#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব-২৬
কলেজে জয়েন করার পর থেকে ইভার সাথে প্রায়ই দেখা হতে লাগলো। ভালো সম্পর্কও হয়ে গেল। মেয়েটা মিশুক, মিষ্টভাষী, তবে চোখেমুখে বিষাদ লুকিয়ে থাকে। দেখলে মনে হয় বুকে কষ্ট চাপা দিয়ে রেখে হাসছে।
একদিন আমি আমার রুমে বসে আছি, ইভা হঠাৎ উপস্থিত। চোখমুখ ফোলা। প্রচুর কান্নাকারি করেছে বোঝা যায়। আমি তাকে নিয়ে বসালাম। সে জানালো তাকে তার সৎ মা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, “বের করে কেমন করে?”
ইভা নাক টেনে চোখ মুছে বলল, “আমাকে বিয়ে দিতে চায়। বুড়ো এক লোকের সাথে। ওই লোকের আগের পক্ষে তিনটা বাচ্চাও আছে। একটা তো কলেজে পড়ে। টাকা দেখে মা লোভে পড়ে গেছে। আমাকে বিয়ে দিবেই। আমি রাজি না। তাই আজকে বের করে দিয়ে বলেছে বিয়েতে রাজি হলে বাড়ি ফিরতে, নয়তো কোনোদিন মুখ না দেখাতে।”
“তোমার বাবা কিছু বলেন না?”
“বাবা আমায় আর ভালোবাসে না…” বলে ইভা কেঁদেই ফেলল। ঢোক গিলে বলল, “আমি কোথায় যাব ম্যাম? আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই! ওই বাড়িতে ফিরলে লোকটাকে বিয়ে করতে হবে!”
“চলো, তোমার বাড়িতে যাব আমি।”
ও ইতস্তত করে বলল, “আমার সৎ মায়ের ব্যবহার অনেক খারাপ!”
“হোক, এভাবে তো চলবে না। তোমার বাবা জুতোর ব্যবসায়ী তাই না?”
“হ্যাঁ আপনি জানেন কী করে?”
“দেখেছি। চলো তুমি।”
.
ইভার বাড়িতে গিয়ে বড় বিচিত্র অভিজ্ঞতা হলো। ওদের বাড়িটা ঘিঞ্চি এলাকায়। প্রচুর লোকের বাস। লম্বা ঘরের সারি। প্রতিটা ঘরে এক পরিবার বাস করে। ওদের ঘরে গিয়ে দেখি বাচ্চায় ভর্তি। ওর সৎ মায়ের চার ছেলেমেয়ে। সবাই ছোট। মহিলাকে দেখেই বোঝা যায় বেশ মেজাজ। আমাকে বসতে দিয়ে কথা বলেই গেল। সব তার অভাবের ফিরিস্তি। এক পর্যায়ে আমার কাছে এসে বসে বলল, “দ্যাখেন ম্যাডাম, এই মাইয়্যারে এমনিতেও ভালা ঘরে বিয়া দেওয়া সম্ভাব না। ওই অবস্থা আমগো নাই। আমার চাইরডা পোলাপানের দিকে চাইয়া দ্যাখেন। ইভারে বিয়া দিতে পারলে ওগোরে নিয়া আমার আর কষ্ট থাকব না৷ আপনেই কন, ওরে কষ্ট কইরা মানুষ করছি ও এইটুকু করতে পারব না আমগো লাইগ্যা?”
আমি প্রথমবার মুখ খুললাম, “তাই বলে একটা মেয়েকে তার বাবার বয়সী লোকের সাথে বিয়ে দেবেন? ওর জীবনের কোনে মূল্য নেই? ও কি বড়লোক বৃদ্ধের শখের বস্তু? আপনাদের ছেলেমেয়ের ব্যবস্থা আপনারা করবেন। ওকে কেন ওর জীবন নষ্ট করতে হবে সেজন্য?”
মহিলা কিছুক্ষণ শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমাকে আর কিছুই বলল না। আমার সামনে ইভার চুলের মুঠি ধরে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে চেঁচাতে শুরু করল, “তুই উকিল ধরছোছ? কী ভাবছোছ হেরে নিয়া আইলে আমি তোরে ঘরে তুইলা আদর করমু…..”
বকার এক পর্যায়ে মহিলা ডালঘুটনি নিয়ে এসে ওকে মারতে শুরু করল। আমি বহুকষ্টে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে বের হয়ে এলাম বাড়ি থেকে। বলে এলাম, মহিলার নামে কেস করব।
মহিলার তাতে কোনো ভাবান্তর নেই। চেঁচিয়ে শুনিয়ে দিল, “আমার মাইয়্যা, আমি মারছি, কেডা কী করে আমিও দেখমু।”
এরপর গেলাম ইভার বাবার কাছে। স্ত্রীর কথাগুলোই শান্তভাবে পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি। বুঝলাম, স্ত্রীরোগে পেয়েছে। একে কিছু বলে লাভ নেই।
আমি ইভাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গেলাম। আপতত সে আমার কাছেই থাকুক।
.
একদিন কলেজ শেষে বের হয়ে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা প্যাকেট। নেভি ব্লু শার্ট আর খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে কি সুন্দর যে লাগছে! মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমায় বলল, “এবার সময় হয়েছে আসল বাড়ি ফেরার।”
“মানে তোমার বাড়ি?”
“হ্যাঁ।”
“এখন ফেরা সম্ভব নয়।”
“কখন সম্ভব?”
“ভাইয়াকে বিয়ে দিতে হবে, খুশবুকে ভালো একটা মা দিয়ে তবে আমি তোমার বাড়ি যাব।”
“আমার বুঝি কষ্ট হয় না? এটার কেমন কথা বলোতো? বিয়ের পর স্বামী ছেড়ে দিনের পর দিন বাপের বাড়িতে পড়ে থাকবে? যা হবে হবে, তুমি আমার সাথে খুব তাড়াতাড়ি ফিরবে।”
“যত দ্রুত ব্যবস্থা হবে, আমি চলে যাব।”
“কিন্তু আমি কি অনন্তকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করব?”
“করতে পারলে করবে।”
“না পারলে?”
“আরেকটা বিয়ে করে নাও।”
সে আশ্চর্য হয়ে একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলল, “তুমি এটা বলতে পারলে? আরেকটা বিয়ে করার হলে অনেক আগে করে ফেলতাম।”
“তাহলে আমাকে সময় দিতে হবে।”
এই একই কথা অসংখ্যবার আমাদের মধ্যে হয়েছে। বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত আমি। নরম স্বরে কিছু বললে তার এক ঘ্যানঘ্যান শেষ হতেই চায় না। তাই সোজা বলে দেই যা বলার।
সে আমার কথা শুনে লম্বা নিশ্বাস নিয়ে আমার হাতে প্যাকেটটা দিয়ে চলে গেল। বাড়ি ফিরে খুলে দেখি তাতে সুন্দর একটা ডায়েরী। ওপরের কভারে সাদার মধ্যে অসংখ্য নীল রঙের প্রজাপতি। ভেতরের প্রতিটা পাতার নিচে আমার নাম লেখা। ডায়েরীর সাথে ছোট্ট চিরকুট- “খাতায় লেখ কেন? এটাতে লিখবে এখন থেকে। তোমার লেখনীর সাথে যুক্ত হোক আমার অজস্র ভালোবাসা।”
ডায়েরী পেয়ে মন ভালো হয়ে গেল। নিজেকে অপরাধী লাগতে লাগলো তার সাথে ওভাবে কড়া কথা বলার জন্য। আমি তাকে ফোন করলাম, ধরলো না। সেদিন থেকে টানা অনেকগুলো দিন আমার সাথে কথা বলল না।
গুনে গুনে বিশদিন পর নিজেই ফোন করলো। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, “এমনটা কেন করলে? আমি নাহয় একটু খারাপভাবে কথা বলেছি, তাই বলে এমন করতে হবে?”
সে বলল, “ইচ্ছে হয়নি তোমার ফোন ধরতে।”
আমার কান্না পেয়ে গেল। তবে তাকে বুঝতে দিলাম না। সে তারপরেই একেবারে স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে কথা বলতে থাকলো। আমিও আর ওকথা তুললাম না।
.
অপরিচিত একটা মেয়েকে বাড়িতে আশ্রয় দেয়াটা বাড়ির সদস্যদের কাছে বেশ বিব্রতকর আর বিরক্তির কারন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ইভার বেলায় সেটা হলো না। ও প্রথমদিন থেকেই সবার সাথে ঘরের মেয়ের মতো মিশে গেল।
কয়েকদিন থাকতে থাকতে সংসারের কাজগুলোও নিজের করে নিল। আমি ওঠার আগেই উঠে রান্নাঘরের কাজ শুরু করে দেয়। আমি বাঁধা দিলে বলে বাড়িতে সব কাজ ও করতো। এখন না কাজ না করলে ভালো লাগে না।
আমার সবচেয়ে ভালো লাগলো, ও যখন খুশবুর সাথে চমৎকার একটা সম্পর্ক গড়ে তুলল। খুশবুকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা, পড়ানো অনেকগুলো দায়িত্ব মেয়েটা নিয়ে নিল।
ইভা আসার পর ও আমাকে দেখিয়েছিল কেমন করে ওর মা ওকে মারতো। মেয়েটার পুরো পিঠ জুড়ে মারের দাগ। হাতে কয়েকটা পোড়া দাগও আছে৷ সেগুলো গরম খুন্তির ছ্যাকা। আমি প্রথমবার দেখলাম এমন নির্যাতনের চিত্র। পুলিশের কাছে কমপ্লেইন্ট করতে প্রায় চলেই যাচ্ছিলাম, ইভাই আটকে দিলো। বলল, “পুলিশ ধরলে বাবাকে ধরবে। তখন ছোট ভাইবোনগুলোর কী হবে?”
ওর অনেক বলার পর আমি তাই আর গেলাম না৷ বলে দিলাম, “বাড়ি ফেরার প্রয়োজন নেই, এখানেই থাকো।”
কিন্তু ও লজ্জা পায় আশ্রিত থাকতে৷ চলে যেতে চায়। বাবাও ওকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছেন। তাই বাবাকে দিয়ে বলিয়ে ওকে রাখলাম বাড়িতে।
একদিন বিকেলে আমি কলেজ থেকে ফিরে দেখি খুশবু আর ইভা ঘুমিয়ে আছে। খুশবু ইভার বুকে মুখ গুঁজে ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ইদানিং ও ইভা আন্টি বলতে পাগল। আমার হিংসেই হয় মাঝে মাঝে। আবার ভালোও লাগে।
এই দৃশ্য দেখে হঠাৎ আমার মনে হলো, ভাইয়ার সাথে ইভার বিয়ে দিলে কেমন হয়? আমি জামাটাও বদলালাম না। নতুন ভাবনাটা পেয়ে বসল একেবারে। অনেক চিন্তা করে দেখলাম এরচেয়ে ভালো আর কিছু হতেই পারে না। আমি দৌড়ে বাবাকে গিয়ে কথাটা বললাম। বাবাও এক কথায় রাজি। ঝিনুও শুনে লাফিয়ে উঠল একেবারে। ও ও ইভাকে দারুণ পছন্দ করে।
.
কিছুদিন পর কথাটা ইভাকে বললাম। আমার ভাবনা ছিল হয়তো রাজি হবে না। আবার খানিকটা অপরাধবোধও ছিল, ভাইয়া অনেক বড়। এক মেয়ের বাবা। ও হয়তো ভাববে আশ্রয় দিয়েছি বলে অন্যায় করছি ওর সাথে। কিন্তু কথাটা শুনে ইভা রাগ করল না, বা মন খারাপও করল না। উল্টো লজ্জা পেয়ে উঠে চলে গেল। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। এবার ভাইয়ার পালা।
ভাইয়া ইভাকে দেখতো, কিন্তু খুব একটা পাত্তা দিতো না। মাঝে মাঝে খুশবুর ব্যাপারে কথা বলতো। ভাইয়াকে বলতে সে প্রথমে খানিক চেঁচামেচি করল। তারপর খুশবু আর ইভার কেমিস্ট্রিটা তাকে আমি আস্তে আস্তে বোঝালাম। নমুনাও দেখালাম। একসময় নিমরাজি হলো। ব্যাস, আর কী লাগে!
