#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ১৭
আমাদের বাগানজুড়ে অপরাজিতা ফুল ফুটেছে। নীল রঙ ছেয়ে আছে চারদিকে। সন্ধ্যা হতে বেশি দেরি নেই। গোধুলীবেলার লাল আলোয় চারদিক মায়াময় হয়ে আছে। এমন দিনে ইচ্ছে করে কোন ছোট্টবেলায় পড়া রূপকথার দেশে হারিয়ে যাই। সুয়োরানী-দুয়োরানীর দেশে, বীর রাজপুত্রের দেশে চলে যাই, বনের মাঝে থমকে গিয়ে শুনি ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর কথা!
আমি খুশবুকে কোলে নিয়ে বাগানে হাঁটছি। মেয়েটা ঘুমিয়েছিলো দুপুরে। মাত্র উঠলো। এখন না হাঁটলে যে কান্না শুরু করবে, তা থামতে থামতে রাত। আমি ছাড়া আর কারো কাছে যাবে না জেদ ধরেছে। বয়স তিনে পড়ল। তাও আহ্লাদ কমেনি।
এদিকে আমার পড়াশুনা আছে। আগামীকাল ফাইনাল পরীক্ষা শুরু। হঠাৎ কে যেন গেটের কাছে ডাকাডাকি শুরু করল। গিয়ে দেখি চিঠি এসেছে। আমার নামেই। সেটা হাতে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর ঘরে ঢুকতে নিলে আমার গেটে ধাক্কা। গিয়ে দেখি বড় আপা এসেছে। আমি চমকে চিৎকার দিয়ে উঠলাম।
সে বাড়িতে ঢুকেই খুশবুকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। ও আপাকে তেমন চেনে না। নতুন মানুষ দেখে তাই কাঁদো কাঁদো হয়েও বেশি আদরের চোটে কাঁদতে পারলো না। আয়াশও দুষ্টুমি শুরু করল। ছেলেটা বড় হয়েছে কতো! আমি তাদের ধরে ঘরে নিয়ে গেলাম।
“শুধু দু’জনেই এসেছ? ভাইয়া আসেনি?”
আপা ঠোঁট উল্টে বলল, “নাহ। তার কাজের যা চাপ!”
“তুমি না বলে এলে কেন?”
“সারপ্রাইজ দিতে!”
আপাকে নিয়ে কাটলো অনেকটা সময়। প্রায় নয়টার দিকে পড়তে বসলাম। মনে হচ্ছে হিমালয় পর্বতের মতো পড়া ঘাড়ে চেপে আছে। প্রস্তুতি এবার তুলনামূলক অনেক ভালো, আগে তো এর অর্ধেক পড়া হলেও মনে হতো যথেষ্ট। এখন সব কেমন বদলে গেছে। আমার চিন্তা ভাবনার দিকগুলোও অনেক পরিণত হয়েছে। নিজেকে গোছানো মনে হয় খুব। আগের মতো এলোমেলো, উদাসীন, একটা হলেই চলে ভাবটা আর নেই।
বসতে না বসতে অর্নার ফোন এলো। এই মেয়েটা এখনো নিয়মিত ফোন করে। সবসময় বলে, দেখো ভাইয়ার সাথে ঠিক ঠিক তোমার মিল হয়ে যাবে। আমি কথাটা হেসে উড়িয়ে দেই। তবু কি মনের কোথাও কি চিকন সলতেতে আবছা হয়ে একটা প্রদীপ অল্প সময়ের জন্য জ্বলে ওঠে?
তার সাথে আর দেখা হয়নি সেদিনের পর। রাস্তাঘাটে কতো পরিচিত লোকের সাথে দেখা হয়। তার সাথে হয় না কেন? সে কি ইচ্ছে করে আমাকে এড়িয়ে চলে? আমার তাতে ভালোই হয়েছে। একটা বিয়ের সম্পর্কের চিকন সুতো দু’জনকে এখনো জুড়ে রেখেছে। তবুও আমরা যোজন যোজন দূর। সে আর বিয়েও করেনি। নোরা ইংল্যান্ড চলে গেছে। ওবাড়িতে খুব একটা শান্তি আছে বলে মনে হয় না।
“বলো অর্না।”
“প্রিপারেশন কেমন?”
“মোটামুটি।”
“মানে কী! তুমি তো কবে থেকে পড়ছিলে!”
“তবুও মনে হয় কিছু পারব না।”
“খুব পারবে। রিলাক্স থাকো।”
“পারছি না তো।”
“কেন বলো তো, কিছু হয়েছে?”
“নাহ, এই পরীক্ষার জন্যই।”
“কোনো প্রবলেম হলে শেয়ার করতে পারো কিন্তু..”
