#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৪৭
#লিখা_তানজিলা
ফাহাদের উল্টো লটকে থাকা ঝুলন্ত দেহ কিছুক্ষণ পর পর বিশালাকার ড্রামভর্তি পানিতে চুবিয়ে পুনরায় ওপরে তোলা হচ্ছে। যখনই মনে হচ্ছে দম ফুরিয়ে যাবে তখনই সাথে সাথে উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে ফাহাদকে। নাজিম শিকদারের কাছে এ যেন কোন মজাদার দৃশ্য! গত ছয় মাস যাবৎ নাজিমের সাই*কোগিরির স্বীকার কম হয়নি ফাহাদ।
-“একেবারে মে*রেই ফেলছিস না কেন!!”
ফাহাদের দূর্বল ক্ষীণ কন্ঠে উচ্চস্বরে হেঁসে উঠলো নাজিম।
-“তোর এ চেহারা দেখে যা আনন্দ হয় সেটা মে*রে ফেললে হতো না!”
নাজিম শিকদার হাত দ্বারা ইশারা করতেই ফাহাদের শরীরটা মেঝেতে ফেলা হলো। পুরো দেহের জায়গায় জায়গায় ক্ষত! হাত-পা এর নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। মানতে হচ্ছে, লোকটা এই বয়সেও যথেষ্ট ফিট। নইলে এখনো কেমন ফরফর করে মুখ খুলে যাচ্ছে! সত্যি বলতে ইদানিং আগ্রহটা ক্রমশ কমে আসছে নাজিমের। শীঘ্রই হয়তো ফাহাদকে খু*ন করবে ও!
বাইরে কনকনে ঠান্ডা। এরই মাঝে ফাহাদকে সিক্ত অবস্থায় ফেলে রেখেছে নাজিম। লোকটার চিৎকার যেন ওর কানে বেঝে চলা কোন মধুর সঙ্গীত! এমনিও মনে হচ্ছে না বেশিদিন টিকবে!
মৃদু হেসে গাড়িতে গিয়ে বসলো নাজিম। দুই সপ্তাহ পর রায়হানের বিয়েটা ওর জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ বিয়েতে কোন ঝামেলা চায় না নাজিম। কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও আইজা ওর পরিবারের সাথে জড়িত। না! অনেক সময় দিয়েছে মেয়েটাকে। আর না!
***
একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়িটা থামালো সীমান্ত। তখনকার পর থেকে কেউ কোন কথা বলেনি। সীমান্ত আগে নেমে আইজার পাশের দরজা খুলে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
-“নামুন।”
আইজার কোন হেলদোল নেই। জড় পদার্থের মতো নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে সে। যেন আশেপাশে থাকা কোন শব্দ তার কান অব্দি পৌঁছাচ্ছে না।
সীমান্তর মুখ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। ও জানে ছয় মাস আগের ঘটনা আইজার ওপর কতটা ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। তাই এতোদিন ওকে নিজের মতো থাকতে দিয়েছিলো ও। যদিও সীমান্তর নজর সবসময়ই আইজার ওপর ছিলো। ফাহাদ এখনো ধরা পড়েনি। তাই রিস্ক নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না!
শেষমেষ আইজার হাত ধরতেই কিছুটা কেঁপে উঠলো সে। যেন এতক্ষণ কোন ঘোরের মধ্যে ছিলো। সীমান্তর দিকে চোখ পড়তেই আইজা নিজের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে নিলো। কোনোমতেই সীমান্তকে নিজের দূর্বলতা জানাতে চায় না সে! নিঃশব্দে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো আইজা।
রেস্টুরেন্টে খাবার সীমান্তকেই অর্ডার করতে হলো। মুখে যেন তালা লাগিয়েছে সামনে বসে থাকা মানবী। হাজার প্রশ্ন করেও তার মুখ থেকে একটা কথাও বের করতে পারেনি সীমান্ত!
-“আপনার কী মনে হচ্ছে; আমাকে সাইলেন্ট ট্রিটমেন্ট দিলেই আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করা বন্ধ করে দেবো!”
দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলো সীমান্ত।
আইজা এখনো নিশ্চুপ হলেও এবার সীমান্তর দিকে ঠান্ডা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ও। সীমান্তর মুখ দেখে কখনোই তার অনুভূতি নিশ্চিত রূপে বুঝতে পারে না আইজা। যেমনটা এখন। ঠান্ডা পড়েছে আজ অনেক। লোকটা ইতোমধ্যে নিজেকে একের অধিক গরম পোশাকে ডুবিয়ে রেখেছে। শীত নামক বস্তুটাকে যেন সহ্য হয় না তার!
সীমান্ত শক্ত গলায় বলে উঠলো,
-“সত্যি বলতে আমি এখনই আপনাকে শিকদার বাড়িতে নিতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু সামনে রায়হানের বিয়ে। আপনাকে অন্তত তিন সপ্তাহের জন্য বাড়ি যেতে হবে।”
-“না।”
অবশেষে মুখ খুললো আইজা।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঠান্ডা দৃষ্টি নিক্ষেপ করা হলো আইজার দিকে। পরক্ষনেই মুচকি হেঁসে উঠলো সে। লোকটা হয়তো বাইপো*লার! মাঝে মাঝে এর চেয়ে ভালো কোন ব্যখ্যা আইজার মাথায় আসে না।
-“নো প্রবলেম! আপনি না চাইলে জোর করবো না!”
সীমান্তর কথায় আইজার ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। আইজার মুখ থেকে কথা বের করাই তার মূল উদ্দেশ্য ছিলো!
-“আমার মনে হয় না; আপনার ভাই আমাকে দেখে খুশি হবে!”
আইজার কথায় সীমান্তর নিষ্প্রাণ চাহনি বাইরে গিয়ে ঠেকলো। সময়টা দুপর হলেও হালকা কুয়াশা চোখে পড়ছে। সীমান্ত নিজ দৃষ্টি বাইরের থেকে সরিয়ে আইজার দিকে রেখে বলে উঠলো,
-“আমি আপনার প্রতি দূর্বল; তার মানে এই না যে, আপনি আমার ফ্যামিলির সাথে যা ইচ্ছে করবেন আর আমি চুপ থাকবো!”
সীমান্তর চোখে ক্রোধের কোন রেশ নেই। আর না কন্ঠে আছে। আইজা যদি সীমান্তর কার্যকলাপে পরিচিত না থাকতো তাহলে হয়তো বুঝতেই পারতো না যে কতটা ভয়ংকর ভাবে রেগে আছে সে।
***
রাস্তার একপাশে পাখিকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো রিয়াদ। খুব ব্যস্ত দেখাচ্ছে মেয়েটাকে।
-“কেমন আছেন?”
রিয়াদের প্রশ্নে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাকালো পাখি। তবে সে প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না। মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে। মৃদুস্বরে বলে উঠলো,
-“শুনলাম আপনার না-কি চাকরি হয়েছে। তা-ও আবার নাজিম শিকদারের অফিসে! শেষ পর্যন্ত আপনার উদ্দেশ্য সফল হলো!”
-“আমার উদ্দেশ্য নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না। আপনার বয়স কম। নিজের জীবনটা উপভোগ করুন। আশা করি এমন কিছু করবেন না যাতে আবারও নাজিম শিকদারের নজর আপনার ওপর পড়ে!”
-“নিজের চরকায় তেল দিন!”
রুক্ষ গলায় বললো পাখি।
মৃদু হাসলো রিয়াদ। কিন্তু পাল্টা কিছু বললো না। উল্টো পথে হাঁটা ধরছিলো ও। কিন্তু পরক্ষনেই পাখির কন্ঠে থেমে গেলো পা জোড়া!
