#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলামপর্ব-১০
ফেসবুকে আমি কখনোই খুব একটা একটিভ থাকি না। মাঝেমাঝে একটু আধটু ঢুকলেও ঘন্টার পর ঘন্টা পড়ে থাকা হয় না। আমি নিজেই সেই আসক্তি তৈরি হতে দেইনি। শুধু বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখা আর ক্লাসের আপডেট পাওয়ার মধ্যেই আমার ফেসবুক কর্মকাণ্ড সীমিত। মোটামুটি ফ্রি থাকার সময় কখনো বা বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নিয়েছি, একটুকুই। বাকি সময় পড়াশোনা করি আর নয়তো ঘুরেফিরে বেড়াই। এলাকার মানুষজনের সাথে পরিচিত হতে চেষ্টা করি। টং দোকানে একা মেয়ে বসে থাকতে দেখে অনেকে বাঁকা চোখে তাকায়। পরোয়া করি না।
তার মানে কিন্তু এই নয় যে আমার কোনো বন্ধু নেই। বন্ধু ঠিকই আছে, অনেক আছে। ইউনিভার্সিটিতে সবাই সবার বন্ধু। আর সবচেয়ে ভালো বন্ধু বা বেস্ট ফ্রেন্ড খুঁজতে গেলে আমাকে যেতে হয় ঠিক আবার ওপরের ঘরটাতে। মানে আমি দোতলার যে কামরায় থাকি, তিনতলায় সেই কামরায় থাকে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড নীনা। খুবই সিরিয়াস ধরণের মেয়ে। সারাক্ষণ পড়াশোনা করে, কথাবার্তা বলে খুবই কম। তবু কেমন করে বন্ধুত্ব হলো, সে এক ইতিহাস। বললেও পুরোটা বোঝা যাবে কিনা সন্দেহ।
নীনার কাছেই গেলাম আমার সমস্যা নিয়ে। হলে ফিরেছি দিন পাঁচেক হলো। এখনো গা থেকে বাড়ির গন্ধ যায়নি। পুরোদমে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে অবশ্য বাড়ির কথা অত ভাববারও সুযোগ পাচ্ছি না। তবে আমার চিন্তার টানাপোড়েন বাড়িয়ে দিচ্ছে রাশিক আর বর্ষণ। নাম দুটোই দিনদিন অসহ্য হয়ে উঠছে। এদের ঝেড়ে ফেলতে পারলে সবচেয়ে ভালো হতো, তবে সেটাও সম্ভব না। আমি নিজেই পারব না।
নীনার ঘরে গিয়ে দেখি সে শাড়ি পরছে। ও ফিজিক্সের ছাত্রী। ল্যাব করতে করতে জীবন বের হয়ে যায়। আজও দেখলাম খুব কাহিল হয়ে এসেছে৷ এখন আবার শাড়ি পরার শক্তি কোথায় পাচ্ছে কে জানে!
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “যাচ্ছিস কোথায়?”
সে উত্তরে বলল, “কুঁচিটা ধর তো!”
আমি শাড়িটা সুন্দর করে পরিয়ে দিলাম। সে তাড়াহুড়ো করে ভ্যানিটি ব্যাগে কিছু টাকা আর মোবাইল ভরে বলল, “পরে গল্প করব রে ধারা। এক্ষুনি যেতে হবে।”
“কোথায় যেতে হবে সেটা তো বল!”
“পরে পরে।”
আমি ওর সাথে সাথে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে নামতে আবার জিজ্ঞেস করলাম, “কারো সাথে ডেটে যাচ্ছিস বুঝি?”
সে বের হয়ে যাওয়ার আগে বলল, “তোর মনে হয় আমার ওসব হবে? যাচ্ছি ছাত্রীর বার্থডে পার্টিতে।”
আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। “এত সেজেগুজে বার্থডে পার্টি?”
ও উত্তর দেবার জন্য দাঁড়িয়ে নেই, চলে গেছে। ভেবেছিলাম বুঝি প্রেমট্রেম করছে। কিন্তু না, কিছু মানুষের আসলেই ওসব হয় না। আর ওকে বর্ষণ-রাশিকের কথা বললে নিশ্চিতভাব বলবে দুটোকে বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে।
★
অগত্যা হতাশ হয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দেখলাম রুমমেট নীরা আপু মোবাইলে খুব মনোযোগ দিয়ে কী একটা পড়ছে। জিজ্ঞেস করতেই বলল, “ভাইরাল কাহিনী। পড়ে দ্যাখ।”
ফেসবুকে তেমন একটিভ নই বলেই ভাইরাল কাহিনী দেখা হয়ে ওঠেনি। আপুর হাত থেকে মোবাইল নিয়ে পড়ে দেখি বিরাট ঝামেলার ব্যাপার! এক মেয়ে ফেসবুকে প্রেম করে মোবাইলেই বিয়ে করে বসেছে ছেলের সাথে। ছেলে বলেছিল সে কোনো এক কোম্পানির সিইও। কিন্তু প্রথম দেখার দিন মেয়েটা জানতে পারল সেই ছেলে একটা ডিপার্টমেন্টাল শপের সেলসম্যান। এখন ছেলে সেই মেয়েকে ছাড়বে না। কেসটেস করে হযবরল অবস্থা। এর মাঝে মেয়ে গলায় ফাঁস দিতে গেছে। মৃতপ্রায় অবস্থায় উদ্ধার করার পর হাসপাতালে ভর্তি করতেই জানা গেছে মেয়ের বাচ্চা হবে৷ এবার ছেলেটা দাবি করছে সে ওই বাচ্চার বাবা নয়। তাদের মধ্যে কখনোই অত গভীর সম্পর্ক হয়নি৷ প্রথমদিনই তার মিথ্যাচার শুনে মেয়ে পিছিয়ে গেছে। এখন মেয়েও মুখ খুলছে না, যদিও তার সুইসাইড নোটে ছেলেটির কথাই লেখা ছিল!
