জড়িয়ে ধরে। পরে অবশ্য বইটা মোড় নেয় ক্রাইম থ্রিলারের দিকে। তবে পুরোটা জুড়েই এক ধরনের ভয় কাজ করছিল।
এই বৃষ্টিদিনে একটু পরপর যেখানে বিদ্যুতের চমক আর বজ্রপাতের ধ্বনি কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে মোমের আলোয় বসে এমন জমাট থ্রিলার যে কি দারুণ লাগে! আমি বহুদিন পর এত উপভোগ করলাম বই পড়াটা! ভয়ে একটু পরপর চারপাশে তাকিয়েছি৷ মনে হয়েছে জমাট আঁধার এই বুঝি উৎকট গন্ধ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর!
মাঝে শুধু একটু খেতে উঠেছিলাম। তাছাড়া পুরোটা পড়ে শেষ করলাম এক বসায়। বোধহয় আমার বই পড়া শেষ হওয়ার অপেক্ষাতে ছিল বিদ্যুৎ। বইটা রাখতেই বাতি জ্বলে উঠল।
আমি মেসেঞ্জারে ঢুকে বর্ষণকে লিখলাম, “আপনাকে দেখে একটুও বোঝা যায় না এত ভয়ানক বুদ্ধি মাথায় নিয়ে ঘোরেন! কী দারুণ একটা গল্প! ইউনিক আইডিয়া! চমৎকার প্লট! আমার খুবই ভালো লেগেছে।”
বর্ষণ ওপাশ থেকে একটা লজ্জা পাওয়ার ইমোজি দিল। অদ্ভুত ছেলে! মাথায় খুন খারাবি ঘোরে কে বলবে!
★
রাতে বেশ অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল বর্ষণের সাথে। প্রায় দুটো পর্যন্ত৷ পছন্দের লেখক, প্রিয় বই, সাহিত্যের সেকাল একাল, সাহিত্যের জনরার মধ্যে পছন্দ অপছন্দ ইত্যাদি নিয়ে। কথা বলার মতো বিষয় পেয়ে বলেছিও অনেক। এত রাত সাধারণত জাগা হয় না। রাশিকের সাথে কথা শেষ হয়ে যায় সাড়ে এগারোটার মধ্যে। আমি বারোটা বাজতে বাজতে ঘুম। দেরি করে ঘুমানোর কারনে সকাল থেকে মাথা ভার লাগছে।
এক কাপ কড়া করে চা বানিয়ে নিয়ে বসলাম জানালার ধারে। গতকালকের গল্পটা মাথায় ঘুরছে এখনো। চরিত্রগুলো যেন বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
এত চমৎকার একজন লেখকের সাথে পরিচয় হয়ে গেল হুট করে। ভেবেই ভালো লাগছে। ছেলেটা একদিন খুব বড় হয়ে যাবে। তখন আমাকে চিনবে কি না কে জানে!
রাশিকের মেসেজ, “কী করেন?”
উত্তর দেবার আগেই মায়ের চিৎকার শোনা গেল। গিয়ে দেখি রান্নাঘরে লাফালাফি করছে ছোট্ট একটা ব্যাঙ। বাড়ির কম্পাউন্ডের পেছনে একটা ডোবা আছে। এখন বর্ষাকাল না হলেও টানা কিছুদিন বৃষ্টি হওয়ায় ব্যাঙেদের উৎসব শুরু হয়ে গেছে। তারই একটা অতি উৎসাহে ঢুকে পড়েছে মায়ের রান্নাঘরে।
বাবা বাড়িতে নেই, অগত্যা আমাকেই কোমর বেঁধে নামতে হলো ব্যাঙ ধরতে। মা আবার এসব পোকামাকড় ভীষণ ভয় পায়। সে গিয়ে ডাইনিং টেবিলে পা তুলে বসে রইল।
ব্যাঙ ফেলতে গিয়ে আমার অবস্থা কাদা মেখে ভূত। সোজা গেলাম গোসলে। ঘন্টাখানেক গোসল করে বের হয়ে প্রচন্ড ক্লান্তি লাগতে লাগল। ঘুমে জড়িয়ে এলো চোখ।
বাকি দিনটা কেমন করে যেন কেটে গেল। বিকেলের স্কুলের বান্ধবী পলিন এসেছিল। ওর সাথে পুরানো দিনের গল্পগুজব হলো, মুড়িমাখা খেলাম, একটু বাইরে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করে এলাম।
সন্ধ্যা থেকেই ঘুম পেতে থাকল। ক্রমাগত হাই তুলছি৷ দ্রুত শুয়ে পড়তে হবে। নিয়মমাফিক চলা আমার শরীর একটু এদিক ওদিক হলেই আর চলতে চায় না।
রাতে আবার রাশিকের মেসেজ। ওর দিনের মেসেজের উত্তর দেয়া হয়নি। গতকালকেরটাও না। সে যখন নক করেছে তখন লোডশেডিং ছিল, কারেন্ট আসতে আসতে সে চলে গেছে।
আজকের মেসেজ, “গ্যালাক্সিগুলো যে দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে সেই তত্ত্বটা পড়েছেন? আইনস্টাইন প্রথমবার এটার ব্যাপারে ভুল থিওরি দিয়েছিল। তার সেই মডেল অনুযায়ী মহাবিশ্ব স্থির। পরে অবশ্য ভুল স্বীকার করেছিল।”
মেসেজ দেখে আমার এত বিরক্ত লাগল যে কিছু বলার ইচ্ছেই হলো না। ইন্টারনেট কানেকশন বন্ধ করে মেবাইল রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে উঠে দেখি রাশিকের তেরোটা মেসেজ। ভয়ে ভয়ে ইনবক্স খুলে দেখি তার বিরাট অভিমান হয়েছে। আমি নাকি তাকে ইগনোর করছি, তার সাথে কথা বলতে এখন আর ভালো লাগে না, নতুন বন্ধু হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষে আবার ব্লক করে দিয়েছে। কী মুসিবত! দু’দিন কথা না বলায় এমন ইগোতে লেগে যাবে কে জানত! এখন কী করি? ফেসবুক ছাড়া এই বান্দাকে চিনি না। অতএব, রাগ ভাঙানোর কোনো উপায় রইল না। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। হাজার হোক, আমার অনেকদিনের ভালো বন্ধু!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু