#অপ্রিয়_প্রেয়সীপর্ব- ১৬
#লিখা_তানজিলা
গাড়ির ডিকি নিশ্চয়ই যাতায়াতের জন্য উত্তম পথ নয়। এমন না যে এই মূল্যবান তথ্য আগে জানা ছিলো না আইজার। তবে এই মুহুর্তে সরসরি গাড়ির ডিকিতে মাথা ফাটানোর অভিজ্ঞতা প্রাপ্তি হলো ওর।
রিয়াদ যেখানেই যাচ্ছে সে পথের বেশিরভাগ রাস্তাই ভাঙাচোরা। যা গাড়ির ডিকিতে লুকিয়ে বেশ জোড়ালো ভাবে টের পাচ্ছে আইজা। একটু পর পর গাড়ির ঝাঁকুনিতে মাথায় চোট পাচ্ছে ও।
এক ঘন্টা হবে কী আধা ঘণ্টা, গাড়িটা হুট করে থেমে গেলো। ডিকিটা একটু উঁচু করে বাইরের পরিস্থিতিতে চোখ বুলালো আইজা। রাস্তার দুই দিক ঘন গাছপালায় ঢাকা। ঠিক যেন কোন জঙ্গল। গাড়ি থেকে কিছুদূর পর একটা কুকুর বসে ছিলো। গাড়ির ডিকির ভেতর থেকে উঁকি দেয়া মানবীকে দেখতেই হঠাৎ ঘেউ ঘেউ আওয়াজ করতে শুরু করলো সে।
কুকুর টা তেড়ে আসতে গেলেই দ্রুত ডিকি টা বন্ধ করে ফেললো আইজা। ধুর! কুকুরটার এতো চিৎকার চেচামেচিতে ধরা পড়তে তো সময়ই লাগবে না! বাইরে থেকে রিয়াদের কন্ঠ শুনতে পাচ্ছে ও। কুকুর টাকে শান্ত করেই গাড়ি থেকে সরিয়ে নিলো সে। রিয়াদের গলা শুনে মনে হলো কিসের যেন তাড়া আছে! হঠাৎ করেই দম বন্ধ মনে হলো ওর। আর বেশিক্ষণ এখানে পড়ে থাকা সম্ভব না। কারও পদচারণের শব্দ কানে না আসায় ডিকিটা একটু উঁচু করলো আইজা। না! কেউ নেই। সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ এক জায়গা।
কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে আইজা ধীর পায়ে গাড়ির সামনের দিকে এগোতেই রক্তাক্ত লোকটিকে আগের জায়গাতেই দেখতে পেলো। তবে এই মুহুর্তে বাঁধা অবস্থায় নেই। দূর থেকে দেখলে মনে হবে অসুস্থ তাই ঘুমিয়ে আছে। আশেপাশে রিয়াদকে দেখতে পেলো না আইজা। তবে খচখচ শব্দ বেশ কাছ থেকে আসছে। গাড়িটা খোলার চেষ্টা করলো ও। কিন্তু লাভ হলো না লক করা ছিলো বলে। হঠাৎ খচখচ শব্দটা আরও জোড়ালো হওয়ায় গাড়ি থেকে দূরে সরে এলো আইজা। বেশ মোটাসোটা একটা গাছের পেছনে লুকিয়ে পড়লো। রিয়াদ এসেই গাড়ি থেকে লোকটিকে বের করে একটা হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিলো। অতঃপর মেইন রোড দিয়েই কোথায় যেন নিয়ে যেতে শুরু করলো।
কিছুদূর যেতেই সামনে আরেক টা সরু রাস্তা। যার দুইপাশের গাছগুলো একে অপরের সাথে মিশে একাকার হয়ে আছে। ফলে আকাশ টাও ঢেকে আছে। এ রাস্তায় বড় কোন গাড়ি আসতে পারবে না। আইজা নিজের জুতা জোড়া অনেক আগেই খুলে নিয়েছিলো। এখন মনে পড়লো সেটা গাড়ির ডিকিতেই ফেলে এসেছে!
