#অপ্রিয়_প্রেয়সীপর্ব- ২০ (পাথর দিল)
#লিখা_তানজিলা
সারাদিন অফিসের ধকল সেরে বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেলো। আট টা বেজে গেছে। মাথাটা ভিষণ ধরেছে আইজার। এক কাপ কড়া কফি হলে মন্দ হতো না। আশেপাশে কাউকে চোখে পড়ছে না। সীমান্ত আইজাকে নামিয়ে দিয়ে কোথায় যেন চলে গেলো। আইজাও কোন প্রশ্ন করেনি।
কোনমতে ফ্রেস হয়ে এসে সিমির কাছে গেলো ও। মেয়েটা পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। ইদানিং সিমির ঘুমের পরিমাণ অত্যাধিক বেড়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর পর ঘুমিয়ে পড়ে। শান্তি পায় হয়তো। আইজারও ইচ্ছে করে একটা লম্বা ঘুম দিয়ে উঠতে। কিন্তু তা আর হয়ে উঠে না। ঘুমটাই যে ধরা দেয় না। নিজের ঘরে এসে আলমারি টা খুললো আইজা। সেদিন মায়ের জন্য আনা ফোনের বাক্স টা ওভাবেই পড়ে আছে। সেদিকে চোখ পড়তেই ঠাস করে আলমারিটা বন্ধ করে দিলো আইজা। মাথা টা পূর্বের তুলনায় একটু বেশিই ব্যথা করছে।
আজকে ওর সো কল্ড চাচার খোঁজ লাগিয়েছিলো আইজা। শুনেছে বালুচর প্রজেক্টের নতুন ইনভেস্টরদের একজন দেশের বাইরে। সিরাজ আজাদ আর নাজিম শিকদার দুইজনই দেশের বাইরে গেছে তাদের প্রজেক্টের কাজে বিদেশি ইনভেস্টরের সাথে জরুরি মিটিং এর জন্য।
সীমান্ত এমনিও একা ছাড়েনি আজ ওকে। বাইরের গেটে যে লুকায়িত সিসি ক্যামেরা আছে জানে ও। আর আইজা এটাও জানে যে ওকে বাইরে যেতে দেয়া হবে না। তাই এখন কিছু করবে না ও। একবার সীমান্ত ঢিল দিলেই সুযোগ বুঝে কাজ করবে আইজা। নিজের বাবার খোঁজ পেতে আগে ঐ কুখ্যাত ক্লাবে যেতে চায় ও। কিন্তু সীমান্তর নজরের জন্য বারবার দমে যাচ্ছে।
ভিষণ গা জ্বলছে আইজার। অন্তর জ্বলে ছাই হচ্ছে ক্রমাগত। ওর মায়ের খুনি নির্দিধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আইজা কী করছে! বাড়ি থেকে বের হতে পর্যন্ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নিজের জন্মদাতা পিতার খোঁজটাও করতে পারলো না। ধীরে ধীরে সমস্ত অনুভূতি আইজার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। শুধুমাত্র ক্রোধের রেশটাই রয়ে গেছে। নিজেকে আটকে রাখার চেয়ে কঠিন কাজ এই মুহুর্তে ওর নজরে পড়ছে না। নাজিম শিকদারের বড় সন্তান সীমান্ত শিকদার। তার সাথে প্রায় প্রতিদিনই একই বিছানায় ঘুমায় আইজা। যেখানে ভরসার জায়গা টুকুই নেই সেখানে এতোদিন শান্তি খুঁজে বেড়িয়েছে ও। শান্তি তো পেলোই না! উল্টো এক কারাগারে ব*ন্দী হয়ে গেছে !
না! আইজা ভেঙে পড়বে না। নাজিম, সীমান্ত আর সিরাজ ; এদের কাউকে ছাড়বে না ও। যতদিন এ লোকদের চোখে র*ক্তের অশ্রু না দেখেছে শান্তি পাবে না আইজা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো ও। চোখটা বন্ধ হয়ে এলো। এক মাস আগেও সুখ নামক মরিচীকার খোঁজ করেছিলো ও। এখনো তাই করছে। কিন্তু আজ পরিস্থিতি আর লক্ষ্য দুটোই ভিন্ন!
মাথাটা চেপে ধরে উঠে বসলো ও। কফি করতে রান্নাঘরের দিকে যেতেই দুইজনের কথোপকথন কানে গেলো আইজার। তৎক্ষনাৎ কিচেনের বাইরে দাঁড়িয়ে পড়লো ও।
-“এই অল্প বয়সে দুনিয়া আমি কম দেখি নাই। এই মানুষের মধ্যে কোন বিবেক নাই। তাই ব্যাটায় বউ ম*রার পরও আহে নাই! এই দিকে সকাল থেইকা দুই ভাইবোনের নাটক দেখতে দেখতে মাথা ব্যাথা করতাছে আমার!”