-“আপনার বাবাকে নাজিম শিকদার খু*ন করেছে তা-ই না!”
-“উল্টো পাল্টা কথা বলা বন্ধ করুন। আমার বাবার এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। আর আমি শেষবারের মতো বলছি, আপনি এসব ব্যপার থেকে দূরেই থাকুন।”
পাখি আর কিছু বলার আগেই সেখান থেকে সরে এলো রিয়াদ। এ পর্যত্ন আসা ওর জন্য মোটেও সহজ ছিলো না। এখনই আটকে গেলে সব কষ্ট বিফলে যাবে!
***
রাত নয়টা বেজে আটাশ মিনিট। বেশ শব্দ করেই বেজে উঠলো কলিং বেল। মাথাটা সেই কখন থেকে ব্যথা করছিলো আইজার। বিশেষ করে সীমান্তর সাথে কথা বলার পর। তাই একটু চোখ বন্ধ করেছিলো আইজা। পাঁচ মিনিট হতে না হতেই দরজার ওপাশ থেকে আসা আওয়াজে মেজাজ বিগড়ে গেলো ওর। হয়তো আরফান এসেছে। সিমি আইজার পাশে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। বিরক্ত মুখেই বিছানা ছাড়লো আইজা।
দরজার ওপাশে নাজিম শিকদারকে দেখে আইজার চোখে ফুটে উঠলো বিস্ময়ের রেখা। নাজিম ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠলো,
-“নাজিম শিকদারের ছেলের বৌ এমন থার্ডক্লাস এলাকায় থাকে! বেশ দুঃখজনক!”
কৃত্রিম ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। আইজাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলো নাজিম। আইজার হাত শক্ত মুঠ হয়ে আছে। তবে ও নিজ ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ করলো না। ঠোঁটর কোণে ক্ষীণ হাসি ঝুলিয়ে নাজিমকে বসতে দিলো।
-“তবে আরমান আজাদের মেয়ের জন্য এ এলাকা একটু বেশিই মনে হচ্ছে! একজন ক্রি*মিনালের পরিবার এতো টাকা পাচ্ছে কোথায়! তার ওপর মেডিকেল বিল! শেষ পর্যন্ত আবার তোমরাও কোন ক্রা*ইমে জড়িয়ে যাওনি তো!!”
-“কফি খাবেন?”
আইজার মুখে মিষ্টি হাসি। যেন সামনে বসে থাকা ব্যক্তি একটু আগে ওকে বাজেভাবে কোন অপমানই করেনি! নাজিম শিকদারের জবাবের অপেক্ষা করলো না ও। সোজা কিচেনে চলে গেলো।
গরম কফির মগ নাজিম শিকদারের পাশের ছোট টেবিলে রাখলো আইজা। সম্মানিত শ্বশুর এতোদিন পর ওর বাড়িতে এলো আর ও যত্ন নেবে না! এ কী করে সম্ভব!
নাজিম শিকদারের মুখ জুড়ে একরাশ সন্দেহর ছাপ। তবুও কফিতে চুমুক দিলো সে। সাথে সাথেই চোখ জোড়া কুঁচকে গেলো তার।
-“তুমি জানো আমি কফিতে চিনি পছন্দ করিনা।
-“জানি! তাই চিনির পরিমাণ একটু বেশিই দিয়েছি। আরো প্রয়োজন হলে বলবেন। হ্যাঁ, চিনির দাম অনেক বেড়েছে। তবে চিন্তা করবেন না, একটু-আকটু ক্রা*ইম করে টাকা জোগাড় করে নেবো!”