দিনের বেলাতেও জায়গায় টা বেশ ভয়ংকর মনে হচ্ছে। বুকের ভেতর থেকে ধুপধুপ আওয়াজটা আইজা বেশ স্পষ্ট ভাবেই শুনতে পাচ্ছে। বেশ ছোটখাটো একটা কুঁড়েঘরের সামনে গিয়ে থামলো রিয়াদ। আইজা নিজেকে যথাসম্ভব নিঃশব্দে রাখার চেষ্টা করছে। যদিও ব্যপারটা সহজ নয়। রিয়াদ একবার পেছনে ঘুরতেই আইজা পুনরায় একটা গাছের পেছনে নিজেকে আড়াল করে ফেললো। এতোক্ষণ তো একটা গাছ থেকে আরেকটা গাছের দিকে যেতে যেতেই রিয়াদ কে ফলো করছিলো ও। এতোগুলা গাছের মধ্যে সবচেয়ে চওড়া গাছগুলো খুজে খুজে সেখানেই আড়াল করছিলো নিজেকে।
হঠাৎ এইদিকে কারও পদচারণের আওয়াজ শুনতে পেলো আইজা। রিয়াদ হয়তো আসছে। সে আরেকটু কাছাকাছি আসতেই গাছের অন্যসাইডে চলে গেলো আইজা। রিয়াদ ফোন হাতে নিয়ে কাউকে কল করেই আশেপাশে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছে যে এখানে কেউ আছে।
-“ভাবি বেড়িয়ে আসুন। আমি জানি আপনি এখানেই আছেন!”
রিয়াদের কন্ঠস্বরে ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার। তবে নিজের জায়গায় অটল ও।
-“ভাবি প্লিজ! সীমান্ত ভাই আপনাকে কিছু না বললেও আমি ফেঁসে যাবো।”
এই কথাগুলো বলতে বলতে আরও সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রিয়াদ। আইজা দেখতে পেলো সেই লোকটা একটু একটু করে হুইল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে। রিয়াদ নিজের মতো করে সামনেই এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনে কী হচ্ছে তাতে কোন হেলদোল নেই তার। এখানে তো রিয়াদের সাথে আর কেউই নেই। এতটা ঢিল দিয়ে কিডন্যাপিং! যেন এই মুহুর্তে আইজাকে খুঁজে বের করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আইজা লক্ষ্য করছে ও যে গাছের পেছনে লুকিয়ে আছে সে গাছ ব্যতিত অন্যান্য সব জায়গায় কিছু একটা খুঁজে যাচ্ছে রিয়াদ। আইজার মনে হচ্ছে রিয়াদ আইজার অবস্থান বুঝতে পেরে ইচ্ছে করেই আইজার সামনে আসছে না।
হঠাৎ রিয়াদের কী হলো এক দৌড়ে সেখান থেকে চলে গেলো সে। আইজা এবার বেরিয়ে এলো। পেছনে ফিরে দেখলো ঐ লোকটা রক্তচক্ষু নিয়ে আইজার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের কালো অংশ ব্যতিত সম্পূর্ণ সাদা অংশ টাই রক্তলাল। আইজা কয়েকবার পিটপিট করে তাকালো। ওর মনে হচ্ছে কিছু ভুল দেখছে। চোখের সাদা অংশ এতোটাও লালচে হতে কখনো দেখেনি ও। এক পা দুই পা করে পিছিয়ে যাচ্ছে আইজা। লোকটার লালচে দৃষ্টি এই মুহুর্তে আইজার ওপরই নিবদ্ধ। সেই গোডাউনে চোখে লেগে থাকা অসহায় চাহনি নেই এখন। আইজা নিজের পায়ের গতি থামাতেই লোকটাও এক জায়গায় স্তব্ধ হয়ে আইজাকে দেখে যাচ্ছে আর বিড়বিড় করে কী যেন বলছে।
-“সেটা আমার..”
-“সেটা শুধুই আমার…”
-“আমি বাদে আর কোন জীবিত মানুষ তার নাগাল পাবে না…!”