ছোট ভাইয়া, ভাবী, আপার সাথে কথা বলে দিনক্ষণ ঠিক করে ঘরোয়াভাবে বিয়েটা হয়ে গেল। ইভার বাবা মাকে জানানো হলো না। কারন তারা মেয়েকে সেদিনই পরিত্যাগ করেছে।
বিয়ের পর খুশবুকে যখন বললাম, “ইভা আন্টিকে এখন থেকে মা ডাকবে। ও তোমার মা হয়ে গেছে।”, খুশবু খুশি হলো না অখুশি বুঝলাম না। বলল, ” কিন্তু আমার মা তো মরে গেছে না?”
“হ্যাঁ, এটা নতুন মা। এখন থেকে তুমি বাবা মায়ের মাঝখানে শুয়ে গল্প করতে পারবে। সবাইকে বলতে পারবে তোমারও মা আছে।”
খুশবু খাটের উপর উঠে চিৎকার করতে শুরু করল। সাথে লাফঝাঁপ তো আছেই। তার উত্তেজনা একটু কমে এলে লাফিয়ে গিয়ে ইভাকে জড়িয়ে ধরল। মুখে চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি সত্যি মা তো? পরে আবার আন্টি হয়ে যাবে না তো?”
ইভা ওকে বুকে টেনে কেঁদে ফেলে বলল, “না আমি মা’ই থাকব।”
.
বিয়ের একটু পর ভাইয়া একেবারে অস্থির হয়ে উঠল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কষ্টে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাকে বলল, “তোর জন্য আমি এই কাজটা করলাম। আমি কেমন করে আরেকটা মেয়ের সাথে থাকব?”
আমি তাকে আবার বোঝালাম। বহুকষ্টে আমি, আপা আর ছোট ভাবী মিলে তাকে বাসর ঘরে পাঠাতে সক্ষম হলাম। খুশবুকে আগেই ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলাম ভুলিয়ে ভালিয়ে। ইভা এদিকে টেনশনে ঘেমে একাকার হয়েছে। তবে আমার বিশ্বাস ছিল ইভা মানিয়ে নিতে পারবে।
সকালবেলা যখন দেখলাম ভাইয়ার মধ্যে গতকালকের অস্থিরতার চিহ্নও নেই, বেশ হাসিখুশি আছে, তখন স্বস্তি পেলাম। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি বলে নিজের ওপর খানিকটা গর্বও হলো! ইভা সকালে উঠে কাজে লেগে গেল। ভারি লজ্জা লজ্জা মুখ করে আছে আজ। আমি প্রথমবার তাকে ভাবী ডাকলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি খুশি হয়েছ তো ভাবী?”
ইভা আমার দিকে খুব ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “জানো আপু, আমি কোনেদিন ভাবিনি আমার কপালে এত সুখ, সম্মান আছে। এত ভালো একটা পরিবার, তোমার ভাইয়ার মতো এত ভালো বর আমি স্বপ্ন দেখতেও ভয় পেতাম। একটা গোপন কথা বলি, তোমার ভাইয়াকে আমার সেই প্রথম দিন থেকেই ভালো লাগতো। বিশ্বাস করো, খারাপ উদ্দেশ্যে না, নিজে কষ্টে থাকি তো, তাই কষ্ট পাওয়া মানুষগুলোকে অনেক আপন মনে হয়।”
তারপর ও আমায় জড়িয়ে ধরে বলল, “তোমার ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না৷ দেখো, তোমার অনেক ভালো হবে।”
(চলবে)