অপূর্ব সমাপ্তি পর্ব-১৯

0
433

#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব -১৯

আপার বাড়ি পৌঁছেই বিরাট এক ঘুম দিলাম। উঠতে উঠতে পরদিন বেলা এগারোটা। উঠে দেখি আপা একাই বকবক করতে করতে ঘরদোর গোছাচ্ছে। ভাইয়া একা মানুষ, অফিসের কাজকর্ম করে বাড়ির দেখাশুনা কী করে করবে! তাও যে বাড়ি বাসযোগ্য আছে এতদিনে সেই বেশি। আমি খেয়ে আপার সাথে কাজে লেগে গেলাম।

দুপুরের পর আয়াশের সাথে কার্টুন মুভি দেখে সময় কাটলো। সন্ধ্যার পর ভাইয়া চলে এল। ভাইয়ার গানবাজনার খুব শখ। একটা আলাদা ঘরই আছে তার। গানের ঘর। গিটার, তবলা, হারমোনিয়াম, আরো কিছু সরঞ্জাম আছে। ভাইয়া একাই গান করে একেক সময় একেকটা বাজিয়ে। আবার গান জানা কাউকে পেলে ধরে নিয়ে আসে বাড়িতে।

আজ ভাইয়ার সাথে আপাও গান গাইল। দুজনের কারোই গলা ততটা ভালো না, তবুও শুনতে বেশ লাগে!

“দূর হতে আমি তারে সাধিব
গোপনে বিরহ ডোরে বাঁধিব….
বাধনবিহীন সেই যে বাঁধন
অকারণ….
মায়াবন বিহারিনী…..”

মনে হয় যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে বেদনার সুর। কেউ একজন ডেকে যাচ্ছে একেবারে মনপ্রাণ দিয়ে। বুকের ভেতর কেমন হু হু করে ওঠে…সে ডাক উপেক্ষা করার সাধ্যি কোনো মানুষের নেই।

রাতে অপূর্বর নাম্বারে মেসেজ পাঠালাম- “আমি চট্টগ্রাম এসেছি।”

সে তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল- “দেখা করবে?”

“হ্যাঁ। আগামীকাল সকালে।”

সে ঠিকানা মেসেজ করে দিল। কীভাবে যেতে হবে তাও বলে দিল।

পরদিন ভাইয়া অফিসে গেলে আপাও বের হয়ে গেল আয়াশকে নিয়ে। আয়াশকে নতুন স্কুলে ভর্তি করবে। আগের স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার পর অন্য স্কুলে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু ওই সময় ওই ক্লাসে সিট ফাঁকা ছিল না। তাই সামার সেকশনে ভর্তি করবে। মাঝখানে সুযোগে আয়াশ কিছুদিন নানুবাড়ি বেরিয়ে এল।

আপাকে বলেছিলাম যে আমিও বের হব এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে। আপা বের হওয়ার পরপর আমিও বেরিয়ে গেলাম। তার কোয়ার্টারে পৌঁছুতে এগারোটা বেজে গেল। প্রায় দুপুরে একেবারে মাথার ওপর সূর্যটা। ঘেমে একাকার হয়ে গেছি। বাড়িটা একতলা ছিমছাম দালান। সাদা রঙ করা। বাড়ির দুই পাশে দুটো আমগাছ ছায়া দিয়ে রেখেছে। ঢোকার পথে দুটো লম্বা সুপারি গাছ। আর চারপাশে প্রচুর ঝোপঝাড়। সন্ধ্যামালতি আর নয়নতারার গাছ সব। সাথে সে যে বেগুনী ফুলের কথা বলেছিল সেটাও আছে।দেখেই মনে হলে নিশ্চিত প্রচুর মশা হয়৷ থাকে কেমন করে?

বেল বাজাতে দরজা খুলে দিল এক মাঝবয়সী শুকনোমতো লোক। আমাকে দেখে একগাল হেসে সালাম দিয়ে বলল, “কেমন আছেন মা জননী?”

একটু হেসে বললাম, “ভালো। বাড়িতে আর কেউ নেই?”

“স্যার বাড়িতেই আছেন। আসুন ভেতরে।”

আমি ড্রইং রুমে বসলাম। কয়েকটা সাধারণ সোফাসেট আর একটা ছোট টিভি। বড় জানালার ঘেঁষে ঝোপালো গাছে বাগানবিলাস ফুটে আছে।

অপূর্ব নামক মানুষটি গলা খাকারি দিয়ে ঘরে এসে ঢুকলো। একগাল হেসে আমার মুখোমুখি সোফায় বসে বলল, “আসতে অসুবিধা হয়নি তো?”

আমি চুপ করে তাকে দেখে গেলাম। ছয় ফুট লম্বা, আদুরে মুখখানা, খাড়া নাক আর কপালের ওপর ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো। সেই চিরচেনা মানুষটি। চোখের কোল বসে গেছে, গায়ের রঙ রোদে পুড়ে বাদামি হয়েছে। আমায় চমকে দিতে পারার আনন্দে তার চোখদুটো ঝিকমিক করছে। যেন বুদ্ধির খেলায় জিতে বসে আছে।

আমি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বললাম, “না। কেমন আছ?”

সে খানিকটা ভড়কে গিয়ে বলল, “তুমি বুঝে গিয়েছিলে আমি অপূর্ব?”

সত্যি বলতে আমি ধারনা করেছিলাম আগে, তবে একেবারে নিশ্চিত ছিলাম না। তবুও মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললাম, “হ্যাঁ, এটা বোঝা কোনো ব্যাপার?”

সে একটু রাগ হয়ে বলল, “কী করে বুঝলে? আমি চট্টগ্রাম আছি সেটাই তো তোমার জানার কথা নয়।”

“সেটা জানতাম না। তবে চিঠিগুলো তুমি ছাড়া অন্য কেউ পাঠাবে না তা জানা ছিল।”

“ইশ্ আমি কোনো ক্লু রাখিনি। হাতের লেখাও অন্যরকম করে লিখেছি। গুল দিচ্ছ। তুমি বোঝোনি।”

“একশোবার বুঝেছি। তুমি ছাড়া অমন কাব্য করে চিঠি কে লিখবে? তুমি ছাড়া অমন করে কেউ বলতে পারে না।”

সে হাত দিয়ে নিজের কপাল থেকে চুল পেছনে সরিয়ে ভুরু উঁচু করে বলল, “তাই বুঝি?”

“হুম। তাছাড়া অপূর্ব বুঝি অন্য কেউ?”

“তা না। কেউ তো অপূর্ব ডাকে না। আর ভেবেছিলাম তুমি এই নামটা জানো না।”

“তিন বছরেই সব ভুলে গেছ? তোমার দাদীর গল্প কম শুনিয়েছ আমায়? যতবার শুনিয়েছ ততবার বলেছ দাদী তোমার নাম রেখেছিল অপূর্ব। যেটা এখন কেউ ডাকে না, এমনকি বেশিরভাগ মানুষ জানে না।”

“হায় হায়। মজাটাই মাটি!”

“তোমার কাছে কি পুরো জীবনটাই মজা? সত্যি করে বলোতো!”

“না তো, আমার তো মনে হয় আমার পুরো জীবনটাই বড়সড় একটা প্রহসন!”

“তোমার নাকি আমার?”

“দুজনেরই। আমাদের জীবন তো একই সুতোয় গাঁথা ।”

“আমাকে এখানে ডেকে নিয়ে আসার কারনটা জানতে পারি?”

“তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে আমার।”

“সেই সবকিছু বলার সময় বুঝি এতদিনে হলো? এতদিন তো তোমার জন্য কিছু আটকে থাকেনি। আশা করি ভবিষ্যতেও থাকবে না।”

সে আমার দিকে গভীর চোখে তাকালো। অনেক আগে প্রথম প্রথম যেমন তাকাতো, ঠিক তেমন করে। বহু সময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। আমার চোখ, নাক, ঠোঁট, চুল, মুখের প্রতিটা রেখা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের পর সে বলল, “তোমাকে আমি এমনভাবেই দেখতে চেয়েছিলাম। বিশ্বাস করো, এই সাহসী, সংগ্রামী তুমিকে দেখার জন্য আমি এতদিন অপেক্ষা করেছি। নয়তো এত কষ্টের জীবনটা কেন সহ্য করতাম বলো!”

“যা বলবে সোজাসুজি বলো।”

সে উঠে জানালার কাছে চলে গেল। গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে বাইরে শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমার বিয়ের শুরু থেকে আমাকে নিয়ে অনেক অভিযোগ, আমার আচরন নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে তাই না? সেসবের উত্তর আজ দেব তোমায়। শুনতে চাও?”

“চাই।”

“তার আগে কিছু খেয়ে জিরিয়ে নাও। গরমে একেবারে সেদ্ধ হয়ে গেছ মনে হচ্ছে।”

সে ‘সুবোধ’ নাম ধরে ডাকতেই মাঝবয়সী লোকটা এলো। সে আমার জন্য শরবত আর নাস্তা আনতে বলল।

সুবোধ মিনিটখানেকের মাথায় ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে হাজির হলো। আমি ঠান্ডার গ্লাসটা নিলাম।

সে আবার আমার মুখোমুখি এসে বসল। হাতদুটোর কনুই হাঁটুতে ঠেকিয়ে আঙুলের খাঁজে আঙুল ঢুকিয়ে যেন প্রস্তুতি নিল। তারপর বলতে শুরু করল-

“তুমি বাড়ি থেকে চলে আসার পর আমি শেলফে তোমার অংশে তোমার ডয়েরি পেয়েছি। তাতে ওই সময় পর্যন্ত তোমার সাথে ঘটা প্রতিটা ঘটনা তুমি তোমার মতো করে লিখে রেখেছিলে। সেখান থেকেই আমি তোমার অভিযোগগুলো জানতে পেরেছি। তোমার মনে প্রথম প্রশ্ন জেগেছিলো সিলেটে মা যাওয়ার পর। হঠাৎ তিনি কী করে উপস্থিত হলেন সেটা নিয়ে।

আমরা সিলেটে যাওয়ার পর মা প্রতিদিনই আমাকে ফোন করতো। একবার নয়, অনেক বার। কান্নাকাটি করতো, অনুরোধ করতো ফিরে যাওয়ার জন্য। মা আমাকে কথা দিয়েছিল তোমাকে মেনে নেবে। সেসব শুনে একসময় আমি গলে যাই। তাকে বলি যে ফিরে যাব। কিন্তু তার সিলেট আসার কথা আগের দিন রাত পর্যন্ত আমি জানতাম না। তুমি সেরাতে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর মায়ের ফোন আসে। আমাকে জানায় সে ভোরের ফ্লাইটে আসছে। ভোর হতেই তাই আমি বেরিয়ে যাই। অত ভোরে তোমায় ডাকতে ইচ্ছে হয়নি। এই ছিল মায়ের আসার কাহিনী।

দ্বিতীয় প্রশ্ন বাড়ি নিয়ে মিথ্যে কথা বলা।
এটা আমার ভুল আমি স্বীকার করছি। আসলে আমাদের তানজিমের বাড়িতেই ওঠার কথা ছিল। কিন্তু বাড়ির দেখাশুনা ওর চাচা করেন। সেটা যে অলরেডি পনেরো দিনের জন্য ভাড়া হয়ে গিয়েছিল তা তানজিম জানতো না। জেনেছিল শেষ মুহূর্তে। ওই সময় সন্ধ্যারাতে তোমায় নিয়ে কোথায় উঠতাম? তাই শেষে আমাদের বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। বাড়িটা মায়ের, আর মায়ের সাথেই সমস্যা করে তার বাড়িতে ওঠার কথাটা তোমাকে বলতে ইচ্ছে হয়নি। ভেবেছিলাম বললে তুমি স্বচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবে না।”

জিজ্ঞেস করলাম, “পরে বলোনি কেন?”