-“আস্তে রাজিয়া আপু! ভাবি শুনে ফেলবে!”
-“শুনলে শুনুক! দেখ পাখি, আমি ঐ মহিলারে ডরাই না। মনে করছিলাম মা ম*রছে এইবার তো মনটা নরম হইছে! না! আজকে সকালে ছোট সাহেবরে কী জানি কইছে, লোকটা না খাইয়া মুখটা ছোট কইরা বাইরে গেলো তো গেলো। এহনো আইলো না! ফোনও ধরতাছে না! পাথর দিল মহিলা একটা!”
রাজিয়ার কথার বিপরীতে পাখি কিছু বললো না। রাজিয়া আরও বলতে লাগলো,
-“ফিহা আপা তো কইছিলো আজকে তাড়াতাড়ি আইবো! আমার বান্ধবীর বিয়া। কই সাজুম আমি!”
-“রাজিয়া এক কাপ কফি করে আমার ঘরে এসো।”
আইজার ঠান্ডা কন্ঠ শুনে কিঞ্চিত লাফিয়ে উঠলো রাজিয়া। হয়তো এসময় আইজাকে এখানে আশা করেনি। পাখি কাজ আছে বলে রান্নাঘর থেকে চলে গেলো। আইজাও রাজিয়ার দিকে না তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো।
কিছু সময় পর রাজিয়া কফির কাপ নিয়ে দরজার বাইরে থেকেই আইজাকে ডাকতে শুরু করলো। অবাক হলো না আইজা। সচরাচর কাউকে ও নিজের ঘরে আসতে দেয় না। তবে আজ রাজিয়াকে নিজের থেকে টেনে এনে ওর হাতে থাকা কফির কাপ টা রেখে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনের টুলটাতে বসিয়ে দিলো আইজা। বক্র হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলে উঠলো,
-“তোমাকে আজ আমি সাজিয়ে দিচ্ছি।”
***
বেশ কিছুক্ষণ পর আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে রাজিয়ার চাহনিতে এক রাশ বিস্ময় ফুটে উঠলো। সাথে সন্তুষ্টিও। আইজা রাজিয়ার কোমর সমান লম্বা চুল গুলোতে আলতো হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠলো,
-“জানো রাজিয়া, এই মেক-আপ প্রোডাক্টস কিন্তু সম্পূর্ণ ওয়াটার প্রুফ।”
রাজিয়া প্রশ্নবোধক চাহনিতে আয়নায় ফুটে ওঠা আইজার প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো। হয়তো আইজার কথার মানে বুঝে উঠেনি বলে। আইজা উচ্চস্বরে হেসে বললো,
-“মানে এখন তুমি যতই কাঁদো না কেন, তোমার সাজ নষ্ট হবে না।”
সাথে সাথে রাজিয়ার মাথায় বিচরণ করতে থাকা আইজার হাতের বাঁধন শক্ত হয়ে উঠলো। কিঞ্চিত আর্তনাদ করে উঠলো রাজিয়া। আইজার হাত থেকে নিজের মাথার চুলগুলো ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে ও। কিন্তু বেশিক্ষণ তা পারলো না।নিজের ঠোঁটের ওপর ধারালো ছু*রির অবস্থান টের পেয়ে ছটফট করা বন্ধ করে দিলো সে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে।
-“লিপস্টিক টা বেশ দামী। আমি এটা খারাপ করতে চাই না। আমি শুধু চাই এই পর্যন্ত আমার অগোচরে যা যা বলেছো আজ এই মুহুর্তে সেগুলো তুমি আমার সামনে বলবে। আমার চোখে চোখ রেখে।”
রাজিয়ার চোখ সেই ধারালো ছু*রির দিকেই আঁটকে আছে। আইজা নিজের হাতে থাকা ছু*রিটা কিছুটা আলগা করতেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো রাজিয়া। কম্পিত কন্ঠে বলে উঠলো,
-“এ..এগুলা কী করতাছেন ভাবি! আমি আপনার কী ক্ষতি করছি!”
-“তুমি তো অনেক বিচক্ষণ! দুনিয়া অনেক দেখেছো! এই কয়েক মাসে আমাকে নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি করে ফেলেছো! শুধু আমি কেন, আমার পরিবার নিয়েও তোমার ধারণার অন্ত হচ্ছে না। এখন কিছু বলছো না কেন! তোমার না অনেক সাহস! বলো..!”
