#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৪২

0
799

#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৪২
#লিখা_তানজিলা

শোরগোলের আওয়াজ কান অব্দি পৌঁছোতেই টনক নড়লো সীমান্তর। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ জোড়া বন্ধ করে পরক্ষণেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো ও। সাইরেনের শব্দে কান বেজে উঠছে! সীমান্ত
আইজার হাত ধরে সিঁড়ির নিম্নাংশ পর্যন্ত এগিয়ে গেলো। মস্তিষ্ক জুড়ে তার মুখনিঃসৃত প্রত্যেকটা বাক্যের বিচরণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলেও সীমান্ত আইজার সামনে সেটা এখনই প্রকাশ করতে চায় না।

হঠাৎ ব*বন্দুকধারী একজন এগিয়ে আসতেই টর্চ অফ করে দেয়ালের এক ভাজে লুকিয়ে পড়লো ওরা। আইজা নিঃশব্দে সীমান্তর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সে হয়তো পালানোর পথ খুঁজছে।

-“এখানেই থাকুন!”
আইজাকে উদ্দেশ্য করে বললো সীমান্ত। কিন্তু তার পক্ষ থেকে শুধু নিরবতা ছাড়া আর কিছু পেলো না ও।
-“প্লিজ, এবার অন্তত কোথাও চলে যাবেন না। একবার এখান থেকে বের হতে পারলে যত খুশি রাগ দেখান, আমি কিছু বলবো না। কিন্তু এখন না..!”

পূর্বের ন্যায় এখনও নিস্তব্ধতা। সীমান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে স্থান থেকে বেড়িয়ে এলো। লোকটার পড়নে কোন আলাদা কস্টিউম নেই। শুধুমাত্র মুখে পার্টি মাস্ক। সে ক্লাবের কোন মেম্বার হবে হয়তো! নইলে একা একা এদিকে আসতো না। লোকটা সীমান্তকে নিজের পেছনে টের পেতেই সীমান্ত সাথে সাথে তার ঘাড় বরাবর আ*ঘাত করে বসলো।

জ্ঞানহীন লোকটার পরিহিত বস্ত্র হাতড়ে সেই ব*ন্দুকটি সহ আরেকটি কাঙ্ক্ষিত বস্তু বের করে নিলো ও। সাহিলের কাছ থেকে জেনেছিলো ক্লাবে আসা প্রত্যেক মেম্বারদের কাছেই একটা ইমারজেন্সি কার্ড থাকে যা ক্লাবে কর্মরত ব্যাক্তিদের কাছে নেই৷ এটি মূলত কোন ইমারজেন্সি পরিস্থিতির জন্য। এই মুহুর্তে ক্লাবের মেম্বারদের ভিরে বেরিয়ে যাওয়াই একমাত্র পথ। নইলে ক্লাব কর্মচারীরা সীমান্ত আর আইজাকে মুহূর্তেই চিনে ফেলবে!

বেশ কিছু পদধ্বনি ভেসে আসছে। অর্থাৎ এদিকে নিশ্চয়ই বের হওয়ার পথ আছে যেটা শুধুমাত্র ক্লাব মেম্বারদের জন্য। আইজাও হয়তো এ কারণেই ওকে এ পর্যন্ত এনেছিলো। কারণ এদিকটায় ক্লাব মেম্বাররাই বেশি আসে কর্মচারীরা না!

লোকটার দেহ একদিকে চাপিয়ে রাখলো সীমান্ত। আরো বেশ কিছু ব্যাক্তি এসে ওকে উপেক্ষা করেই হলের শেষ প্রান্তে ছুটে যাচ্ছে।
সীমান্ত কার্ডটা জ্যাকেটের মাঝে রেখে আইজাকে যেখানে রেখে এসেছিলো সেদিকে পা বাড়ালো। মনে হচ্ছে একটু পর ভীর আরো বাড়বে। এখনি বের হতে হবে ওদের!

তবে মানুষ যা চায় তাতো সবসময় তার মনমতো হয় না। আইজাকে শেষবার যেখানে রেখে এসেছিলো সে স্থান পুরো খালি। যেন কোন মানবীর উপস্থিতি ছিলোই না সেদিকে। টর্চের আলোয় পুরো জায়গা ছান মারলো ও। ফলাফল শূন্য। মেয়েটার ফ্যাকাশে চাহনি চোখের সামনে ভাসছে প্রতিনিয়ত। কতবার বারণ করলো কোথাও না যেতে। হৃদয় কোণে বেড়ে ওঠা ক্রোধ যেন পাহাড়সম ভয়কে দমাতে চাইছে। তবে সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ। মূল্যবান কোন কিছু হারানোর ভয়টা যে প্রচন্ড ভয়ানক। ব*ন্দুকটা এক হাতে সতর্ক ভঙ্গিতে নিলো সে।

-“স্যার..!”