আমি আপুকে বললাম, “এ কি অবস্থা! এগুলোর মানে কী?”
আপু খিলখিল করে হেসে বললেন, “মাথা নষ্ট অবস্থা। লোকজন খুব মজা নিচ্ছে।”
“কিন্তু ঘটনা কী বলেন তো?”
“কে জানে! আমার মনে হচ্ছে মেয়ে একসাথে দুটো সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিল। দুজনই তাকে ঠকিয়েছে, একজন মিথ্যে বলে, অন্যজন প্রেগন্যান্ট করে দিয়ে।”
“ভয়ানক!”
“আরে কত হচ্ছে এসব! ছাড় তো! চল কিছু খেয়ে আসি।”
“যেতে ইচ্ছে করছে না আপু।”
“আচ্ছা কী খাবি বল, আমি নিয়ে আসব।”
আপু ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেল। বিকেলে সে হাঁটতে বের হয়। হাঁটা শেষে ক্লান্ত হয়ে মাঠের পাশে কড়ই গাছের নিচে বসে থাকে চুপচাপ। কখনো গলা ছেড়ে গান ধরে। তার কিছু গায়ক বন্ধু আছে, তারাও জুটে যায়। সবগুলোই বাদাম বা চাওয়ালা পিচ্চি৷ আমিও কখনো কখনো আপুর সাথে বের হই। তার জীবনটা সুখের মনে হয়৷ ফিলোসফিতে পড়ে, ক্লাসের চাপ কম। যদিও তার জীবনের কাহিনী মোটেও সরল নয়, সেসব পরে কখনো বলা যাবে।
আমি এই ভাইরাল কাহিনীর মাঝে আপাতত ডুবে গেলাম। মেয়েটার জায়গায় কেন যেন নিজেকে কল্পনা করে ফেলছি। কিন্তু আমি মোটেও তেমন নই। ছি!
★
রাতে রাশিকের মেসেজ এলো, “চাকরিটা কনফার্ম হয়ে গেল ধারা! ইউ আর লাকি!”
“অভিনন্দন। কিন্তু আমি লাকি হব কেন? লাকি তো আপনি।”
“ওইযে উইশ করেছিলেন মনে আছে?”
আমি হেসে ফেললাম৷ একটু বেশিই ইনোসেন্ট ভাব নিচ্ছে।
লিখলাম, “এখন কি বিসিএসের পড়াশোনা বাদ?”
“টোটালি! এই চাকরিতেই থিতু হয়ে যেতে পারলে আর পেছন ফিরে দেখতে হবে না। আমি স্যাটিসফায়েড।”
“বেশ বেশ!”
“আপনি একটা জিনিস মিস করে যাচ্ছেন!”
“কী?”
“সুসংবাদ দিলে সবাই ট্রিট চায় ধারা!” তার কথায় হতাশা!
“ওহ আচ্ছা! কিন্তু আপনি এত দূরে থাকেন, ট্রিট কেমন করে দেবেন?”
“সেটাই প্রশ্ন।”
“এজন্যই তো চাইনি।”
“চাইলে আমি গিয়ে দিয়ে আসতাম।”
“বলেন কী? কত ব্যস্ত মানুষ আপনি!”
“তো কী হয়েছে? যাব একদিন। নতুন অফিস তো, একটু অ্যাডজাস্ট হয়ে নেই, তারপর যাব।”
“ওকে।”
“গুড নাইট ধারা। ঘুমাব।”
“হুম৷ ঘুমান।”
“আপনিও ঘুমিয়ে পড়ুন।”
“আমি এত জলদি শুয়ে পড়তে পারি না।”
“অভ্যাস হয়ে যাবে। ডোন্ট ওরি!”
শেষ কথায় কী বোঝালো কে জানে! আমার ভালোই লাগল।
বর্ষণের সাথে মেসেজে কম, ফোনে কথা হয় বেশি। আজও হয়েছে। একগাদা ভূতের গল্প শুনিয়েছে। মনে হয় পাগল করে ছাড়বে। আবার কথা না বললেও ভালো লাগে না। আমি লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। আমি কি রাশিকের কথা রাখতে দ্রুত শুয়ে পড়লাম? কিন্তু শুয়ে শুয়ে বর্ষণের কথা মনে পড়লে। ইয়া খোদা! আমাকে ভাইরাল কাহিনী বানিয়ে দিও না প্লিজ!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু