#অপ্রিয়_প্রেয়সীপর্ব- ২৯
#লিখা_তানজিলা
ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও আইজার পা যেন নড়তে চাইছে না। ওকে একপ্রকার টেনে হিঁচড়েই সে জায়গা থেকে সরানো হলো। জামিল ওকে করিডোরের একপাশে দাঁড় করিয়ে কপাল কুঁচকে বললো,
-“ওখানে কিসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলে! সীমান্ত তোমাদের হাতের নাগালে গেলে কী হবে জানো!”
আইজার যেন এখন টনক নড়লো। জামিলের দিকে কিঞ্চিত সতর্ক ভঙ্গিতে তাকালো ও। জোড়ালো কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আমি তো আপনাকে এ পর্যন্ত কিছুই বলিনি! আপনি এসব..!”
-“আগে ওপরে চলো। বাকি কথা ওখানেই হবে।”
মাঝপথেই আইজার কথা থামিয়ে দিলো জামিল। দোতলার ফ্ল্যাটে গিয়েই ক্ষান্ত হলো ওরা।
রুমে এসেই আইজা একবার জানালার ফাঁকে নিচে তাকালো। বাতাসে জানালার দুলতে থাকা পর্দা বারবার আইজার মুখে দিয়ে লাগছিলো। চোখ মুখ কুঁচকে সেটি শক্ত হাতে চেপে ধরলো ও। নিচে সীমান্ত ক্রমাগত নিজের চোখে পানি দিয়ে যাচ্ছে। আর তাকে সাহায্য করছে রিয়াদ।
চারদিকে একবার মনোযোগ সহকারে চোখ বুলিয়ে নিলো আইজা। যেমনটা ধারণা করেছিলো, সীমান্ত তার দলবল নিয়েই এসেছে এখানে! ক্লিনিকের দুই পাশেই কয়েক জন দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ জানালার পর্দা পাইপ সহ নিচে পড়তেই লাফিয়ে উঠলো আইজা। পা জোড়া দ্রুত গতিতে পিছিয়ে গেলো! জামিল আর আরফান ভ্রু কুঁচকে ওকে দেখে যাচ্ছে। আইজা একবার নিচে পড়ে থাকা পাইপসহ পর্দায় চোখ রেখে ঠোঁট ফুলালো। এতোটাও শক্তি যে ওর গায়ে আছে আগে জানা ছিলো না!
-“এতো কষ্ট করার কী দরকার। চিৎকার করে জানিয়ে দে সীমান্তকে, যে তার বউ এখানে অধীর আগ্রহে তার জন্য অপেক্ষা করছে!”
দাঁতে দাঁত চেপে বললো আরফান। আইজা বুকে দুই হাত ভাজ করে নিজের চোখ জোড়া অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলো। শক্ত গলায় বললো,
-“চিন্তা করিস না! তোদের এ জায়গা থেকে ও জোর করে নিয়ে যেতে পারবে না।”
আইজার কথা শুনে যেন আরফান আরো চটে গেলো। নিজের মাথার চুল টেনে ধরে বললো,
-“কিন্তু তোকে ঠিকই নিয়ে যেতে পারবে! ভয় লাগছে না তোর!”
হুরমুরিয়ে আরফানের দিকে কিছুটা এগিয়ে এলো আইজা।
-“তোর কী মনে হয়, আমি সীমান্তর ভয়ে এখানে লুকিয়ে আছি! না! আমি এসব তোদের কথা ভেবে করেছি! সীমান্তকে ভয় পাবো, আমি!! ভাবতেই হাসি পাচ্ছে আমার!”
আরফান দুই ভ্রু উঁচু করে বললো,
-“তো এখানে কী করছিস! নিচে যা। সীমান্তর সামনে দাঁড়িয়ে বল তুই ওর সাথে ফেরত যেতে চাস না! ব্যস, প্রবলেম সল্ভ! আমাদের আর পালিয়ে বেড়াতে হবে না!”
-“ঝগড়া শেষ হলে এদিকে এসে উদ্ধার করো আমাকে!”
জামিলের ক্লান্ত কন্ঠ ভেসে এলো অন্য রুম থেকে। আইজা আর আরফান গোমরা মুখ নিয়ে ওদিকে গিয়ে দেখলো জামিল ঘুমন্ত সিমিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক তখনই রুমে ইনসিয়া এসে আইজার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো,
-তুমি কী পাগল! ওদের চোখ নষ্টও হতে পারতো! এক ঝামেলার ওপর আরেক ঝামেলা এসে জুটতো তখন!!”
