#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৩৬

0
737

#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৩৬
#লিখা_তানজিলা

-“এমনি এমনি তো আর এতোগুলা টাকা আমাকে দিচ্ছেন না! আপনার মতলবটা কী!”

সাহিলের কন্ঠস্বরে ক্রমশ অধৈর্য্যের মান বেড়ে চলছে। যদিও সীমান্ত ওর এ অনবরত বকবকানির বিপরীতে টু শব্দটি করারও যেন প্রয়োজনবোধ করছে না। মনে হচ্ছে পুরো ফ্ল্যাটটা এই মুহুর্তে সীমান্তর কাছে একটা পর্যটক কেন্দ্র। শুধু ঘুরছে আর নিজের ফোনে কী যেন চেক করছে!

-“এই পাশের রুমের চাবিটা দিন তো!”

সীমান্তর অযাচিত আদেশে যেন এবার ধৈর্যের বাঁধ ভে*ঙে চৌচির হয়ে গেলো সাহিলের। ক্ষুব্ধ গলায় সীমান্তর সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,
-“কী শুরু করলেন আপনি! আবারও আমাকে হাসপাতালে পাঠানোর ধান্ধা করছেন না তো! প্রথমে জাফর শিকদার আর এখন আপনি! বললাম তো আমার কাছে কোন ভিডিও নেই! আমাকে কোটি কোটি টাকা দিন বা গলায় পারা দিয়ে ধরুন, কোন লাভ হবে না! যেটা আমার কাছে নেই সেটা আমি আপনাকে কী করে এনে দেই!!!”

সাহিলের অবস্থা বেশ বেগতিক। এতোগুলা কথা এক নিশ্বাসে বলে এখন হাঁপাচ্ছে সে। তবে সীমান্তর চোখ এখন আর ফোনে আটকে নেই। কুঁচকে আসা ভ্রু জোড়া সাহিলের দিকে নিবন্ধ।
-“কিসের ভিডিও!”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সাহিল। চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
-“সেটা আমি কী করে বললো! আগেও বলেছি এখনো বলছি, আমার কাছে আপনাদের কু*কর্মের কোন ভিডিও নেই! আর এখানকার সাইবার ক্যাফেতে পুরো শহরের মানুষ আসে। শুধু আমাকেই কেন জে*রা করা হচ্ছে!!”

ক্ষীপ্র গতিতে পকেট থেকে একটা ফোল্ডিং চা*কু বের করে সাহিলের গলার একদম মাঝ বরাবর চেপে ধরলো সীমান্ত। ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো,
-“স্পষ্ট করে বলুন। কিসের ভিডিওর কথা বলছেন আপনি!”

-“বললাম তো জানিনা। আপনার আঙ্কেলকেই জিজ্ঞেস করুন না! কে না কে তাকে ব্ল্যা*কমেইল করছে আর ব্যাটা আমাকে জ্বা*লাচ্ছে!”

সাহিলের কথায় ধীর গতিতে ওর গলা থেকে চা*কু সরিয়ে নিলো সীমান্ত। সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন মুখভঙ্গি নিয়ে পুনরায় সোফায় বসে পড়লো ও। জাফর শিকদারের আজ দেশে আসার কথা ছিলো জানতো। কিন্তু সাহিলের কথা শুনে মনে হচ্ছে লোকটা আগেই এসে হাজির হয়েছে! হয়তো সীমান্তর বাবা জানতো।

মাথায় দুই সাইড প্রচন্ড বাজে রকমের ব্যথায় চিনচিন করে যাচ্ছে। এতো জায়গার খোঁজ রাখা তো আর সম্ভব না! আইজাকে বারবার বলেছে হুট করে যেখানে সেখানে একা না যেতে! কিন্তু না, ম্যাডাম তো নিজের মর্জি অনুযায়ী যাবে। একবার হাতের নাগালে পেলে….!

সব পরিস্থিতিতে নিজেকে ঠান্ডা রাখার অভ্যেসটা ও বেশ ছোটবেলা থেকেই নিজের মধ্যে গড়ে তুলেছে। কারণ অশান্ত মনকে বিভ্রান্ত করা সবচেয়ে সহজ! কিন্তু আজ যেন আর পারছে না সে শান্ত হতে। আইজারও কী এমন মনে হয়েছিলো এতোদিন! চারিদিকে ঘটে যাওয়া কোন কিছুরই হিসেব বুঝতে না পারা অথবা সবকিছুই অচেনা মনে হওয়া!

নিজের ফোনের স্ক্রীনে ভেসে থাকা লোকেশন বেশ মনোযোগ সহকারে দেখে যাচ্ছে সীমান্ত। আইজা ওর খুব কাছে। কিন্তু তাও সে নাগালে নেই।
বিল্ডিংটা একটা জোড়া বিল্ডিং। দৃষ্টি অনুযায়ী দুটো জোড়া বিল্ডিংএর মাঝ বরাবর প্রশস্ত জায়গা দেয়াল। আর আইজার লোকেশন ঐ মাঝের দেয়াল দ্বারা আবৃত স্থানেই শো করছে! আজ এম্বুলেন্সে ঠিক দুটো ট্র্যাকার লাগিয়েছিলো সীমান্ত। একটা গাড়ির নিচে আরেকটা ড্রাইভিং সীটের পেছনে। সীমান্ত যে আইজার ওপর কড়া নজর রাখছে সেটা আইজাকে বোঝাতেই এটা করেছিলো ও। তবে পরিস্থিতি যে ভিন্ন হয়ে যাবে সেটা কল্পনাও করেনি সীমান্ত।

আইজা হয়তো ট্র্যাকারটা নিজের কাছে রেখেছে। ঐ ট্র্যাকারের লোকেশন প্রথম দিকে চেকও করেনি সীমান্ত। পরে যখন মাথায় এলো একটা ট্র্যাকার মিসিং ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। তবে এটার দ্বারা আইজা পর্যন্ত পৌঁছানো গেলেও যে ওকে সুরক্ষিত অবস্থায় ফেরত আনা যাবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। আরো বড় কিছু ভাবতে হবে সীমান্তকে।
-“ঐ ঘরের চাবিটা দিন আমাকে! জাফর শিকদারের ব্যপারে পরে কথা হবে!”
কিছুটা হুংকার কন্ঠে বলে উঠলো সীমান্ত।

-“চাবি নেই! ঐ রুম আমার না! আমি কিচ্ছু জানি না!”
গড়গড় করে বললো সাহিল।

-“আপনি এখানে থাকেন মাসখানেক হয়েছে সাহিল সাহেব। আর আপনার কোন ধারণাই নেই ঐ রুম সম্পর্কে! এটা বিশ্বাস করতে বলছেন আমাকে!”
সাহিলের দিকে অনেকটা তেড়ে এগিয়ে গেলো সীমান্ত। তার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিলো।

-“এসব কী করছেন! আমার ফোন ফেরত দিন!”

-“আইজার সাথে শেষ কবে দেখা হয়েছিলো আপনার?”

সীমান্তর প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে তাকালো সাহিল। কর্কশ গলায় বললো,
-“যেদিন ঐ বিষধর সাপ…!”
সীমান্তর রক্তলাল চোখমুখ দেখে নিজের কথা মাঝপথেই থামিয়ে দিলো সাহিল। পরক্ষনেই দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
-“যেদিন আমাকে অফিস থেকে বের করে দেয়া হয়েছিলো।”

-“এরপর আর ওকে দেখেননি?”

-“কেন বলুন তো! আপনার বৌ পালিয়েছে না-কি! ঐ মেয়েকে বিয়ে করতে গিয়ে আমাকে হেনস্তা করেছেন বাপ ব্যাটা মিলে। এখন পালানোর পরও কী আমাকেই দোষারোপ করবেন!”

সাহিলের ব্যঙ্গাত্বক হাসির শব্দে ঠান্ডা চোখে তাকালো সীমান্ত। সাহিলের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে একটু টোকা দিলেই জান বেড়িয়ে যাবে তার! এজন্যই কিছু করছে না। নইলে এতোক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা হতো না তার! হাত দুটো জোরালো ভাবে মুঠ করলো ও। সাহিলের দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সজোরে ঐ বন্ধ ঘরের দরজায় একের পর লাথি মারতে শুরু করলো সীমান্ত। যেন ভেতরে থাকা সমস্ত ক্ষোভ আজ এই দরজার ওপরই যাবে!

দরজা ভেঙেই ক্ষান্ত হলো সে। ঘন ঘন নিশ্বাস ছেড়ে সাহিলকে উপেক্ষা করে সে রুমে ঢুকে পড়লো সীমান্ত। সাথে সাথেই নাকে মুখে এসে লাগলো ধুলোবালির আক্রমণ। ফুসফুস যেন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। অথচ এ রুমে কিছুই নেই। সম্পূর্ণ খালি। সাহিলের কথা অনুযায়ী এখানে কারো জিনিসপত্র দূরে থাক, একটা সুতোও নেই। অবাক হলো না সীমান্ত। মৃদু হাসলো শুধু।

-“ডাকাত কোথাকার! আমি এক্ষুনি পুলিশে খবর করবো!”