***

সেই জোড়া বিল্ডিংএর সামনে পুলিশের ঢল। পুলিশের গাড়ির ঠিক পেছনে আরো দুটো গাড়ি। তার মধ্যে একটি নাজিম শিকদারের। সে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েছে ইতোমধ্যে। পেছন পেছন আসা রিয়াদের দিকে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করলো নাজিম। কর্কশ গলায় বলে উঠলো,

-“যদি সীমান্তর গায়ে একটা আঁচও লাগে তোকে সবার আগে মাটিতে মিশিয়ে ফেলবো! তুই আমার ছেলের মাথা বিগড়ে দিয়েছিস!!”

চুপচাপ দাড়িয়ে আছে রিয়াদ। সেই মুহূর্তে ওদের পিছু নেয়া গাড়িটা যে নাজিমের ছিলো সেটা প্রথমেই বুঝে উঠতে পারেনি ও। কি করে বুঝবে! ব্যাটা কয়েক দিন পর পর নতুন গাড়ি কিনে বসে ! সবকিছু কী মাথায় জায়গা নেয়। তবে নাজিম ওদের ফলো করায় একটা উপকারই হয়েছে। সীমান্ত যে কেন তার বাবার কাছে সরাসরি সাহায্য চায় না সেটা বরাবরই রিয়াদের বোধগম্যের বাইরে। যেটা সীমান্তর করতে কাল সকাল পেড়িয়ে যেতো সেটা এখনই হয়ে যাচ্ছে!

তবে সীমান্তর প্ল্যান এভাবেই ছুড়ে ফেলবে না রিয়াদ। এ ক্লাবকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার তো লাগবেই। রিয়াদ জানে পরিপূর্ণ চাপ ছাড়া এ ব্যপারটা আবারও ধামাচাপা দেয়া হবে। নাজিমের চেয়েও হাজার গুণে বেশি পাওয়ারফুল ব্যাক্তিবর্গ এ ক্লাবের সাথে জড়িত। তারা নিশ্চয়ই নিজেদের রক্ষা করতে চাইবে!

***

শ্বাস আঁটকে আসছে আইজার। ওর চিবুকের নিচ অংশে বেশ জোর হাতেই ব*ন্দুক চাপিয়ে রাখা হয়েছে।

-“এতো সহজেই বেরিয়ে যাবেন স্যার!”

আইজার সামনেই থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে সীমান্ত। তবে তার চাহনি এই মুহুর্তে ওর দিকে না বরং আসিফের দিকে। টর্চের আলোয় ক্রমাগত নড়তে থাকা সীমান্তর নেত্রগোলক নিষ্প্রভ চাহনিতে দেখে যাচ্ছে ও। আঁখি জোড়া বন্ধ প্রায়। এতোক্ষণ শক্ত শরীরে নিজেকে সামলে নিলেও এখন আর শরীরে কুলচ্ছে না। ভেতরের সবকিছু গুলিয়ে আসছে। তলপেট একটু পর পর চিনচিন করে উঠছে।
ক্রমশ ঝিমিয়ে আসছে পুরো দেহ। ছেড়ে দিলেই হয়তো আছড়ে পড়বে নিচে!

-“আসিফ, আপনার শত্রুতা আমার সাথে! ওকে ছাড়ুন। ও আপনার কোন ক্ষতি করেনি!”

-“প্রিয়াও তো তোর কোন ক্ষতি করেনি। তাও তুই মে*রে ফেললি ওকে! মেয়েটা বিয়ের আগ মুহূর্তে আমার কাছে ফেরত আসতে চাইছিলো। কিন্তু তুই…!”
আসিফের কন্ঠে ক্ষুব্ধতার আভাস। তবুও তার মুখ থেকে প্রতিটা কথাই গলায় আঁটকে আসছে।

-“আমি কাউকে মা*রিনি!”
শক্ত গলায় বলে উঠলো সীমান্ত। প্রিয়ার খু*নের ব্যপারে ও কিছু জানে পর্যন্ত না।

সাথে সাথেই গু*লি বর্ষনের আওয়াজে আঁতকে উঠলো আইজা। ওর সামনেই মৃদু আর্তনাদে পেটের র*ক্তাক্ত স্থান চেপে ধরলো সীমান্ত। হাতে থাকা টর্চ নিচে পড়তেই অন্ধকারে ছেয়ে গেলো সবকিছু। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইলো আইজা।

-“সীমান্ত!”

মৃদুস্বরে ডেকে উঠলো ও। ইতোমধ্যে নিজেকে মুক্ত অনুভব করছে আইজা।

-“সীমান্ত!!!”

