#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ২২
রাত দশটা। ঝড় থেমে গেছে, এখন শুধু ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। আমি অনেকক্ষণ এই ঘরটাতে বসে আছি। বাসায় শুধু আমি আর সে। সুবোধ রাতের রান্না করে দিয়ে বিকেলে চলে গেছে।
রান্নাঘরে শব্দ শুনে ঘর থেকে বের হলাম। দেখি সে টেবিল সাজাচ্ছে। আমায় দেখে বলল, “খেতে বসো।”
আমি চুপচাপ গিয়ে বসলাম। খাওয়ার সময় সে এটা ওটা এগিয়ে দিল, সাধারন কথাবার্তা বলল। দেশের কথা, রাজনীতির কথা। এমনটা সবসময় বলতো আগে। তার কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন কিছুই হয়নি। আমরা একসাথে থাকি। প্রতিদিন এভাবে খেতে বসি।
খাওয়া শেষে সে ঘরে গিয়ে মশারি টানিয়ে দিল। যা ভেবেছিলাম এখানে তারচেয়ে অনেক বেশি মশা। একেকটা বিরাট সাইজ! সন্ধ্যার আগে আগে কয়েল না জ্বালালে টেকা অসম্ভব।
মশারি টানানো শেষ হলে সে ড্রইং রুমে বসে টিভি অন করল। মনোযোগ দিয়ে নিউজ দেখতে থাকলো। আমি তার সামনে গিয়ে বললাম, “আমি শুতে যাচ্ছি। ভোরবেলা চলে যেতে হবে।”
সে টিভি থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, “যাও।”
আমি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ঠিক দুই মিনিটের মাথায় সে দরজা ধাক্কাতে শুরু করল।
খুলে দিতেই বলল, “দরজা বন্ধ করছ কেন? আমি আসব তো।”
“তুমি অন্য ঘরে শোবে।” বলেই মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিলাম।
আবার ধাক্কা। টিকতে না পেরে খুললাম। খুলেই বললাম, “প্লিজ যাও, রাতদুপুরে কাহিনী করো না।”
সে কাতর গলায় বলল, “আমরা স্বামী- স্ত্রী! আলাদা শোবো কেন?”
আমি একটু হেসে বললাম, “এতদিন তোমার ইচ্ছে হয়নি আমার সাথে থাকতে, এখন আমার ইচ্ছে নেই।”
তারপর আবার দরজা বন্ধ। বাইরের বৃষ্টির শব্দের সাথে কেমন হু হু শব্দ আসছে। বড় ঘরটাতে ভয় ভয় লাগছে। আমি পাত্তা দিলাম না। শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে ক্রমাগত কান্না পেতে থাকলো। সব কথা মনে পড়ে আর কাঁদি। বাইরে বৃষ্টি থেমে গেল একসময়। অনেকক্ষণ কেঁদে মাথা ব্যথা করছে। আমি উঠে দরজা খুললাম ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য।
দরজা খুলেই শুনে ওপাশে ড্রইং রুম থেকে টিভির শব্দ আসছে। সে এখনো টিভি দেখছে নাকি? ক’টা বাজে?
গিয়ে দেখি সে ঘুমিয়ে আছে। সোফায় গুটিশুটি হয়ে। এত লম্বা মানুষটার জায়গা হয়নি। পা দুটো বেকায়দাভাবে রাখা। মাথার নিচে সোফার শক্ত কাঠ। কয়েলটা শেষ হয়ে নিভে গেছে। চারদিকে মশাদের কনসার্ট চলছে। এভাবে একটা মানুষ ঘুমায় কেমন করে?
সিনেমায় দেখতাম প্রেমে ব্যর্থ ছেলেরা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকে। আরেকজন এখানে আজ বউ সাথে ঝগড়া করে মশাদের খাবার হচ্ছে! কি আজব!
আমি তাকে ডেকে তুললাম। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, “কী হয়েছে?”
“তুমি এভাবে শুয়ে আছ কেন?”
“তুমি তো জায়গা দিলে না।”
“তোমার আরেকটা ঘর আছে সেখানে কী হয়েছে?”
সে উঠে বসে ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল, “ব্যথা হয়ে গেছে, উফ! হঠাৎ ঘুমিয়ে গেছি তো। ওই ঘরে আবার ফ্যান নষ্ট।”
আমি প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বললাম, “দুনিয়ার সমস্যা আজকেই হবে। আর সব বিষয়ে তোমার অযুহাত তৈরি থাকবে। যাও তোমার ঘরে গিয়েই শোও।”
সে হেসে বলল, “আচ্ছা।”
তারপর উঠে হাই তুলতে তুলতে ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে নাক ডাকতে শুরু করল। সেই ভয়ানক শব্দের নাক ডাকা!
আমি মাথায় পানি দিয়ে এলাম। কিছুক্ষণ ড্রইং রুমে বসে থাকলাম, কিন্তু থাকা যায় না। কয়েল কোথায় আছে কে জানে! খুঁজে পেলাম না। পাশের ঘরে গিয়ে দেখি ফ্যান সত্যি নষ্ট।
আমি ওর ঘরের দিকেই গেলাম। খাটটা বড়। অন্যপাশে শুয়ে পড়লাম। এখনো ঘুম আসছে না। বৃষ্টিশেষে ভ্যাপসা গরম পড়ছে। ঘরটার আবহাওয়া অস্বস্তিদায়ক হয়ে উঠছে। একটু পর দেখি সে উঠে জানালা খুলে দিল। জিজ্ঞেস করলাম, “ঘুমাওনি?”
“ঘুমিয়েছিলাম। ইদানিং ঘুম গাঢ় হয় না। ছাড়া ছাড়া হয়। আশেপাশে যা হয় সব বুঝতে পারি।”
“ওহ।”
সে খাটে বসে বলল, “তুমি সত্যি কালকে চলে যাবা?”
“হ্যাঁ।”
“তারপর?”
“তারপর আমি যা বলেছি তাই।”
“তার মানে আমরা আর একসাথে থাকব না?”
আমার এবার ভীষণ কষ্ট হলো কথাটা শুনে। আমি তার দিকে তাকালাম। বাইরে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। চাঁদের আলোয় ভরে গেছে চারপাশ। তারই একটা অংশ জানালা গলে তার মুখে এসে পড়েছে। বিষন্নতা আর আকুতি মিশে আছে তার মুখজুড়ে। আমি কিছুই বলতে পারলাম না।
সে বলতে থাকলো, “আমি তোমার ক্ষতি চাইনি, তোমার সাথে খেলতেও চাইনি। আমি জানি আমার সমস্যা আছে খানিকটা, আমার চিন্তা ভাবনাগুলোই এমন। তার জন্য এত বড় শাস্তি দেবে? আমি নিজেও তো কষ্টে থেকেছি। এতগুলো বছর তোমারই অপেক্ষা করেছি। ভালো না বাসলে করতাম? তোমার সাথে বিয়ের পর অন্য কারো দিকে চোখ তুলেও তাকাইনি। শেষ সুযোগটা অন্তত দিতে পারতে!”
“তুমি চুপ করবে প্লিজ? আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে।”
আমি অন্যদিকে ফিরে মুখ লুকিয়ে চোখের জল মুছে নিলাম। ভয়ানক ইচ্ছে করছে তাকে ক্ষমা করে দিতে। সত্যি বলতে সন্ধ্যার পর থেকে চাইলেও রাগ করতে পারছি না। সে আমায় ভালোবাসে এটা আমি অস্বিকার করতে পারি না। আমার এই তিন বছরে একটা একা মেয়েকে যতটা সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় তার কোনোটাই সে আমার হতে দেয়নি। আড়ালে থেকে আগলে রেখেছে সবসময়। এই আমায় নিয়েই পড়ে থেকেছে। তাকে সুযোগ দিতেই পারি আমি। হয়তো যত্ন নিলে, পাশে থাকলে সে আর এমন থাকবে না। আবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে উল্টোপাল্টা কিছু করেও বসতে পারে।
আমি তার দিকে তাকালাম। সে বসেই আছে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, “কী হয়েছে?”
সে কিছু বলল না। চেয়েই রইল।
আমরা আমাদের জীবনটা যেরকম চাই সেটা কি তেমন করে হয়? কখনোই না। কোনো ঘটনাই পরিকল্পনামাফিক হয় না। হয় কল্পনার চেয়ে সুন্দর, নয়তো ভয়াবহ কুৎসিত। আমার বিবাহিত জীবনের প্রথম অধ্যায়টা সেরকম কুৎসিত ছিল। আমি চাইলে বাকি জীবনটা সাহসিকতার নামে একা কাটিয়ে দিতে পারি। তাতে হয়তো বাইরে দিয়ে অনেক আলো থাকবে, লোকে অনেক বাহবা দেবে। সফল একটা মানুষ হয়ে বাঁচবো। কিন্তু সুখী হতে পারব না।
আমি তাই সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি আরেকটা সুযোগ তাকে দেব। যদি সে ঠিক থাকে, তবে আমি পৃথিবীর একজন সুখী নারী হব, নয়তো বাকিটা পরে দেখা যাবে।
এটুকু হলো নিজের কাছে নিজের একটা জবাবদিহি। সত্যি বলতে তাকে সামনে দেখে আমি নিজেই স্থির থাকতে পারছি না। পতঙ্গের মতো ছুটে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে আগুনে। মরলে মরব, তাতে কী?
আমি হঠাৎ করেই শোওয়া থেকে উঠে তাকে জাপটে ধরলাম। সে কেঁপে উঠল একেবারে। আমার মাথাটা চেপে ধরল নিজের বুকের সাথে। তারপর খেয়াল করলাম আমার চোখের পানিতে যেমন তার জামা ভিজে একাকার হচ্ছে, তেমনি আমার মাথায়ও টপটপ করে জল ঝরছে! কি আশ্চর্য সে রাতটা! বাইরের আকাশে ফুটে থাকা লক্ষ লক্ষ তারকারাজি তাদের শুভকামনা পাঠিয়ে দিচ্ছে আমাদের ছোট্ট ঘরে। আমরা বহুদিনের বিবাদ ভঞ্জন করে পুরোনো কথা ভুলে একে অপরের সাথে মিশে যাচ্ছি!
.
মাঝরাতের পর ঘুমালেও ঘুম ভাঙলো একেবারে ভোরে। মাত্র সূর্যটা উঠব উঠব করছে। আমি তার বুকে মাথা দিয়ে তখন শুয়ে আছি বেড়ালছানার মতো। সে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে আমায়। আস্তে আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। উঠে জানালার পর্দা টেনে দিলাম।
তারপর গায়ে কাপড় জড়িয়ে ছাদে উঠলাম। পূর্বাকাশে লাল আলোয় উদ্ভাসিত করে সে জানান দিল নিজের। প্রথম আলোটুকু মেখে নিলাম শরীরে। গ্রীষ্মের দিনে সূর্যিমামা উঠেই রোদ ছড়িয়ে দিতে থাকে। মিঠে রোদ গাল ছুয়ে দিয়ে গেল আমার। গতকালকের বৃষ্টিতে ধুলো মুছে সবকিছু ঝলমল করছে। গাছের পাতায় জমে থাকা জলে রোদ পড়ে মুক্তোদানার মতো ঝিলিক দিচ্ছে! কি নির্মল বায়ু! নিঃশ্বাসের সাথে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায় বহুগুন! একবার ভাবলাম তাকে ডেকে এনে দেখাই। কিন্তু আর গেলাম না। থাক ঘুমিয়ে নিক।
এতদিন সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন আমি বাড়ির কোনো কাজই করতাম না। রান্নাবান্না করি না কতকাল! আজ সংসারী হতে ইচ্ছে হলো। ঘরদোর গোছালাম। গোসল করে একটা শাড়ি পরলাম। ওইযে সে যেই বেগুনি পাড়ের আসমানী শাড়িটা কিনে রেখেছিল, সেটাই। সে অবশ্য এখনো ঘুমে। উঠলে ভারি খুশি হবে।
সুবোধ এলে তাকে বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দিলাম। আর আজকের মতো বাকি দিনটা ছুটিও দিয়ে দিলাম। সব কাজ নিজে করব।
সকালের নাস্তা বানিয়ে তাকে ডেকে তুললাম।সে জেগে কতক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমি সকালে উঠে চলে যাবে।”
“মানে কেন যাব?”
“ওইযে বলেছিলে যাবে যে…আহ রে! কতদিন এত ঘুমাই না। আজ একেবারে রিলাক্স লাগছে।”
সে বাথরুমের দিকে গেল। আমার শাড়ির কথা কিছুই বলল না। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এর মধ্যে মায়ের ফোন এলো। আমার বুক কাঁপতে শুরু করল। মাকে তো কিছু বলে আসিনি। এতকিছু হয়ে গেল এর মাঝে। মা কী বলবে শুনলে? কেমন লজ্জা আর অস্বস্তি ঘিরে ধরল। বেজে বেজে একবার ফোন কাটলো। দ্বিতীয়বারে ধরলাম। ওপাশ থেকে মিঠে সুর ভেসে এলো, “ফুপিমা, তুমি কোথায়? তাড়াতাড়ি চলে আসো তো, আই মিস ইউ!”
(চলবে)