ব্যঙ্গার্ত্বক ভঙ্গিতে বলে উঠলো আইজা।
নাজিম আর কিছু না বলে নিঃশব্দে কফি খেতে শুরু করলো। তবে পুরোটা সময়ই তার ঠান্ডা চাহনি আইজার ওপর নিবন্ধ! কিছুক্ষণ পর হাতের ইশারায় আইজাকে তার সামনে বসতে বললো সে। আইজা নিজের শ্বশুরের আদেশ অনুযায়ী আরেকটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। নাজিমের মুখভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে কোন এক উদ্দেশ্যে এসেছে এখানে। শুধুমাত্র আইজাকে অপমান করতেই এ পর্যত্ন কষ্ট করে নিশ্চয়ই আসবে না নাজিম শিকদার।
-“আমি চাই, তোমরা আলাদা হয়ে যাও। বিয়ে নামক সম্পর্কে তোমাদের একসাথে থাকার আর কোন কারণ চোখে পড়ছে না আমার। সীমান্তর বাচ্চা যদি বেঁচে থাকতো তাহলে হয়তো ভেবে দেখতাম আমি। কিন্তু এখন…!”
-“আপনার ছেলে আমাকে ছাড়বে না!”
নাজিমের কথা শেষ হওয়ার আগেই নির্লিপ্ত গলায় বলে উঠলো আইজা।
-“তো ওকে বোঝাও!”
-“কেন! আপনার নিজের ছেলের ওপর আর কোন কন্ট্রোল নেই বুঝি!”
সাথে সাথেই খালি কফির মগটা সামনে ছুঁড়ে মারলো নাজিম। বস্তুটা আইজার পাশের দেয়ালে ছিটকে ভেঙে চৌচির হয়ে পড়লো। নিজের গালে রক্ত নামক তরল পদার্থের কিঞ্চিত অস্তিত্ব টের পাচ্ছে আইজা। হয়তো কাচের ভাঙা অংশ হতে লেগেছে। তবে তা নিয়ে মাথা ঘামালো না ও।
হাতের উল্টো পিঠ দ্বারা সে রক্ত মুছে নিলো আইজা। সামনে দাঁড়িয়ে ফুঁসতে থাকা ব্যক্তির চোখে চোখ রাখলো ও। চাহনিতে কৃত্রিম চিন্তিত ভঙ্গি এনে বলে উঠলো,
-“বয়স তো কম হয়নি আপনার। এ বয়সে মাথায় এতো লোড নিলে হার্টের প্রবলেম হতে পারে। এতো রাগ শরীরের জন্য ভালো না! আপনি বরং বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম করুন। আমাদের বিষয়টা আমরা বুঝে নেবো।”
আইজার নম্র গলায় বলা কথাগুলো হয়তো হজম হলো না নাজিম শিকদারের। মুহূর্তেই ভেঙে যাওয়া কফি মগের একটা অংশ আইজার গলায় চেপে ধরলো সে!
-“কার সামনে কথা বলছিস জানা আছে তোর! একদম জানে মে*রে ফেলবো! তোর পরিবার লা*শ পর্যন্ত খুঁজে পাবে না!”
গলায় ধরে রাখা ধারালো বস্তুটাকে এক প্রকার উপেক্ষাই করলো আইজা। মুখে লেগে আছে বাঁকা হাসি!
-“আরে রিলাক্স! ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাবে তো! আমার তো ভয়ই করছে আপনার স্বাস্থ্যের কথা ভেবে! যদিও আমি অলরেডি সীমান্তকে মেসেজ করে দিয়েছি। সে আসছে আপনার জন্য! কিন্তু আপনাকে এভাবে দেখলে..!”
হঠাৎ করেই আবারও বেজে উঠলো বাসার কলিং বেল। নাজিম শিকদারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দরজার দিকে গিয়ে ঠেকলো। তার চোখে লুকিয়ে থাকা সংশয় স্পষ্ট বুঝতে পারছে আইজা। যদিও ওর গলা থেকে ভাঙা মগের ধারালো অংশ এখনো সরানো হয়নি।
-“কী হলো! আপনার হাত কাঁপছে কেন! আগেই বলেছিলাম; এতো প্রেসার এই বয়সে নেয়ার ক্ষমতা নেই আপনার…বাবা!”
চলবে…