সতর্ক ভঙ্গিতে এক পা দুই পা করে এগিয়ে যাচ্ছে আইজা। কিন্তু সীমান্তর কন্ঠ শুনতে পাচ্ছে না ও। নিজের জামার একাংশে লুকিয়ে রাখা ছোট্ট টর্চ বের করে নিলো আইজা। কিন্তু এর আলো তেমন দূর অব্দি পৌঁছায় না।

হঠাৎ পায়ের নিচে কিছু একটা বেজে উঠতেই তাতে টর্চ মারলো ও। এটা তো সীমান্তর হাতে থাকা সেই ব*ন্দুক। কম্পিত হাতে সেটা উঠিয়ে নিলো আইজা। টর্চটা সামনে তুলে ধরলো। বস্তুটা বেশ ঘনঘন জ্বলজ্বল করছে। ফলে দেখতে অসুবিধা হচ্ছে। সাথে পেটের ব্যথাটাও যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে।

টর্চটা কয়েক সেকেন্ডে একটু সামলে উঠতেই আইজা দেখলো আসিফ সীমান্তর মাথায় ব*ন্দুক তাক করে আছে। সীমান্তর চোখজোড়া আইজার দিকে নিবদ্ধ। ঠোঁট নাড়িয়ে কী যেন বলতে চাইছে সে। সীমান্তর মুখনিঃসৃত কোন কথাই আইজার কানে প্রবেশ করলো না। তবে তার ঠোঁট জোড়ার গতিবিধি স্পষ্ট বুঝতে পারছে ও।

-“চিন্তা করিস না, তোকে এখন মা*রবো না। আগে তোর চোখের সামনে আইজাকে মা*রবো!!”

আসিফের কথা শেষ হতে না হতেই আবারও গু*লির শব্দে গুঞ্জে উঠলো চারিদিক। আসিফের হাতের একাংশ রক্তাক্ত হয়ে আছে। আর তার দিকে ব*ন্দুক তাক করে আছে আইজা। সীমান্ত সাথে সাথেই নিচে পড়ে থাকা আসিফের ব*ন্দুক হাতে নিয়ে নিলো। আসিফের চাহনিতে স্পষ্ট বিস্ময়!

-“আপনি…!”

-“মিথ্যে বলেছিলাম। আমার নিশানা সম্পর্কে তোর কোন ধারণাই নেই!”
শক্ত গলায় বলে উঠলো আইজা। সীমান্ত আসিফের দিকে ব*ন্দুক তাক করে দূর্বল কন্ঠে আইজাকে বলে উঠলো,
-“চলুন। এখন ডায়লগ মারতে হবে না!”

আইজার দৃষ্টি সীমান্তর পেটের দিকে। লোকটাকে এখনই হসপিটালে নিতে হবে। ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না। তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার ছাপ তার চোখ জোড়ায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। যদিও নিজেকে নিজেই ধরে রেখেছে সে। আসিফ রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে আইজার দিকে। সীমান্ত তার দিকে ব*ন্দুক ধরে না রাখলে হয়তো এখনই হামলা করতো।

সীমান্ত আর আইজা সিঁড়ি অব্দি পৌছাতে না পৌছাতেই সেই দরজা ভেদ করে আরো চারজন এসে হাজির হলো। সকলের হাতেই অস্ত্র! সীমান্তর চোখ নিভু নিভু প্রায়। তবুও আইজার হাত শক্ত করে ধরলো সে। তার জ্যাকেটে থাকা একটা কার্ড আইজার হাতে ধরিয়ে কানে ফিসফিস করে বলে উঠলো,

-“পেছনে ফিরবেন না!”

আইজা ভ্রু কুঁচকে আছে। এতোগুলা মানুষের সাথে এই অবস্থায় কখনোই পারবে না সে। সীমান্ত কটমট করে তাকালো ওর দিকে। বলতে গেলে চেষ্টা করলো,

-“যাচ্ছেন না কেন!!”

সীমান্তর চোখে একবার তাকিয়ে তার হাত ছেড়ে দিলো আইজা। তবে সীমান্ত স্বস্থির নিশ্বাস ফেলার আগেই পেছনে থাকা লোকগুলোর দিকে ব*ন্দুক তাক করলো ও।

-“আপনারা না পালিয়ে আমাদের পেছনে কেন আসছেন!”
আইজার অধৈর্য কন্ঠের বিপরীতে তারা কিছুই বললো। উল্টো রোবটের মতো এগিয়ে আসছে।

-“আইজা…!”

তীক্ষ্ণ কন্ঠে কিছু একটা বলতে গিয়ে মাঝপথেই থেমে গেলো সীমান্ত। সিঁড়ির নিচেও আরো দু’জন দাঁড়িয়ে আছে অস্ত্র হাতে। কোন পথই দেখতে পারছে না ও। এতোগুলা অস্ত্রের সামনে ওদের কাছে সেল্ফ-ডিফেন্সের জন্য পর্যাপ্ত কিছুই নেই।

-“আইজাকে যেতে দিন!”

সীমান্তর মুখে সেই একই কথা। তবে লোকগুলো হিংস্র পশুর ন্যায় ওদের দেখে যাচ্ছে। হয়তো আজ বেঁচে ফেরা হবে না ওদের!!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here