আইজা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
-“অন্তত তারা এখন বুঝতে পারবে, রিসোর্টের চেয়ে ক্লিনিকের প্রয়োজনীয়তা বেশি। আর আমাদের এখানে আপনার হাসবেন্ড নিয়ে এসেছে!”
-“একদম চুপ!!!”
জামিলের উচ্চস্বরের ধমকে রুমে এই মুহুর্তে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। কারও মুখে কথা নেই। সবাই চুপচাপ হয়ে রইলেও আইজার দ্বারা তা বেশিক্ষণ সম্ভব হলো না। সে জোড়ালো গলায় বলে উঠলো,
-“সীমান্ত এখানে একা আসেনি। নিজের দলবল নিয়ে এসেছে। এ জায়গা থেকে বের হওয়া এখন সহজ হবে না! আমি জানতাম সীমান্ত প্রথমে আপনার খোঁজই করবে। তাই এখানে থাকতে চাইনি। কিন্তু আপনি…!”
-“কেউ কোথাও যাবে না।”
জামিলের কথায় কিছুটা বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালো আইজা। আরফানেরও একই অবস্থা। সিমির ঘুম ইতিমধ্যে ভেঙে চৌচির। সে ভ্রু কুঁচকে জামিলের দিকে তাকিয়ে আছে। জামিল সিমিকে নামিয়ে সে ঘরের দেয়ালে এটাচ করা আলমারির দরজা খুলে ফেললো।
আলমারিতে রাখা কাপড়চোপড়ের পেছনে থাকা কার্ডবোর্ড সরাতেই পার্সওয়ার্ড দেয়া একটা দরজা সামনে পড়লো। জামিল পার্সওয়ার্ড এন্ট্রি করতেই খুলে গেলো সে দরজা। জামিল তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,
-“তোমরা দ্রুত ভেতরে যাও। যদিও সীমান্তকে এ পর্যন্ত আসতে দেয়া হবে না। তাও সেফটির জন্য।”
আইজার চোখে কিঞ্চিত বিস্ময়। তবে বেশি সময় নষ্ট করলো না ও। আরফান আর সিমিকে ভেতরে পাঠিয়ে কিঞ্চিত সন্দেহের ভঙ্গিতে বললো,
-“আপনি সীমান্তর ব্যপারে কিছু জানেন, তাই না!”
-“ইনসিয়া ওদের সামলিও। আমি সীমান্তর সাথে কথা বলে আসছি!”
আইজাকে কথাকে উপেক্ষা করেই নিজের স্ত্রীকে বললো জামিল।
তার বলার ধরণ কেন যেন ভালো লাগলো না আইজার। তখনই ভেতর থেকে সিমির কান্নার আওয়াজে টনক নড়লো ওর। দ্রুত গতিতে ভেতরে গিয়ে সামনের দৃশ্য চোখে পড়তেই পা জোড়া আচমকা থেমে গেলো। বেডে প্রায় নিথর অবস্থায় পড়ে আছে আরমান আজাদ। এতোদিন পর নিজের পাপাকে স্বচক্ষে দেখছে আইজা। তাও এই অবস্থায়!
****
-“আইজা তোমার সাথে যেতে চায় না!”
জামিল মাহমুদের ঠিক সামনে প্রায় অস্তমিত চোখজোড়া নিয়ে বসে আছে সীমান্ত। মুখে এখনো যন্ত্রনার ছাপ। তবুও জোরপূর্বক শক্ত গলায় বললো,
-“আপনাকে কে বলেছে আমি আইজাকে নিয়ে যেতে এসেছি!”
সীমান্তর কথায় নড়েচড়ে বসলো জামিল। বেশ সতর্কতার সহিত সীমান্তর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে ও।
-“তো কেন এসেছো?”
নিভু নিভু চোখেই মৃদু হাসলো সীমান্ত। ঠান্ডা গলায় বললো,
-“আপনি তো জানেনই, বিয়ের পর স্ত্রীকে ছেড়ে থাকতে কতটা কষ্ট হয়। তার ওপর আপনার ভাগ্নি যেভাবে এলো! একবার কথা না বলে আমি যাবো না!”
