#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ২৮
বৃষ্টিতে ভেজা পথঘাট। ঝিকমিক করা রোদের মাঝে হীরকচূর্ণের মতো বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে পড়ছে। সেই সাথে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে খুশবু হাততালি দিতে দিতে ছড়া কাটছে,
“রোদ হয়, বৃষ্টি হয়,
খ্যাঁকশিয়ালীর বিয়ে হয়…”
ছড়াটা তাকে শিখিয়েছে ইভা। খুশবু মনের আনন্দে জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি জমা করছে হাতের তালুতে। পানিটুকু ছিটিয়ে দিচ্ছে আমার মুখে। ছোট্ট মেয়েটা চাইছে আমি তাকে বকা দেই বা হাসি বা কিছু একটা বলি। দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রয়েছি সেটা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না।
মেয়েটা আজ বড় খুশি৷ আমি যখন চলে গিয়েছিলাম তখন তার সে কী কান্না! দু’দিন কেঁদেই কাটিয়েছে। অনেক কষ্টে তাকে সামলেছিল ইভা। আজ আমাকে পেয়ে সে খুশিতে পারলে ডিগবাজি দেয়। কিন্তু আমার এই চুপচাপ থাকাটা তার হজম হচ্ছে না। মাথার ব্যান্ডেজটাও বার কয়েক হাত বুলিয়ে দিয়ে গেছে। প্রতিবার বলেছে, “অনেক ব্যথা ফুপি মা?”
আমি উত্তর দেইনি।
আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মনটা বিষাক্ত হয়ে আছে। আমায় এভাবে দেখে ইভা এসে কিছুক্ষণ পর খুশবুকে নিয়ে গেল।
ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিলাম অন্ধের মতো। একটা সিএনজি সামনে পেয়ে উঠে পড়েছিলাম। সাথে না ছিল মোবাইল, না টাকার ব্যাগ। কোনোরকম বাড়ির ঠিকানা বলে মরার মতো পড়ে ছিলাম সিটে। সেই সিনএনজিওয়ালা লোকটা আমাকে মাঝরাস্তায় একটা ডিসপেনসারিতে নিয়ে যায়। প্রায় জোর করেই ব্যান্ডেজ করিয়ে দেয়। আমি তাকে বলি, “টাকা নেই।” লোকটা হাসে। ডাক্তারকে নিজের পকেট থেকে টাকা দেয়।
তারপর নিরাপদে আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। বাবা তাকে টাকা দিতে জোর করলেও নেয়নি। লোকটার বেশ বয়স। যাওয়ার আগে আমার মাথায় হাত দিয়ে বলে গেছে, “আমার মাইয়াডাও আফনের মতোইনই। মেল্লা দিন দেখবার পারি না। হুনছি জামাই বাইত গিয়া বালা নাই। আফনে বালা থাইক্কেন মা।”
লোকটা কেমন করে যেন বুঝে গিয়েছিল আমি শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি যাচ্ছি। আমি লক্ষ্য করেছি, আমার আশোপশের মানুষগুলো হয় খুব ভালো, নয়তো খুব খারাপ হয়। মাঝামাঝি পর্যায়ের স্বাভাবিক জীবন আর পেলাম না!
বাবা ডেকে পাঠালেন। ভয়ে ভয়ে গেলাম তার ঘরে। বাবা একটু অসুস্থ। হাঁটুর ব্যথায় কাহিল হয়ে পড়েছেন একেবারে। এখন চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন পা দুটো কুসুম গরম পানিতে চুবিয়ে। আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বললেন, “শুধু আজকেই মারল নাকি আগেও মার খেয়েছ?”
আমার চোখে পানি চলে এল। বাবা প্রায় ধমক দিয়ে বললেন, “তোমাকে এখন আমার মারতে ইচ্ছে করছে। পড়াশুনা শিখেছ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখোনি? সে মারল আর তুমি মার খেলে? জানতাম সে ছেলে ভালো হবে না কোনোদিন। তবুও এত যেতে চাইলে, এখন শখ মিটেছে নাকি ঘা শুকালে আবার ছুটবে?”