শেষের কথাটা আইজা চিৎকার করে বলে ওঠায় কুঁকড়ে উঠলো রাজিয়া। টুল থেকে উঠার চেষ্টা করতেই আবারও ওর চুলের মুঠি টেনে ধরলো আইজা। ছু*রিটা আরো একবার রাজিয়ার ঠোঁটে গিয়ে ঠেকলো। মেয়েটার চোখ গুলো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে।
-“যতক্ষণ না মুখ খুলবে তোমাকে ছাড়ছি না। কী যেন বলছিলে কিছুক্ষণ আগে…!”
আইজার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে নিজের চোখগুলো সরিয়ে নিলো রাজিয়া। ছু*রিটা এবার বেশ জোরেই চেপে ধরেছে আইজা।
-“তুমি কী চাও, তোমার ঠোঁট জোড়া কেটে টুকরো টুকরো করি আমি! নইলে চুপ থেকো না। আমি সবটা প্রথম থেকে শুনতে চাই!”
-“কী হচ্ছে এসব!!”
হঠাৎ সীমান্তর কন্ঠ শুনে দরজার দিকে চোখ গেলো আইজার। সীমান্ত এসেই রাজিয়াকে আইজার থেকে টেনে সরিয়ে দিলো। সুযোগ পেয়ে রাজিয়া সাথে সাথে দৌড়ে রুম থেকে চলে গেলো। আইজা রাজিয়ার পেছনে যেতে চাইলে সীমান্ত ওর হাত শক্ত করে চেপে ধরে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আগে তো বাচ্চামো ছিলো, এখন কি বাড়িতে গু*ন্ডামী করে বেড়াবেন!!”
সীমান্তর কথা শুনে বিরক্তি সহকারে নিজের চোখ জোড়া ঘুরিয়ে নিলো আইজা। ব্যঙ্গাত্বক কন্ঠে বললো,
-“তো এখন সীমান্ত সাহেব আমাকে গু*ন্ডামী না করার পরামর্শ দিতে যাবেন! বেশ চমৎকার তো!”
-“আপনি আজ রায়হানকে কী বলেছেন?”
আইজার ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। চোখে কৌতুহলী ভঙ্গি এনে বলে উঠলো,
-“আপনি জানেন না! আমি তো মনে করেছিলাম সমস্ত ঘর জুড়ে আপনি আপনার মূল্যবান চশমা সেট করে রেখেছেন!”
আইজার কথা শুনে নিজের মাথার চুল নিজেই টেনে ধরলো সীমান্ত। কন্ঠে অধৈর্য্যের রেশ নিয়ে বলে উঠলো,
-“ভণিতা করবেন না। সোজা প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব দিন।”
-“স্পষ্ট জবাব! সেটা আবার কী! আজ প্রথম এই দুটো শব্দের নাম জানলাম!”
মুহুর্তেই আইজার গাল শক্ত করে চেপে ধরলো সীমান্ত। আইজার মনে হচ্ছে গালের মাংস এখনই গলে পড়বে। তবুও নিজের চাহনিতে সেটা প্রকাশ করলো না ও। সীমান্ত ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আমাকে রাগাতে যাবেন না। এর ফল কিন্তু আপনি সহ্য করতে পারবেন না! ভুলে যাবেন না, আপনার দু’জন প্রিয় মানুষ কিন্তু আমার কাছে ব*ন্দী!”
এটুকু বলেই আইজার গাল ছেড়ে দিলো সীমান্ত। আইজা একবার নিজের গাল বুলিয়ে হাতে থাকা ছু*রিটা নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে এগিয়ে গেলো। সীমান্তর চোখের নিচে আলতোভাবে ছু*রিটা স্লাইড করতে শুরু করলো ও। আইজার এ কাজে কোন বাঁধা দিচ্ছে না সীমান্ত। নিরব হয়ে আইজাকে দেখে যাচ্ছে শুধু। একপর্যায়ে আইজা সীমান্তর দিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে শীতল কণ্ঠে বলে উঠলো,
-“আমি চাইলেও সেটা ভুলতে পারবো না সীমান্ত!”
চলবে…
( আইজা আর সীমান্ত এই গল্পের মূল চরিত্র। এই চরিত্র দুটোকে আমি নায়ক নায়িকা বলবো না। গল্পের নামে প্রেয়সীর আগে অপ্রিয় একটা কারণেই দেয়া আছে। এই গল্পে কোন নায়ক নায়িকা নেই। হয়তো শেষের দিকে ওদের চরিত্রে পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু এখন ওদের চরিত্রতে নেগেটিভ দিকটাই বেশি। ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পের ব্যপারে ভুলগুলো ধরিয়ে দিলে খুশি হবো। পরীক্ষার জন্য গল্প পোস্ট করতে একটু লেট হচ্ছে।)