“সত্যি কোনো সমস্যা নাই।”
“ওহ! বেস্ট অফ লাক। আর ডিসটার্ব করব না, রাখি।”
“ভালো থেকো অর্না।”
“তুমিও।”
ফোনটা রেখেই আমার মনে পড়ল আজ একটা চিঠি এসেছিলো। চিঠিটা নিয়ে দেখি তাতে প্রেরকের ঠিকানা সীতাকুন্ড, চট্টগ্রাম। ওখান থেকে কে চিঠি দিলো?
ভেতরে সাদা কাগজে লেখা ছোট্ট একটা চিঠি। সাথে একটা শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ। চিঠিতে লেখা মাত্র কয়েক লাইন-
“কেমন আছ? কাল থেকে ফাইনাল শুরু তাই না? জানি না চিঠি সময়মতো দিনে পৌঁছাবে কি না৷ প্রস্তুতি ভালো তো এবার? জানি তোমার খুব একা একা লাগে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি তোমার সাথে আছি। প্রতিটি মুহূর্ত তোমার মঙ্গল কামনা করছি। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তুমি সফলতার সিঁড়ি বেয়ে বিনা বাধায় উঠে যাও এই দোয়া করি। শুভকামনা ও অজস্র ভালোবাসা রইল।”
– তোমার অপূর্ব
চিঠি পড়ে আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। অপূর্ব! কোন অপূর্ব? তাও আবার আমার! গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। এ কে? কী করে জানলো আমার আগামীকাল পরীক্ষা? আমার পরিবারের বাইরে কোনো ছেলের সাথে যোগাযোগ নেই। মহিলা কলেজে পড়ার সুবাদে ছেলেবন্ধুও নেই। তবে কি এটা….
বড় আপা এসে আমায় অস্থির দেখে বলল, “কী হলো তোর?”
আমি কাঁপা হাতে তাকে চিঠি দেখালাম। আপা চিঠি পড়ে হাসতে হাসতে বলল, “এইটার জন্য ভয় পাচ্ছিস কেন?”
“জানি না। কে পাঠালো বলো তো? আমার পরীক্ষার কথা কে জানলো? চট্টগ্রামের কাউকে আমি চিনি না।”
“সব জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা একসাথে হয়। এটা জানা কোনো ব্যাপার? মনে করে দেখ হয়তো ফেসবুকের কোনো বন্ধু।”
“আমার ফেসবুকে অচেনা কেউ নেই।”
“না থাকুক। পরীক্ষার আগে এসব উড়েচিঠি কেউ পাত্তা দেয় নাকি? কোন পাগল পাঠিয়েছে কে জানে! তবে অপূর্ব নামটা চেনা চেনা লাগছে।”
আমি ঢোক গিলে বললাম, “হয়তো উড়োচিঠিই। ঠিক বলেছ। এসব দেখার আগেই ফেলে দেয়া উচিত।”
আপা চিঠিটা নিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে চলে গেল। দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে বলল, “মনোযোগ দিয়ে পড় তুই। কেউ আসবে না আর।”
আমি উঠে চিঠিটা নিয়ে এলাম। মনে মনে কয়েকবার আউড়ে নিলাম- ‘অপূর্ব! অপূর্ব!’ চিঠিটাতে কী যেন আছে। মনে হচ্ছে ভরসার একটা হাত। স্বপ্নে দেখা হাতের মতো। একেবারে জাদুর মতো কেমন করে যেন আমার দুশ্চিন্তাগুলো টেনে নিল নিজের মাঝে।
বই খুলে দেখি পড়তে শুরু করলাম। একটু আগের ভয়টা আর নেই। আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। মনে হচ্ছে এবার পরীক্ষা ভালোই হবে। বেশ ভালো!
.
পরীক্ষার দিনগুলো বিভীষিকার মতো লাগে আমার। আবার একদিক দিয়ে ভালোও। একেকটা পরীক্ষা চ্যালেঞ্জের মতো। নিজের কাছে নিজের চ্যালেঞ্জ। প্রায় প্রতিটাতেই জিতে যাচ্ছি। তারপর নিজেকে ছোট ছোট গিফট দেই। আবার না পারলে শাস্তিও দেই ঠিক ঠিক। জীবনটা আমার কাছে যেন একটা খেলার অংশ হয়ে গেছে। উপরে ওঠার নেশা পেয়ে বসেছে। তবে জীবন উপভোগ করার ইচ্ছেটা মরে গেছে।
আমার কাছে এক টুকরো অক্সিজেন হলো খুশবু। ও ছাড়া আর কোনো পিছুটান নেই। হ্যাঁ, আমার কিছু হলে মা বাবার কষ্ট হবে, কিন্তু এই স্বামী ছেড়ে আসা কন্যার দায় থেকে মুক্তিও পাবেন। আমিতো হিসেবে তাদের বোঝা হয়ে রয়েছি!