আমি এবার কেঁদেই ফেললাম। বাবা একটু নরম সুরে বললেন, “আর তোমাকে যেতে দেব না। এবার আমি দেখব কেমন করে ডিভোর্স না দেয়। এখন যাও, কিছু খাচ্ছ না নাকি? খেয়ে রেস্ট নাও। পরে কথা বলব।”
ধীরে ধীরে আমার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। ইভা খাবার নিয়ে এসেছে। সেগুলো দেখে মনে হচ্ছে চিরতা পাতা বেটে নিয়ে এসেছে। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। ও জোর করে নিজের হাতে খাবার আমার মুখে গুঁজে দিল।
এখন আর রোদ-বৃষ্টির খেলা নেই। আকাশ কালো হয়ে এসেছে। শো শো বাতাস বইছে। অনেক বৃষ্টি হবে হয়তো। হোক, প্রাণ জুড়োক একটু।
বিকেলের দিকে ঝিনু হঠাৎ দৌড়ে এলো আমার কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে ফোনটা দিয়ে বলল, “অর্না আপু ফোর করেছে।”
আমি ফোন সরিয়ে বললাম, “কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।”
ও জোর করে মোবাইল কানে ধরে বলল, ” কথা বল!”
কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করলেও ওপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ ছাড়া কিছু শুনতে পেলাম না। আমি ভয় পেয়ে কল কেটে আমি আবার কল দিলাম। ও কেটে দিল। একটু পর মেসেজ পাঠিয়ে দিল, “মা ভাইয়া দুজনেই মারা গেছে।”
মেসেজটা দেখে হঠাৎ মনে হলো হাজার হাজার তীর বিঁধে গেছে বুকে। এটা কী লিখেছে ও? ঠিক লিখেছে নাকি ভুল করে অন্য কেউ মেসেজ পাঠিয়েছে? আমি বোবার মতো ঝিনুর দিকে তাকালাম। ঝিনু কাঁদছে মুখে ওড়না চাপা দিয়ে। আমি স্ট্যাচু হয়ে বসে রইলাম। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগল। তারপর মনে হলো, মিথ্যে বলছে না তো আমাকে নেয়ার জন্য? তাই যেন হয়, আমি গিয়েই দেখি।
কীভাবে কীভাবে পৌঁছেছি জানি না, দেখি বাড়ি লোকজনে ভর্তি। বহুকষ্টে ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। এতক্ষণ বিশ্বাস করতেই পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো হয়তো এটা তাদের কোনো নাটক! যদি হতো!
নাহ, সত্যি দুটো লাশ শুয়ে আছে। তার শরীরটা রক্তে ভেজা। ফরসা মুখটা লাল হয়ে আছে। ঠোঁটদুটো কালো হয়ে শক্ত হয়ে আছে। সে সত্যি মরে গেছে! আর আমার শ্বাশুড়ি! এত জাদরেল মহিলা চুপচাপ শুয়ে আছেন। গায়ে গয়না নেই, মুখটা সাদা হয়ে আছে।
সবাই বলাবলি করছে, ছেলেটা এক্সিডেন্ট করেছে, আর মা খবর পেয়ে স্ট্রোক করেছে! আর কিছু কানে গেল না। বাইরে জোরালো শব্দে বাজ পড়ছে। লোডশেডিং হয়ে ঘরবাড়ি অন্ধকার হয়ে গেছে। শুধু বাতাসে পর্দাগুলো দুলে উঠছে আর বিদ্যুতের চমকে ঘর ক্ষণে ক্ষণে আলোকিত হয়ে উঠছে।
আমি আরেকবার তার দিকে তাকালাম। তখনই জেনারেটরের আলো জ্বলে উঠল ঘরময়। বাতাসে তার শরীরের ওপরের চাদরটা সরে গেছে। আর চুলগুলো রক্ত জমে শক্ত হয়ে আছে। আর কোনোদিন রেশমী চুলগলা কপালে ছড়িয়ে থাকবে না, আর কখনো গাল টেনে আদর করে দিতে পারব না। কক্ষনো আর সে আমার দিকে তাকাবে না। সে বহুদূরের অজানায় হারিয়ে গেছে একটা মৃত শরীর রেখে…
আমার নিঃশ্বাস গলার কাছে আটকে গেছে। চারদিকে আর্তনাদের শব্দে দমবন্ধ হয়ে আসছে। মৃত্যুপুরীর বাতাসটা আমার গায়েও লাগলো। আমি ঢলে পড়লাম। কে যেন ধরল। জ্ঞান হারানোর আগে আমি শেষবারের মতো তার গায়ের ঘ্রাণটা পেলাম। রজনীগন্ধার মতো, তবে আজকের ঘ্রাণটা রক্তের গন্ধের সাথে মিশে আছে!
.
তিনটে মাস। খুব বেশি, নাকি কম? আমার স্বাভাবিক হতে তিন মাস লেগেছে। এতদিন কী করেছি, কোথায় ছিলাম কিচ্ছু মনে নেই। যখন থেকে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছি, আমি তখন হাসপাতালের ছোট্ট একটা কেবিনে। মাথাটা সারাদিন ঘোরে। আর ভুলভাল বকতে থাকি। আমার বিছানার সামনে জানালা। জানালার ওপাশে গাছপালা দেখা যায়। গাছের ডালে একটা হলদে পাখি ছানাপোনা নিয়ে বাস করে। পাখিটা মাঝে মাঝে জানালার গ্রীলে এসে বসে। মনে হয় কিছু বলতে চায়, তারপর না বলেই চলে যায়।
মাথা ভালো হওয়ার পর একটু একটু করে জেনেছি, সেদিন সে একসিডেন্ট করেছিলো। জোরে গাড়ি চালাতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছিল মালবাহী ট্রাকের সাথে। গাড়িটা একেবারে থেঁতলে গেছিল। সে ছিটকে পড়েছিল অপর পাশে রাস্তায়। তবে ট্রাক ড্রাইভারের মতে একসিডেন্টটা স্বাভাবিক নয়, সে বলেছে গাড়িটা ইচ্ছে করেই তার ট্রাকের দিকে ছুটে এসেছিল। যদিও একথা কেউ বিশ্বাস করেনি। নেশা করে ট্রাক চালানোর অপরাধে সে এখন জেলে। তবুও আমার মাথায় চিন্তারা দানা বাঁধে, সত্যি কি সে আত্মহননের চেষ্টা করছিলো? কিন্তু কেন?
একদিন আমাকে দেখতে আমার শ্বশুর এলেন। আগেও নাকি এসেছিলেন, আমার জ্ঞান ছিল না তখন। উনার বয়স ষাটের বেশি না, এখন আশি দেখায়৷ উনার সাথে কখনো কথা হয়নি তেমন, তাই স্বাভাবিক হয়ে কিছু বলতে পারলাম না। উনি শুধু করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন আমার দিকে।
একসময় বললেন, “আমার বড় ছেলেটা এমনিতে একটু পাগলাটে হলেও কাজেকর্মে বড় ভালো ছিল। ও অফিসে থাকলে আমার আর ভাবতে হতো না কিছু। কিন্তু ওর পার্সোনাল লাইফ নিয়ে আমি কোনোদিন মাথা ঘামাইনি। ছেলেটার কী থেকে কী হয়ে গেল তাই বুঝতেও পারিনি।”
তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তুমি এমন হলে কি চলবে মা? তোমার সারাজীবন তো পড়েই আছে। এই শোক কাটিয়ে উঠে একটা বিয়ে করে সুন্দর সংসার করো। তোমাকে এভাবে দেখলে আমার ছেলেটাও ওপাড়ে শান্তি পাবে না।”
উনি যাওয়ার আগে আমার সেই ফেলে আসা মোবাইলটা দিয়ে গেলেন। চার্জহীন বন্ধ মোবইল। চার্জ দিয়ে অন করার পর দেখা গেল অনেক কল আর মেসেজে ভর্তি। মোবাইল লক করা ছিল বলে কেউ দেখেওনি। মেসেজের ভিড়ে হঠাৎ চোখে পড়ল তার একটা মেসেজ! তার মোবাইল থেকে পাঠানো শেষ মেসেজ! কাঁপা হাতে মেসেজটা ওপেন করলাম৷ সেখানে লেখা-
“I can feel your pain. But believe me, I can’t control myself! Promise, I will never hurt you again. I love you…I love you more than my life…”
জানালা দিয়ে দমকা বাতাস ছুঁয়ে দিল আমাকে। মেসেজটা মৃত্যুর আগে আগেই পাঠিয়েছে। সে কি মারা যাওয়ার আগে বুঝতে পেরেছিল নাকি মৃত্যুটা তার ইচ্ছেমৃত্যু ছিল?
মানুষটাকে আমি মরার পরও বুঝলাম না, হায়! আজ মনে হলো, আমি অনেক বোকা। অনেক অনেক বোকা। অতল জলরাশির মাঝে পা রাখার ঠাঁই খুঁজছিলাম!
(চলবে)