পাশে বসে থাকা রিয়াদ নামক ব্যাক্তি পানি খেতে খেতে বিষম খাওয়ায় সবার চোখ ওদিকে গিয়ে ঠেকলো। জামিল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-“আইজা তোমার সাথে এখন কোন কথা বলতে চায় না। তুমি বরং পরে এসো!”
-“এখন আমি আপনার কথা অনুযায়ী আইজার সাথে যোগাযোগ রাখবো না-কি! ভুলে যাবেন না, ও কিন্তু আমার স্ত্রী। আমার ইচ্ছে হলে ওকে আমি তুলে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু এই মুহুর্তে সিনক্রিয়েট করার উদ্দেশ্য নিয়ে আমি আসিনি।”
সীমান্তর কন্ঠে স্পষ্ট হুমকির রেশ। রুম জুড়ে বিরাজ করছে ভয়ংকর নিরবতা। কেউ যেন হার মানার মধ্যে নেই।
-“আমি আর দুই ঘন্টা অপেক্ষা করবো এখানে। এর মধ্যে যদি আইজা নিজ থেকে সামনে না আসে তাহলে এই ক্লিনিক আজকের মধ্যে বন্ধ করা হবে! আর আমি কিন্তু মজা করছি না মামা শ্বশুর!”
সীমান্তর কন্ঠে কঠোর শীতলতা। চোখ জোড়া যেন ক্রমশ ঘোলাটে বর্ণ ধারণ করছে।
সাথে সাথেই সীমান্তর কলার চেপে ধরলো জামিল। আঁখিযুগল আগ্নেয়গিরির মতো জ্বল জ্বল করছে তার।
-“তুই কিন্তু নিজের সীমা অতিক্রম করছিস!”
রিয়াদ কিছু করতে গেলেই তাকে থামিয়ে দিলো সীমান্ত। ব্যঙ্গার্ত্বক গলায় বললো,
-“আর মাত্র দুই ঘন্টা! আপনি যদি থানা পুলিশ করতে চান করুন। আমার তাতে কোন আপত্তি নেই! তবে আমার গায়ে কোন আঁচড় পড়লে আপনার সাসপেন্সনের মেয়াদও কিন্তু বাড়বে! অথবা চাকরিটা যাবে!”
ক্ষুব্ধ নিশ্বাস ছেড়ে সীমান্তর কলার ছেড়ে দিলো জামিল। কঠোর মুখভঙ্গিতে বলে উঠলো,
-“বড়লোক বাড়ির ছেলেদের এই এক সমস্যা। একটু টাকা হলেই চাপার জোর বেড়ে যায়!”
জামিল মাহমুদের কথা কানে যেতেই না হেসে পারলো না সীমান্ত। তাও যেই সেই হাসি না। এ হাসিটা আইজার সবচেয়ে অপ্রিয়। সীমান্তর ব্যঙ্গার্ত্বক হাসির বিপরীতে আইজার মুখে লেপ্টে থাকা তীব্র রক্তিম আভার অস্তিত্ব মস্তিষ্কে ভেসে উঠতেই সীমান্তর ঠোঁটে লেগে থাকা হাসি যেন আরও প্রশমিত হয়ে উঠলো। কতটা বিভ্রান্তিকর!
এরকম সময়ও তার বিরক্তিকর মুখটা সামনে চলে আসছে!
জামিল মাহমুদও হয়তো সীমান্তর হাবভাবে ভিষণ বাজে ভাবে ক্রোধিত হচ্ছে। সময় নষ্ট করলো না সীমান্ত। ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
-“এখানে টাকার কোন ভূমিকা নেই। সুযোগ তো আপনি নিজেই আমাকে করে দিয়েছেন।”
-“কী বলতে চাস তুই?”
জামিল মাহমুদের কর্কশ গলায় করা প্রশ্নে সীমান্ত কৃত্রিম ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকালো।
-“আমি আপনার সাথে এতো ভদ্র ভাবে কথা বলছি আর আপনি কি-না তুইতোকারি করছেন! আপনাদের এখানে বুঝি এভাবেই জামাইআদর হয়!”
সীমান্তর প্রতিটা কথায় জামিল মাহমুদের চাহনি ধীরে ধীরে অধৈর্য্যের দিকে এগোচ্ছে। যদিও জামিলের কিছু বলার অপেক্ষা করলো না সীমান্ত। চেয়ারে গা ঠেকিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসলো সে।
-“একজন আসামিকে এখানে লুকিয়ে রাখার মানে বোঝেন!”
চলবে…