সাহিলের কথায় সীমান্তর মুখভঙ্গিতে কোন পরিবর্তন হলো না। উল্টো হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠে বলে উঠলো,
-“অবশ্যই ফোন করবেন। তার আগে ফলো মি।”

সাহিলের ফোন নিয়ে সোজা বিল্ডিংএর বাইরে বেরিয়ে এলো সীমান্ত। সাহিল পিছু পিছু এলে তার সামনে ফোন তুলে ধরলো। সাহিলের মুখে সন্দেহের রেশ। তবুও নিঃশব্দে ফোনের দিকে এগিয়ে এলো সে।

-“আপনি কিন্তু আরো একটা স*ন্ত্রাসী দল থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন ! এ বাড়ির মালিকের সাথে ঐ দলের একটা যোগসূত্রতা আছে।”

-“কী বলতে চাচ্ছেন আপনি! সোজা ভাষায় বলুন!”
সাহিলের কন্ঠে কৌতুহলের রেশ।

-“আপনি কাল আমার একটা কাজ করবেন।”

-“কী কাজ?”
সাহিলের প্রশ্নে সীমান্তর মুখে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠলো। তবে কোন জবাব দিলো না। আশেপাশে অজস্র কান আছে। ফাহাদ খান চেয়েছিলো সাহিলকে ব্যবহার করে ওকে বিভ্রান্ত করতে। বেশ! যে খেলা সে শুরু করেছে তার সমাপ্তি সীমান্ত করবে সেটাও আবার সাহিলের মাধ্যমেই!

****

-“আমি তোমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি। যদি আমার ভরসা জেতো তাহলে জাফর শিকদারের বিরুদ্ধে যে প্রমান আমার কাছে মজুদ আগে সেটা তোমাকে দেয়া হবে।”
একটু সতর্ক হয়ে বসলো আইজা। ফাহাদের কঠোর মুখভঙ্গিতে কোন রসিকতার রেশ নেই। মনের এক প্রান্তে খানিকটা ভয়ের রেখা ফুটে উঠলো। তবুও আইজা নিজেকে শান্ত রেখে প্রশ্ন করে বসলো,
-“কিভাবে?”

আইজার প্রশ্নে তার ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা বাঁকা হাসির উজ্জ্বলতা যেন পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে গেলো।
-“সীমান্ত অলরেডি এ পর্যন্ত চলে এসেছে। এখানেও হয়তো চলে আসবে।” এ কথা বলতেই লোকটার চোখের ধরণ মুহূর্তেই পাল্টে গেলো। ক্রমশ সে আঁখি জোড়ায় হিং*স্রতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ফাহাদ শক্ত কণ্ঠে আইজাকে প্রশ্ন করলো,
-“তুমি ব*ন্দুক চালাতে পারো?”

এমন ভয়ংকর প্রশ্নে কিঞ্চিত কেঁপে উঠলো আইজা। দ্রুতগতিতে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। জিজ্ঞেস করলো,
-“কেন?”

-“নো প্রবলেম। আসিফ তোমাকে সাহায্য করবে।”
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই লম্বা লোকটাকে ইশারা করলো ফাহাদ। আসিফ নামটা শুনতেই আইজার এক ভ্রু উঁচু হয়ে এলো। কিন্তু কিছু বললো না।

বুকের ওড়নাটা ঠিক করে নিলো ও। এম্বুলেন্সে উঠতেই ওর চোখ প্রথমে ড্রাইভিং সীটের পেছনের সাইডে পড়েছিলো। ছোটখাটো একটা ফুলের স্টিকার লাগানো ছিলো সেখানে। যেন তেন স্টিকার ছিলো না সেটা। সীমান্তর দেয়া ব্যাগেও একই স্টিকার লাগানো ছিলো। চিনতে সময় লাগেনি আইজার।

হাত দুটো সামনের দিকে বাঁধা ছিলো বলে কোনমতে সেই স্টিকার নিয়ে ড্রেসের কলার ডিজাইনের ভেতরের দিকে আটকে রেখেছে ও। সীমান্ত হয়তো সেটা ট্র্যাক করে এখানে এসেছে। তবে ফাহাদের চাহনি দেখে মনে হচ্ছে এই লোক আগাম অনেক কিছুই পরিকল্পনা করে রেখেছে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here