“তোমাকে যে মিথ্যে বলেছি সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। তুমিও আর মনে করিয়ে দাওনি।”

“এতদিন পর কেন মিথ্যে কথা বলছ বলবে? তুমি সিলেটে গিয়েছিলেই মায়ের কথামতো। প্ল্যান করে। সিলেট মিশন! হাহ!”

“তোমাকে কে বলেছে আমি মায়ের কথায় গেছি?”

“তোমার মা নিজেই বলেছে।”

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিচের দিকে তাকিয়ে। আস্তে আস্তে বলল, “মা মিথ্যে কথা বলেছিল। আমাদের তেমন কোনো প্ল্যান হয়নি।আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছিলাম মায়ের সাথে ঝগড়া করে। মা সব জানতে পেরেছিল অনেক পরে। তোমাকে ওসব কেন বলেছে আমি জানি না। আর আমি যে তোমাকে সত্যিটা বলব সে সুযোগ তুমি দাওনি। তুমি কখনো আমার কাছে কোনো অভিযোগ করোনি। সবসময় মুখ বুজে থেকেছ। কেন বলোতো? আমার পক্ষে কি সম্ভব তোমার মনের সব কথা জেনে ফেলা? সাথে সাথে বলে দিলেই অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয় না। মা সিলেটে আসার দিন তাকে এতদিন পর দেখে এত খুশি হয়ে গেছিলাম যে অজান্তেই তোমাকে কষ্ট দিয়েছি সেটা নিজেও বুঝিনি। এসব আমি জেনেছি অনেক পরে, তোমার ডায়েরি থেকে।”

“তারপর?”

“ঢাকায় আসার পর তোমার সাথে আমার সম্পর্ক ক্রমাগত খারাপ হচ্ছিলো, যেটার কারন সময়ের অভাব। অফিসে এত কাজ সামলে উঠতে পারছিলাম না আমি। সময় পেতাম না। আর যাও বা পেতাম, বাড়িতে এসে মায়ের কাছে তোমার নামে গাদা গাদা নালিশ শুনতে হতো। সারাদিন পরিশ্রমের পর সেসব শুনলে কার মেজাজ ঠিক থাকে বলো? অকারনেই তখন তোমায় কথা শুনিয়ে ফেলতাম। আমি তোমাকে শুরুতেই বলেছিলাম মা আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। তাকে কষ্ট দিতে পারি না বলে সব রাগ তোমার ওপর ঝাড়তাম! পরে অবশ্য মনে হতো তোমার সাথে অন্যায় করছি, তখন সব মিটিয়ে নিতে চাইতাম, কিন্তু তার আগেই আবার নতুন করে ঝামেলা তৈরি হতো। দিন দিন একেবারে অসহ্য হয়ে উঠেছিল সব। তুমি যে কী করে ছিলে ভাবতেও আমার বিচ্ছিরি লাগে! আমি সবকিছুর জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাই। আমি জোর করে তোমায় বিয়ে করে সুখী করতে পারিনি, সেটা আমার ব্যর্থতা।”

সে আরও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চোখদুটো বিষন্ন, ম্লান হয়ে আছে। অনুশোচনার পাহাড় জমেছে তাতে। আমার মায়া হলো। ভাবলাম হাতদুটো ধরে বলব দরকার নেই এসব কৈফিয়তের। কিন্তু সবটা যে জানতে হবে! বললাম, “তারপর বলো।”
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here