একনাগাড়ে এতোসব উদ্ভট উদ্ভট কথাগুলো বলতে বলতে আবারও আইজার দিকে এগিয়ে আসছে লোকটা। আইজা যতবার পা পিছিয়ে নিচ্ছে, লোকটা ততবারই সামনে আগাচ্ছে।
এক পা.. দুই পা.. এরপর আর সহ্য করতে না পেরে দৌড়াতে শুরু করলো আইজা। লোকটার গতিবিধি সুবিধার ছিলো না। যেন কোন নেশা করে বসে আছে। আইজা যত দ্রুত দৌঁড়ানোর চেষ্টা করছে ততটাই দ্রুততার সাথে লোকটাও আইজার পেছনে ছুটতে শুরু করছে। ধুর! কী করতে এসেছিলো আর কী করছে! হুট করেই দাঁড়িয়ে পড়লো আইজা। নিজের কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগ থেকে একটা পিস্তল বের করে পেছনে ঘুরে লোকটার দিকে তাক করলো ও।
আইজা থামতেই লোকটাও তার পায়ের গতি থামিয়ে দিলো। সাথে বেশ অস্বাভাবিক ভাবে নিজের ঘাড়টা নাড়াচ্ছে। এভাবে তো ঘাড় টাই ভেঙে যাবে। তবে চোখের সাদা অংশের লালচে ভাবটা আগের থেকে কম লাল হয়ে আছে। আইজার হাতে থাকা পিস্তল টায় একবার চোখ রেখে লোকটা ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আপনার সিক্রেটস কখনো কাউকে বলবেন না!! কাউকে না!! আপনার দিকে কেউ বন্দুক তাক করলেও না!”
নেশাখোরের মতো একা একাই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো লোকটা। আইজা তীক্ষ্ণ স্বরে প্রশ্ন করলো,
-“সীমান্ত আপনাকে আটকে রেখেছে কেন জানেন আপনি? সে কী আপনার কাছ থেকে কোন গোপন তথ্য জানতে চায়?”
লোকটা আইজার কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই মাটিতে বসে পড়লো। হাতের নখ দিয়ে কিছু মাটি উপড়ে খেতে শুরু করলো। হঠাৎ এরূপ কান্ডে কিঞ্চিৎ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো আইজা। পিস্তলটা হাতে নিয়েই লোকটার থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনার ক্ষুধা পেয়েছে? আমি আপনার জন্য খাবার এনে দিচ্ছি!”
লোকটা একটু করূণ চাহনিতে তাকালো। যেন অনেক দিন ধরে পেটে কিছু পড়েনি। আইজা লোকটির চোখের ভাষা বুঝতে পেরে ব্যাগ থেকে ফোন বের করতেই লোকটা এক থাবায় আইজার হাত থেকে পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে আইজার দিকেই তাক করলো। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বুঝে উঠতে সময় লাগলো ওর। পরক্ষনেই ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার। এমনিও পিস্তল টা আসল না। খেলনা পিস্তল ছিলো।
লোকটা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে হয়তো। তীক্ষ্ণ নজরে পিস্তলটা পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলো সে। আইজা ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো,
-“দেখুন, আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি আপনাকে এখান থেকে বের হতে সাহায্য করবো! আপনি শুধু আমাকে সবটা বলুন।”
-“আপনার বাবাও আমাকে সেম কথা বলেছিলো। আর দেখুন আমি কতটা সুরক্ষিত সময় কাটাচ্ছি! তবে একটা কথা বলে রাখছি আমি, সীমান্তকে কখনোই ভরসা করবেন না।”
লোকটার কথা শুনে আইজা কিছু বলবে তার আগেই গুলির আওয়াজে আঁতকে উঠলো ও। কানটা ভনভন করছে। যেন খুব কাছ থেকেই কোন বিকট শব্দ কানে বেজে উঠলো। একটু আগেও সামনে বসে থাকা লোকটা আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। গুলি প্রাপ্ত স্থান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। কাঁপা কাঁপা দৃষ্টিতে পিছনে ফিরে তাকালো আইজা। সীমান্ত বন্দুক হাতে ওর থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। তবে বন্দুকের নলটা এই মুহুর্তে আইজার দিকে!
চলবে…