তাই এখন মনে হয়, হয় জীবনে কিছু করব নয়তো মরব। তবুও ধুঁকে ধুঁকে বাঁচবো না। সুইসাইড করার ইচ্ছে কিন্তু নেই। এই মৃত্যু শরীরী মৃত্যু নয়। চলে যাব যেদিকে দু’চোখ যাবে। হয়তো কোনো আশ্রমে সন্যাসিনী হয়ে!
.
শেষ পরীক্ষার দিন আবার সেই স্বপ্নময় বুক স্টোরে গেলাম। সেই বৃদ্ধটিকে পেলাম না। তার কথা জিজ্ঞেস করলে দোকানী মনে করতে পারলো না কার কথা বলছি। বলল তার দোকানে নাকি সে ছাড়া অন্য কেউ বসে না। আমি জোর দিয়ে বললাম, সে বিশ্বাসই করল না। প্রায় দুই বছর আগের কথা কেই বা মনে রেখেছে! এতদিন খোঁজ নেয়ারও প্রয়োজন মনে করিনি আমি। এদিকটা মাড়াইনি আর। তবে এখন কিসের যেন হিসেব মনে খচকচ করছে। সেটা মেলাতে গিয়েছিলাম। তা আর হলো কই।
সেদিন আবার একটা চিঠি এলো। চট্টগ্রাম থেকেই।
“ভালো আছ? মনে হয় নেই। তুমি খুব দুঃস্বপ্ন দেখো তাই না? রাতের বেলা স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলে মনের কষ্টগুলো আকাশে ছড়িয়ে দিও। আমি ঠিক ঠিক সেগুলা খুঁজে নিয়ে নিজের কাছে জমিয়ে রাখব।”
– তোমার অপূর্ব
আমার এবার আগের মতো অবাক লাগলো না। মনে হলো এটা যেন পাওয়ারই ছিল। মানুষটা কে জানার প্রয়োজন নেই। সে থাকুক পাশে।
কয়েকদিন পর আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার লেখা আত্মিক উন্নতি সম্পর্কিত “প্রভা” নামের একটা ছোট প্রবন্ধ পত্রিকায় ছাপা হলো। কাজটা মৃন্ময় স্যার করেছেন। আমি স্যারকে ফোন করলাম। স্যার বললেন,
“কেমন সারপ্রাইজ দিলাম?”
“ভয়ানক! কিন্তু আপনি এটা কেন করলেন?”
“অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম পাঠাবো। তোমার লেখা আগের তুলনায় বেশ পরিপক্ক হয়েছে। এটাই তো সময়। আরো বেশি করে লেখো। সবাই চিনুক তোমাকে।”
“কিন্তু স্যার কেমন যেন লাগে। আমি তো এমনি লিখি…”
“যা লেখ, সেসব দেশের মানুষের পড়ার অধিকার আছে। প্রতিভা শুধু নিজের মধ্যে কেন রাখবে? ছড়িয়ে দাও সবার মাঝে। তাছাড়া তুমি তো বলেছিলে পৃথিবীর জন্য কিছু করতে চাও।”
“জি স্যার।”
“তাহলে এটাই তো সুযোগ। কলমের কত শক্তি তা নিশ্চয়ই জানো।”
“আমি কি পারব?”
“অবশ্যই পারবে মেয়ে। তুমিই পারবে।”
লেখা ছাপা হওয়ার ঠিক দু’দিন পর আবার চিঠি-
“লেখাটা পড়লাম। তুমি এত ভালো লিখতে কবে শিখলে? কথাই তো গুছিয়ে বলতে পারো না। অপেক্ষায় রইলাম পরের লেখার। ভালোবাসা নিও।”
– তোমার অপূর্ব
আমি অবসময় সময়গুলোতে আরও কয়েকটা লেখা লিখলাম। স্যারের কাছে সবগুলো পাঠিয়ে দেই। স্যার তার পছন্দমতো লেখা পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দেয়। কিছুদিন পর আবার পত্রিকায় ছাপা হলো আমার নতুন লেখা। এবারেরটা মনস্তাত্বিক ছোটগল্প৷ নাম ‘কাকের কুঁড়ে’। এটা বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেল। তার কিছুদিন পর আরেকটা- নাম ‘সুগন্ধী’।
এই দুটো গল্প ছাপা হওয়ার কিছুদিন পর একটা খুব প্রচলিত ম্যাগাজিনের সম্পাদক স্যারের সাথে যোগাযোগ করলেন৷ তাদের মাসিক পত্রিকার জন্য নিয়মিত লিখতে। আমি লোভীর মতো প্রস্তাবটা নিয়ে নিলাম। লেখালেখিটা এবার খুব জোর দিয়ে শুরু করলাম।
(চলবে)